ভিখারিনী
Stories
কাশ্মীরের দিগন্তব্যাপী জলদস্পর্শী শৈলমালার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটিরগুলি আঁধার আঁধার ঝোপঝাপের মধ্যে প্রচ্ছন্ন। এখানে সেখানে শ্রেণীবদ্ধ বৃক্ষচ্ছায়ার মধ্য দিয়া একটি-দুইটি শীর্ণকায় চঞ্চল ক্রীড়াশীল নির্ঝর গ্রাম্য কুটিরের চরণ সিক্ত করিয়া, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপলগুলির উপর দ্রুত পদক্ষেপ করিয়া এবং বৃক্ষচ্যুত ফুল ও পত্রগুলিকে তরঙ্গে তরঙ্গে উলটপালট করিয়া, নিকটস্থ সরোবরে লুটাইয়া পড়িতেছে। দূরব্যাপী নিস্তরঙ্গ সরসী--লাজুক উষার রক্তরাগে, সূর্যের হেমময় কিরণে, সন্ধ্যার স্তরবিন্যস্ত মেঘমালার প্রতিবিম্বে, পূর্ণিমার বিগলিত জ্যোৎস্নাধারায় বিভাসিত হইয়া শৈললক্ষ্মীর বিমল দর্পণের ন্যায় সমস্ত দিনরাত্রি হাস্য করিতেছে। ঘনবৃক্ষবেষ্টিত অন্ধকার গ্রামটি শৈলমালার বিজন ক্রোড়ে আঁধারের অবগুণ্ঠন পরিয়া পৃথিবীর কোলাহল হইতে একাকী লুকাইয়া আছে। দূরে দূরে হরিৎ শস্যময় ক্ষেত্রে গাভী চরিতেছে, গ্রাম্য বালিকারা সরসী হইতে জল তুলিতেছে, গ্রামের আঁধার কুঞ্জে বসিয়া অরণ্যের ম্রিয়মাণ কবি বউকথাকও মর্মের বিষণ্ন গান গাহিতেছে। সমস্ত গ্রামটি যেন একটি কবির স্বপ্ন।
এই গ্রামে দুইটি বালক-বালিকার বড়োই প্রণয় ছিল। দুইটিতে হাত ধরাধরি করিয়া গ্রাম্যশ্রীর ক্রোড়ে খেলিয়া বেড়াইত; বকুলের কুঞ্জে কুঞ্জে দুইটি অঞ্চল ভরিয়া ফুল তুলিত; শুকতারা আকাশে ডুবিতে না ডুবিতে, উষার জলদমালা লোহিত না হইতে হইতেই সরসীর বক্ষে তরঙ্গ তুলিয়া ছিন্ন কমলদুটির ন্যায় পাশাপাশি সাঁতার দিয়া বেড়াইত। নীরব মধ্যাহ্নে স্নিগ্ধতরুচ্ছায় শৈলের সর্বোচ্চ শিখরে বসিয়া ষোড়শবর্ষীয় অমরসিংহ ধীর মৃদুলস্বরে রামায়ণ পাঠ করিত, দুর্দান্ত রাবণ-কর্তৃক সীতাহরণ পাঠ করিয়া ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিত। দশমবর্ষীয়া কমলদেবী তাহার মুখের পানে স্থির হরিণনেত্র তুলিয়া নীরবে শুনিত, অশোকবনে সীতার বিলাপকাহিনী শুনিয়া পক্ষ্ণরেখা অশ্রুসলিলে সিক্ত করিত। ক্রমে গগনের বিশাল প্রাঙ্গণে তারকার দীপ জ্বলিলে, সন্ধ্যার অন্ধকার-অঞ্চলে জোনাকি ফুটিয়া উঠিলে, দুইটিতে হাত ধরাধরি করিয়া কুটিরে ফিরিয়া আসিত। কমলদেবী বড়ো অভিমানিনী ছিল; কেহ তাহাকে কিছু বলিলে সে অমরসিংহের বক্ষে মুখ লুকাইয়া কাঁদিত। অমর তাহাকে সান্ত্বনা দিলে, তাহারঅশ্রুজল মুছাইয়া দিলে, আদর করিয়া তাহার অশ্রুসিক্ত কপোল চুম্বন করিলে, বালিকার সকল যন্ত্রণা নিভিয়া যাইত। পৃথিবীর মধ্যে তাহার আর কেহই ছিল না; কেবল একটি বিধবা মাতা ছিল আর স্নেহময় অমরসিংহ ছিল, তাহারাই বালিকাটির অভিমান সান্ত্বনা ও ক্রীড়ার স্থল।
আরো দেখুন
নতুন পুতুল
Stories
এই গুণী কেবল পুতুল তৈরি করত; সে পুতুল রাজবাড়ির মেয়েদের খেলার জন্যে।
বছরে বছরে রাজবাড়ির আঙিনায় পুতুলের মেলা বসে। সেই মেলায় সকল কারিগরই এই গুণীকে প্রধান মান দিয়ে এসেছে।
আরো দেখুন
৩২
Verses
৩২
বিলম্বে উঠেছ তুমি কৃষ্ণপক্ষশশী,
রজনীগন্ধা যে তবু চেয়ে আছে বসি॥  
আরো দেখুন
সওগাত
Stories
পুজোর পরব কাছে। ভাণ্ডার নানা সামগ্রীতে ভরা। কত বেনারসি কাপড়, কত সোনার অলংকার; আর ভাণ্ড ভ'রে ক্ষীর দই, পাত্র ভ'রে মিষ্টান্ন।
মা সওগাত পাঠাচ্ছেন।
আরো দেখুন
19
Verses
প্রতিদিন তব গাথা
       গাব আমি সুমধুর,
তুমি মোরে দাও কথা
       তুমি মোরে দাও সুর।
                 তুমি যদি থাক মনে
                 বিকচ কমলাসনে,
                 তুমি যদি কর প্রাণ
                        তব প্রেমে পরিপূর--
                 প্রতিদিন তব গাথা
                        গাব আমি সুমধুর।
তুমি যদি শোন গান
       আমার সমুখে থাকি,
সুধা যদি করে দান
       তোমার উদার আঁখি,
                 তুমি যদি দুখ-'পরে
                 রাখ হাত স্নেহভরে,
                 তুমি যদি সুখ হতে
                        দম্ভ করহ দূর--
                 প্রতিদিন তব গাথা
                        গাব আমি সুমধুর।
আরো দেখুন
বাণী
Stories
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে আকাশের মেঘ নামে, মাটির কাছে ধরা দেবে ব'লে। তেমনি কোথা থেকে মেয়েরা আসে পৃথিবীতে বাঁধা পড়তে।
তাদের জন্য অল্প জায়গার জগৎ, অল্প মানুষের। ঐটুকুর মধ্যে আপনার সবটাকে ধরানো চাই-- আপনার সব কথা, সব ব্যথা, সব ভাবনা। তাই তাদের মাথায় কাপড়, হাতে কাঁকন, আঙিনায় বেড়া। মেয়েরা হল সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী।
আরো দেখুন
অপর পক্ষ
Verses
সময় একটুও নেই।
            লাল মখমলের জুতোটা গেল কোথায়;
                     বেরোল খাটের নীচে থেকে।
গলার বোতাম লাগাতে লাগাতে গেছি চৌকাঠ পর্যন্ত,
                   হঠাৎ এলেন বাবা।
              আলাপ শুরু করলেন ধীরে সুস্থে;
      খবর পেয়েছেন দুজন পাত্রের, মিনির জন্যে।
তাঁর মনটা একবার এর দিকে ঝুঁকছে একবার ওর দিকে।
           ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি আর উঠছি ঘেমে
                রাস্তায় বেরোলেম;
           হাওড়ায় গাড়ি আসতে বারো মিনিট।
      বুকের মধ্যে রক্তবেগ মন্দগতি সময়কে মারছে ঠেলা।
                 ট্যাক্সি ছুটল বে-আইনি চালে।
           হ্যারিসন রোড, চিৎপুর রোড,
                         হাওড়া ব্রিজ, ন মিনিট বাকি।
  দুর্ভাগ্য আর গোরুর গাড়ি আসে যখন
                 আসে ভিড় করে।
      রাস্তাটা পিণ্ডি পাকিয়ে গেছে পাট-বোঝাই গাড়িতে।
              হাঁক ডাক আর ধাক্কা লাগালে কনিস্টেবল;
            নিরেট আপদ ফাঁক দেয় না কোথাও।
                  নেমে পড়লুম ট্যাক্সি ছেড়ে,
                      হন্‌হনিয়ে চললুম পায়ে হেঁটে।
            পৌঁছলুম হাওড়া স্টেশনে।
কী জানি কব্জিঘড়িটা ফাস্ট্‌ হয় যদি পনেরো মিনিট।
            কী জানি, আজ থেকে টাইম্‌টেবিলের
                    সময় যদি পিছিয়ে থাকে।
                 ঢুকে পড়লুম ভিতরে।
                     দাঁড়িয়ে আছে একটা খালি ট্রেন --
      যেন আদিকালের প্রকাণ্ড সরীসৃপটার কঙ্কাল,
            যেন একঘেয়ে অর্থের গ্রন্থিতে বাঁধা
                       অমরকোষের একটা লম্বা শব্দাবলী।
নির্বোধের মতো এলেম উঁকি মেরে মেয়ে-গাড়িগুলোতে।
                       ডাকলেম নাম ধরে,
            "কী জানি' ছাড়া আর-কোনো কারণ নেই
                          সেই পাগলামির।
                 ভগ্ন আশা শূন্য প্লাট্‌ফরম্‌ জুড়ে ভূলুণ্ঠিত।
                       বেরিয়ে এলুম বাইরে--
                 জানি নে যাই কোন্‌ দিকে।
      বাসের নীচে চাপা পড়ি নি নিতান্ত দৈবক্রমে।
              এই দয়াটুকুর জন্যে ইচ্ছে নেই
                    দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে।
আরো দেখুন
মুসলমানীর গল্প
Stories
তখন অরাজকতার চরগুলো কণ্টকিত করে রেখেছিল রাষ্ট্রশাসন, অপ্রত্যাশিত অত্যাচারের অভিঘাতে দোলায়িত হত দিন রাত্রি। দুঃস্বপ্নের জাল জড়িয়েছিল জীবনযাত্রার সমস্ত ক্রিয়াকর্মে, গৃহস্থ কেবলই দেবতার মুখ তাকিয়ে থাকত, অপদেবতার কাল্পনিক আশঙ্কায় মানুষের মন থাকত আতঙ্কিত। মানুষ হোক আর দেবতাই হোক কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল, কেবলই চোখের জলের দোহাই পাড়তে হত। শুভ কর্ম এবং অশুভ কর্মের পরিণামের সীমারেখা ছিল ক্ষীণ। চলতে চলতে পদে পদে মানুষ হোঁচট খেয়ে খেয়ে পড়ত দুর্গতির মধ্যে।
এমন অবস্থায় বাড়িতে রূপসী কন্যার অভ্যাগম ছিল যেন ভাগ্যবিধাতার অভিসম্পাত। এমন মেয়ে ঘরে এলে পরিজনরা সবাই বলত 'পোড়ারমুখী বিদায় হলেই বাঁচি'। সেই রকমেরই একটা আপদ এসে জুটেছিল তিন-মহলার তালুকদার বংশীবদনের ঘরে।
আরো দেখুন
তুমি একলা ঘরে
Songs
তুমি      একলা ঘরে বসে বসে কী সুর বাজালে
           প্রভু,  আমার জীবনে!
তোমার  পরশরতন গেঁথে গেঁথে আমায় সাজালে
           প্রভু,  গভীর গোপনে ॥
দিনের আলোর আড়াল টানি    কোথায় ছিলে নাহি জানি,
           অস্তরবির তোরণ হতে চরণ বাড়ালে
               আমার রাতের স্বপনে ॥
আমার    হিয়ায় হিয়ায় বাজে আকুল আঁধার যামিনী,
               সে যে তোমার বাঁশরি।
আমি     শুনি তোমার আকাশপারের তারার রাগিণী,
               আমার সকল পাশরি।
কানে আসে আশার বাণী-- খোলা পাব দুয়ারখানি
           রাতের শেষে শিশির-ধোওয়া প্রথম সকালে
               তোমার করুণ কিরণে ॥
আরো দেখুন
দানপ্রতিদান
Stories
বড়োগিন্নি যে কথাগুলা বলিয়া গেলেন, তাহার ধার যেমন তাহার বিষও তেমনি। যে-হতভাগিনীর উপর প্রয়োগ করিয়া গেলেন, তাহার চিত্তপুত্তলি একেবারে জ্বলিয়া জ্বলিয়া লুটিতে লাগিল।
বিশেষত, কথাগুলা তাহার স্বামীর উপর লক্ষ্য করিয়া বলা-- এবং স্বামী রাধামুকুন্দ তখন রাত্রের আহার সমাপন করিয়া অনতিদূরে বসিয়া তাম্বুলের সহিত তাম্রকূটধূম সংযোগ করিয়া খাদ্যপরিপাকে প্রবৃত্ত ছিলেন। কথাগুলো শ্রুতিপথে প্রবেশ করিয়া তাঁহার পরিপাকের যে বিশেষ ব্যাঘাত করিল, এমন বোধ হইল না। অবিচলিত গাম্ভীর্যের সহিত তাম্রকূট নিঃশেষ করিয়া অভ্যাসমত যথাকালে শয়ন করিতে গেলেন।
আরো দেখুন