নিশীথজগৎ (nishithjagat)


জন্মেছি নিশীথে আমি, তারার আলোকে

          রয়েছি বসিয়া।

চারি দিকে নিশীথিনী মাঝে মাঝে হু হু করি

          উঠিছে শ্বসিয়া।

পশ্চিমে করেছে মেঘ, নিবিড় মেঘের প্রান্তে

          স্ফুরিছে দামিনী,

দুঃস্বপ্ন ভাঙিয়া যেন শিহরি মেলিছে আঁখি

          চকিত যামিনী।

আঁধারে অরণ্যভূমি নয়ন মুদিয়া

          করিতেছে ধ্যান,

অসীম আঁধার নিশা আপনার পানে চেয়ে

          হারায়েছে জ্ঞান।

মাথার উপর দিয়া উড়িছে বাদুড়,

          কাঁদিছে পেচক--

একেলা রয়েছি বসি, চেয়ে শূন্য-পানে

          না পড়ে পলক।

 

আঁধারের প্রাণী যত ভূমিতলে হাত দিয়া

          ঘুরিয়া বেড়ায়--

চোখে উড়ে পড়ে ধুলা, কোন্‌খানে কী যে আছে

          দেখিতে না পায়।

চরণে বাধিছে বাধা, পাষাণে বাজিছে মাথা,

          কাঁদিছে বসিয়া--

অগ্নিহাসি উপহাসি উল্কা-অভিশাপশিখা

          পড়িছে খসিয়া।

তাদের মাথার 'পরে সীমাহীন অন্ধকার

          স্তব্ধ গগনেতে,

আঁধারের ভারে যেন নুইয়া পড়িছে মাথা

          মাটির পানেতে।

নড়িলে গাছের পাতা চকিতে চমকি উঠে,

          চায় চারি ধারে,

ঘোর আঁধারের মাঝে কোথা কী লুকায়ে আছে

          কে বলিতে পারে।

 

গহন বনের মাঝে চলিয়াছে শিশু

          মার হাত ধরে,

মুহূর্ত ছেড়েছে হাত, পড়েছে পিছায়ে

          খেলাবার তরে--

অমনি হারায়ে পথ কেঁদে ওঠে শিশু,

          ডাকে "মা মা" বলে--

"আয় মা, আয় মা, আয়, কোথা চলে গেলি,

          মোরে নে মা কোলে।"

মা অমনি চমকিয়া "বাছা বাছা" বলে ছোটে,

          দেখিতে না পায়--

শুধু সেই অন্ধকারে "মা মা" ধ্বনি পশে কানে,

          চারি দিকে চায়।

 

সহসা সমুখ দিয়া কে গেল ছায়ার মতো,

          লাগিল তরাস,

কে জানে সহসা যেন কোথা কোন্‌ দিক হতে

          শুনি দীর্ঘশ্বাস।

কে বসে রয়েছে পাশে? কে ছুঁইল দেহ মোর

          হিমহস্তে তার?

ও কী ও? এ কী রে শুনি! কোথা হতে উঠিল রে

          ঘোর হাহাকার?

ও কী হোথা দেখা যায়--ওই দূরে অতি দূরে

          ও কিসের আলো?

ও কী ও উড়িছে শূন্যে দীর্ঘ নিশাচর পাখি?

          মেঘ কালো কালো?

 

এই আঁধারের মাঝে কত, না অদৃশ্য প্রাণী

          কাঁদিছে বসিয়া--

নীরবে টুটিছে প্রাণ, চাহিছে তারার পানে

          অরণ্যে পশিয়া।

কেহ বা রয়েছে শুয়ে দগ্ধ হৃদয়ের 'পরে

          স্মৃতিরে জড়ায়ে--

কেহ না দেখিছে তারে, অন্ধকারে অশ্রুধারা

          পড়িছে গড়ায়ে।

কেহ বা শুনিছে সাড়া, উর্ধ্বকণ্ঠে নাম ধরে

          ডাকিছে মরণে--

পশিয়া হৃদয়-মাঝে আশার অঙ্কুরগুলি

          দলিছে চরণে।

 

ও দিকে আকাশ-'পরে মাঝে মাঝে থেকে থেকে

          উঠে অট্টহাস,

ঘন ঘন করতালি, উনমাদ কণ্ঠস্বরে

          কাঁপিছে আকাশ।

জ্বালিয়া মশাল-আলো নাচিছে গাইছে তারা,

          ক্ষণিক উল্লাস--

আঁধার মুহূর্ত-তরে হাসে যথা প্রাণপণে

          আলেয়ার হাস।

 

অরণ্যের প্রান্তভাগে নদী এক চলিয়াছে

          বাঁকিয়া বাঁকিয়া--

স্তব্ধ জল, শব্দ নাই, ফণী-সম ফুঁসি উঠে

          থাকিয়া থাকিয়া।

আঁধারে চলিতে পান্থ দেখিতে না পায় কিছু

          জলে গিয়া পড়ে,

মুহূর্তের হাহাকার মুহূর্তে ভাসিয়া যায়

          খরস্রোতভরে।

সখা তার তীরে বসি একেলা কাঁদিতে থাকে,

          ডাকে উর্ধ্বশ্বাসে--

কাহারো না পেয়ে সাড়া শূন্যপ্রাণ প্রতিধ্বনি

          কেঁদে ফিরে আসে।

 

নিশীথের কারাগারে কে বেঁধে রেখেছে মোরে

          রয়েছি পড়িয়া--

কেবল রয়েছি বেঁচে স্বপন কুড়ায়ে লয়ে

          ভাঙিয়া গড়িয়া।

আঁধারে নিজের পানে চেয়ে দেখি, ভালো করে

          দেখিতে না পাই--

হৃদয়ে অজানা দেশে পাখি গায়, ফুল ফোটে,

          পথ জানি নাই।

অন্ধকারে আপানারে দেখিতে না পাই যত

          তত ভালোবাসি,

তত তারে বুকে করে বাহুতে বাঁধিয়া লয়ে

          হরষেতে ভাসি।

তত যেন মনে হয় পাছে রে চলিতে পথে

          তৃণ ফুটে পায়,

যতনের ধন পাছে চমকি কাঁদিয়া ওঠে

          কুসুমের ঘায়!

সদা হয় অবিশ্বাস কারেও চিনি না হেথা,

          সবি অনুমান,

ভালোবেসে কাছে গেলে দূরে চলে যায় সবে,

          ভয়ে কাঁপে প্রাণ।

গোপনেতে অশ্রু ফেলে মুছে ফেলে, পাছে কেহ

          দেখিবারে পায়--

মরমের দীর্ঘশ্বাস মরমে রুধিয়া রাখে,

          পাছে শোনা যায়।

 

সখারে কাঁদিয়া বলে-- "বড়ো সাধ যায় সখা,

          দেখি ভালো করে!

তুই শৈশবের বঁধু, চিরজন্ম কেটে গেল

          দেখিনু না তোরে,

বুঝি তুমি দূরে আছ, একবার কাছে এসে

          দেখাও তোমায়।"

সে অমনি কেঁদে বলে-- "আপনারে দেখি নাই,

          কী দেখাব হায়।"

 

অন্ধকার ভাগ করি, আঁধারের রাজ্য লয়ে

          চলিছে বিবাদ।

সখারে বধিছে সখা, সন্তানে হানিছে পিতা,

          ঘোর পরমাদ।

মৃতদেহ পড়ে থাকে, শকুনি বিবাদ করে

          কাছে ঘুরে ঘুরে।

মাংস লয়ে টানাটানি করিতেছে হানাহানি

          শৃগালে কুকুরে।

অন্ধকার ভেদ করি অহরহ শুনা যায়

          আকুল বিলাপ--

আহতের আর্তস্বর, হিংসার উল্লাসধ্বনি

          ঘোর অভিশাপ।

 

মাঝে মাঝে থেকে থেকে কোথা হতে ভেসে আসে

          ফুলের সুবাস--

প্রাণ যেন কেঁদে ওঠে, অশ্রুজলে ভাসে আঁখি,

          উঠে রে নিশ্বাস।

চারি দিক ভুলে যাই, প্রাণে যেন জেগে ওঠে

          স্বপন-আবেশ--

কোথা রে ফুটেছে ফুল, আঁধারের কোন্‌ তীরে

          কোথা কোন্‌ দেশ!

 

রুদ্ধপ্রাণ ক্ষুদ্র প্রাণী, রুদ্ধ প্রাণীদের সাথে

          কত রে রহিব--

ছোটো ছোটো সুখ দুখ, ছোটো ছোটো আশাগুলি

          পুষিয়া রাখিব!

 

নিদ্রাহীন আঁখি মেলি পুরব-আকাশ-পানে

          রয়েছি চাহিয়া--

কবে রে প্রভাত হবে, আনন্দে বিহঙ্গগুলি

          উঠিবে গাহিয়া।

 

ওই যে পুরবে হেরি অরুণ-কিরণে সাজে

          মেঘ-মরীচিকা।

না রে না, কিছুই নয়--পূরব-শ্মশানে উঠে

          চিতানলশিখা।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •