১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০  উদয়ন [শান্তিনিকেতন]


 

৬ (khedubabur edo pukur)


খেঁদুবাবুর এঁধো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে;

পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে।

আপনি এল ব্যাক্‌টিরিয়া, তাকে ডাকা হয় নাই।

হাঁসপাতালের মাখন ঘোষাল বলেছিল, ভয় নাই।

সে বলে, সব বাজে কথা, খাবার জিনিস খাদ্য--

দশ দিনেতেই ঘটিয়ে দিল দশজনারই শ্রাদ্ধ।

শ্রাদ্ধের যে ভোজন হবে কাঁচা তেঁতুল দরকার,

বেগুনমুলোর সন্ধানেতে ছুটল ন্যাড়া সরকার।

বেগুনমুলো পাওয়া যাবে নিলফামারির বাজারে,

নগদ দামে বিক্রি করে তিন টাকা দাম হাজারে।

দুমকাতে লোক পাঠিয়েছিল, বানিয়ে দেবে মুড়কি--

সন্দেহ হয় ওজনমতো মিশল তাতে গুড় কি।

সর্ষে যে চাই মণ দু'তিনেক ঝোলে ঝালে বাটনায়,

কালুবাবু তারই খোঁজে গেলেন ধেয়ে পাটনায়।

বিষম খিদেয় করল চুরি রামছাগলের দুধ,

তারই সঙ্গে মিশিয়ে নিলে গমভাঙানির খুদ।

       ঐ শোনা যায় রেডিয়োতে বোঁচা গোঁফের হুমকি;

       দেশবিদেশে শহরগ্রামে গলা-কাটার ধুম কী।

       খাঁচায় পোষা চন্দনাটা ফড়িঙে পেট ভরে;

       সকাল থেকে নাম করে গান, হরে কৃষ্ণ হরে।

 

বালুর চরে আলুহাটা-- হাতে বেতের চুপড়ি,

খেতের মধ্যে ঢুকে কালু মুলো নিল উপ্‌ড়ি।

নদীর পাড়ে কিচিরমিচির লাগালো গাঙশালিখ যে,

অকারণে ঢোলক বাজায় মুলোখেতের মালিক যে।

কাঁকুড়খেতে মাচা বাঁধে পিলেওয়ালা ছোকরা,

বাঁশের বনে কঞ্চি কাটে মুচিপাড়ার লোকরা।

পাটনাতে নীলকুঠির গঞ্জে খেয়া চালায় পাট্‌নি,

রোদে জল নিতুই চলে চার পহরের খাট্‌নি।

কড়াপড়া কঠিন হাতে মাজা কাঁসার কাঁকনটা,

কপালে তার পত্রলেখা উল্কিদেওয়া আঁকনটা।

কুচোমাছের টুকরি থেকে চিলেতে নেয় ছোঁ মেরে,

মেছনি তার সাত গুষ্টি উদ্দেশে দেয় যমেরে।

ও পারেতে খড়গপুরে কাঠি পড়ে বাজনায়,

মুন্সিবাবু হিসেব ভোলে জমিদারের খাজনায়।

       রেডিয়োতে খবর জানায়, বোমায় করলে ফুটো,

       সমুদ্দুরে তলিয়ে গেল মালের জাহাজ দুটো।

       খাঁচার মধ্যে ময়না থাকে, বিষম কলরবে

       ছাতু ছড়ায়, মাতায় পাড়া আত্মারামের স্তবে।

 

হুইস্‌ল্‌ দিল প্যাসেঞ্জারে সাঁৎরাগাছির ড্রাইভার--

মাথায় মোছে হাতের কালি, সময় না পায় নাইবার।

ননদ গেল ঘুঘুডাঙায়, সঙ্গে গেল চিন্তে--

লিলুয়াতে নেমে গেল ঘুড়ির লাঠাই কিনতে।

লিলুয়াতে খইয়ের মোওয়া চার ধামা হয় বোঝাই,

দান দিতে হায় টাকার থলি মিথ্যে হল খোঁজাই।

ননদ পরল রাঙা চেলি, পাল্কি চড়ে চলল--

পাড়ায় পাড়ায় রব উঠেছে গায়ে-হলুদ কল্য।

কাহারগুলো পাগড়ি বাঁধে, বাঁদি পরে ঘাগরা,

জমাদারের মামা পরে শুঁড়তোলা তার নাগরা।

পাঁড়েজি তাঁর খড়ম নিয়ে চলেন খটাৎ খটাৎ|,

কোথা থেকে ধোবার গাধা চেঁচিয়ে ওঠে হঠাৎ।

খয়রাডাঙার ময়রা আসে, কিনে আনে ময়দা--

পচা ঘিয়ের গন্ধ ছড়ায়, যমালয়ের পয়দা।

       আকাশ থেকে নামল বোমা, রেডিয়ো তাই জানায়,

       অপঘাতে বসুন্ধরা ভরল কানায় কানায়

       খাঁচার মধ্যে শ্যামা থাকে, ছিরকুটে খায় পোকা,

       শিস দেয় সে মধুর স্বরে, হাততালি দেয় খোকা।

 

হুইস্‌ল্‌ বাজে ইস্টিসনে, বরের জ্যাঠামশাই

চমকে ওঠে--গেলেন কোথায় অগ্রদ্বীপের গোঁসাই।

সাঁৎরাগাছির নাচনমণি কাটতে গেল সাঁতার,

হায় রে কোথায় ভাসিয়ে দিল সোনার সিঁথি মাথার।

মোষের শিঙে ব'সে ফিঙে লেজ দুলিয়ে নাচে--

শুধোয় নাচন, সিঁথি আমার নিয়েছে কোন্‌ মাছে।

মাছের লেজের ঝাপটা লাগে, শালুক ওঠে দুলে;

রোদ পড়েছে নাচনমণির ভিজে চিকন চুলে।

কোথায় ঘাটের ফাটল থেকে ডাকল কোলাব্যাঙ,

খড়গ্‌পুরের ঢাকে ঢোলে বাজল ড্যাড্যাংড্যাঙ।

কাঁপছে ছায়া আঁকাবাঁকা, কলমিপাড়ের পুকুর--

জল খেতে যায় এক-পা-কাটা তিনপেয়ে এক কুকুর।

হুইস্‌ল্‌ বাজে, আছে সেজে পাইকপাড়ার পাত্রী,

শেয়ালকাঁটার বন পেরিয়ে চলে বিয়ের যাত্রী।

       গ্যাঁগোঁ করে রেডিয়োটা কে জানে কার জিত--

       মেশিন্‌গানে গুঁড়িয়ে দিল সভ্যবিধির ভিত।

       টিয়ের মুখের বুলি শুনে হাসছে ঘরে পরে--

       রাধে কৃষ্ণ, রাধে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে।

 

দিন চলে যায় গুন্‌গুনিয়ে ঘুমপাড়ানির ছড়া,

শানবাঁধনো ঘাটের ধারে নামছে কাঁখের ঘড়া।

আতাগাছের তোতাপাখি, ডালিমগাছে মৌ,

হীরেদাদার মড়মড়ে থান, ঠাকুরদাদার বউ।

পুকুরপাড়ে জলের ঢেউয়ে দুলছে ঝোপের কেয়া,

পাটনি চালায় ভাঙা ঘাটে তালের ডোঙার খেয়া।

খোকা গেছে মোষ চরাতে, খেতে গেছে ভুলে,

কোথায় গেল গমের রুটি শিকের 'পরে তুলে।

আমার ছড়া চলেছে আজ রূপকথাটা ঘেঁষে,

কলম আমার বেরিয়ে এল বহুরূপীর বেশে।

আমরা আছি হাজার বছর ঘুমের ঘোরের গাঁয়ে,

আমরা ভেসে বেড়াই স্রোতের শেওলা-ঘেরা নায়ে।

কচি কুমড়োর ঝোল রাঁধা হয়, জোরপুতুলের বিয়ে,

বাঁধা বুলি ফুকরে ওঠে কমলাপুলির টিয়ে।

ছাইয়ের গাদায় ঘুমিয়ে থাকে পাড়ার খেঁকি কুকুর,

পান্তিহাটে বেতোঘোড়া চলে টুকুর-টুকুর।

তালগাছেতে হুতোমথুমো পাকিয়ে আছে ভুরু,

ভক্তিমালা হড়মবিবির গলাতে সাতপুরু।

আধেক জাগায় আধেক ঘুমে ঘুলিয়ে আছে হাওয়া,

দিনের রাতের সীমানাটা পেঁচোয়-দানোয়-পাওয়া।

ভাগ্যলিখন ঝাপসা কালির, নয় সে পরিস্কার--

দুঃখসুখের ভাঙা বেড়ায় সমান যে দুই ধার।

কামারহাটার কাঁকুড়গাছির ইতিহাসের টুকরো,

ভেসে চলে ভাঁটার জলে উইয়ে-ঘুনে-ফুকরো।

অঘটন তো নিত্য ঘটে রাস্তাঘাটে চলতে,

লোকে বলে, সত্যি নাকি!--ঘুমোয় বলতে বলতে।

       সিন্ধুপারে চলছে হোথায় উলটপালট কাণ্ড,

       হাড় গুঁড়িয়ে বানিয়ে দিলে নতুন কী ব্রহ্মাণ্ড।

       সত্য সেথায় দারুণ সত্য, মিথ্যে ভীষণ মিথ্যে,

       ভালোয় মন্দে সুরাসুরের ধাক্কা লাগায় চিত্তে।

       পা ফেলতে না ফেলতে হতেছে ক্রোশ পার।

       দেখতে দেখতে কখন যে হয় এসপার-ওসপার।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •