শান্তিনিকেতন, ২০ জুন, ১৯৩৬


 

মিলভাঙা (milbhanga)


এসেছিলে কাঁচা জীবনের

        পেলব রূপটি নিয়ে --

     এনেছিলে আমার হৃদয়ের প্রথম বিস্ময়,

            রক্তে প্রথম কোটালের বান।

      আধোচেনার ভালোবাসার মাধুরী

            ছিল যেন ভোরবেলাকার

      কালো ঘোমটার সূক্ষ্ম সোনার কাজ--

            গোপন শুভদৃষ্টির আবরণ।

      মনের মধ্যে তখনো

     অসংশয় হয় নি পাখির কাকলি;

      বনের মর্মর একবার জাগে

           একবার যায় মিলিয়ে।

      বহুলোকের সংসারের মাঝখানে

            চুপিচুপি তৈরি হতে লাগল

                      আমাদের দুজনের নিভৃত জগৎ।

            পাখি যেমন প্রতিদিন

                 খড়কুটো কুড়িয়ে এনে বাসা বাঁধে

                      তেমনি সেই জগতের উপকরণ সামান্য,

                         চল্‌তি মুহূর্তের খসে-পড়া

                                উড়ে-আসা সঞ্চয় দিয়ে গাঁথা

                          তার মূল্য ছিল তার রচনায়,

                                    নয় তার বস্তুতে।

      শেষে একদিন দুজনের নৌকো-বাওয়া থেকে

                       কখন একলা গেছ নেমে;

                    আমি ভেসে চলেছি স্রোতে,

                তুমি বসে রইলে ও পারের ডাঙায়।

মিলল না আর আমার হাতে তোমার হাতে

                   কাজে কিম্বা খেলায়।

      জোড় ভেঙে ভাঙল আমাদের জীবনের গাঁথনি।

          যে দ্বীপের শ্যামল ছবিখানি সদ্য আঁকা পড়েছে

                সমুদ্রের লীলাচঞ্চল তরঙ্গপটে

                       তাকে যেমন দেয় মুছে

                     এক জোয়ারের তুমুল তুফানে,

          তেমনি মিলিয়ে গেল আমাদের কাঁচা জগৎ

                     সুখদুঃখের নতুন-অঙ্কুর-মেলা

                                শ্যামল রূপ নিয়ে।

      তার পরে অনেক দিন গেছে কেটে।

           আষাঢ়ের আসন্নবর্ষণ সন্ধ্যায়

                 যখন তোমাকে দেখি মনে মনে,

                       দেখতে পাই তুমি আছ

            সেইদিনকার কচি যৌবনের মায়া দিয়ে ঘেরা।

                     তোমার বয়স গেছে থেমে।

            তোমার সেই বসন্তের আমের বোলে

                       আজও তেমনি গন্ধেরই ঘোষণা;

                তোমার সেদিনকার মধ্যাহ্ন

      আজ মধ্যাহ্নেও ঘুঘুর ডাকে তেমনি বিরহাতুর।

                  আমার কাছে তোমার স্মরণ রয়ে গেছে

           প্রকৃতির বয়সহারা এই-সব পরিচয়ের দলে।

                       সুন্দর তুমি বাঁধা রেখায়,

                       প্রতিষ্ঠিত তুমি অচল ভূমিতে।

আমার জীবনধারা

    কোথাও রইল না থেমে।

      দুর্গমের মধ্যে, গভীরের মধ্যে,

            মন্দভালোর দ্বন্দ্ববিরোধে,

                 চিন্তায় সাধনায় আকাঙক্ষায়,

কখনো সফলতায়, কখনো প্রমাদে,

                 চলে এসেছি তোমার জানা সীমার

                       বহুদূর বাইরে;

            সেখানে আমি তোমার কাছে বিদেশী।

        সেই তুমি আজ এই মেঘ-ডাকা সন্ধ্যায়

                যদি এসে বস আমার সামনে

                       দেখতে পাবে আমার চোখে

                             দিক-হারানো চাহনি

                       অজানা আকাশের সমু্‌দ্রপারে

                              নীল অরণ্যের পথে।

তুমি কি পাশে বসে শোনাবে

      সেদিনকার কানে-কানে কথার উদ্‌বৃত্ত।

            কিন্তু ঢেউ করছে গর্জন,

                 শকুন করছে চীৎকার,

                       মেঘ ডাকছে আকাশে,

                          মাথা নাড়ছে নিবিড় শালের বন।

                       তোমার বাণী হবে খেলার ভেলা

                          খেপাজলের ঘূর্ণিপাকে।

      সেদিন আমার সব মন

            মিলেছিল তোমার সব মনে,

      তাই প্রকাশ পেয়েছে নূতন গান

            প্রথম সৃষ্টির আনন্দে।

                      মনে হয়েছে,

           বহু যুগের আশ মিটল তোমাতে আমাতে।

            সেদিন প্রতিদিনই বয়ে এনেছে

                   নূতন আলোর আগমনী

      আদিকালে সদ্য-চোখ-মেলা তারার মতো।

আজ আমার যন্ত্রে

             তার চড়েছে বহুশত,

                 কোনোটা নয় তোমার জানা।

            যে সুর সেধে রেখেছ সেদিন

                 সে সুর লজ্জা পাবে এর তারে।

            সেদিন যা ছিল ভাবের লেখা

                 আজ হবে তা দাগা-বুলোনো।

            তবু জল আসে চোখে।

      এই সেতারে নেমেছিল তোমার আঙুলের

                          প্রথম দরদ;

                 এর মধ্যে আছে তার জাদু।

      এই তরীটিকে প্রথম দিয়েছিলে ঠেলে

      কিশোর-বয়সের শ্যামল পারের থেকে;

               এর মধ্যে আছে তার বেগ।

      আজ মাঝনদীতে সারিগান গাইবে যখন

               তোমার নাম পড়বে বাঁধা

                       তার হঠাৎ তানে।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •