চন্দননগর, আষাঢ়, ১৩৪২


 

নাট্যশেষ (natyoshesh)


দূর অতীতের পানে পশ্চাতে ফিরিয়া চাহিলাম;

হেরিতেছি যাত্রী দলে দলে। জানি সবাকার নাম,

চিনি সকলেরে। আজ বুঝিয়াছি, পশ্চিম-আলোতে

ছায়া ওরা। নটরূপে এসেছে নেপথ্যলোক হতে

দেহ-ছদ্মসাজে; সংসারের ছায়ানাট্য অন্তহীন,

সেথায় আপন পাঠ আবৃত্তি করিয়া রাত্রিদিন

কাটাইল; সূত্রধার অদৃষ্টের আভাসে আদেশে

চালাইল নিজ নিজ পালা, কভু কেঁদে, কভু হেসে

নানা ভঙ্গি নানা ভাবে। শেষে অভিনয় হলে সারা,

দেহবেশ ফেলে দিয়ে নেপথ্যে অদৃশ্যে হল হারা।

যে খেলা খেলিতে এল হয়তো কোথাও তার আছে

নাট্যগত অর্থ কোনোরূপ, বিশ্বমহাকবি-কাছে

প্রকাশিত। নটনটী রঙ্গসাজে ছিল যতক্ষণ

সত্য বলে জেনেছিল প্রত্যহের হাসি ও ক্রন্দন,

উত্থানপতন বেদনায়। অবশেষে যবনিকা

নেমে এল; নিবে গেল একে একে প্রদীপের শিখা;

ম্লান হল অঙ্গরাগ; বিচিত্র চাঞ্চল্য গেল থেমে;

যে নিস্তব্ধ অন্ধকারে রঙ্গমঞ্চ হতে গেল নেমে

          স্তুতি নিন্দা সেথায় সমান, ভেদহীন মন্দ ভালো,

          দুঃখসুখভঙ্গি অর্থহীন, তুল্য অন্ধকার আলো,

লুপ্ত লজ্জাভয়ের ব্যঞ্জনা। যুদ্ধ উত্তারিয়া সীতা

পরক্ষণে প্রিয়হস্ত রচিতে বসিল তার চিতা;

সে পালায় অবসানে নিঃশেষে হয়েছে নিরর্থক

সে দুঃসহ দুঃখদাহ--শুধু তারে কবির নাটক

কাব্যডোরে বাঁধিয়াছে, শুধু তারে ঘোষিতের গান,

শিল্পের কলায় শুধু রচে তাহা আনন্দের দান।

জনশূন্য ভাঙাঘাটে আজি বৃদ্ধ বটচ্ছায়াতলে

গোধূলির শেষ আলো আষাঢ়ে ধূসর নদীজলে

মগ্ন হল। ওপারের লোকালয় মরীচিকাসম

চক্ষে ভাসে। একা বসে দেখিতেছি মনে মনে, মম

দূর আপনার ছবি নাট্যের প্রথম অঙ্কভাগে

কালের লীলায়। সেদিনের সদ্য-জাগা চক্ষে জাগে

অস্পষ্ট কী প্রত্যাশার অরুণিম প্রথম উন্মেষ;

সম্মুখে সে চলেছিল, না জানিয়া শেষের উদ্দেশ,

নেপথ্যের প্রেরণায়। জানা না-জানার মধ্যসেতু

নিত্য পার হতেছিল কিছু তার না বুঝিয়া হেতু।

অকস্মাৎ পথমাঝে কে তারে ভেটিল একদিন,

দুই অজানার মাঝে দেশকাল হইল বিলীন

সীমাহীন নিমেষেই; পরিব্যাপ্ত হল জানাশোনা

জীবনের দিগন্ত পারায়ে। ছায়ায়-আলোয়-বোনা

আতপ্ত ফাল্গুনদিনে মর্মরিত চাঞ্চল্যের স্রোতে

কুঞ্জপথে মেলিল সে স্ফুরিত অঞ্চলতল হতে

কনকচাঁপার আভা। গন্ধে শিহরিয়া গেল হাওয়া

শিথিল কেশের স্পর্শে। দুজনে করিল আসাযাওয়া

অজানা অধীরতায়।

                             সহসা সে রাত্রে সে গেল চলি

যে রাত্রি হয় না কভু ভোর। অদৃষ্টের যে অঞ্জলি

এনেছিল সুধা, নিল ফিরে। সেই যুগ হল গত

চৈত্রশেষে অরণ্যের মাধবীর সুগন্ধের মতো।

তখন সেদিন ছিল সবচেয়ে সত্য এ ভুবনে,

সমস্ত বিশ্বের যন্ত্র বাঁধিত সে আপন বেদনে

আনন্দ ও বিষাদের সুরে। সেই সুখ দুঃখ তার

জোনাকির খেলা মাত্র, যারা সীমাহীন অন্ধকার

পূর্ণ করে চুম্‌কির কাজে বিঁধে আলোকের সূচি;

সে রাত্রি অক্ষত থাকে, বিনা চিহ্নে আলো যায় ঘুচি।

সে ভাঙা যুগের 'পরে কবিতার অরণ্যলতায়

ফুটিছে ছন্দের ফুল, দোলে তার গানের কথায়।

সেদিন আজিকে ছবি হৃদয়ের অজন্তাগুহাতে

অন্ধকার ভিত্তিপটে; ঐক্য তার বিশ্বশিল্প-সাথে।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •