দর্পহরণ
Stories
কী করিয়া গল্প লিখিতে হয়, তাহা সম্প্রতি শিখিয়াছি। বঙ্কিমবাবু এবং সার্‌ ওয়াল্‌টার স্কট পড়িয়া আমার বিশেষ ফল হয় নাই। ফল কোথা হইতে কেমন করিয়া হইল, আমার এই প্রথম গল্পেই সেই কথাটা লিখিতে বসিলাম।
আমার পিতার মতামত অনেকরকম ছিল; কিন্তু বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কোনো মত তিনি কেতাব বা স্বাধীনবুদ্ধি হইতে গড়িয়া তোলেন নাই। আমার বিবাহ যখন হয় তখন সতেরো উত্তীর্ণ হইয়া আঠারোয় পা দিয়াছি; তখন আমি কলেজে থার্ডইয়ারে পড়ি-- এবং তখন আমার চিত্তক্ষেত্রে যৌবনের প্রথম দক্ষিণবাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়া কত অলক্ষ্য দিক হইতে কত অনির্বচনীয় গীতে এবং গন্ধে, কম্পনে এবং মর্মরে আমার তরুণ জীবনকে উৎসুক করিয়া তুলিতেছিল, তাহা এখনো মনে হইলে বুকের ভিতরে দীর্ঘনিশ্বাস ভরিয়া উঠে।
আরো দেখুন
পরীর পরিচয়
Stories
রাজপুত্রের বয়স কুড়ি পার হয়ে যায়, দেশবিদেশ থেকে বিবাহের সম্বন্ধ আসে।
ঘটক বললে, 'বাহ্লীকরাজের মেয়ে রূপসী বটে, যেন সাদা গোলাপের পুষ্পবৃষ্টি।'
আরো দেখুন
ল্যাবরেটরি
Stories
নন্দকিশোর ছিলেন লণ্ডন য়ুনিভার্সিটি থেকে পাস করা এঞ্জিনীয়ার। যাকে সাধুভাষায় বলা যেতে পারে দেদীপ্যমান ছাত্র অর্থাৎ ব্রিলিয়ান্ট, তিনি ছিলেন তাই। স্কুল থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার তোরণে তোরণে ছিলেন পয়লা শ্রেণীর সওয়ারী।
ওঁর বুদ্ধি ছিল ফলাও, ওঁর প্রয়োজন ছিল দরাজ, কিন্তু ওঁর অর্থসম্বল ছিল আঁটমাপের।
আরো দেখুন
মেঘ ও রৌদ্র
Stories
পূর্বদিনে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আজ ক্ষান্তবর্ষণ প্রাতঃকালে ম্লান রৌদ্র ও খণ্ড মেঘে মিলিয়া পরিপক্কপ্রায় আউশ ধানের ক্ষেত্রের উপর পর্যায়ক্রমে আপন আপন সুদীর্ঘ তুলি বুলাইয়া যাইতেছিল; সুবিস্তৃত শ্যাম চিত্রপট একবার আলোকের স্পর্শে উজ্জ্বল পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিতেছিল আবার পরক্ষণেই ছায়াপ্রলেপে গাঢ় স্নিগ্ধতায় অঙ্কিত হইতেছিল।
যখন সমস্ত আকাশরঙ্গভূমিতে মেঘ এবং রৌদ্র, দুইটি মাত্র অভিনেতা, আপন আপন অংশ অভিনয় করিতেছিল তখন নিম্নে সংসাররঙ্গভূমিতে কত স্থানে কত অভিনয় চলিতেছিল তাহার আর সংখ্যা নাই।
আরো দেখুন
নষ্টনীড়
Stories
ভূপতির কাজ করিবার কোনো দরকার ছিল না। তাঁহার টাকা যথেষ্ট ছিল, এবং দেশটাও গরম। কিন্তু গ্রহবশত তিনি কাজের লোক হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। এইজন্য তাঁহাকে একটা ইংরেজি খবরের কাগজ বাহির করিতে হইল। ইহার পরে সময়ের দীর্ঘতার জন্য তাঁহাকে আর বিলাপ করিতে হয় নাই।
ছেলেবেলা হইতে তাঁর ইংরেজি লিখিবার এবং বক্তৃতা দিবার শখ ছিল। কোনোপ্রকার প্রয়োজন না থাকিলেও ইংরেজি খবরের কাগজে তিনি চিঠি লিখিতেন, এবং বক্তব্য না থাকিলেও সভাস্থলে দু-কথা না বলিয়া ছাড়িতেন না।
আরো দেখুন
অসম্ভব কথা
Stories
এক যে ছিল রাজা।
তখন ইহার বেশি কিছু জানিবার আবশ্যক ছিল না। কোথাকার রাজা, রাজার নাম কী, এ সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া গল্পের প্রবাহ রোধ করিতাম না। রাজার নাম শিলাদিত্য কি শালিবাহন, কাশী কাঞ্চি কনোজ কোশল অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের মধ্যে ঠিক কোন্‌খানটিতে তাঁহার রাজত্ব, এ সকল ইতিহাস-ভূগোলের তর্ক আমাদের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ ছিল,-- আসল যে-কথাটি শুনিলে অন্তর পুলকিত হইয়া উঠিত এবং সমস্ত হৃদয় একমুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুদ্বেগে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হইত সেটি হইতেছে-- এক যে ছিল রাজা।
আরো দেখুন
অকারণে অকালে মোর
Songs
অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক
          তখন আমি ছিলেম শয়ন পাতি।
বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়ায়ে নির্বাক,
          ধরায় তখন তিমিরগহন রাতি।
          ঘরের লোকে কেঁদে কইল মোরে,
          "আঁধারে পথ চিনবে কেমন ক'রে?'
আমি কইনু, "চলব আমি নিজের আলো ধরে,
          হাতে আমার এই-যে আছে বাতি।'
বাতি যতই উচ্চ শিখায় জ্বলে আপন তেজে
          চোখে ততই লাগে আলোর বাধা,
ছায়ায় মিশে চারি দিকে মায়া ছড়ায় সে-যে--
          আধেক দেখা করে আমায় আঁধা।
          গর্বভরে যতই চলি বেগে
          আকাশ তত ঢাকে ধুলার মেঘে,
শিখা আমার কেঁপে ওঠে অধীর হাওয়া লেগে--
          পায়ে পায়ে সৃজন করে ধাঁধা ॥
হঠাৎ শিরে লাগল আঘাত বনের শাখাজালে,
          হঠাৎ হাতে নিবল আমার বাতি।
চেয়ে দেখি পথ হারিয়ে ফেলেছি কোন্‌ কালে--
          চেয়ে দেখি তিমিরগহন রাতি।
          কেঁদে বলি মাথা করে নিচু,
          "শক্তি আমার রইল না আর কিছু!'
সেই নিমেষে হঠাৎ দেখি কখন পিছু পিছু
          এসেছ মোর চিরপথের সাথি ॥
আরো দেখুন
গিন্নি
Stories
ছাত্রবৃত্তি ক্লাসের দুই-তিন শ্রেণী নীচে আমাদের পণ্ডিত ছিলেন শিবনাথ। তাঁহার গোঁফদাড়ি কামানো, চুল ছাঁটা এবং টিকিটি হ্রস্ব। তাঁহাকে দেখিলেই বালকদের অন্তরাত্মা শুকাইয়া যাইত।
প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়, যাহাদের হুল আছে তাহাদের দাঁত নাই। আমাদের পণ্ডিতমহাশয়ের দুই একত্রে ছিল। এ দিকে কিল চড় চাপড় চারাগাছের বাগানের উপর শিলাবৃষ্টির মতো অজস্র বর্ষিত হইত, ও দিকে তীব্র বাক্যজ্বালায় প্রাণ বাহির হইয়া যাইত।
আরো দেখুন
রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা
Stories
যাহারা বলে, গুরুচরণের মৃত্যুকালে তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের সংসারটি অন্তঃপুরে বসিয়া তাস খেলিতেছিলেন, তাহারা বিশ্বনিন্দুক, তাহারা তিলকে তাল করিয়া তোলে। আসলে গৃহিণী তখন এক পায়ের উপর বসিয়া দ্বিতীয় পায়ের হাঁটু চিবুক পর্যন্ত উত্থিত করিয়া কাঁচা তেঁতুল, কাঁচা লঙ্কা এবং চিংড়িমাছের ঝালচচ্চড়ি দিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পান্তাভাত খাইতেছিলেন। বাহির হইতে যখন ডাক পড়িল, তখন স্তূপাকৃতি চর্বিত ডাঁটা এবং নিঃশেষিত অন্নপাত্রটি ফেলিয়া গম্ভীরমুখে কহিলেন, "দুটো পান্তাভাত-যে মুখে দেব, তারও সময় পাওয়া যায় না।"
এ দিকে ডাক্তার যখন জবাব দিয়া গেল তখন গুরুচরণের ভাই রামকানাই রোগীর পার্শ্বে বসিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন, "দাদা, যদি তোমার উইল করিবার ইচ্ছা থাকে তো বলো!" গুরুচরণ ক্ষীণস্বরে বলিলেন, "আমি বলি, তুমি লিখিয়া লও।" রামকানাই কাগজকলম লইয়া প্রস্তুত হইলেন। গুরুচরণ বলিয়া গেলেন, "আমার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত বিষয়সম্পত্তি আমার ধর্মপত্নী শ্রীমতী বরদাসুন্দরীকে দান করিলাম।" রামকানাই লিখিলেন- কিন্তু লিখিতে তাঁহার কলম সরিতেছিল না। তাঁহার বড়ো আশা ছিল, তাঁহার একমাত্র পুত্র নবদ্বীপ অপুত্রক জ্যাঠামহাশয়ের সমস্ত বিষয়সম্পত্তির অধিকারী হইবে। যদিও দুই ভাইয়ে পৃথগন্ন ছিলেন, তথাপি এই আশায় নবদ্বীপের মা নবদ্বীপকে কিছুতেই চাকরি করিতে দেন নাই-- এবং সকাল-সকাল বিবাহ দিয়াছিলেন, এবং শত্রুর মুখে ভস্ম নিক্ষেপ করিয়া বিবাহ নিষ্ফল হয় নাই। কিন্তু তথাপি রামকানাই লিখিলেন এবং সই করিবার জন্য কলমটা দাদার হাতে দিলেন। গুরুচরণ নির্জীব হস্তে যাহা সই করিলেন, তাহা কতকগুলা কম্পিত বক্ররেখা কি তাঁহার নাম, বুঝা দুঃসাধ্য।
আরো দেখুন
পুরোনো বাড়ি
Stories
অনেক কালের ধনী গরিব হয়ে গেছে, তাদেরই ঐ বাড়ি।
দিনে দিনে ওর উপরে দুঃসময়ের আঁচড় পড়ছে।
আরো দেখুন
ধ্বনি
Verses
                     জন্মেছিনু সূক্ষ্ম তারে বাঁধা মন নিয়া,
                     চারি দিক হতে শব্দ উঠিত ধ্বনিয়া
                                    নানা কম্পে নানা সুরে
                            নাড়ীর জটিল জালে ঘুরে ঘুরে।
                     বালকের মনের অতলে দিত আনি
                            পাণ্ডুনীল আকাশের বাণী
                                    চিলের সুতীক্ষ্ণ সুরে
                                          নির্জন দুপুরে,
                     রৌদ্রের প্লাবনে যবে চারি ধার
                            সময়েরে করে দিত একাকার
                                    নিষ্কর্ম তন্দ্রার তলে।
                     ওপাড়ার কুকুরের সুদূর কলকোলাহলে
           মনেরে জাগাত মোর অনির্দিষ্ট ভাবনার পারে
                                    অস্পষ্ট সংসারে।
                     ফেরিওলাদের ডাক সূক্ষ্ম হয়ে কোথা যেত চলি,
                                    যে-সকল অলিগলি
                                                জানি নি কখনো
                                          তারা যেন কোনো
                                      বোগদাদের বসোরার
                                          পরদেশী পসরার
                            স্বপ্ন এনে দিত বহি।
                                    রহি রহি
                    রাস্তা হতে শোনা যেত সহিসের ডাক ঊর্ধ্বস্বরে,
                                    অন্তরে অন্তরে
                            দিত সে ঘোষণা কোন্‌ অস্পষ্ট বার্তার,
                                    অসম্পন্ন উধাও যাত্রার।
                            একঝাঁক পাতিহাঁস
                                    টলোমলো গতি নিয়ে উচ্চকলভাষ
                                          পুকুরে পড়িত ভেসে।
                     বটগাছ হতে বাঁকা রৌদ্ররশ্মি এসে
                            তাদের সাঁতার-কাটা জলে
                                    সবুজ ছায়ার তলে
                     চিকন সাপের মতো পাশে পাশে মিলি
                     খেলাত আলোর কিলিবিলি।
                                    বেলা হলে
           হলদে গামছা কাঁধে হাত দোলাইয়া যেত চলে
                            কোন্‌খানে কে যে।
                     ইস্কুলে উঠিত ঘণ্টা বেজে।
                            সে ঘণ্টার ধ্বনি
           নিরর্থ আহ্বানঘাতে কাঁপাইত আমার ধমনী।
                     রৌদ্রক্লান্ত ছুটির প্রহরে
                 আলস্যে-শিথিল শান্তি ঘরে ঘরে;
                            দক্ষিণে গঙ্গার ঘাট থেকে
                                    গম্ভীরমন্দ্রিত হাঁক হেঁকে
                            বাষ্পশ্বাসী সমুদ্র-খেয়ার ডিঙা
                                    বাজাইত শিঙা,
                            রৌদ্রের প্রান্তর বহি
                     ছুটে যেত দিগন্তে শব্দের অশ্বারোহী।
                            বাতায়নকোণে
                                    নির্বাসনে
                     যবে দিন যেত বয়ে
           না-চেনা ভুবন হতে ভাষাহীন নানা ধ্বনি লয়ে
                  প্রহরে প্রহরে দূত ফিরে ফিরে
                     আমারে ফেলিত ঘিরে।
           জনপূর্ণ জীবনের যে আবেগ পৃথ্বীনাট্যশালে
                                    তালে ও বেতালে
                                          করিত চরণপাত,
                                                কভু অকস্মাৎ
                                    কভু মৃদুবেগে ধীরে
                            ধ্বনিরূপে মোর শিরে
           স্পর্শ দিয়ে চেতনারে জাগাইত ধোঁয়ালি চিন্তায়,
                     নিয়ে যেত সৃষ্টির আদিম ভূমিকায়।
           চোখে দেখা এ বিশ্বের গভীর সুদূরে
                                    রূপের অদৃশ্য অন্তঃপুরে
                     ছন্দের মন্দিরে বসি রেখা-জাদুকর কাল
           আকাশে আকাশে নিত্য প্রসারে বস্তুর ইন্দ্রজাল।
                            যুক্তি নয়, বুদ্ধি নয়,
                     শুধু যেথা কত কী যে হয়--
           কেন হয় কিসে হয় সে প্রশ্নের কোনো
                         নাহি মেলে উত্তর কখনো।
           যেথা আদিপিতামহী পড়ে বিশ্ব-পাঁচালির ছড়া
                       ইঙ্গিতের অনুপ্রাসে গড়া--
           কেবল ধ্বনির ঘাতে বক্ষস্পন্দে দোলন দুলায়ে
                            মনেরে ভুলায়ে
                     নিয়ে যায় অস্তিত্বের ইন্দ্রজাল যেই কেন্দ্রস্থলে,
               বোধের প্রত্যুষে যেথা বুদ্ধির প্রদীপ নাহি জ্বলে।
আরো দেখুন
একটা আষাঢ়ে গল্প
Stories
দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ। সেখানে কেবল তাসের সাহেব, তাসের বিবি, টেক্কা এবং গোলামের বাস। দুরি তিরি হইতে নহলা-দহলা পর্যন্ত আরো অনেক-ঘর গৃহস্থ আছে কিন্তু তাহারা উচ্চজাতীয় নহে।
টেক্কা সাহেব গোলাম এই তিনটেই প্রধান বর্ণ, নহলা-দহলারা অন্ত্যজ-- তাহাদের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে বসিবার যোগ্য নহে।
আরো দেখুন