১১। ১২ জ্যৈষ্ঠ  ১৮৯০  শান্তিনিকেতন  


 

অহল্যার প্রতি (oholyar proti)


কী স্বপ্নে কাটালে তুমি দীর্ঘ দিবানিশি,

অহল্যা, পাষাণরূপে ধরাতলে মিশি,

নির্বাপিত-হোম-অগ্নি তাপসবিহীন

শূন্য তপোবনচ্ছায়ে? আছিলে বিলীন

বৃহৎ পৃথ্বী সাথে হয়ে এক-দেহ,

তখন কি জেনেছিলে তার মহাস্নেহ?

ছিল কি পাষাণতলে অস্পষ্ট চেতনা?

জীবধাত্রী জননীর বিপুল বেদনা,

মাতৃধৈর্যে মৌন মূক সুখদুঃখ যত

অনুভব করেছিলে স্বপনের মতো

সুপ্ত আত্মা-মাঝে? দিবারাত্রি অহরহ

লক্ষ কোটি পরানীর মিলন, কলহ,

আনন্দবিষাদক্ষুব্ধ ক্রন্দন গর্জন,

অযুত পান্থের পদধ্বনি অনুক্ষণ--

পশিত কি অভিশাপ-নিদ্রা ভেদ করে

কর্ণে তোর? জাগাইয়া রাখিত কি তোরে

নেত্রহীন মূঢ় রূঢ় অর্ধজাগরণে?

বুঝিতে কি পেরেছিলে আপনার মনে

নিত্যনিদ্রাহীন ব্যথা মহাজননীর?

যে দিন বহিত নব বসন্তসমীর,

ধরণীর সর্বাঙ্গের পুলকপ্রবাহ

স্পর্শ কি করিত তোরে? জীবন-উৎসাহ

ছুটিত সহস্র পথে মরুদিগ্বিজয়ে

সহস্র আকারে, উঠিত সে ক্ষুব্ধ হয়ে

তোমার পাষাণ ঘেরি করিতে নিপাত

অনুর্বর-অভিশাপ তব, সে আঘাত

জাগাত কি জীবনের কম্প তব দেহে?

যামিনী আসিত যবে মানবের গেহে

ধরণী লইত টানি শ্রান্ত তনুগুলি

আপনার বক্ষ-'পরে; দুঃখশ্রম ভুলি

ঘুমাত অসংখ্য জীব-- জাগিত আকাশ--

তাদের শিথিল অঙ্গ, সুষুপ্ত নিশ্বাস

বিভোর করিয়া দিত ধরণীর বুক--

মাতৃ-অঙ্গে সেই কোটি জীবস্পর্শসুখ--

কিছু তার পেয়েছিলে আপনার মাঝে?

যে গোপন অন্তঃপুরে জননী বিরাজে,

বিচিত্রিত যবনিকা পত্রপুষ্পজালে

বিবিধ বর্ণের লেখা, তারি অন্তরালে

রহিয়া অসূর্যম্পশ্য নিত্য চুপে চুপে

ভরিছে সন্তানগৃহ ধনধান্যরূপে

জীবনে যৌবনে, সেই গূঢ় মাতৃকক্ষে

সুপ্ত ছিলে এতকাল ধরণীর বক্ষে

চিররাত্রিসুশীতল বিস্মৃতি-আলয়ে;

যেথায় অনন্তকাল ঘুমায় নির্ভয়ে

লক্ষ জীবনের ক্লান্তি ধূলির শয্যায়;

নিমেষে নিমেষে যেথা ঝরে পড়ে যায়

দিবসের তাপে শুষ্ক ফুল, দগ্ধ তারা,

জীর্ণ কীর্তি, শ্রান্ত সুখ, দুঃখ দাহহারা।

সেথা স্নিগ্ধ হস্ত দিয়ে পাপতাপরেখা

মুছিয়া দিয়াছে মাতা; দিলে আজি দেখা

ধরিত্রীর সদ্যোজাত কুমারীর মতো

সুন্দর, সরল, শুভ্র; হয়ে বাক্যহত

চেয়ে আছ প্রভাতের জগতের পানে।

যে শিশির পড়েছিল তোমার পাষাণে

রাত্রিবেলা, এখন সে কাঁপিছে উল্লাসে

আজানুচুম্বিত মুক্ত কৃষ্ণ কেশপাশে

যে শৈবাল রেখেছিল ঢাকিয়া তোমায়

ধরণীর শ্যামশোভা অঞ্চলের প্রায়

বহু বর্ষ হতে, পেয়ে বহু বর্ষাধারা

সতেজ সরস ঘন, এখনো তাহারা

লগ্ন হয়ে আছে তব নগ্ন গৌর দেহে

মাতৃদত্ত বস্ত্রখানি সুকোমল স্নেহে।

হাসে পরিচিত হাসি নিখিল সংসার।

তুমি চেয়ে নির্নিমেষ; হৃদয় তোমার

কোন্‌ দূর কালক্ষেত্রে চলে গেছে একা

আপনার ধূলিলিপ্ত পদচিহ্নরেখা

পদে পদে চিনে চিনে। দেখিতে দেখিতে

চারি দিক হতে সব এল চারি ভিতে

জগতের পূর্ব পরিচয়; কৌতূহলে

সমস্ত সংসার ওই এল দলে দলে

সম্মূখে তোমার; থেমে গেল কাছে এসে

চমকিয়া। বিস্ময়ে রহিল অনিমেষে।

অপূর্ব রহস্যময়ী মূর্তি বিবসন,

নবীন শৈশবে স্নাত সম্পূর্ণ যৌবন--

পূর্ণস্ফুট পুষ্প যথা শ্যামপত্রপুটে

শৈশবে যৌবনে মিশে উঠিয়াছে ফুটে

এক বৃন্তে। বিস্মৃতিসাগরনীলনীরে

প্রথম উষার মতো উঠিয়াছ ধীরে।

তুমি বিশ্ব-পানে চেয়ে মানিছ বিস্ময়,

বিশ্ব তোমা-পানে চেয়ে কথা নাহি কয়;

দোঁহে মুখোমুখি। অপাররহস্যতীরে

চিরপরিচয়-মাঝে নব পরিচয়।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •