বড়ো খবর (baro khobor)


কুসমি বললে, তুমি যে বললে এখনকার কালের বড়ো বড়ো সব খবর তুমি আমাকে শোনাবে, নইলে আমার শিক্ষা হবে কী রকম ক'রে, দাদামশায়।

 

দাদামশায় বললে, বড়ো খবরের ঝুলি বয়ে বেড়াবে কে বলো, তার মধ্যে যে বিস্তর রাবিশ।

 

সেগুলো বাদ দাও-না।

 

বাদ দিলে খুব অল্প একটু বাকি থাকবে, তখন তোমার মনে হবে ছোটো খবর। কিন্তু আসলে সে'ই খাঁটি খবর।

 

আমাকে খাঁটি খবরই দাও।

 

তাই দেব। তোমাকে যদি বি-এ পাশ করতে হ'ত, সব রাবিশই তোমার টেবিলে উঁচু করতে হত; অনেক বাজে কথা, অনেক মিথ্যে কথা, টেনে বেড়াতে হত খাতা বোঝাই ক'রে।

 

কুসমি বললে, আচ্ছা দাদামশায়, এখনকার কালের একটা খুব বড়ো খবর দাও দেখি খুব ছোটো ক'রে, দেখি তোমার কেমন ক্ষমতা।

 

আচ্ছা শোনো।

 

শান্তিতে কাজ চলছিল।

 

মহাজনি নৌকোয় ঘোরতর ঝগড়া চলছে পালে আর দাঁড়ে। দাঁড়ের দল ঠক্‌ঠক্‌ করতে করতে মাঝির বিচার-সভায় এসে উপস্থিত, বললে, এ তো আর সহ্য হয় না। ঐ যে তোমার অহংকেরে পাল, বুক ফুলিয়ে বলে আমাদের ছোটোলোক। কেননা, আমরা দিনে রাতে নীচের পাটাতনে বাঁধা থেকে জল ঠেলে ঠেলে চলি। আর উনি চলেন খেয়ালে, কারও হাতের ঠেলার তোয়াক্কা রাখেন না। সেইজন্যেই উনি হলেন বড়োলোক। তুমি ঠিক করে দাও কার কদর বেশি। আমরা যদি ছোটোলোক হই তবে জোট বেঁধে কাজে ইস্তফা দেব, দেখি তুমি নৌকো চালাও কী ক'রে।

 

মাঝি দেখলে বিপদ, দাঁড় ক'টাকে আড়ালে টেনে নিয়ে চুপিচুপি  বললে, ওর কথায় কান দিয়ো না, ভায়ারা। নিতান্ত ফাঁপা ভাষায় ও কথা ব'লে থাকে। তোমরা জোয়ানরা সব মরি-বাঁচি করে না খাটলে নৌকো একেবারে অচল। আর, ঐ পাল করেন ফাঁকা বাবুয়ানা উপরের মহলে। একটু ঝোড়ো হাওয়া দিয়েছে কি উনি কাজ বন্ধ করে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকেন নৌকোর চালের উপরে। তখন ফড়্‌ফড়ানি বন্ধ, সাড়াই পাওয়া যায় না। কিন্তু, সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে হাটে-ঘাটে তোমরাই আছ আমার ভরসা। ঐ নবাবির বোঝাটাকে যখন-তখন তোমাদের টেনে নিয়ে বেড়াতে হয়। কে বলে তোমাদের ছোটোলোক।

 

মাঝির ভয় হল, কথাগুলো পালের কানে উঠল বুঝি। সে এসে কানে কানে বললে, পাল-মশায়, তোমার সঙ্গে কার তুলনা। কে বলে যে তুমি নৌকো চালাও, সে তো মজুরের কর্ম। তুমি আপন ফুর্তিতে চল আর তোমার ইয়ারবক্সিরা তোমার ইশারায় পিছন-পিছন চলে। আবার ঝুলে পড় একটু যদি হাঁপ ধরে। ঐ দাঁড়গুলোর ইৎরমিতে তুমি কান দিয়ো না ভায়া, ওদের এমনি ক'ষে বেঁধে রেখেছি যে যতই ওদের ঝপ্‌ঝপানি থাক্‌-না কাজ না করে উপায় নেই।

 

শুনে পাল উঠল ফুলে। মেঘের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাই তুলতে লাগল।

 

কিন্তু, লক্ষণ ভালো নয়। দাঁড়গুলোর মজবুত হাড়, এমন কাত হয়ে আছে, কোন্‌ দিন খাড়া হয়ে দাঁড়াবে, লাগাবে ঝাপটা, চৌচির হয়ে যাবে পালের গুমর। ধরা পড়বে দাঁড়েই চালায় নৌকো-- ঝড় হোক, ঝাপট হোক, উজান হোক, ভাঁটা হোক।

 

কুসমি বললে, তোমার বড়ো খবর এইটুকু বই নয়? তুমি ঠাট্টা করছ।

 

দাদামশায় বললে, ঠাট্টার মতন এখন শোনাচ্ছে। দেখতে দেখতে একদিন বড়ো খবর বড়ো হয়েই উঠবে।

 

তখন?

 

তখন তোমার দাদামশায় ঐ দাঁড়গুলোর সঙ্গে তাল মেলানো অভ্যাস করতে বসবে।

 

আর, আমি?

 

যেখানে দাঁড় বড়ো বেশি কচ্‌কচ্‌ করে সেখানে দেবে একটু তেল।

 

দাদামশায় বললেন, খাঁটি খবর ছোটো হয়েই থাকে, যেমন বীজ। ডালপালা নিয়ে বড়ো গাছ আসে পরে। এখন বুঝেছ তো?

 

কুসমি বললে, হ্যাঁ, বুঝেছি।

 

মুখ দেখে বোঝা গেল, বোঝে নি। কিন্তু কুসমির একটা গুণ আছে, দাদামশায়ের কাছে ও সহজে মানতে চায় না যে ও কিছু বোঝে নি। ওর ইরুমাসির চেয়ে ও বুদ্ধিতে যে কম, এ কথাটা চাপা থাকাই ভালো।

 

         *

 

      *     *

 

পালের সঙ্গে দাঁড়ের বুঝি গোপন রেষারেষি,

মনে মনে তর্ক করে কার সমাদর বেশি।

দাঁড় ভাবে যে, পাঁচ-ছজনা গোলাম তাহার পাছে,

একলা কেবল বুড়ো মাঝি পালের তত্ত্বে আছে।

পাল ভাবে যে, জলের সঙ্গে দাঁড়ের নিত্য বৈরি,

বাতাসকে তো বক্ষে নিতে আমি সদাই তৈরি;

আমার খাতির মিতার সঙ্গে ভালোবাসার জোরে,

ওরা মরে ঝেঁকে ঝেঁকেই শুধু লড়াই ক'রে--

ওঠে পড়ে পরের খেয়ে তাড়া,

আমি চলি আকাশ থেকে যখনি পাই সাড়া।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •