বিয়াত্রিচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য
Essays
ইতালিয়ার এই স্বপ্নময় কবির জীবন গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় হইতে শেষ পর্যন্ত বিয়াত্রিচে (Beatrice)। বিয়াত্রিচেই তাঁহার সমুদয় কাব্যের নায়িকা, বিয়াত্রিচেই তাঁহার জীবন-কাব্যের নায়িকা! বিয়াত্রিচেকে বাদ দিয়া তাঁহার কাব্য পাঠ করা বৃথা, বিয়াত্রিচেকে বাদ দিলে তাঁহার জীবন-কাহিনী শূন্য হইয়া পড়ে। তাঁহার জীবনের দেবতা বিয়াত্রিচে, তাঁহার সমুদয় কাব্য বিয়াত্রিচের স্তোত্র। বিয়াত্রিচের প্রতি প্রেমই তাঁহার প্রথম কবিতার উৎস উৎসারিত করিয়া দেয়। তাঁহার প্রথম গীতিকাব্য "ভিটা নুওভা'র (Vita Nuova) প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত বিয়াত্রিচেরই আরাধনা, ইহার কিয়দ্দূর লিখিয়াই তাঁহার বিরক্তি বোধ হইল-- তাঁহার মনঃপূত হইল না; পাঠকের চক্ষে বিয়াত্রিচেকে দূর-স্বর্গের অলৌকিক দেবতার ন্যায় চিত্রিত করিয়াও তিনি পরিতৃপ্ত হইলেন না। এই কাব্যের শেষ ভাগে তিনি লিখিতেছেন--
"এই পর্যন্ত লিখিয়াই আমি এক অতিশয় আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিলাম-- সেই স্বপ্নে যাহা দেখিলাম তাহাতে এই স্থির করিলাম যে, আমি সেই প্রিয় দেবীর বিষয় যাহা লিখিতেছি তাহা তাঁহার যোগ্য নহে-- যে পর্যন্ত ইহা অপেক্ষা যোগ্যতর কবিতা না লিখিতে পারিব সে পর্যন্ত আর লিখিব না। ইহা নিশ্চয়ই যে, তিনি (বিয়াত্রিচে) জানিতেছেন, আমি তাঁহার বিষয়ে যোগ্যতর কবিতা লিখিবার ক্ষমতা প্রাপ্তির জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছি। সমুদয় জীবের প্রাণদাতা ঈশ্বর-প্রসাদে আর কিছুদিন যদি বাঁচিয়া থাকি, তবে তাঁহার বিষয়ে এমন লিখিব, যাহা এ পর্যন্ত কোনো মহিলার সম্বন্ধে কেহ কখনো লেখে নাই।' এই স্থির করিয়াই তিনি তাঁহার মহাকাব্য "ডিভাইনা কামেডিয়া' (Divina Commedia) লিখেন ও বিয়াত্রিচে সম্বন্ধে এমন কথা বলেন, যাহা কোনো মহিলা সম্বন্ধে কেহ কখনো বলে নাই।
প্রেম-বন্দী হৃদি যাঁরা, সুকোমল মন,
যাঁরা পড়িবেন এই সংগীত আমার,
তাঁরা মোর অনুনয় করুন শ্রবণ,
বুঝায়ে দিউন্ মোরে অর্থ কী ইহার?
যে কালে উজ্জ্বল তারা উজলে আকাশ,
নিশার চতুর্থ ভাগ হয়ে গেছে শেষ,
প্রেম মোর নেত্রে আসি হলেন প্রকাশ,
স্মরিলে এখনো কাঁপে হৃদয় প্রদেশ!
দেখে মনে হল যেন প্রফুল্ল আনন;
মোর হৃদ্পিণ্ড রহে করতলে তাঁর;
বাহু-'পরে শান্ত ভাবে করিয়া শয়ন
ঘুমাইয়া রয়েছেন মহিলা আমার--
অবশেষে জাগি উঠি, প্রেমের আদেশে
সভয়ে জ্বলন্ত-হৃদি করিলা আহার!
তার পরে চলি গেলা প্রেম অন্য দেশে
কাঁদিতে কাঁদিতে অতি বিষণ্ণ-আকার!
রমণি! তোমরা বুঝ প্রেমের ব্যাপার--
মহিলার কথা মোর করহ শ্রবণ--
ব'লে ফুরায় না কভু প্রশংসা তাঁহার--
মন খুলে ব'লে তবু জুড়াইবে মন!
পৃথিবীতে যত কিছু আছে গো মহান--
তাহা হতে মহত্তর চরিত তাঁহার
হেন দীপিয়াছে প্রেমে এ মোর পরান,
চির বল অর্পিয়াছে বচনে আমার!
সাধ যায় করি তাঁর হেন যশোগান
সমস্ত পুরুষে তাঁর পদতলে আনি--
কিন্তু থাক্-- গাব নাকো সে সমুচ্চ তান
গাহিতে ক্ষমতা যদি না থাকে কী জানি!
আমার এ ভালোবাসা অতি সুকোমল,
গাব তাই অতিশয় সুকোমল তানে--
সুকোমল হৃদি ওগো মহিলা সকল!
যে গান লাগিবে ভালো তোমাদের কানে!
স্বর্গের দেবতা এক কহিলা ঈশ্বরে--
"দেখো প্রভু, দেখো চেয়ে এই পৃথ্বীতলে--
মানব হইতে এক হেন জ্যোতি ক্ষরে,
নিম্ন দেশ পৃথিবীরে সে জ্যোতি উজলে!
স্বর্গের অভাব প্রভু নাই কিছু আর,
শুধু ওই জ্যোতি, ওই বিমল কিরণ!
তাই দেব অনুনয় শুন গো আমার,
দেবতার মাঝে তারে করো আনয়ন।'
আমাদের প্রতি দয়া হইল বিধির--
কহিলেন, "ধৈর্য ধরো, আসুক সময়--
পৃথিবীতে এক জন আছে গো অধীর
কখন হারায় তারে সদা তার ভয়।'
...
প্রেম কহে তার পানে করি নিরীক্ষণ
...
ঈশ্বর নূতন সৃষ্টি করিলা সৃজন!
মুকুতার মতো পাণ্ডু বরন তাহার--
প্রকৃতির পূর্ণতম-শিল্প সেই জন,
কহি তারে পূর্ণতম আদর্শ শোভার!
সুন্দর নয়নে তার সদাই জাগ্রত
এমন প্রেমের জ্যোতি, এমন উজ্জ্বল
যে জ্যোতি দর্শক আঁখি করায় মুদিত--
সে জ্যোতি ঢালয়ে হৃদে আলোক বিমল।
হাসিতে চিত্রিত যেন প্রেমের আকার--
এক দৃষ্টে কে তাকাবে সে হাসি তাহার?
তোমারে কহি, হে গান, সন্তান প্রেমের,
তুমি তো যাইবে বহু মহিলার কাছে,
বিলম্ব কোরো না কভু, বলো তাঁহাদের--
"দেবীগণ, মোর শুধু এক কাজ আছে--
তাঁহার চরণে যাওয়া, যাঁর মহা যশে
ভাণ্ডার আমার এই পূর্ণ রহিয়াছে।'
যদিবা বিলম্ব তব হয় দৈববশে,
দেখো যেন রহিয়ো না তাহাদের কাছে--
অসাধু যাদের জান, মন ভালো নয়--
কেবল রমণী আর প্রেমিকের কানে
খুলিয়া হে গীত তুমি তোমার হৃদয়!
মহিলা আমার বসি আছেন সেখানে [যেখানে,]
সেখানে তোমারে তাঁরা যাবেন লইয়া--
তাঁরে মোর কথা তুমি দিয়ো বুঝাইয়া!
কত কাল আছি আমি প্রেমের শাসনে,
এমন গিয়াছে স'য়ে অধীনতা তাঁর,
প্রথমে যা দুখ ব'লে করেছিনু মনে
এখন তা ধরিয়াছে সুখের আকার!
যদিও গো বলহীন হয়েছে পরান,
গেছে চলি তেজ যাহা ছিল এই চিতে,
তবু হেন সুখ প্রেম করেন গো দান
মৃত্যুমূল্য দিয়ে চাই সে সুখ কিনিতে!
প্রেমের প্রসাদে মোর হেন শক্তি আছে,
প্রত্যেক নিশ্বাস ধরি প্রার্থনা আকার--
অনুগ্রহ-ভিক্ষা চায় মহিলার কাছে--
অতি দীনভাবে অতি নম্রভাবে আর!
তাঁরে দেখিলেই আসে সে ভাব আমার।
এ নয়ন কাঁদিয়া কাঁদিয়া যন্ত্রণায়,
জীর্ণ হয়ে পড়িয়াছে গেছে শুকাইয়া--
নিভাতে এ জ্বালা যদি থাকে গো উপায়
(যেন জ্বালা অতি ধীরে যেতেছে লইয়া
ক্রমশ এ দেহ মোর কবরের পানে,)
তবে তাহা মৃত্যু, কিংবা প্রকাশি এ ব্যথা!
যখন মহিলা মোর আছিলা এখানে
আর কারে বলি নাই এ মর্মের কথা,
হে রমণি তোমাদের কোমল হৃদয়ে
মরমের কথা মোর ঢেলেছি কেবল।
যখন গেছেন তিনি স্বরগ আলয়ে--
রাখিয়া আমার তরে শোক-অশ্রুজল--
তখন যা-কিছু মোর বলিবার আছে
হে রমণি বলিব গো তোমাদেরি কাছে।
যাও তুমি, হে করুণ সংগীত আমার,
যাও সেথা যেইখানে রমণীরা আছে,
আগে তুমি যেতে সেথা বহি সুখভার,
কত সুখ পেতে, রহি তাহাদের কাছে!
এখনো তাদেরি কাছে করো গো প্রয়াণ,
বিষণ্ণ ও শূন্য তুমি শোকের সন্তান!
ধীরে যাইতেছে চলি, ওগো যাত্রীদল
যেন কোন্ দূর বস্তু করি কল্পনা--
মোদের দহিছে যেই বিষাদ অনল
তোমাদের পরশে নি যেন সে যাতনা!
তোমাদের নিজদেশ এতই কি দূরে?
এ শোকার্ত নগরীর যাও মধ্য দিয়া
বোধ হয় তবু যেন জান না, এ পুরে
কী মহান শোকানল দহিতেছে হিয়া!
তবু যদি একবার দাঁড়াও হেথায়,
কিছুক্ষণ মোর কথা শোনো মন দিয়া--
তা হলে বিদায়কালে বিষম ব্যথায়
যাবে চলি উচ্চ স্বরে কাঁদিয়া কাঁদিয়া!
তিল মাত্র যার কথা করিলে বর্ণন,
তিল মাত্র যার কথা করিলে শ্রবণ,
মানুষ কাঁদিতে থাকে ব্যথিত অন্তর,
সেই বিয়াত্রিচে-হারা অভাগা নগর!
জীবনের মধ্যপথে দেখিনু সহসা,
ভ্রমিতেছি ঘোর বনে পথ হারাইয়া--
সে যে কী ভীষণ অতি দারুণ গহন--
স্মৃতি তার ভয়ে মোরে করে অভিভূত!
সে ভয়ের চেয়ে মৃত্যু নহে ভয়ানক!
হেনকালে সহসা দেখিনু এক জন
বহুদিন মৌন রহি ক্ষীণ স্বর তাঁর--
"জীবিত বা মৃত আত্মা যে হও-না কেন
দয়া করো মোরে' আমি সমুচ্চে কহিনু
সে অরণ্য মাঝে যবে হেরিনু তাঁহারে!
মহাছায়া কহিলেন "মিথ্যা আশঙ্কায়
হৃদয় হয়েছে তব বৃথা অভিভূত--
পশু যথা ভয় পায় সন্ধ্যার আঁধারে
হেরিয়া অলীক ছায়া-- তেমনি মানুষ
মহান সংকল্প হতে হয় গো বিরত
বৃথা ভয়ে। এ আশঙ্কা করিবারে দূর--
কহি তোরে কোথা হতে এলেম হেথায়--
প্রথমে কাহার কথা করিয়া শ্রবণ
তোরে দয়া হল মোর, কহি তোরে তাহা!
পরলোকে থাকে যারা সংশয় আঁধারে--
তাহাদের মধ্যে মোর নিবাস কহিনু।
একদা রমণী এক আহ্বানিলা মোরে--
হেন পুণ্যময় মূর্তি এমন সুন্দরী
দেখেই অমনি তাঁর মাগিনু আদেশ--
অতিশয় মৃদু আর অতি সুকোমল
দেবতার স্বরে সুর বাঁধি, কহিলেন--
"অয়ি উপছায়া! তুমি যাহার সুযশ
যদিন প্রকৃতি রবে, রহিবে বাঁচিয়া--
এই অনুনয় মোর করহ শ্রবণ!--
বন্ধু এক মোর (নহে বন্ধু সম্পদের)
মহারণ্যে নিদারুণ বাধা বিঘ্ন পেয়ে--
ভয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছেন তিনি।
ভয় করি পাছে হন হেন পথহারা
আর তাঁরে একেবারে ফিরাতে না পারি!
উদ্দীপনা-বাক্যে তব, যে-কোনো উপায়ে,
ফিরাইয়া আনো, তবে লভিব বিরাম!
আসিয়াছি স্বর্গ হতে বিয়াত্রিচে আমি
প্রেম-উত্তেজনে আমি কৈনু অনুরোধ,
মোর মধ্য দিয়া সবে যাও দুঃখদেশে;
মোর মধ্য দিয়া যাও চির-দুঃখভোগে--
চিরকাল তরে যারা হয়েছে পতিত,
মোর মধ্য দিয়া যাও তাহাদের কাছে!
ন্যায়ের আদেশে আমি হয়েছি নির্মিত--
অনন্ত জ্ঞান ও প্রেম স্বর্গীয় ক্ষমতা--
আমারে পোষণ করা কার্য তাহাদের!
মোর পূর্বে আর কিছু হয় নি সৃজিত--
অনন্ত-পদার্থ ছাড়া, তাই কহিতেছি
হেথায় অনন্ত কাল দহিতেছি আমি।
"হে প্রবেশি, ত্যজি স্পৃহা, প্রবেশ এ দেশে।'
তারকা-অবিদ্ধ শূন্য করিছে ধ্বনিত,
শুনিয়া, প্রবেশি সেথা উঠিনু কাঁদিয়া।
নানাবিধ ভাষা আর ভয়ানক কথা,
যন্ত্রণার আর্তনাদ, ক্রোধের চীৎকার
করতালি-- কঠোর ও ভগ্নকণ্ঠ-ধ্বনি--
নিরেট সে আঁধারের চার দিক ঘেরি
ঘূর্ণ-বায়ে রেণুসম ফিরিছে সতত!
আঁখি মোর দেখে তাঁরে পারে নি চিনিতে
তবু তাঁর দেহ হতে এমন একটি
বিকীরিত হতেছিল শুভ্র-পূণ্য-জ্যোতি,
তাহার পরশে যেন পুরাতন প্রেম
হৃদয়ে আমার পুন উঠিল জাগিয়া।
সেই পুরাতন স্বপ্ন কত শত দিন
যে স্বপ্নে হৃদয় মোর আছিল মগন--
যখনি উঠিল জাগি স্বর্গীয় কিরণে,
অমনি আকুল হয়ে ফিরিয়া ধাইনু।
কবি বার্জিলের পানে, শিশু সে যেমন
ভয় কিংবা শোক-ভারে হলে বিচলিত,
অমনি মায়ের বুকে যায় লুকাবারে!
ভাবিনু কাতর স্বরে কহিব তাঁহারে--
"প্রতি রক্তবিন্দু মোর কাঁপিছে শিরায়,
পুরানো সে অগ্নি পুন উঠিছে জ্বলিয়া।'
হা-- বর্জিল কোথা-- হয়েছেন অন্তর্ধান!
প্রিয়তম পিতা তুমি বর্জিল আমার!
জাগি উঠি স্বপ্ন যদি ভুলে যাই সব,
তবু তার ভাব যেমন থাকে মনে মনে,
তেমনি আমারো হল, স্বপ্ন গেল ছুটে
মাধুর্য তবুও তার রহিল হৃদয়ে।
আরো দেখুন