শান্তিনিকেতন, ৩০ মে, ১৯৩৬


 

সম্ভাষণ (sombhashon)


রোজই ডাকি তোমার নাম ধরে,

                     বলি "চারু'।

            হঠাৎ ইচ্ছা হল আর-কিছু বলি,

                        যাকে বলে সম্ভাষণ,

            যেমন বলত সত্যযুগের ভালোবাসায়।

              সব চেয়ে সহজ ডাক-- প্রিয়তমে।

            সেটা আবৃত্তি করেছি মনে মনে,

                        তার উত্তরে মনে-মনেই শুনেছি তোমার উচ্চহাসি।

                বুঝেছি, মন্দমধুর হাসি এ যুগের নয়;

                     এ যে নয় অবন্তী, নয় উজ্জয়িনী।

আটপহুরে নামটাতে দোষ কী হল

            এই তোমার প্রশ্ন।

                 বলি তবে।

                     কাজ ছিল না বেশি,

                 সকাল সকাল ফিরেছি বাসায়।

         হাতে বিকেলের খবরের কাগজ,

                 বসেছি বারান্দায়, রেলিঙে পা দুটো তোলা।

                     হঠাৎ চোখে পড়ল পাশের ঘরে

         তোমার বৈকালিকী সাজের ধারা।

                      বাঁধছিলে চুল আয়নার সামনে

            বেণী পাকিয়ে পাকিয়ে, কাঁটা বিঁধে বিঁধে।

         এমন মন দিয়ে দেখি নি তোমাকে অনেক দিন;

              দেখি নি এমন বাঁকা করে মাথা-হেলানো

                     চুল-বাঁধার কারিগরিতে,

                 এমন দুই হাতের মিতালি

                     চুড়িবালার ঠুনঠুনির তালে।

                 শেষে ওই ধানিরঙের আঁচলখানিতে

                      কোথাও কিছু ঢিল দিলে,

                        আঁট করলে কোথাও বা,

                 কোথাও একটু টেনে দিলে নীচের দিকে,

                   কবিরা যেমন ছন্দ বদল করে

                        একটু আধটু বাঁকিয়ে চুরিয়ে।

              আজ প্রথম আমার মনে হল

                   অল্প মজুরির দিন-চালানো

                        একটা মানুষের জন্যে

                   নিজেকে তো সাজিয়ে তুলছে

                        আমাদের ঘরের পুরোনো বউ

            দিনে দিনে নতুন-দাম দেওয়া রূপে।

এ তো নয় আমার আটপহুরে চারু।

                        ঠিক এমনি করেই দেখা দিত অন্যযুগের অবন্তিকা

            ভালোলাগার অপরূপবেশে

                   ভালোবাসার চকিত চোখে।

                        অমরুশতকের চৌপদীতে

            --শিখরিণীতে হোক, স্রগ্ধরায় হোক--

                 ওকে তো ঠিক মানাতো।

            সাজের ঘর থেকে বসবার ঘরে

              ওই যে আসছে অভিসারিকা,

            ও যেন কাছের কালে আসছে

                   দূরের কালের বাণী।

                        বাগানে গেলেম নেমে।

                   ঠিক করেছি আমিও আমার সোহাগকে দেব মর্যাদা

         শিল্পে-সাজিয়ে-তোলা মানপত্রে।

            যখন ডাকব তোমাকে ঘরে

                     সে হবে যেন আবাহনী।

                          সামনেই লতা ভরেছে সাদা ফুলে--

                          বিলিতি নাম, মনে থাকে না--

                               নাম দিয়েছি তারাঝরা;

                             রাতের বেলায় গন্ধ তার

                               ফুলবাগানের প্রলাপের মতো।

                   এবার সে ফুটেছে অকালে,

                               সবুর সয় নি শীত ফুরোবার।

                          এনেছি তার একটি গুচ্ছ,

                   তারও একটি সই থাকবে আমার নিবেদনে।

            আজ গোধূলিলগ্নে তুমি ক্লাসিক যুগের চারুপ্রভা,

                 আমি ক্লাসিকযুগের অজিতকুমার।

                     দুটি কথা আজ বলব আমি,

সাজানো কথা--

                          হাসতে হয় হেসো।

                        সে কথা মনে মনে গড়ে তুলেছি

            যেমন করে তুমি জড়িয়ে তুলেছ তোমার খোঁপা।

                      বলব, "প্রিয়ে, এই পরদেশী ফুলের মঞ্জরী

         আকাশে চেয়ে খুঁজছিল বসন্তের রাত্রি,

              এনেছি আমি তাকে দয়া করে

                   তোমার ওই কালো চুলে।"

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •