শ্রাবণ ১৯২০


 

অনাবশ্যক (onaboshyok)


আমরা বর্ত্তমানের জীব। কোন জিনিষ বর্ত্তমানের পরপারে প্রত্যক্ষের বাহিরে গেলেই আমাদের হাতছাড়া হইবার যো হয়। যাহা পাইতেছি তাহা প্রত্যহই হারাইতেছি। আজ যে ফুলের আঘ্রাণ লইয়াছি, কাল সকালে তাহা আর রহিল না, কাল বিকালে তাহার স্মৃতিও চলিয়া গেল। এমন কত ফুলের ঘ্রাণ লইয়াছি, কত পাখীর গান শুনিয়াছি, কত মুখ দেখিয়াছি, কত কথা কহিয়াছি, কত সুখ দুঃখ অনুভব করিয়াছি, তাহারা নাই, এবং তাহারা এক কালে ছিল বলিয়া মনেও নাই। যদি বা মনে থাকে সে কি আর প্রত্যক্ষের মত আছে? তাহা একটি নিরাকার অথবা কেবলমাত্র ছায়ার মত জ্ঞানে পর্য্যবসিত হইয়াছে। অমুক ঘটনা ঘটিয়াছে এইরূপ একটা জ্ঞান আছে মাত্র, অমুককে জানিতাম এইরূপ একটা সত্য অবগত আছি বটে! কেবল মাত্র জ্ঞানে যাহাকে জানি তাহাকে কি আর জানা বলে, তাহাকে মানিয়া লওয়া বলে। অনেক সময়ে আমাদের কানে শব্দ আসে, কিন্তু তাহাকে শোনা বলি না; কারণ সে শব্দটা আমাদের কান আছে বলিয়াই শুনিতেছি, আমাদের মন আছে বলিয়া শুনিতেছি না। কান বেচারার না শুনিয়া থাকিবার যো নাই, কিন্তু মনটা তখন ছুটি লইয়া গিয়াছিল। তেমনি আমরা যাহা জ্ঞানে জানি তাহা না জানিয়া থাকিবার যো নাই বলিয়াই জানি; সাক্ষী আনিয়া প্রমাণ করিয়া দিলেই জ্ঞানকে জানিতেই হইবে--সে যত বড় লোকটাই হউক না কেন, এ আইনের কাছে তাহার নিষ্কৃতি নাই। কিন্তু উহার উর্দ্ধে আর জোর খাটে না। তেমনি আমরা অনেক অপ্রত্যক্ষ অতীত ঘটনা ঘটিয়াছিল বলিয়া জানি, কিন্তু আর তাহা অনুভব করিতে পারি না। মাঝে মাঝে অনুভব করিতে চেষ্টা করি, ভান করি, কিন্তু বৃথা!

 

কিন্তু মাঝে মাঝে এমন হয় না কি, যখন অতীত ঘটনার নামে বহুবিধ ওয়ারেণ্ট জারি করিয়াও কিছুতেই মনের সম্মুখে তাহাকে আনিতে পারা গেল না, এমন-কি যখন তাহার অস্তিত্বের বিষয়েই সন্দেহ উপস্থিত হইল, তখন হয়ত সেদিনকার একটি চিঠির একটুখানি ছেঁড়া টুক্‌রা অথবা দেয়ালের উপর বহুদিনকার পুরান একটি পেন্সিলের দাগ দেখিবামাত্র সে যেন তৎক্ষণাৎ সশরীরে বিদ্যুতের মত আমার সমুখে আসিয়া উপস্থিত হয! ঐ কাগজের টুক্‌রাটি, পেন্সিলের দাগটি তাহাকে যেন যাদু করিয়া রাখিয়াছিল; তোমার চারি দিকে আরও ত কত শত জিনিষ আছে, কিন্তু সেই অতীত ঘটনার পক্ষে ঐ ছেঁড়া কাগজটুকু ও সেই পেন্সিলের দাগটুকু ছাড়া আর সকলগুলিই non-conductor। অর্থাৎ আমরা এমনি ভয়ানক প্রত্যক্ষবাদী, যে, বর্ত্তমানের গায়ের উপর অতীতের একটা স্পষ্ট চিহ্ন থাকা চাই, তবেই তাহার সহিত আমাদের ভালরূপ আদান প্রদান চলিতে পারে। যাহার অতীতজীবন বহুবিধ কার্য্যভার বহন করিয়া ধনবান বণিকের মত সময়ের পথ দিয়া চলিয়া গিয়াছিল, সে নিশ্চয়ই পথ চলিতে চলিতে একটা-না-একটা টুক্‌রা ফেলিতে ফেলিতে গিয়াছিল, সেইগুলি ধরিয়া ধরিয়া অনায়াসেই সে তাহার অতীতের পথ খুঁজিয়া লইতে পারে। আর আমাদের মত যাহার অলস অতীত রিক্তহস্তে পথ চলিতেছিল, সে আর কি চিহ্ন রাখিয়া যাইবে! সুতরাং তাহাকে আর খুঁজিয়া পাইবার সম্ভাবনা নাই, সে একেবারে হারাইয়া গেল!

 

ইতিহাস সম্বন্ধেও এইরূপ বলা যায়। বর্ত্তমানের গায়ে অতীতকালের একটা নাম-সই থাকা নিতান্তই আবশ্যক। কালিদাস যে এক সময়ে বর্ত্তমান ছিলেন তাহা আমি অস্বীকার করি না, কিন্তু আজ যদি আমি দৈবাৎ তাঁহার স্বহস্তে-লিখিত মেঘদূত পুঁথিখানি পাই, তবে তাঁহার অস্তিত্ব আমার পক্ষে কিরূপ জাজ্জ্বল্যমান হইয়া উঠে! আমরা কল্পনায় যেন তাঁহার স্পর্শ পর্য্যন্ত অনুভব করিতে পারি। ইহা হইতে তীর্থ-যাত্রার একটি প্রধান ফল অনুমান করা যায়। আমি একজন বুদ্ধের ভক্ত। বুদ্ধের অস্তিত্বের বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু যখন আমি সেই তীর্থে যাই, যেখানে বুদ্ধের দন্ত রক্ষিত আছে, সেই শিলা দেখি যাহার উপর বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত আছে, তখন আমি বুদ্ধকে কতখানি প্রাপ্ত হই! যখন দেখি, ফুটন্ত, ছুটন্ত বর্ত্তমান স্রোতের উপর পুরাতন কালের একটি প্রাচীন জীর্ণ অবশেষ নিশ্চলভাবে বসিয়া তাহার অমরতার অভিশাপের জন্য শোক করিতেছে, অতীতের দিকে অনিমেষনেত্রে চাহিয়া আছে, অতীতের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিতেছে, তখন এমন হৃদয়হীন পাষাণ কে আছে যে মুহূর্ত্তের জন্য থামিয়া একবার পশ্চাৎ ফিরিয়া সেই মহা অতীতের দিকে চাহিয়া না দেখে!

 

কিছুই ত থাকে না, সবই ত চলিয়া যায়, তথাপি এই-যে দুটি-একটি চিহ্ন অতীত রাখিয়া গিয়াছে ইহাও মুছিয়া ফেলিতে চায়, এমন কে আছে? সময়ের অরণ্য অসীম।

 

এই অন্ধকার অসীম মহারণ্যের মধ্য দিয়া আমরা একটি মাত্র পায়ের চিহ্ন রাখিয়া আসিতেছি, সে চিহ্ন মুছিয়া মুছিয়া আসিবার আবশ্যকটা কি? পথের মধ্যে যে গাছের তলায় বসিয়া খেলা করিয়াছ, যে অতিথিশালায় বসিয়া আমোদপ্রমোদে বন্ধুবান্ধবদের সহিত রাত্রিযাপন করিয়াছ, একবারও কি ফিরিয়া যাইয়া সেই তরুর তলে বসিতে ইচ্ছা যাইবে না, সেই অতিথিশালার দ্বারে দাঁড়াইতে সাধ যাইবে না? কিন্তু ফিরিবে কেমন করিয়া যদি সে পথের চিহ্ন মুছিয়া ফেল! যে স্থান, যে গৃহ, যে ছায়া, যে আশ্রয় এককালে নিতান্তই তোমার ছিল তাহার অধিকার যদি একেবারে চিরকালের জন্য হারাইয়া ফেল!

 

দেশ ও কালেই আমরা বাস করি! অথচ দেশের উপরেই আমাদের যত অনুরাগ। এক কাঠা জমির জন্য আমরা লাঠালাঠি করি, কিন্তু সুদূরবিস্তৃত সময়ের স্বত্ব অনায়াসেই ছাড়িয়া দিই, একবারও তাহার জন্য দুঃখ করি না!

 

পুরাতন দিনের একখানি চিঠি, একটি আংটি, একটি গানের সুর, একটা যা-হয় কিছু অত্যন্ত যত্নপূর্ব্বক রাখিয়া দেয় নাই, এমন কেহ আছে কি? যাহার জ্যোৎস্নার মধ্যে পুরাতন দিনের জ্যোৎস্না, যাহার বর্ষার মধ্যে পুরাতন দিনের মেঘ লুক্কায়িত নাই, এত বড় অপৌত্তলিক কেহ আছে কি! পৌত্তলিকতার কথা বলিলাম, কেননা প্রত্যক্ষ দেখিয়া অপ্রত্যক্ষকে মনে আনাই পৌত্তলিকতা। জগৎকে দেখিয়া জগতাতীতকে মনে আনা পৌত্তলিকতা। একটি চিঠি দেখিয়া যদি আমার অতীত কালের কথা মনে পড়ে তবে তাহা পৌত্তলিকতা নহে ত কি? ঐ চিঠিটুকু আমার অতীত কালের প্রতিমা। উহার কোন মূল্য নাই, কেবল উহার মধ্যে আমার অতীত কাল প্রতিষ্ঠিত আছে বলিয়াই উহার এত সমাদর। জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, এমন কোন লোক কি আছে যে তাহার পুরাতন দিবসের একটা কোনও চিহ্নও রাখিয়া দেয় নাই? আছে বৈকি! তাহারা অত্যন্ত কাজের লোক, তাহারা অতিশয় জ্ঞানী লোক! তাহাদের কিছুমাত্র কুসংস্কার নাই। যতটুকু দরকার আছে কেবল মাত্র ততটুকুকেই তাহারা খাতির করে। বোধ করি দশ বৎসর পর্য্যন্ত তাহারা মা-কে মা বলে, তাহার পর তাঁর নাম ধরিয়া ডাকে। কারণ, সন্তানপালনের জন্য যত দিন মায়ের বিশেষ আবশ্যক তত দিনই তিনি মা, তাহার পর অন্য বৃদ্ধার সহিত তাঁহার তফাৎ কি?

 

আমি যে সম্প্রদায়ের কথা বলিতেছি তাঁহারা যে সত্য-সত্যই বয়স হইলে মাকে মা বলেন না তাহা নহে। অনাবশ্যক মাকেও ইহাঁরা মা বলিয়া আদর করিয়া থাকেন। কিন্তু অতীত মাতার প্রতি ইঁহাদের ব্যবহার স্বতন্ত্র। মায়ের কাছ হইতে ইঁহারা যাহা-কিছু পাইয়াছেন, অতীতের কাছ হইতে তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী পাইয়াছেন, তবে কেন অতীতের প্রতি ইঁহাদের এমনতর অকৃতজ্ঞ অবহেলা! অতীতের অনাবশ্যক যাহা-কিছু, তাহা সমস্তই ইঁহারা কেন কুসংস্কার বলিয়া একেবারে ঝাঁটাইয়া ফেলিতে চান? তাঁহারা ইহা বুঝেন না, শুষ্ক জ্ঞানের চক্ষে সমস্ত আবশ্যক ধরা পড়ে না। আমাদের আচার ব্যবহারে কতকগুলি চিরন্তন প্রথা প্রচলিত আছে, সেগুলি ভালও নয় মন্দও নয়, কেবল দোষের মধ্যে তাহারা অনাবশ্যক -- তাহাদের দেখিয়া কঠোর জ্ঞানবান লোকের মুখে হাসি আসে এই ছুতায় তুমি তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিলে। মনে করিলে, তুমি কতকগুলি অর্থহীন অনাবশ্যক হাস্যরসোদ্দীপক অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করিলে মাত্র, কিন্তু আসলে কি করিলে! সেই অর্থহীন প্রথার মন্দির-মধ্যে অধিষ্ঠিত সুমহৎ অতীতদেবকে ভাঙ্গিয়া ফেলিলে, একটি জীবন্ত ইতিহাসকে বধ করিলে, তোমার পূর্ব্বপুরুষদিগের একটি স্মরণচিহ্ন ধ্বংস করিয়া ফেলিলে। তোমার কাছে তোমার মায়ের যদি একটি স্মরণচিহ্ন থাকে, বাজারে তাহার দাম নাই বলিয়া তোমার কাছেও যদি তাহার দাম না থাকে তবে তুমি মহাপাতকী। তেমনি অনেকগুলি অর্থহীন প্রথা পূর্ব্বপুরুষদিগের ইতিহাস বলিয়াই মূল্যবান। তুমি যদি তাহার মূল্য না দেখিতে পাও, তাহা অকাতরে ফেলিয়া দাও, তবে তোমার শরীরে দয়াধর্ম্ম কোন্‌খানে থাকে তাহাই আমি ভাবি। যাহাদের বুট-তরী আশ্রয় করিয়া তোমরা ভবসমুদ্র পার হইতে চাও, সেই ইংরাজ মহাপুরুষেরা কি করেন একবার দেখ- না। তাঁহাদের রাজসভায়, তাঁহাদের পার্ল্যামেণ্ট সমিতিতে, এবং অন্যান্য নানা স্থলে কতশত প্রকার অর্থহীন অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে, তাহা কে না জানে!

 

অতীত কাল ধরণীর মত আমাদের অচলপ্রতিষ্ঠ করিয়া রাখে। যখন বাহিরে রৌদ্রের খরতর তাপ, আকাশ হইতে বৃষ্টি পড়ে না, তখন শিকড়ের প্রভাবে আমরা অতীতের অন্ধকার নিম্নতন দেশ হইতে রস আকর্ষণ করিতে পারি। যখন সকল সুখ ফুরাইয়া গেছে তখন আমরা পিছন ফিরিয়া অতীতের ভগ্নাবিশিষ্ট চিহ্নসকল অনুসরণ করিয়া অতীতে যাইবার পথ অনুসন্ধান করিয়া লই। বর্ত্তমানে যখন নিতান্ত দুর্ভিক্ষ নিতান্ত উৎপীড়ন দেখি তখন অতীতের মাতৃক্রোড়ে বিশ্রাম করিতে যাই। বাঙ্গালা সাহিত্যে যে এত পুরাতত্ত্বের আলোচনা দেখা যাইতেছে তাহার প্রধান কারণ, আমাদের একমাত্র সান্ত্বনার স্থল অতীত কালকে জীবন্ত করিয়া তুলিবার চেষ্টা হইতেছে। সে পথও যদি কেহ বন্ধ করিতে চায়, অতীতের যাহা-কিছু অবশেষ আমাদের ঘরে ঘরে পড়িয়া রহিয়াছে তাহাকে দূর করিয়া যদি কেহ অতীতকে আরও অতীতে ফেলিতে চায়, তবে সে সমস্ত জাতির অভিশাপের পাত্র হইবে। যদি আমরা অতীতকে হারাই তবে আমরা কতখানি হারাই! আমাদের কতটুকু প্রাণ থাকে! একটি নিমেষ মাত্র লইয়া কিসের সুখ! আমাদের জীবন যদি কতকগুলি বিচ্ছিন্ন জলবিম্ব মাত্র হয়, তবে তাহা অত্যন্ত দুর্ব্বল জীবন। কিন্তু আমাদের জীবনের জন্মশিখর হইতে আরম্ভ করিয়া সাগরসঙ্গম পর্য্যন্ত যদি যোগ থাকে তবে তাহার কত বল! তবে তাহা পাষাণের বাধা মানিবে না, কথায় কথায় রৌদ্রতাপে শুকাইয়া বাষ্প হইয়া যাইবে না। আমি কিছু পরগাছা নহি, গাছ হইতে গাছে ঝুলিয়া বেড়াই না। বাহিরের রৌদ্র, বাহিরের বাতাস, বাহিরের বৃষ্টি আমি ভোগ করিতেছি, কিন্তু মাটির ভিতরে ভিতরে প্রসারিত আমার অতীতের উপর আমি দাঁড়াইয়া আছি। আমার অতীতের মধ্যে আমার কতকগুলি তীর্থস্থান প্রতিষ্ঠিত আছে, যখন বর্ত্তমানে পাপে তাপে শোকে কাতর হইয়া পড়ি তখন সেই তীর্থস্থানে গমন করি, সরল বাল্যকালের সমীরণ ভোগ করি -- নবজীবনের প্রথম সঙ্কল্প, মহৎ উদ্দেশ্য, তরুণ আশা-সকল পুনরায় দেখিতে পাই। আমার এ অতীতের পথ যদি মুছিয়া যাইত তাহা হইলে আজ আমি কি হইতাম! একটি জরাজীর্ণ কঠোরহৃদয় অবিশ্বাসী বিদ্রূপ-পরায়ণ বৃদ্ধ হইয়া উদাসনেত্রে সংসারের দিকে চাহিয়া থাকিতাম।

 

এই জন্যই আমি এই-সকল অতিশয় তুচ্ছদ্রব্যগুলিকে, অতীত কালের অতি সামান্য চিহ্নটুকুকেও যত্ন করিয়া রাখিয়াছি; অত্যধিক জ্ঞানলাভ করিয়া, কুসংস্কারের অত্যন্ত অভাবে সেগুলিকে অনাবশ্যক-বোধে ফেলিয়া দিই নাই।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •