স্মরণ
Verses
যখন রব না আমি মর্তকায়ায়
          তখন স্মরিতে যদি হয় মন
তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়
          যেখা এই চৈত্রের শালবন।
হেথায় যে মঞ্জরী দোলে শাখে শাখে,
          পুচ্ছ নাচায়ে যত পাখি গায়,
ওরা মোর নাম ধরে কভু নাহি ডাকে,
          মনে নাহি করে বসি নিরালায়।
কত যাওয়া কত আসা এই ছায়াতলে
          আনমনে নেয় ওরা সহজেই,
মিলায় নিমেষে কত প্রতি পলে পলে
          হিসাব কোথাও তার কিছু নেই।
ওদের এনেছে ডেকে আদিসমীরণে
          ইতিহাসলিপিহারা যেই কাল
আমারে সে ডেকেছিল কভু খনে খনে,
          রক্তে বাজায়েছিল তারি তাল।
সেদিন ভুলিয়াছিনু কীর্তি ও খ্যাতি,
          বিনা পথে চলেছিল ভোলা মন;
চারি দিকে নামহারা ক্ষণিকের জ্ঞাতি
          আপনারে করেছিল নিবেদন।
সেদিন ভাবনা ছিল মেঘের মতন,
          কিছু নাহি ছিল ধরে রাখিবার;
সেদিন আকাশে ছিল রূপের স্বপন,
          রঙ ছিল উড়ো ছবি আঁকিবার।
সেদিনের কোনো দানে ছোটো বড়ো কাজে
          স্বাক্ষর দিয়ে দাবি করি নাই;
যা লিখেছি যা মুছেছি শূন্যের মাঝে
          মিলায়েছে, দাম তার ধরি নাই।
সেদিনের হারা আমি-- চিহ্নবিহীন
          পথ বেয়ে কোরো তার সন্ধান,
হারাতে হারাতে যেথা চলে যায় দিন,
          ভরিতে ভরিতে ডালি অবসান।
মাঝে মাঝে পেয়েছিল আহ্বান-পাঁতি
          যেখানে কালের সীমারেখা নেই--
খেলা করে চলে যায় খেলিবার সাথি
          গিয়েছিল দায়হীন সেখানেই।
দিন নাই, চাই নাই, রাখি নি কিছুই
          ভালো মন্দের কোনো জঞ্জাল;
চলে-যাওয়া ফাগুনের ঝরা ফুলে ভুঁই
          আসন পেতেছে মোর ক্ষণকাল।
সেইখানে মাঝে মাঝে এল যারা পাশে
          কথা তারা ফেলে গেছে কোন্‌ ঠাঁই;
সংসার তাহাদের ভোলে অনায়াসে,
          সভাঘরে তাহাদের স্থান নাই।
বাসা যার ছিল ঢাকা জনতার পারে,
          ভাষাহারাদের সাথে মিল যার,
যে আমি চায় নি কারে ঋণী করিবারে,
          রাখিয়া যে যায় নাই ঋণভার,
সে আমারে কে চিনেছ মর্তকায়ায়,
          কখনো স্মরিতে যদি হয় মন,
ডেকো না ডেকো না সভা-- এসো এ ছায়ায়
          যেথা এই চৈত্রের শালবন।
আরো দেখুন
অধ্যাপক
Stories
কলেজে আমার সহপাঠীসম্প্রদায়ের মধ্যে আমার একটু বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। সকলেই আমাকে সকল বিষয়েই সমজদার বলিয়া মনে করিত।
ইহার প্রধান কারণ, ভুল হউক আর ঠিক হউক, সকল বিষয়েই আমার একটা মতামত ছিল। অধিকাংশ লোকেই হাঁ এবং না জোর করিয়া বলিতে পারে না, আমি সেটা খুব বলিতাম।
আরো দেখুন
ঠাকুরদা
Stories
নয়নজোড়ের জমিদারেরা এককালে বাবু বলিয়া বিশেষ বিখ্যাত ছিলেন। তখনকার কালের বাবুয়ানার আদর্শ বড়ো সহজ ছিল না। এখন যেমন রাজা-রায়বাহাদুর খেতাব অর্জন করিতে অনেক খানা নাচ ঘোড়দৌড় এবং সেলাম-সুপারিশের শ্রাদ্ধ করিতে হয়, তখনো সাধারণের নিকট হইতে বাবু উপাধি লাভ করিতে বিস্তর দুঃসাধ্য তপশ্চরণ করিতে হইত।
আমাদের নয়নজোড়ের বাবুরা পাড় ছিঁড়িয়া ফেলিয়া ঢাকাই কাপড় পরিতেন, কারণ পাড়ের কর্কশতায় তাঁহাদের সুকোমল বাবুয়ানা ব্যথিত হইত। তাঁহারা লক্ষ টাকা দিয়া বিড়ালশাবকের বিবাহ দিতেন এবং কথিত আছে, একবার কোনো উৎসব উপলক্ষে রাত্রিকে দিন করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়া অসংখ্য দীপ জ্বলাইয়া সূর্যকিরণের অনুকরণে তাঁহারা সাচ্চা রুপার জরি উপর হইতে বর্ষণ করিয়াছিলেন।
আরো দেখুন
দুরাশা
Stories
দার্জিলিঙে গিয়া দেখিলাম, মেঘে বৃষ্টিতে দশ দিক আচ্ছন্ন। ঘরের বাহির হইতে ইচ্ছা হয় না, ঘরের মধ্যে থাকিতে আরো অনিচ্ছা জন্মে।
হোটেলে প্রাতঃকালের আহার সমাধা করিয়া পায়ে মোটা বুট এবং আপাদমস্তক ম্যাকিন্টশ পরিয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছি। ক্ষণে ক্ষণে টিপ্‌ টিপ্‌ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে এবং সর্বত্র ঘন মেঘের কুজ্ঝটিকায় মনে হইতেছে, যেন বিধাতা হিমালয়পর্বতসুদ্ধ সমস্ত বিশ্বচিত্র রবার দিয়া ঘষিয়া ঘষিয়া মুছিয়া ফেলিবার উপক্রম করিয়াছেন।
আরো দেখুন
১৬৪
Verses
১৬৪
বহ্নি যবে বাঁধা থাকে তরুর মর্মের মাঝখানে
       ফলে ফুলে পল্লবে বিরাজে।
যখন উদ্দাম শিখা লজ্জাহীনা বন্ধন না মানে
       মরে যায় ব্যর্থ ভস্মমাঝে॥  
আরো দেখুন
সুয়োরানীর সাধ
Stories
সুয়োরানীর বুঝি মরণকাল এল।
তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে, তার কিছুই ভালো লাগছে না। বদ্দি বড়ি নিয়ে এল। মধু দিয়ে মেড়ে বললে, 'খাও।' সে ঠেলে ফেলে দিলে।
আরো দেখুন
পণরক্ষা
Stories
বংশীবদন তাহার ভাই রসিককে যেমন ভালোবাসিত এমন করিয়া সচরাচর মাও ছেলেকে ভালোবাসিতে পারে না। পাঠশালা হইতে রসিকের আসিতে যদি কিছু বিলম্ব হইত তবে সকল কাজ ফেলিয়া সে তাহার সন্ধানে ছুটিত। তাহাকে না খাওয়াইয়া সে নিজে খাইতে পারিত না। রসিকের অল্প কিছু অসুখবিসুখ হইলেই বংশীর দুই চোখ দিয়া ঝর্‌ঝর্‌ করিয়া জল ঝরিতে থাকিত।
রসিক বংশীর চেয়ে ষোলো বছরের ছোটো। মাঝে যে কয়টি ভাইবোন জন্মিয়াছিল সবগুলিই মারা গিয়াছে। কেবল এই সব-শেষেরটিকে রাখিয়া, যখন রসিকের এক বছর বয়স, তখন তাহার মা মারা গেল এবং রসিক যখন তিন বছরের ছেলে তখন সে পিতৃহীন হইল। এখন রসিককে মানুষ করিবার ভার একা এই বংশীর উপর।
আরো দেখুন
12
Verses
অমল কমল সহজে জলের কোলে
       আনন্দে রহে ফুটিয়া--
ফিরিতে না হয় আলয় কোথায় ব'লে
       ধুলায় ধুলায় লুটিয়া।
তেমনি সহজে আনন্দে হরষিত
তোমার মাঝারে রব নিমগ্নচিত,
পূজাশতদল আপনি সে বিকশিত
       সব সংশয় টুটিয়া।
       কোথা আছ তুমি পথ না খুঁজিব কভু,
              শুধাব না কোনো পথিকে।
       তোমারি মাঝারে ভ্রমিব ফিরিব, প্রভু,
              যখন ফিরিব যে দিকে।
চলিব যখন তোমার আকাশগেহে
তব আনন্দপ্রবাহ লাগিবে দেহে,
তোমার পবন সখার মতন স্নেহে
       বক্ষে আসিবে ছুটিয়া।
আরো দেখুন
বোষ্টমী
Stories
আমি লিখিয়া থাকি অথচ লোকরঞ্জন আমার কলমের ধর্ম নয়, এইজন্য লোকেও আমাকে সদাসর্বদা যে রঙে রঞ্জিত করিয়া থাকে তাহাতে কালির ভাগই বেশি। আমার সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনিতে হয়; কপালক্রমে সেগুলি হিতকথা নয়, মনোয়ারী তো নহেই।
শরীরে যেখানটায় ঘা পড়িতে থাকে সে জায়গাটা যত তুচ্ছই হোক সমস্ত দেহটাকে বেদনার জোরে সেই ছাড়াইয়া যায়। সে লোক গালি খাইয়া মানুষ হয়, সে আপনার স্বভাবকে যেন ঠেলিয়া একঝোঁকা হইয়া পড়ে। আপনার চারি দিককে ছাড়াইয়া আপনাকেই কেবল তাহার মনে পড়ে-- সেটা আরামও নয়, কল্যাণও নয়। আপনাকে ভোলাটাই তো স্বস্তি।
আরো দেখুন
একটা আষাঢ়ে গল্প
Stories
দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ। সেখানে কেবল তাসের সাহেব, তাসের বিবি, টেক্কা এবং গোলামের বাস। দুরি তিরি হইতে নহলা-দহলা পর্যন্ত আরো অনেক-ঘর গৃহস্থ আছে কিন্তু তাহারা উচ্চজাতীয় নহে।
টেক্কা সাহেব গোলাম এই তিনটেই প্রধান বর্ণ, নহলা-দহলারা অন্ত্যজ-- তাহাদের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে বসিবার যোগ্য নহে।
আরো দেখুন
তারাপ্রসন্নের কীর্তি
Stories
লেখকজাতির প্রকৃতি অনুসারে তারাপ্রসন্ন কিছু লাজুক এবং মুখচোরা ছিলেন। লোকের কাছে বাহির হইতে গেলে তাঁহার সর্বনাশ উপস্থিত হইত। ঘরে বসিয়া কলম চালাইয়া তাঁহার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, পিঠ একটু কুঁজা, সংসারের অভিজ্ঞতা অতি অল্প। লৌকিকতার বাঁধি বোলসকল সহজে তাঁহার মুখে আসিত না, এইজন্য গৃহদুর্গের বাহিরে তিনি আপনাকে কিছুতেই নিরাপদ মনে করিতেন না।
লোকেও তাঁহাকে একটা উজবুক রকমের মনে করিত এবং লোকেরও দোষ দেওয়া যায় না। মনে করো, প্রথম পরিচয়ে একটি পরম ভদ্রলোক উচ্ছ্বসিত কন্ঠে তারাপ্রসন্নকে বলিলেন, "মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ হয়ে যে কী পর্যন্ত আনন্দ লাভ করা গেল, তা একমুখে বলতে পারি নে"-- তারাপ্রসন্ন নিরুত্তর হইয়া নিজের দক্ষিণ করতল বিশেষ মনোযোগপূর্বক নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। হঠাৎ সে নীরবতার অর্থ এইরূপ মনে হয়, "তা, তোমার আনন্দ হয়েছে সেটা খুব সম্ভব বটে, কিন্তু আমার-যে আনন্দ হয়েছে এমন মিথ্যা কথাটা কী করে মুখে উচ্চারণ করব তাই ভাবছি।"
আরো দেখুন