শান্তিনিকেতন, ৩১ জুলাই - ২ অগস্ট, ১৯৩৫


 

অতীতের ছায়া (otiter chhaya)


মহা-অতীতের সাথে আজ আমি করেছি মিতালি--

     দিবালোক-অবসানে তারালোক জ্বালি

          ধ্যানে সেথা বসেছে সে

               রূপহীন দেশে;

     যেথা অস্তসূর্য হতে নিয়ে রক্তরাগ

          গুহাচিত্রে করিছে সজাগ

               তার তুলি

     ম্রিয়মাণ জীবনের লুপ্ত রেখাগুলি;

     নিমীলিত বসন্তের ক্ষান্তগন্ধে যেখানে সে

গাঁথিয়া অদৃশ্যমালা পরিছে নিবিড় কালোকেশে;

          যেখানে তাহার কণ্ঠহারে

               দুলায়েছে সারে সারে

     প্রাচীন শতাব্দীগুলি শন্ত-চিত্তদহন বেদনা

               মাণিক্যের কণা।

        সেথা বসে আছি কাজ ভুলে

          অস্তাচলমূলে

               ছায়াবীথিকায়।

        রূপময় বিশ্বধারা অবলুপ্তপ্রায়

          গোধূলিধূসর আবরণে,

অতীতের শূন্য তার সৃষ্টি মেলিতেছে মোর মনে।

       এ শূন্য তো মরুমাত্র নয়,

               এ যে চিত্তময়;

          বর্তমান যেতে যেতে এই শূন্যে যায় ভ'রে রেখে

                   আপন অন্তর থেকে

                       অসংখ্য স্বপন;

               অতীত এ শূন্য দিয়ে করেছি বপন

                   বস্তুহীন সৃষ্টি যত,

নিত্যকাল-মাঝে তারি ফলশস্য ফলিছে নিয়ত।

আলোড়িত এই শূন্য যুগে যুগে উঠিয়াছে জ্বলি,

          ভরিয়াছে জ্যোতির অঞ্জলি।

     বসে আছি নির্নিমেষ চোখে

          অতীতের সেই ধ্যানালোকে--

নি:শব্দ তিমিরতটে জীবনের বিস্মৃত রাতির।

হে অতীত,

       শান্ত তুমি নির্বাণ-বাতির

          অন্ধকারে,

     সুখদুখনিষ্কৃতির পারে।

   শিল্পী তুমি, আঁধারের ভূমিকায়

নিভৃতে রচিছ সৃষ্টি নিরাসক্ত নির্মম কলায়,

স্মরণে ও বিস্মরণে বিগলিত বর্ণ দিয়া লিখা

          বর্ণিতেছ আখ্যায়িকা;

পুরাতন ছায়াপথে নূতন তারার মতো

          উজ্জ্বলি উঠিছে কত,

     কত তার নিভাইছ একেবারে

          যুগান্তের অশান্ত ফুৎকারে।

     আজ আমি তোমার দোসর,

আশ্রয় নিতেছি সেথা যেথা আছে মহা-অগোচর।

   তব অধিকার আজি দিনে দিনে ব্যাপ্ত হয়ে আসে

          আমার আয়ুর ইতিহাসে।

     সেথা তব সৃষ্টির মন্দিরদ্বারে

আমার রচনাশালা স্থাপন করেছি একধারে

          তোমারি বিহারবনে ছায়াবীথিকায়।

                   ঘুচিল কর্মের দায়,

ক্লান্ত হল লোকমুখে খ্যাতির আগ্রহ;

     দুঃখ যত সয়েছি দুঃসহ

           তাপ তার করি অপগত

               মূর্তি তারে দিব নানামতো

                   আপনার মনে মনে।

কলকোলাহলশান্ত জনশূন্য তোমার প্রাঙ্গণে,

     যেখানে মিটেছে দ্বন্দ্ব মন্দ ও ভালোয়,

                   তারার আলোয়

সেখানে তোমার পাশে আমার আসন পাতা--

     কর্মহীন আমি সেথা বন্ধহীন সৃষ্টির বিধাতা।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •