রোম্যাণ্টিক
Verses
আমারে বলে যে ওরা রোম্যাণ্টিক।
              সে কথা মানিয়া লই
                   রসতীর্থ-পথের পথিক।
                মোর উত্তরীয়ে
          দুয়ার-বাহিরে তব আসি যবে
                   সুর করে ডাকি আমি ভোরের ভৈরবে।
         বসন্তবনের গন্ধ আনি তুলে
                   রজনীগন্ধার ফুলে
               নিভৃত হাওয়ায় তব ঘরে।
         কবিতা শুনাই মৃদুস্বরে,
                   ছন্দ তাহে থাকে,
                        তার ফাঁকে ফাঁকে
         শিল্প রচে বাক্যের গাঁথুনি--
                        তাই শুনি
                   নেশা লাগে তোমার হাসিতে।
                        আমার বাঁশিতে
                   যখন আলাপ করি মুলতান
         মনের রহস্য নিজ রাগিণীর পায় না সন্ধান।
            যে-কল্পলোকের কেন্দ্রে তোমারে বসাই
                   ধূলি-আবরণ তার সযত্নে খসাই--
         আমি নিজে সৃষ্টি করি তারে।
            ফাঁকি দিয়ে বিধাতারে
কারুশালা হতে তাঁর চুরি করে আনি রঙ-রস,
         আনি তাঁরি জাদুর পরশ।
     জানি, তার অনেকটা মায়া,
                        অনেকটা ছায়া।
আমারে শুধাও যবে "এরে কভু বলে বাস্তবিক?'
     আমি বলি, "কখনো না, আমি রোম্যাণ্টিক।'
               যেথা ঐ বাস্তব জগৎ
          সেখানে আনাগোনার পথ
              আছে মোর চেনা।
                 সেথাকার দেনা
              শোধ করি--সে নহে কথায় তাহা জানি--
                   তাহার আহ্বান আমি মানি।
দৈন্য সেথা, ব্যাধি সেথা, সেথায় কুশ্রীতা,
              সেথায় রমণী দস্যুভীতা--
     সেথায় উত্তরী ফেলি পরি বর্ম;
                   সেথায় নির্মম কর্ম;
সেথা ত্যাগ, সেথা দুঃখ, সেথা ভেরি বাজুক "মাভৈঃ';
          শৌখিন বাস্তব যেন সেথা নাহি হই।
                সেথায় সুন্দর যেন ভৈরবের সাথে
                   চলে হাতে-হাতে।
আরো দেখুন
একটা আষাঢ়ে গল্প
Stories
দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ। সেখানে কেবল তাসের সাহেব, তাসের বিবি, টেক্কা এবং গোলামের বাস। দুরি তিরি হইতে নহলা-দহলা পর্যন্ত আরো অনেক-ঘর গৃহস্থ আছে কিন্তু তাহারা উচ্চজাতীয় নহে।
টেক্কা সাহেব গোলাম এই তিনটেই প্রধান বর্ণ, নহলা-দহলারা অন্ত্যজ-- তাহাদের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে বসিবার যোগ্য নহে।
আরো দেখুন
গোরা
Novels
শ্রাবণ মাসের সকালবেলায় মেঘ কাটিয়া গিয়া নির্মল রৌদ্রে কলিকাতার আকাশ ভরিয়া গিয়াছে। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার বিরাম নাই, ফেরিওয়ালা অবিশ্রাম হাঁকিয়া চলিয়াছে, যাহারা আপিসে কালেজে আদালতে যাইবে তাহাদের জন্য বাসায় বাসায় মাছ-তরকারির চুপড়ি আসিয়াছে ও রান্নাঘরে উনান জ্বালাইবার ধোঁওয়া উঠিয়াছে--কিন্তু তবু এত বড়ো এই-যে কাজের শহর কঠিন হৃদয় কলিকাতা, ইহার শত শত রাস্তা এবং গলির ভিতরে সোনার আলোকের ধারা আজ যেন একটা অপূর্ব যৌবনের প্রবাহ বহিয়া লইয়া চলিয়াছে।
এমন দিনে বিনা-কাজের অবকাশে বিনয়ভূষণ তাহার বাসার দোতলার বারান্দায় একলা দাঁড়াইয়া রাস্তায় জনতার চলাচল দেখিতেছিল। কালেজের পড়াও অনেক দিন চুকিয়া গেছে, অথচ সংসারের মধ্যেও প্রবেশ করে নাই, বিনয়ের অবস্থাটা এইরূপ। সভাসমিতি চালানো এবং খবরের কাগজ লেখায় মন দিয়াছে-- কিন্তু তাহাতে সব মনটা ভরিয়া উঠে নাই। অন্তত আজ সকালবেলায় কী করিবে তাহা ভাবিয়া না পাইয়া তাহার মনটা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। পাশের বাড়ির ছাতের উপরে গোটা-তিনেক কাক কী লইয়া ডাকাডাকি করিতেছিল এবং চড়ুই-দম্পতি তাহার বারান্দার এক কোণে বাসা-নির্মাণ-ব্যাপারে পরস্পরকে কিচিমিচি শব্দে উৎসাহ দিতেছিল-- সেই সমস্ত অব্যক্ত কাকলি বিনয়ের মনের মধ্যে একটা কোন্‌ অস্পষ্ট ভাবাবেগকে জাগাইয়া তুলিতেছিল।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়
"বোলো না কাতর স্বরে না করি বিচার
জীবন স্বপনসম মায়ার সংসার।"
দুখনিশীথিনী হল আজি ভোর।
কাটিল কাটিল অধীনতা ডোর।
চাঁদের অমিয়া-সনে চন্দন বাঁটিয়া গো
কে মাজিল গোরার দেহখানি--
আরো দেখুন
বোষ্টমী
Stories
আমি লিখিয়া থাকি অথচ লোকরঞ্জন আমার কলমের ধর্ম নয়, এইজন্য লোকেও আমাকে সদাসর্বদা যে রঙে রঞ্জিত করিয়া থাকে তাহাতে কালির ভাগই বেশি। আমার সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনিতে হয়; কপালক্রমে সেগুলি হিতকথা নয়, মনোয়ারী তো নহেই।
শরীরে যেখানটায় ঘা পড়িতে থাকে সে জায়গাটা যত তুচ্ছই হোক সমস্ত দেহটাকে বেদনার জোরে সেই ছাড়াইয়া যায়। সে লোক গালি খাইয়া মানুষ হয়, সে আপনার স্বভাবকে যেন ঠেলিয়া একঝোঁকা হইয়া পড়ে। আপনার চারি দিককে ছাড়াইয়া আপনাকেই কেবল তাহার মনে পড়ে-- সেটা আরামও নয়, কল্যাণও নয়। আপনাকে ভোলাটাই তো স্বস্তি।
আরো দেখুন
জীবিত ও মৃত
Stories
রানীহাটের জমিদার শারদাশংকরবাবুদের বাড়ির বিধবা বধূটির পিতৃকুলে কেহ ছিল না; সকলেই একে একে মারা গিয়াছে। পতিকুলেও ঠিক আপনার বলিতে কেহ নাই, পতিও নাই পুত্রও নাই। একটি ভাশুরপো, শারদাশংকরের ছোটো ছেলেটি, সেই তাহার চক্ষের মণি। সে জন্মিবার পর তাহার মাতার বহুকাল ধরিয়া শক্ত পীড়া হইয়াছিল, সেইজন্য এই বিধবা কাকি কাদম্বিনীই তাহাকে মানুষ করিয়াছে। পরের ছেলে মানুষ করিলে তাহার প্রতি প্রাণের টান আরো যেন বেশি হয়, কারণ তাহার উপরে অধিকার থাকে না; তাহার উপরে কোনো সামাজিক দাবি নাই, কেবল স্নেহের দাবি-- কিন্তু কেবলমাত্র স্নেহ সমাজের সমক্ষে আপনার দাবি কোনো দলিল অনুসারে সপ্রমাণ করিতে পারে না এবং চাহেও না, কেবল অনিশ্চিত প্রাণের ধনটিকে দ্বিগুণ ব্যাকুলতার সহিত ভালোবাসে।
বিধবার সমস্ত রুদ্ধ প্রীতি এই ছেলেটির প্রতি সিঞ্চন করিয়া একদিন শ্রাবণের রাত্রে কাদম্বিনীর অকস্মাৎ মৃত্যু হইল। হঠাৎ কী কারণে তাহার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হইয়া গেল-- সময় জগতের আর-সর্বত্রই চলিতে লাগিল, কেবল সেই স্নেহকাতর ক্ষুদ্র কোমল বক্ষটির ভিতর সময়ের ঘড়ির কল চিরকালের মতো বন্ধ হইয়া গেল।
আরো দেখুন
ঠাকুরদা
Stories
নয়নজোড়ের জমিদারেরা এককালে বাবু বলিয়া বিশেষ বিখ্যাত ছিলেন। তখনকার কালের বাবুয়ানার আদর্শ বড়ো সহজ ছিল না। এখন যেমন রাজা-রায়বাহাদুর খেতাব অর্জন করিতে অনেক খানা নাচ ঘোড়দৌড় এবং সেলাম-সুপারিশের শ্রাদ্ধ করিতে হয়, তখনো সাধারণের নিকট হইতে বাবু উপাধি লাভ করিতে বিস্তর দুঃসাধ্য তপশ্চরণ করিতে হইত।
আমাদের নয়নজোড়ের বাবুরা পাড় ছিঁড়িয়া ফেলিয়া ঢাকাই কাপড় পরিতেন, কারণ পাড়ের কর্কশতায় তাঁহাদের সুকোমল বাবুয়ানা ব্যথিত হইত। তাঁহারা লক্ষ টাকা দিয়া বিড়ালশাবকের বিবাহ দিতেন এবং কথিত আছে, একবার কোনো উৎসব উপলক্ষে রাত্রিকে দিন করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়া অসংখ্য দীপ জ্বলাইয়া সূর্যকিরণের অনুকরণে তাঁহারা সাচ্চা রুপার জরি উপর হইতে বর্ষণ করিয়াছিলেন।
আরো দেখুন
চন্দনী
Stories
জানোই তো সেদিন কী কাণ্ড। একেবারে তলিয়ে গিয়েছিলেম আর-কি, কিন্তু তলায় কোথায় যে ফুটো হয়েছে তার কোনো খবর পাওয়া যায় নি। না মাথা ধরা, না মাথা ঘোরা, না গায়ে কোথাও ব্যথা, না পেটের মধ্যে একটুও খোঁচাখুঁচির তাগিদ। যমরাজার চরগুলি খবর আসার সব দরজাগুলো বন্ধ করে ফিস্‌ ফিস্‌ ক'রে মন্ত্রণা করছিল। এমন সুবিধে আর হয় না! ডাক্তারেরা কলকাতায় নব্বই মাইল দূরে। সেদিনকার এই অবস্থা।
সন্ধে হয়ে এসেছে। বারান্দায় বসে আছি। ঘন মেঘ ক'রে এল। বৃষ্টি হবে বুঝি। আমার সভাসদ্‌রা বললে, ঠাকুরদা, একসময় শুনেছি তুমি মুখে মুখে গল্প ব'লে শোনাতে, এখন শোনাও না কেন।
আরো দেখুন
বড়ো খবর
Stories
কুসমি বললে, তুমি যে বললে এখনকার কালের বড়ো বড়ো সব খবর তুমি আমাকে শোনাবে, নইলে আমার শিক্ষা হবে কী রকম ক'রে, দাদামশায়।
দাদামশায় বললে, বড়ো খবরের ঝুলি বয়ে বেড়াবে কে বলো, তার মধ্যে যে বিস্তর রাবিশ।
আরো দেখুন
অতিথি
Verses
ওই শোনো গো, অতিথ বুঝি আজ
            এল আজ।
ওগো বধূ, রাখো তোমার কাজ
            রাখো কাজ।
শুনছ না কি তোমার গৃহদ্বারে
রিনিঠিনি শিকলটি কে নাড়ে,
            এমন ভরা সাঁঝ!
পায়ে পায়ে বাজিয়ো নাকো মল,
ছুটো নাকো চরণ চঞ্চল,
            হঠাৎ পাবে লাজ।
ওই শোনো গো, অতিথ এল আজ
            এল আজ।
ওগো বধূ, রাখো তোমার কাজ
            রাখো কাজ।
নয় গো কভু বাতাস এ নয় নয়
            কভু নয়।
ওগো বধূ, মিছে কিসের ভয়
            মিছে ভয়!
আঁধার কিছু নাইকো আঙিনাতে,
আজকে দেখো ফাগুন-পূর্ণিমাতে
            আকাশ আলোময়।
নাহয় তুমি মাথার ঘোমটা টানি
হাতে নিয়ো ঘরের প্রদীপখানি,
            যদি শঙ্কা হয়।
নয় গো কভু বাতাস এ নয় নয়
            কভু নয়।
ওগো বধূ মিছে কিসের ভয়
            মিছে ভয়!
নাহয় কথা কোয়ো না তার সনে
            পান্থ-সনে।
দাঁড়িয়ে তুমি থেকো একটি কোণে
            দুয়ার-কোণে।
প্রশ্ন যদি শুধায় কোনো-কিছু
নীরব থেকো মুখটি করে নীচু
            নম্র দু-নয়নে।
কাঁকন যেন ঝংকারে না হাতে,
পথ দেখিয়ে আনবে যবে সাথে
            অতিথিসজ্জনে।
নাহয় কথা কোয়ো না তার সনে
            পান্থ-সনে।
দাঁড়িয়ে তুমি থেকো একটি কোণে
            দুয়ার-কোণে।
ওগো বধূ, হয় নি তোমার কাজ
            গৃহ-কাজ?
ওই শোনো কে অতিথ এল আজ
            এল আজ।
সাজাও নি কি পূজারতির ডালা?
এখনো কি হয় নি প্রদীপ জ্বালা
            গোষ্ঠগৃহের মাঝ?
অতি যত্নে সীমান্তটি চিরে
সিঁদুর-বিন্দু আঁক নাই কি শিরে?
            হয় নি সন্ধ্যাসাজ?
ওগো বধূ, হয় নি তোমার কাজ
             গৃহ-কাজ?
ওই শোনো কে অতিথ এল আজ
            এল আজ।
আরো দেখুন
পুনরাবৃত্তি
Stories
সেদিন যুদ্ধের খবর ভালো ছিল না। রাজা বিমর্ষ হয়ে বাগানে বেড়াতে গেলেন।
দেখতে পেলেন, প্রাচীরের কাছে গাছতলায় বসে খেলা করছে একটি ছোটো ছেলে আর একটি ছোটো মেয়ে।
আরো দেখুন