শান্তিনিকেতন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬


 

এগারো (phalguner rongin abesh)


ফাল্গুনের রঙিন আবেশ

            যেমন দিনে দিনে মিলিয়ে দেয় বনভূমি

                   নীরস বৈশাখের রিক্ততায়,

তেমনি করেই সরিয়ে ফেলেছ হে প্রমদা, তোমার মদির মায়া    

                  অনাদরে অবহেলায় ।

একদিন আপন হাতে আমার চোখে বিছিয়েছিলে বিহ্বলতা,

                   রক্তে দিয়েছিলে দোল,

                          চিত্তে ভরেছিলে নেশায়,হে আমার সাকী,

পাত্র উজাড় ক'রে

   জাদুরসধারা আজ ঢেলে দিয়েছ ধুলায় ।

আজ উপেক্ষা করেছ আমার স্তুতিকে,

   আমার দুই চক্ষুর বিস্ময়কে ডাক দিতে ভুলে গেলে;

            আজ তোমার সাজের মধ্যে  কোনো আকুতি নেই;

               নেই সেই নীরব সুরের ঝংকার

                  যা আমার নামকে দিয়েছিল রাগিণী ।

 

শুনেছি একদিন চাঁদের দেহ ঘিরে

              ছিল হাওয়ার আবর্ত ।

    তখন ছিল তার রঙের শিল্প,

              ছিল সুরের মন্ত্র,

                     ছিল সে নিত্য নবীন ।

        দিনে দিনে উদাসী কেন ঘুচিয়ে দিল

                     আপন লীলার প্রবাহ ।

কেন ক্লান্ত হল সে আপনার মাধুর্যকে নিয়ে ।

    আজ শুধু তার মধ্যে আছে

          আলোছায়ার মৈত্রীবিহীন দ্বন্দ্ব --

                    ফোটে না ফুল,

                       বহে না কলমুখরা নির্ঝরিণী ।

 

সেই বাণীহারা চাঁদ তুমি আজ আমার কাছে ।

        দুঃখ এই যে,এতে দুঃখ নেই তোমার মনে ।

একদিন নিজেকে নূতন নূতন ক'রে সৃষ্টি করেছিলে মায়াবিনী,

   আমারই ভালোলাগার রঙে রঙিয়ে ।

আজ তারই উপর তুমি টেনে দিলে

         যুগান্তের কালো যবনিকা

                         বর্ণহীন,ভাষাহীন ।

ভুলে গেছ যতই দিতে এসেছিলে আপনাকে

       ততই পেয়েছিলে আপনাকে বিচিত্র করে ।

  আজ আমাকে বঞ্চিত করে

  বঞ্চিত হয়েছ আপন সার্থকতায় ।

তোমার মাধুর্যযুগের ভগ্নশেষ

                   রইল আমার মনের স্তরে স্তরে --

সেদিনকার তোরণের স্তুপ,

                   প্রাসাদের ভিত্তি,

গুল্মে-ঢাকা বাগানের পথ ।

 

আমি বাস করি

  তোমার ভাঙা ঐশ্বর্যের ছড়ানো টুকরোর মধ্যে ।

                   আমি খুঁজে বেড়াই মাটির তলার অন্ধকার,

                       কুড়িয়ে রাখি যা ঠেকে হাতে ।

আর তুমি আছ

আপন কৃপণতার পাণ্ডুর মরুদেশে,

পিপাসিতের জন্যে জল নেই সেখানে,

  পিপাসাকে ছলনা করতে পারে

                নেই এমন মরীচিকারও সম্বল ।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •