কামাল আতাতুর্ক
Essays
এশিয়াতে একসময় এক যুগ এসেছিল, যাকে সত্যযুগ বলা যেতে পারে, তখন এখান থেকে সভ্যতার মূল উৎসগুলি উৎসারিত হয়েছিল, নানাদিকে নানাদেশে। প্রাচীন এশিয়ার যে আলোকের উৎস যে সভ্যতার দীপালী অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার নানা আলোক জ্বালিয়েছিল চীন, ভারত, আরব, পারস্য, তাদের ধর্মে, কর্মে আচরণে ও জ্ঞানে। সেই আলোক থেকে শিখা গ্রহণ করে সভ্যতার প্রকাশ হয় পাশ্চাত্যদেশে বিশেষ করে ধর্মের ব্যাপারে। একসময়ে এশিয়াতে যে-শিখা প্রজ্বলিত ছিল, তার নির্বাপণের দিন এল, ক্রমে ঘনীভূত হয়ে এল প্রদোষের অন্ধকার। তখন ভিতরের লজ্জা গোপন আর অন্তরের গৌরব রক্ষার জন্য আমরা বার বার নাম জপ করছিলুম ভীষ্ম, দ্রোণ, ভীমার্জুনের, আর তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলুম, বীর হামির, রানা প্রতাপ, এমন-কি বাংলা দেশের প্রতাপাদিত্য পর্যন্ত। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে বুঝতে পারি যে, অতীতের গৌরব ও বর্তমানের তুচ্ছতা নিয়ে আমাদের মনের ভিতর প্রবল বেদনা নিহিত ছিল। এই অতীতের দোহাই দেওয়া নিষ্ফলতা আঁকড়ে থাকতে গিয়ে আমরা পদে পদে অপমানিত হয়েছি। এই সভ্যতার মূলে যে স্বাতন্ত্র্য ছিল এবং যে সংস্কৃতি গ্রামে গ্রামে প্রচারিত ও পরিব্যাপ্ত হয়েছিল, সে সমস্তকে পশ্চিমের বন্যা এসে ডুবিয়ে একাকার করে দিয়েছে।
ক্রমে বিদেশী ইস্কুলমাস্টারের হাতে আমাদের শিক্ষা যতই পাকা হয়েছে ততই ধারণা হতে লাগল যে, অক্ষমতা আমাদের মজ্জাগত, অজ্ঞতা অন্তর্নিহিত, অন্ধসংস্কার ও মূঢ়তার বোঝা বয়ে পাশ্চাত্যের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে থাকবে চিরদিন। তখন আমরা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে নিলাম যে, বিদেশী শাসনকর্তাদের দ্বারা চালিত হওয়ার বাইরে আমাদের চলৎশক্তি নেই। এদের অনুগ্রহ গণ্ডূষের জন্যে যুগান্তকাল পর্যন্ত অঞ্জলি পেতে থাকাই আমাদের ভাগ্যে নির্দিষ্ট। আপন অধিকারে আপন শক্তিতে জিতে নিতে হবে এমন দুঃসাহসকে তখনকার কংগ্রেসী বীরেরাও মনে স্থান দেন নি। তাঁরা আবেদনের ঝুলি নিয়ে রাজকর্মচারীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলেন; মুষ্টিভিক্ষার সকরুণ আবদার নিয়ে বার বার দ্বাররক্ষীদের হাতে তাঁদের লাঞ্ছনাও ঘটল। তখন আমরা ভেবেছিলুম যে, স্বল্পতমে সন্তুষ্ট থাকাটাই যেন আমাদের সুদীর্ঘতমকালের একমাত্র গতি। ওরা কেড়ে নেবে আর আমরা বিনা নালিশেই দেব, আর সেই দানেরই সামান্য কিছু উচ্ছিষ্ট থেকে পেট ভরাবার প্রত্যাশার চেয়ে উপরে উঠতে মন সে দিন সাহস পায় নি। নতমস্তকে মেনে নিয়েছি, পাশ্চাত্য চড়ে আছে দুর্গম উচ্চে আর প্রাচ্য গড়াচ্ছে সর্বজনের পদদলিত ধূলিশয্যায়। থেকে থেকে শঙ্খ ঘণ্টা বাড়িয়ে শিবনেত্র হয়ে বলেছি আমরা আধ্যাত্মিক, আর যারা আমাদের কান মলে তারা বস্তুতান্ত্রিক। হই-না-কেন রোগে জীর্ণ, উপবাসে ক্ষীণ, অশিক্ষায় নিমগ্ন, ছোটো বড়ো সকল প্রকার দুর্গ্রহের কাছে নিঃসহায়, তবু ওদের মতো ম্লেচ্ছ নই। আমরা ফোঁটা কাটি, মালা জপি, স্নানের যোগ এলে চারদিক থেকে হাজার হাজার লোকের আঁধি লেগে যায় স্বর্গলাভের লোভে, আর ওদের যত লোভ আর যত লাভ সবই এই মর্ত্যলোকের সীমানায়-- ধিক্। পিঠে মার এসে পড়ে বাস্তবের দেশে আর চুন হলুদ লাগাতে যাই অবাস্তব লোকে।
আরো দেখুন