অকাল কুষ্মাণ্ড (okal kushmando)
সাবিত্রী লাইব্রেরির সাংবৎসরিক উৎসব উপলক্ষে লিখিত
পরামর্শ দেওয়া কাজটা না কি গুরুতর নহে, অথচ যিনি পরামর্শ দেন তিনি সহসা অত্যন্ত গুরুতর হইয়া উঠেন, এই নিমিত্ত পরামর্শদাতার অভাব লইয়া সমাজ বা ব্যক্তিবিশেষকে বোধ করি কখনো আক্ষেপ করিতে হয় নাই! নিতান্ত যে গরীব, যাহার একবেলা এক কুন্কে চাল জোটে না, সে তিন সন্ধে তিন বস্তা করিয়া পরামর্শ বিনি খরচায় ও বিনি মাসুলে পাইয়া থাকে-- আশ্চর্য এই যে তাহাতে তাহার পেট ভরিবার কোনো সহায়তা করে না। বিশেষত কতকগুলি নিতান্ত সত্য কথা আছে তাহারা এত সত্য যে সচরাচর কোনো ব্যবহারে লাগে না অর্থাৎ তাহারা এত সস্তা যে, তাহাদের পয়সা দিয়া কেহ কেনে না-- কিন্তু গায়ে পড়িয়া বদান্যতা করিবার সময় তেমন সুবিধার জিনিস আর কিছু হইতে পারে না। যৎপরোনাস্তি সত্য কথাগুলির দশা কী হইত যদি সংসারে পরামর্শদাতার কিছুমাত্র অভাব থাকিত! তাহা হইলে কে বলিত, "বাপু সাবধান হইয়া চলিয়ো, বিবেচনাপূর্বক কাজ করিয়ো, মনোযোগপূর্বক বিষয়-আশয় দেখিয়ো; এগ্জামিন পাস হইতে চাও তো ভালো করিয়া পড়া মুখস্থ করিয়ো-- খামকা পড়িয়া হাত-পা ভাঙিয়ো না, খবরদার জলে ডুবিয়া মরিয়ো না-- ইত্যাদি?' এই কথাগুলো কোম্পানির মাল হইয়া পড়িয়াছে, দরিয়ায় ঢালিতে হইলে ইহাদের প্রতি আর কেহ মায়া-মমতা করে না!
অনেক ভালো ভালো পরামর্শও দুরবস্থায় পড়িয়া সস্তা হইয়া উঠিয়াছে। সহসা তাহাদের এত বেশি আমদানি হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহাদের দাম নাই বলিলেও হয়। যাহাদের মূলধন কম, এমন সাহিত্য-দোকানদার মাত্রেই তাড়াতাড়ি এই-সকল সস্তা ও পাঁচরঙা পদার্থ লইয়া দৈনিকে, সাপ্তাহিকে, পাক্ষিকে, মাসিকে, ত্রৈমাসিকে, পুঁথিতে চটিতে, এক কলম, দু কলম, এক পেজ, দু পেজ, এক ফর্মা দু ফর্মা, যাহার যেমন সাধ্য পসরা সাজাইয়া ভারি হাঁকডাক আরম্ভ করিয়াছে। দেশকে উপদেশ এবং আদেশ করিতে কেহই পরিশ্রমের ত্রুটি করেন না; রাস্তায় যত লোক চলিতেছে তাহা অপেক্ষা ঢের বেশি লোক পথ দেখাইয়া দিতেছে। (বাংলাটা Finger-Post-এরই রাজত্ব হইয়া উঠিল।) কিন্তু তাহাদের এই অত্যন্ত গুরুতর কর্তব্য সমাধান করিতে তাহারা এত বেশি ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছে যে, পথিকেরা চলিবার রাস্তা পায় না। সহসা সকলেরই একমাত্র ধারণা হইয়াছে যে, দেশটা যে রসাতলে যাইতেছে সে কেবলমাত্র উপদেশের অভাবে। কিন্তু কেহ কেহ এমনও বলিতেছেন যে, ঢের হইয়াছে-- গোটাকতক কুড়োনো কথা ও আর তিনশোবার করিয়া বলিয়ো না-- ওটাতে যা-কিছু পদার্থ ছিল, সে তোমাদের আওয়াজের চোটে অনেক কাল হইল নিকাশ হইয়া গিয়াছে। আমাদের এই ক্ষুদ্র সাহিত্যের ডোঙাটা একটুখানি হাল্কা করিয়া দাও, বাজে উপদেশ ও বাঁধি পরামর্শ ইহার উপর আর চাপাইয়ো না-- বস্তার উপর বস্তা জমিয়াছে, নৌকাডুবি হইতে আর বিস্তর বিলম্ব নাই-- কাতর অনুরোধে কর্ণপাত করো, ওগুলো নিতান্তই অনাবশ্যক। তুমি তো বলিলে অনাবশ্যক! কিন্তু ওগুলো যে সস্তা! মাথার খোলটার মধ্যে একটা সিকি পয়সা ও আধুলি বৈ আর যে কিছু নাই, মাথা নাড়িলে সেই দুটোই ঝম্ঝম্ করিতে থাকে, মনের মধ্যে আনন্দ বোধ হয়-- সেই দুটো লইয়াই কারবার করিতে হইবে-- সুতরাং দুটো-চারটে অতি জীর্ণ উপদেশ পুরোনো তেঁতুলের সহিত শিকেয় তোলা থাকে-- বুদ্ধির ডোবা হইতে এক ঘটি জল তুলিয়া তাহাতে ঢালিয়া দিলে তাহাই অনেকটা হইয়া ওঠে এবং তাহাতেই গুজ্রান্ চলিয়া যায়। একটা ভালো জিনিস সস্তা হইলে এই প্রকার খুচরা দোকানদার মহলে অত্যন্ত আনন্দ পড়িয়া যায়। দেখিতেছেন না, আজকাল ইহাদের মধ্যে ভারি স্ফূর্তি দেখা যাইতেছে! সাহিত্যের ক্ষুদে পিঁপড়েগণ ছোটো ছোটো টুকরো মুখে লইয়া অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া ও অত্যন্ত গর্বের সহিত সার বাঁধিয়া চলিয়াছে! এখানে একটা কাগজ, ওখানে একটা কাগজ, সেখানে একটা কাগজ, এক রাত্রের মধ্যে হুস করিয়া মাটি ফুঁড়িয়া উঠিতেছে। ইহা হইতে স্পষ্টই প্রমাণ হইতেছে যে, আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরা যখন ইংরিজি বিদ্যাটাকে কলা দিয়া চটকাইয়া ফলার করিতেছিলেন, তখন তাঁহাদের পাতের চার দিকে পোলিটিকল্ ইকনমি ও কন্স্টিট্যুশনল হিস্ট্রির, বর্কলের ও মিলের এবং এ-ও তার কিছু কিছু গুঁড়া পড়িয়াছিল-- সাহিত্যের ক্ষুধিত উচ্ছিষ্টপ্রত্যাশী এক দল জীববিশেষ তাহাদের অসাধারণ ঘ্রাণশক্তি প্রভাবে শুঁকিয়া শুঁকিয়া তাহা বাহির করিয়াছে। বড়ো বড়ো ভাবের আধখানা শিকিখানা টুকরা পথের ধুলার মধ্যে পড়িয়া সরকারি সম্পত্তি হইয়া উঠিয়াছে, ছোটো ছোটো মুদি এবং কাঁসারিকুলতিলকগণ পর্যন্ত সেগুলোকে লইয়া রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া ইঁটপাটকেলের মতো ছোড়াছুড়ি করিতে আরম্ভ করিয়াছে। এত ছড়াছড়ি ভালো কি না সে বিষয়ে কিছু সন্দেহ আছে-- কারণ, এরূপ অবস্থায় উপযোগী দ্রব্যসকলও নিতান্ত আবর্জনার সামিল হইয়া দাঁড়ায়-- অস্বাস্থ্যের কারণ হইয়া উঠে এবং সমালোচকদিগকে বড়ো বড়ো ঝাঁটা হাতে করিয়া ম্যুনিসিপলিটির শকট বোঝাই করিতে হয়।
এমন কেহ বলিতে পারেন বটে যে, ভালো কথা মুখে মুখে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িলে তাহাতে হানি যে কেন হইবে বুঝিতে পারিতেছি না। হানি হইবার একটা কারণ এই দেখিতেছি-- যে কথা সকলেই বলে, সে কথা কেহই ভাবে না। সকলেই মনে করে, আমার হইয়া আর পাঁচশো জন এ কথাটা ভাবিয়াছে ও ভাবিতেছে, অতএব আমি নির্ভাবনায় ফাঁকি দিয়া কথাটা কেবল বলিয়া লই-না কেন? কিন্তু ফাঁকি দিবার জো নাই-- ফাঁকি নিজেকেই দেওয়া হয়। তুমি যদি মনে কর একটা ঘোড়াকে স্থায়ীরূপে নিজের অধিকারে রাখিতে হইলে আর কিছুই করিতে হইবে না, কেবল রশারশি দিয়া খুব শক্ত করিয়া বাঁধিয়া রাখিলেই হইল, তাহাকে দানা ছোলা দিবার কোনো দরকার নাই-- এবং সেইমতো আচরণ কর, তাহা হইলে কিছুদিনের মধ্যে দেখিবে দড়িতে একটা জিনিস খুব শক্তরূপে বাঁধা আছে বটে কিন্তু সেটাকে ঘোড়া না বলিলেও চলে। তেমনি ভাষারূপ দড়িদড়া দিয়া ভাবটাকে জিহ্বার আস্তাবলে দাঁতের খুঁটিতে খুব শক্ত করিয়া বাঁধিয়া রাখিলেই যে সে তোমার অধিকারে চিরকাল থাকিবে তাহা মনে করিয়ো না-- তিন সন্ধ্যা তাহার খোরাক জোগাইতে হইবে। যে ভাবনার মাটি ফুঁড়িয়া যে কথাটি উদ্ভিদের মতো বাড়িয়া উঠিয়াছে, সেই মাটি হইতে সেই কথাটিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইলে সে আর বেশিদিন বাঁচিতে পারে না। দিন দুই-চার সবুজ থাকে বটে ও গৃহশোভার কাজে লাগিতে পারে কিন্তু তার পর যখন মরিয়া যায় ও পচিয়া উঠে তখন তাহার ফল শুভকর নহে। একটা গল্প আছে, একজন অতিশয় বুদ্ধিমান লোক বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনের উদ্দেশে একটা পরীক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন, তিনি দেখিতেছিলেন ঘোড়াকে নিয়মিতরূপে না-খাওয়ানো অভ্যাস করাইলে সে টেঁকে কি না। অভ্যাসের গুণে অনেক হয় আর এটা হওয়াই বা আশ্চর্য কী! কিন্তু সেই বিজ্ঞানহিতৈষী বুদ্ধিমান ব্যক্তি সম্প্রতি এই বলিয়া আক্ষেপ করিতেছেন যে-- প্রতিদিন একটু একটু করিয়া ঘোড়ার খোরাক কমাইয়া যখন ঠিক একটিমাত্র খড়ে আসিয়া নাবিয়াছি, এমন সময়টিতে ঘোড়াটা মারা গেল! নিতান্ত সামান্য কারণে এত বড়ো একটা পরীক্ষা সমাপ্ত হইতেই পারিল না, ও এ বিষয়ে বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত নিতান্ত অসম্পূর্ণ রহিয়াই গেল। আমরাও বুদ্ধিমান বিজ্ঞানবীরগণ বোধ করি কতকগুলি ভাব লইয়া সেইরূপ পরীক্ষা আরম্ভ করিয়াছি-- কিছুমাত্র ভাবিব না-- অথচ গোটাকতক বাঁধা ভাব পুষিয়া রাখিব, শুধু তাই নয় চব্বিশ ঘণ্টা তাহাদের ঘাড়ে চড়িয়া রাস্তার ধুলা উড়াইয়া দেশময় দাপাদাপি করিয়া বেড়াইব, অবশেষে পরীক্ষা সম্পূর্ণ হইবার ঠিক পূর্বেই দেখিব, কথা সমস্তই বজায় আছে অথচ ভাবটার যে কী খেয়াল গেল সে হঠাৎ মরিয়া গেল! অনেক সময়ে প্রচলিত কথার বিরুদ্ধ কথা শুনিলে আমাদের আনন্দ হয় কেন? কারণ, এই উপায়ে ডোবায় বদ্ধ স্তব্ধ নিস্তরঙ্গ প্রচলিত মতগুলি গুরুতর নাড়া পাইয়া আন্দোলনের প্রভাবে কতকটা স্বাস্থ্যজনক হয়। যে-সকল কথাকে নিতান্তই সত্য মনে করিয়া নির্ভাবনায় ও অবহেলায় ঘরের কোণে জমা করিয়া রাখিয়াছিলাম, তাহাদের বিরুদ্ধে সন্দেহ উত্থাপিত হইলে ফের তাহাদের টানিয়া বাহির করিতে হয়, ধুলা ঝাড়িয়া চোখের কাছে লইয়া নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিতে হয়-- ও এইরূপে পুনশ্চ তাহারা কতকটা ঝকঝকে হইয়া উঠে। যতবড়ো বুদ্ধিমানই হউন-না-কেন সত্য কথার বিরুদ্ধে কাহারও কথা কহিবার সাধ্য নাই-- তবে যখন কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির নিকট হইতে প্রচলিত সত্যের বিপক্ষে কোনো কথা শুনা যায় তখন একটু মনোযোগপূর্বক ভাবিয়া দেখিলেই দেখা যায় যে, সেটা একটা ফাঁকি মাত্র। তিনি সেই কথাটাই কহিতেছেন, অথচ ভান করিতেছেন যেন তাহার সহিত ভারি ঝগড়া চলিতেছে। এইরূপে নির্জীব কথাটার অন্ত্যেষ্টিসৎকার করিয়া আর-একটা নূতন কথার দেহে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা হয়-- দেখিতে ঠিক বোধ হইল যেন সত্যটাকেই পুড়াইয়া মারিলেন, কিন্তু আসলে কী করিলেন, না, জরাগ্রস্ত সত্যের দেহান্তর প্রাপ্তি করাইয়া তাহাকে অমর যৌবন দান করিলেন।
য়ুরোপে যাহা হইয়াছে তাহা সহজে হইয়াছে, আমাদের দেশে যাহা হইতেছে তাহা দেখাদেখি হইতেছে এইজন্য ভারি কতকগুলো গোলযোগ বাধিয়াছে। সমাজের সকল বিভাগেই এই গোলযোগ উত্তরোত্তর পাকিয়া উঠিতেছে। আমরা য়ুরোপীয় সভ্যতার আগডালে বসিয়া আনন্দে দোল খাইতেছি, তাহার আগাটাই দেখিতেছি, তাহার যে আবার একটা গোড়া আছে ইহা কোনোক্রমেই বিশ্বাস হয় না। কিন্তু এরূপ ভ্রম শাখামৃগেরই শোভা পায়। যে কারণে এতটা কথা বলিলাম তাহা এই-- য়ুরোপে দেখিতে পাই বিস্তর পাক্ষিক মাসিক ত্রৈমাসিক বার্ষিক সাময়িক পত্র প্রকাশিত হয়, ইহা সেখানকার সভ্যতার একটা নিদর্শন বলিতে হইবে। আমাদের দেশেও বিস্তর সাময়িক পত্র বাহির হইতে আরম্ভ হইয়াছে, কিন্তু ইহাই লইয়া কি উল্লাস করিব? এ বিষয়ে আমি কিন্তু একটুখানি ইতস্তত করিয়া থাকি। আমার সন্দেহ হয় ইহাতে ঠিক ভালো হইতেছে কি না। য়ুরোপে লেখক ও চিন্তাশীল ব্যক্তি বিস্তর আছে তাই কাগজপত্র আপনা হইতে জাগিয়া উঠিতেছে। আমরা তাই দেখাদেখি আগেভাগে কাগজ বাহির করিয়া বসিয়া আছি, তার পরে লেখক লেখক করিয়া চতুর্দিক হাৎড়াইয়া বেড়াইতেছি। ইহাতে যে কুফল কী হইতে পারে, তাহা ক্রমশ ব্যক্ত করা যাইতেছে।
আমার একটি বিশ্বাস এই যে, য়ুরোপেই কী আর অন্য দেশেই কী, সাহিত্য সম্বন্ধে নিয়মিত জোগান দিবার ভার গ্রহণ করা ভালো নয়; কারণ তাহা হইলে দোকানদার হইয়া উঠিতে হয়। সাহিত্যে যতই দোকানদারি চলিবে ততই তাহার পক্ষে অমঙ্গল। প্রথমত, ভাবের জন্য সবুর করিয়া বসিয়া থাকিলে চলে না, লেখাটাই সর্বাগ্রে আবশ্যক হইয়া পড়ে। কিন্তু ইহা অপেক্ষাও গুরুতর আশঙ্কার বিষয় আরেকটি আছে। ইংরাজেরা দাস-ব্যবসায় উঠাইয়া দিয়াছেন-- কিন্তু স্বাধীন ভাবগুলিকে ক্রীতদাসের মতো কেনাবেচা করিবার প্রথা তাঁহারাই অত্যন্ত প্রচলিত করিয়াছেন। এইরূপে শতসহস্র ভাব প্রত্যহই নিতান্ত হেয় হইয়া পড়িতেছে। স্বাধীন অবস্থায় তাহারা যেরূপ গৌরবের সহিত কাজ করিতে পারে, দাসত্বের জোর-জবরদস্তিতে ও অপমানে তাহারা সেরূপ পারে না ও এইরূপে ইংরাজিতে যাহাকে cant বলে সেই cant-এর সৃষ্টি হয়। ভাব যখন স্বাধীনতা হারায়, দোকানদারেরা যখন খরিদ্দারের আবশ্যক বিবেচনা করিয়া তাহাকে শৃঙ্খলিত করিয়া হাটে বিক্রয় করে তখন তাহাই দতশঢ় হইয়া পড়ে। য়ুরোপের বুদ্ধি ও ধর্মরাজ্যের সকল বিভাগেই cantনামক একদল ভাবের শূদ্রজাতি সৃজিত হইতেছে। য়ুরোপের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা আক্ষেপ করেন যে, প্রত্যহ Theological cant, Sociological cant, Political cant-এর দলপুষ্টি হইতেছে। আমার বিশ্বাস তাহার কারণ-- সেখানকার বহুবিস্তৃত সাময়িক সাহিত্য ভাবের দাস-ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছে। কেননা, পূর্বে যাহা বলা হইয়াছে তাহাতেই বুঝাইতেছে-- স্বাধীন ভাবেরই অবস্থান্তর cant। যদি কোনো সহৃদয় ব্যক্তি cant-এর দাসত্বশৃঙ্খল খুলিয়া দিয়া পুনশ্চ তাহাকে মুক্ত করিয়া দেন, তবে সেই আবার স্বাধীন ভাব হইয়া ওঠে-- এবং তাহাকেই সকলে বহুমান করিয়া পূজা করিতে থাকে। সত্যকথা মহৎকথাও দোকানদারীর অনুরোধে প্রচার করিলে অনিষ্টজনক হইয়া উঠে। যথার্থ হৃদয় হইতে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিলে যে কথা দেবতার সিংহাসন টলাইতে পারিত, সেই কথাটাই কি না ডাকমাসুল সমেত সাড়ে তিন টাকা দরে মাসহিসাবে বাঁটিয়া-বাঁটিয়া ছেঁড়া কাগজে মুড়িয়া বাড়ি-বাড়ি পাঠান! যাহা সহজ প্রকৃতির কাজ তাহারও ভার নাকি আবার কেহ গ্রহণ করিতে পারে! কোনো দোকানদার বলুক দেখি সে মাসে মাসে এক-একটা ভাগীরথী ছাড়িবে, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় লাটাই বাঁধিয়া ধূমকেতু উড়াইবে বা প্রতি শনিবারে ময়দানে একটা করিয়া ভূমিকম্পের নাচ দেখাইবে। সে হুঁকার জল ফিরাইতে, ঘুড়ি উড়াইতে ও বাঁদর নাচাইতে পারে বলিয়া যে অম্লান বদনে এমনতরো একটা গুরুতর কার্য নিয়মিতরূপে সম্পন্ন করিবার ভার গ্রহণ করিতে চাহে, ইহা তাহার নিতান্ত স্পর্ধার কথা। আজকাল খাতায় টুকিয়া রাখিতে হয়-- অমুক দিন ঠিক অমুক সময়ে পকেট হইতে রুমালটি বাহির করিয়া দেশের জন্য কাঁদিব-- তাহার পরদিন সাড়ে তিনটের সময় সহসা দেশের লোকের কুসংস্কার কিছুতেই বরদাস্ত করিতে পারিব না ও তাহাই লইয়া ঠিক তিনপোয়া-আন্দাজ রাগ ও একপোয়া-আন্দাজ দুঃখ করিব; বন্ধু যখন নিমন্ত্রণ করিতে আসেন-- উনত্রিশে চৈত্র ১১টার সময় আমার ওখানে আহার করিতে আসিয়ো, তখন আমাকে বলিতে হয়-- "না ভাই তাহা পারিব না। কারণ ত্রিশে চৈত্র আমার কাগজ বাহির হইবে, অতএব কাল ঠিক এগারোটার সময় দেশের অনৈক্য দেখিয়া আমার হৃদয় ভয়ানক উত্তেজিত হইয়া উঠিবে এবং ভীষ্ম দ্রোণ ও অশ্বত্থামাকে স্মরণ করিয়া আমাকে অতিশয় শোকাতুর হইতে হইবে।' য়ুরোপে লেখক বিস্তর আছে, সেখানে তবু এতটা হানি হয় না, কিন্তু হানি কিছু হয়ই। আর, আমাদের দেশে লেখক নাই বলিলেও হয়, তবুও তো এতগুলো কাগজ চলিতেছে। কেমন করিয়া চলে? লেখার ভান করিয়া চলে। সহৃদয় লোকদের হৃদয়ে অন্তঃপুরবাসী পবিত্র ভাবগুলিকে সাহিত্যসমাজের অনার্যেরা যখনি ইচ্ছা অসংকোচে তাহাদের কঠিন মলিন হস্তে স্পর্শ করিয়া অশুচি করিয়া তুলিতেছে। এই-সকল ম্লেচ্ছেরা মহৎবংশোদ্ভব কুলীন ভাবগুলির জাত মারিতেছে। কঠিন প্রায়শ্চিত্ত করাইয়া তবে তাহাদিগকে সমাজে তুলিতে হয়। কারণ, সকল বিষয়েই অধিকারী ও অনধিকারী আছে। লেখার অধিকারী কে? না, যে ভাবে, যে অনুভব করে। ভাবগুলি যাহার পরিবারভুক্ত লোক। যে-খুশি-সেই কোম্পানির কাছ হইতে লাইসেন্স লইয়া ভাবের কারবার করিতে পারে না। সেরূপ অবস্থা মগের মুল্লুকেই শোভা পায় সাহিত্যের রাম-রাজত্বে শোভা পায় না। কিন্তু আমাদের বর্তমান সাহিত্যের অরাজকতার মধ্যে কি তাহাই হইতেছে না! না হওয়াই যে আশ্চর্য। কারণ এত কাগজ হইয়াছে যে, তাহার লেখার জন্য যাকে-তাকে ধরিয়া বেড়াইতে হয়-- নিতান্ত অর্বাচীন হইতে ভীমরতিগ্রস্ত পর্যন্ত কাহাকেও ছাড়িতে পারা যায় না। মনে করো, হঠাৎ যুদ্ধ করিবার আবশ্যক হইয়াছে, কেল্লায় গিয়া দেখিলাম সৈন্য বড়ো বেশি নাই-- তাড়াতাড়ি মুটেমজুর চাষাভুষো যাহাকে পাইলাম এক-একখানা লাল পাগড়ি মাথায় জড়াইয়া সৈন্য বলিয়া দাঁড় করাইয়া দিলাম। দেখিতে বেশ হইল। বিশেষত রীতিমতো সৈন্যের চেয়ে ইহাদের এক বিষয়ে শ্রেষ্ঠতা আছে-- ইহারা বন্দুকটা লইয়া খুব নাড়িতে থাকে, পা খুব ফাঁক করিয়া চলে এবং নিজের লাল পাগড়ি ও কোমরবন্ধটার বিষয় কিছুতেই ভুলিতে পারে না-- কিন্তু তাহা সত্ত্বেও যুদ্ধে হার হয়। আমাদের সাহিত্যেও তাই হইয়াছে-- লেখাটা চাই-ই চাই, তা-সে যেই লিখুক-না কেন। এ লেখাতেও না কি আবার উপকার হয়! উপকার চুলায় যাউক স্পষ্ট অপকার হয় ইহা কি কেহ অস্বীকার করিতে পারেন! অনবরত ভান চলিতেছে-- গদ্যে ভান, পদ্যে ভান, খবরের কাগজে ভান, মাসিকপত্রে ভান, রাশি রাশি মৃত-সাহিত্য জমা হইতেছে, ভাবের পাড়ায় মড়ক প্রবেশ করিয়াছে। ভারত-জাগানো ভাবটা কিছু মন্দ নয়। বিশেষত যথার্থ সহৃদয়ের কাতর মর্মস্থান হইতে এই জাগরণ-সংগীত বাজিয়া উঠিলে, আমাদের মতো কুম্ভকর্ণেরও এক মুহূর্তের জন্য নিদ্রাভঙ্গ হয়; নিদেন হাই তুলিয়া গা-মোড়া দিয়া পাশ ফিরিয়া শুইতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এখন এমনি হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, ভারত জাগানো কথাটা যেন মারিতে আসে! তাহার কারণ আর কিছুই নয়, আজ দশ-পনেরো বৎসর ধরিয়া অনবরত বালকে এবং স্ত্রীলোকে পর্যন্ত ভারত-জাগানোর ভান করিয়া আসিয়াছে-- ভাবটা ফ্যাশান হইয়া পড়িল, সাহিত্য-দোকানদারেরা লোকের ভাব বুঝিয়া বাজারের দর দেখিয়া দিনে দিনে সপ্তাহে সপ্তাহে মাসে মাসে প্রচুর পরিমাণে আমদানি করিতে লাগিল; কাপড়ের একটা নতুন পাড় উঠিলে তাহা যেমন সহসা হাটে-ঘাটে-মাঠে অত্যন্ত প্রচলিত হইয়া উঠে-- ভারত-জাগানোটাও ঠিক তেমনি হইয়া উঠিল-- কাজেই ঝট্ করিয়া তাহাকে মারা পড়িতে হইল। কুম্ভকর্ণকে যেমন ঢাকঢোল জগঝম্প বাজাইয়া উৎপীড়ন করিয়া কাঁচাঘুম হইতে জাগাইয়া তুলিল ও সে যেমন জাগিল, তেমনি মরিল। ইহার বিপুল মৃতদেহ আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রের কতটা স্থান জুড়িয়া পড়িয়া আছে একবার দেখো দেখি! এখনও কেহ কেহ কাজকর্ম না থাকিলে জেঠাইমাকে গঙ্গাযাত্রা হইতে অব্যাহতি দিয়া এই মৃতদেহের কানের কাছে ঢাকঢোল বাজাইতে আসেন। কিন্তু এ আর উঠিবে না, এ নিতান্তই মারা পড়িয়াছে! যদি ওঠে তবে প্রতিভার সঞ্জীবনী মন্ত্রে নূতন দেহ ধারণ করিয়া উঠিবে। এমন একটার উল্লেখ করিলাম কিন্তু প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে শতকরা কত কত ভাব হৃদয়হীন কলমের আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত হইয়া ও কপট কৃত্রিম রসনা শয্যার উপরে হাত-পা খিচাইয়া ধনুষ্টংকার হইয়া মরিতেছে তাহার একটা তালিকা কে প্রস্তুত করিতে পারে! এমনতরো দারুণ মড়কের সময় অবিশ্রাম চুলা জ্বালাইয়া এই শত সহস্র মৃত সাহিত্যের অগ্নিসৎকার করিতে কোন্ সমালোচক পারিয়া ওঠে! চাহিয়া দেখো-না, বাংলা নবেলের মধ্যে নায়ক-নায়িকার ভালোবাসাবাসির একটা ভান, কবিতার মধ্যে নিতান্ত অমূলক একটা হা-হুতাশের ভান, প্রবন্ধের মধ্যে অত্যন্ত উত্তেজনা উদ্দীপনা ও রোখা-মেজাজের ভান! এ তো ভান করিবার বয়েস নয়-- আমাদের সাহিত্য এই যে সে-দিন জন্মগ্রহণ করিল-- এরই মধ্যে হাবভাব করিতে আরম্ভ করিলে বয়সকালে ইহার দশা যে কী হইবে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।
কথাটা সত্য হইলেই যে সমস্ত দায় হইতে এড়াইলাম তাহা নহে। সত্য কথা অনুভব না করিয়া যে বলে তাহার বলিবার কোনো অধিকার নাই। কারণ সত্যের প্রতি সে অন্যায় ব্যবহার করে। সত্যকে সে এমন দীনহীনভাবে লোকের কাছে আনিয়া উপস্থিত করে, যে কেহ সহসা তাহাকে বিশ্বাস করিতে চায় না। বিশ্বাস যদি বা করে তা মৌখিকভাবে করে, সসম্ভ্রমে হৃদয়ের মধ্যে ডাকিয়া আনিয়া তাহাকে আসন পাতিয়া দেয় না। সে যত বড়ো লোকটা তদুপযুক্ত আদর পায় না। অনবরত রসনায় রসনায় দেউড়িতে ফিরিতে থাকে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিতে পায় না, ক্রমে রসনার শোভা হইয়া ওঠে, হৃদয়ের সম্পত্তি হয় না। হৃদয়ের চারা রসনায় পুঁতিলে কাজেই সে মারা পড়ে।
সত্যের দুই দিক আছে-- প্রথম, সত্য যে সে আপনা-আপনিই সত্য, দ্বিতীয়, সত্য আমার কাছে সত্য। যতক্ষণ-না আমি সর্বতোভাবে অনুভব করি ততক্ষণ সত্য হাজার সত্য হইলেও আমার নিকটে মিথ্যা। সুতরাং আমি যখন অনুভব না করিয়া সত্য কথা বলি, তখন সত্যকে প্রায় মিথ্যা করিয়া তুলি। অতএব বরঞ্চ মিথ্যা বলা ভালো তবু সত্যকে হত্যা করা ভালো নয়। কিন্তু প্রত্যহই যে সেই সত্যের প্রতি মিথ্যাচরণ করা হইতেছে! যাহারা বোঝে না তাহারাও বুঝাইতে আসিয়াছে, যাহারা ভাবে না তাহারাও টিয়া পাখির মতো কথা কয়, যাহারা অনুভব করে না তাহারাও তাহাদের রসনার শুষ্ককাষ্ঠ লইয়া লাঠি খেলাইতে আসে! ইহার কি কোনো প্রায়শ্চিত্ত নাই! অপমানিত সত্য কি তাঁহার অপমানের প্রতিশোধ লইবেন না! লক্ষ লক্ষ বৎসর অবিশ্রাম ভান করিলেও কি কোনোকালে যথার্থ হইয়া ওঠা যায়! দেবতাকে দিনরাত্রি মুখ ভেংচাইয়াই কি দেবতা হওয়া যায়, না তাহাতে পুণ্য সঞ্চয় হয়!
সম্পূর্ণ বিদেশীয় ভাবের সংস্রবে আসিয়াই, বোধ করি, আমাদের এই উৎপাত ঘটিয়াছে। আমরা অনেক তত্ত্ব তাহাদের কেতাব হইতে পড়িয়া পাইয়াছি।-- ইহাকেই বলে প'ড়ে পাওয়া-- অর্থাৎ ব্যবহারী জিনিস পাইলাম বটে কিন্তু তাহার ব্যবহার জানি না। যাহা শুনিলাম মাত্র, ভান করি যেন তাহাই জানিলাম। পরের জিনিস লইয়া নিজস্ব স্বরূপে আড়ম্বর করি। কথায় কথায় বলি, ঊনবিংশ শতাব্দী, ওটা যেন নিতান্ত আমাদেরই। একে বলি ইনি আমাদের বাংলার বাইরন, ওঁকে বলি উনি আমাদের বাংলার গ্যারিবল্ডি, তাঁকে বলি তিনি আমাদের বাংলার ডিমস্থিনিস-- অবিশ্রাম তুলনা করিতে ইচ্ছা যায়-- ভয় হয় পাছে একটুমাত্র অনৈক্য হয়-- হেমচন্দ্র যে হেমচন্দ্রই এবং বাইরন যে বাইরনই, তাহা মনে করিলে মন কিছুতেই সুস্থ হয় না। জবরদস্তি করিয়া কোনোমতে বটকে ওক বলিতেই হইবে, পাছে ইংলন্ডের সহিত বাংলার কোনো বিষয়ে এক চুল তফাত হয়। এমনতরো মনের ভাব হইলে ভান করিতেই হয়-- পাউডর মাখিয়া সাদা হইতেই হয়, গলা বাঁকাইয়া কথা কহিতেই হয় ও বিলাতকে "হোম্' বলিতে হয়! সহজ উপায়ে না বাড়িয়া আর-একজনের কাঁধের উপরে দাঁড়াইয়া লম্বা হইয়া উঠিবার এইরূপ বিস্তর অসুবিধা দেখিতেছি! আমরা খল্সেরা দেখিতেছি অ্যাংব্যাংগণ খুব থপ্থপ্ করিয়া চলিতেছে, সুতরাং খল্সে বলিতেছেন, আমিও যাই! যাও তাহাতে তো দুঃখ নাই, কিন্তু আমাদের চাল যে স্বতন্ত্র! অ্যাংব্যাংয়ের চালে চলিতে চেষ্টা করিলে আমাদের চলিবার সমূহ অসুবিধা হইবে এইটে জানা উচিত!
আমাদের এ সাহিত্য প্রতিধ্বনির রাজ্য হইয়া উঠিতেছে। চারি দিকে একটা আওয়াজ ভোঁ ভোঁ করিতেছে মাত্র, কিন্তু তাহা মানুষের কণ্ঠস্বর নহে, হৃদয়ের কথা নহে, ভাবের ভাষা নহে। কানে তালা লাগিলে যেমন একপ্রকার শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়-- সে শব্দটা ঘূর্ণ্যবায়ুর মতো বন্বন্ করিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে মস্তিষ্কের সমস্ত ভাবগুলিকে ধূলি ও খড়কুটার মতো আস্মানে উড়াইয়া দিয়া মাথার খুলিটার মধ্যে শাঁখ বাজাইতে থাকে; জগতের যথার্থ শব্দগুলি একেবারে চুপ করিয়া যায় ও সেই মিথ্যা শব্দটাই সর্বেসর্বা হইয়া বৃত্রাসুরের মতো সংগীতের স্বর্গরাজ্যে একাধিপত্য করিতে থাকে; মাথা কাঁদিয়া বলে, ইহা অপেক্ষা অরাজকতা ভালো, ইহা অপেক্ষা বধিরতা ভালো-- আমাদের সাহিত্য তেমনি করিয়া কাঁদিয়া বলিতেছে-- শব্দ খুবই হইতেছে কিন্তু এ ভোঁ ভোঁ, এ মাথাঘোরা আর সহ্য হয় না! এই দিগন্ত-বিস্তৃত কোলাহলের মহামরুর মধ্যে, এই বধিরকর শব্দরাজ্যের মহানীরবতার মধ্যে একটা পরিচিত কণ্ঠের একটা কথা যদি শুনিতে পাই, তবে আবার আশ্বাস পাওয়া যায়-- মনে হয়, পৃথিবীতেই আছি বটে, আকার-আয়তনহীন নিতান্ত রসাতলরাজ্যে প্রবেশ করিতেছি না।
আমরা বিশ্বামিত্রের মতো গায়ের জোরে একটা মিথ্যাজগৎ নির্মাণ করিতে চাহিতেছি-- কিন্তু ছাঁচে ঢালিয়া, কুমারের চাকে ফেলিয়া, মস্ত একতাল কাদা লইয়া জগৎ গড়া যায় না! বিশ্বামিত্রের জগৎ ও বিশ্বকর্মার জগৎ দুই স্বতন্ত্র পদার্থ-- বিশ্বকর্মার জগৎ এক অচল অটল নিয়মের মধ্য হইতে উদ্ভিন্ন হইয়া বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহার আর বিনাশ নাই; তাহা রেষারেষি করিয়া, তর্জমা করিয়া, গায়ের জোরে বা খামখেয়াল হইতে উৎপন্ন হয় নাই; এই নিমিত্তই তাহার ভিত্তি অচলপ্রতিষ্ঠ। এই নিমিত্তই এই জগৎকে আমরা এত বিশ্বাস করি-- এই নিমিত্তই এক পা বাড়াইয়া আর-এক পা তুলিবার সময় মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে হয় না পাছে জগৎটা পায়ের কাছ হইতে হুস করিয়া মিলাইয়া যায়! আর বিশ্বামিত্রের ঘরগড়া জগতে যে হতভাগ্য জীবদিগকে বাস করিতে হইত তাহাদের অবস্থা কী ছিল একবার ভাবিয়া দেখো দেখি! তাহারা তপ্ত ঘিয়ে ময়দার চক্র ছাড়িয়া দিয়া ভাবিতে বসিত ইহা হইতে লুচি হইবে কি চিনির শরবত হইবে! এক গাছ ফল দেখিলেও তাহাদের গাছে উঠিয়া পাড়িতে প্রবৃত্তি হইত না, সন্দেহ হইত পাছে হাত বাড়াইলেই ওগুলো পাখি হইয়া উড়িয়া যায়। তাহাদের বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা মিলিয়া তর্ক করিত পায়ে চলিতে হয় কি মাথায় চলিতে হয়; কিছুই মীমাংসা হইত না। প্রতিবার নিশ্বাস লইবার সময় দুটো-তিনটে ডাক্তার ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিতে হইত, নাকে নিশ্বাস লইব কি কানে নিশ্বাস লইব, কেহ বলিত নাকে, কেহ বলিত কানে। অবশেষে একদিন ঠিক দুপুরবেলা যখন সেখানকার অধিবাসীরা ক্ষুধা পাইলে খাইতে হয় কি উপবাস করিতে হয়, এই বিষয়ে তর্ক করিতে করিতে গলদ্ঘর্ম হইয়া উঠিতেছিল, এমন সময়ে হঠাৎ বিশ্বামিত্রের জগৎটা উল্টোপাল্টা, হিজিবিজি, হ-য-ব-র-ল হইয়া, ভাঙিয়া চুরিয়া ফাটিয়া, বোমার মতো আওয়াজ করিয়া, হাউয়ের মতো আকাশে উঠিয়া সবসুদ্ধ কোন্খানে যে মিলাইয়া গেল, আজ পর্যন্ত তাহার ঠিকানাই পাওয়া গেল না! তাহার কারণ আর কিছু নয়-- সৃষ্ট হওয়ায় এবং নির্মিত হওয়ায় অনেক তফাত। বিশ্বামিত্রের জগৎটা যে অন্যায় হইয়াছিল তা বলিবার জো নাই-- তিনি এই জগৎকেই চোখের সুমুখে রাখিয়া এই জগৎ হইতেই মাটি কাটাইয়া লইয়া তাঁহার জগৎকে তাল পাকাইয়া তুলিয়াছিলেন, এই জগতের বেলের খোলার মধ্যে এই জগতের কুলের আঁটি পূরিয়া তাঁহার ফল তৈরি করিয়াছিলেন; অর্থাৎ এই জগতের টুকরো লইয়া খুব শক্ত শিরীষের আঠা দিয়া জুড়িয়াছিলেন সুতরাং দেখিতে কিছু মন্দ হয় নাই। আমাদের এই জগৎকে যেমন নিঃশঙ্কে আকাশে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে, এ আপনার কাজ আপনি করিতেছে, আপনার নিয়মে আপনি বাড়িয়া উঠিতেছে, কোনো বালাই নাই, বিশ্বামিত্রের জগৎ সেরূপ ছিল না; তাহাকে ভারি সন্তর্পণে রাখিতে হইত, রাজর্ষির দিন-রাত্রি তাহাকে তাঁহার কোঁচার কাপড়ে বাঁধিয়া লইয়া বেড়াইতেন, এক দণ্ড ছাড়িয়া থাকিতে পারিতেন না। কিন্তু তবু তো সে রহিল না! তাহার কারণ, সে মিথ্যা! মিথ্যা কেমন করিয়া হইল! এইমাত্র যে বলিলাম, এই জগতের টুকরা লইয়াই সে গঠিত হইয়াছে, তবে সে মিথ্যা হইল কী করিয়া? মিথ্যা নয় তো কী? একটি তালগাছের প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম অংশ বজায় থাকিতে পারে, তাহার ছাল আঁশ কাঠ মজ্জা পাতা ফল শিকড় সমস্তই থাকিতে পারে; কিন্তু যে অমোঘ সজীব নিয়মে তাহার নিজ চেষ্টা ব্যতিরেকেও সে দায়ে পড়িয়া তালগাছ হইয়াই উঠিয়াছে, মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহার তুলসীগাছ হইবার জো নাই, সেই নিয়মটি বাহির করিয়া লইলে সে তালগাছ নিতান্ত ফাঁকি হইয়া পড়ে, তাহার উপরে আর কিছুমাত্র নির্ভর করা যায় না! তাহার উপরে যে লোক নির্ভর করিতে পারে, সে কৃষ্ণনগরের কারিগরের গঠিত মাটির কলা খাইতেও পারে-- কিন্তু সে কলায় শরীর পুষ্টও হয় না, জিহ্বা তুষ্টও হয় না, কেবল নিতান্ত কলা খাওয়াই হয়।
যাহা বলা হইল তাহাতে এই বুঝাইতেছে যে, অংশ লইয়া অনেক লইয়া সত্য নহে, সত্য একের মধ্যে মূল নিয়মের মধ্যে বাস করে। আমাদের সাহিত্যে নবেল থাকিতে পারে, নাটক থাকিতে পারে, মহাকাব্য গীতিকাব্য খণ্ডকাব্য থাকিতে পারে, সাপ্তাহিক পত্র থাকিতে পারে এবং মাসিক পত্রও থাকিতে পারে কিন্তু সেই অমোঘ নিয়ম না থাকিতেও পারে, যাহাতে করিয়া নবেল নাটক পত্রপুষ্পের মতো আপনা-আপনি বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। আমরা একটি গঠিত সাহিত্য দিনরাত্রি চোখের সুমুখে দেখিতে পাইতেছি। আমরা লিখিবার আগেই সমালোচনা পড়িতে পাইয়াছি; আমরা আগেভাগেই অলংকারশাস্ত্র পড়িয়া বসিয়া আছি, তাহার পরে কবিতা লিখিতে শুরু করিয়াছি। সুতরাং ল্যাজায় মুড়ায় একাকার হইয়া সমস্তই বিপর্যয় ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সাহিত্যটা যেরূপ মোটা হইয়া উঠিতেছে তাহাকে দেখিলে সকলেই পুলকিত হইয়া উঠেন। কিন্তু ঐ বিপুল আয়তনের মধ্যে রোগের বীজ বিনাশের কারণ প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। কোন্ দিন সক্কালে উঠিয়াই শুনিব--"সে নাই।' খবরের কাগজে কালো গণ্ডি আঁকিয়া বলিবে "সে নাই'। "কিসে মরিল?' "তাহা জানি না হঠাৎ মরিয়াছে।' বঙ্গসাহিত্য থাকিতে পারে, খাঁটি বাঙালি জন্মিতে পারে, কিন্তু এ সাহিত্য থাকিবে না। যদি থাকে তো কিছু থাকিবে। যাঁহারা খাঁটি হৃদয়ের কথা বলিয়াছেন তাঁহাদের কথা মরিবে না।
সত্য ঘরে না জন্মাইলে সত্যকে "পুষ্যি' করিয়া লইলে ভালো কাজ হয় না। বরঞ্চ সমস্তই সে মাটি করিয়া দেয়। কারণ সেই সত্যকে জিহ্বার উপরে দিনরাত্রি নাচাইয়া নাচাইয়া আদুরে করিয়া তোলা হয়। সে কেবল রসনা-দুলাল হইয়া উঠে। সংসারের কঠিন মাটিতে নামাইয়া তাহার দ্বারা কোনো কাজ পাওয়া যায় না। সে অত্যন্ত খোশ-পোশাকী হয় ও মনে করে আমি সমাজের শোভা মাত্র! এইরূপ কতকগুলো অকর্মণ্য নবাবী সত্য পুষিয়া সমাজকে তাহার খোরাক জোগাইতে হয়। আমাদের দেশের অনেক রাজা-মহারাজা শখ করিয়া এক-একটা ইংরাজ চাকর পুষিয়া থাকেন, কিন্তু তাহাদের দ্বারা কোনো কাজ পাওয়া দূরে থাক্ তাহাদের সেবা করিতে করিতেই প্রাণ বাহির হইয়া যায়! আমরাও তেমনি অনেকগুলি বিলিতি সত্য পুষিয়াছি, তাহাদিগকে কোনো কাজেই লাগাইতে পারিতেছি না, কেবল গদ্যে পদ্যে কাগজে পত্রে তাহাদের অবিশ্রাম সেবাই করিতেছি। ঘোরো সত্য কাজকর্ম করে ও ছিপছিপে থাকে, তাহাদের আয়তন দুটো কথার বেশি হয় না আর নবাবী সত্যগুলো ক্রমিক মোটা হইয়া ওঠে ও অনেকটা করিয়া কাগজ জুড়িয়া বসে-- তাহার সাজ-সজ্জা দেখিলে ভালো মানুষ লোকের ভয় লাগে-- তাহার সর্বাঙ্গে চারি দিকে বড়ো বড়ো নোটগুলো বটগাছের শিকড়ের মতো ঝুলিতেছে-- বড়ো বড়ো ইংরিজির তর্জমা, অর্থাৎ ইংরিজি অপেক্ষা ইংরিজিতর সংস্কৃত, যে সংস্কৃত শব্দের গন্ধ নাকে প্রবেশ করিলে শুচি লোকদিগকে গঙ্গাস্নান করিতে হয়, এমনতরো বৃহদায়তন ম্লেচ্ছ সংস্কৃত ও অসাধু সাধু ভাষা গলগণ্ডের মতো, ফোস্কার মতো, ব্রণর মতো তাহার সর্বাঙ্গে ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে-- তাহারই মধ্যে আবার বন্ধনী-চিহ্নিত ইংরিজি শব্দের উল্কির ছাপ-- ইহার উপরে আবার ভূমিকা উপসংহার পরিশিষ্ট-- পাছে কেহ অবহেলা করে এইজন্য তাহার সঙ্গে সঙ্গে সাত-আটটা করিয়া নকীব তাহার সাতপুরুষের নাম হাঁকিতে হাঁকিতে চলে-- বেকন্, লক্, হব্স্, মিল্, স্পেন্সর, বেন্-- শুনিয়া আমাদের মতো ভীতু লোকের সর্দিগর্মি হয়, পাড়াগেঁয়ে লোকের দাঁতকপাটি লাগে! যাহাই হউক, এই ব্যক্তিটার শাসনেই আমরা চলিতেছি। এমনি হইয়া দাঁড়াইয়াছে, সত্য বিলিতি বুটজুতা পরিয়া না আসিলে তাহাকে ঘরে ঢুকিতে দিই না। এবং সত্যের গায়ে দিশি থান ও পায়ে নাগ্রা জুতো দেখিলে আমাদের পিত্তি জ্বলিয়া ওঠে ও তৎক্ষণাৎ তাহার সহিত তুইতাকারি করিতে আরম্ভ করি! যদি শুনিতে পাই, সংস্কৃতে এমন একটা দ্রব্যের বর্ণনা আছে, যাহাকে টানিয়া-বুনিয়া টেবিল বলা যাইতে পারে বা রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের বিশেষ একটা জায়গায় কাঁটাচামচের সংস্কৃত প্রতিশব্দ পাওয়া গিয়াছে। বা বারুণী ব্র্যান্ডির, সুরা শেরীর, মদিরা ম্যাডেরার, বীর বিয়ারের অবিকল ভাষান্তর মাত্র-- তবে আর আমাদের আশ্চর্যের সীমা-পরিসীমা থাকে না-- তখনই সহসা চৈতন্য হয় তবে তো আমরা সভ্য ছিলাম! যদি প্রমাণ করিতে পারি, বিমানটা আর কিছুই নয়, অবিকল এখানকার বেলুন, এবং শতঘ্নীটা কামান ছাড়া আর কিছু হইতেই পারে না, তাহা হইলেই ঋষিগুলোর উপর আবার কথঞ্চিৎ শ্রদ্ধা হয়! এ-সকল তো নিতান্ত অপদার্থের লক্ষণ! সকলেই বলিতেছেন, এইরূপ শিক্ষা, এইরূপ চর্চা হইতে আমরা বিস্তর ফল লাভ করিতেছি। ঠিক কথা, কিন্তু সে ফলগুলো কী রকমের? গজভুক্তকপিত্থবৎ!
ইহার ফল কি এখনি দেখা যাইতেছে না! আমরা প্রতিদিনই কি মনুষ্যত্বের যথার্থ গাম্ভীর্য হারাইতেছি না। এক প্রকার বিলিতি পুতুল আছে তাহার পেট টিপিলেই সে মাথা নাড়িয়া ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করিয়া খঞ্জনী বাজাইতে থাকে, আমরাও অনবরত সেইরূপ ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দও করিতেছি, মাথা নাড়িয়া খঞ্জনীও বাজাইতেছি, কিন্তু গাম্ভীর্য কোথায়। মানুষের মতো দেখিতে হয় কই যে, বাহিরের পাঁচ জন লোক দেখিয়া শ্রদ্ধা করিবে! আমরা জগতের সম্মুখে পুৎলোবাজি আরম্ভ করিয়াছি, খুব ধড়ফড় ছটফট করিতেছি ও গগনভেদী তীক্ষ্ণ উচ্চস্বরে কথোপকথন আরম্ভ করিয়াছি। সাহেবরা কখনো হাসিতেছেন, কখনো হাততালি দিতেছেন, আমাদের নাচনী ততই বাড়িতেছে, গলা ততই উঠিতেছে! ভুলিয়া যাইতেছি এ কেবল অভিনয় হইতেছে মাত্র-- ভুলিয়া যাইতেছি যে, জগৎ একটা নাট্যশালা নহে, অভিনয় করাও যা কাজ করাও তা একই কথা নহে। পুতুল নাচ যদি করিতে চাও, তবে তাহাই করো-- আর কিছু করিতেছি মনে করিয়া বুক ফুলাইয়া বেড়াইয়ো না; মনে করিয়ো না যেন সংসারের যথার্থ গুরুতর কার্যগুলি এইরূপ অতি সহজে অবহেলে ও অতি নিরুপদ্রবে সম্পন্ন করিয়া ফেলিতেছে; মনে করিয়ো না অন্যান্য জাতিরা শত শত বৎসর বিপ্লব করিয়া প্রাণপণ করিয়া, রক্তপাত করিয়া যাহা করিয়াছেন আমরা অতিশয় চালাক জাতি কেবলমাত্র ফাঁকি দিয়া তাহা সারিয়া লইতেছি-- জগৎসুদ্ধ লোকের একেবারে তাক লাগিয়া গিয়াছে। আমাদের এই প্রকার চটুলতা অত্যন্ত বিস্ময়জনক সন্দেহ নাই-- কিন্তু ইহা হইতেই কি প্রমাণ হইতেছে না আমরা ভারি হাল্কা! এ প্রকার ফড়িংবৃত্তি করিয়া জাতিত্বের অতি দুর্গম উন্নতিশিখরে উঠা যায় না এবং এই প্রকার ঝিঁঝিপোকার মতো চেঁচাইয়া কাল নিশীথের গভীর নিদ্রাভঙ্গ করানো অসম্ভব ব্যাপার। অত্যন্ত অভদ্র, অনুদার, সংকীর্ণ গর্বস্ফীত ভাবের প্রাদুর্ভাব কেন হইতেছে! লেখায় কুরুচি, ব্যবহারে বর্বরতা, সহৃদয়তার আত্যন্তিক অভাব কেন দেখা যাইতেছে! কেন পূজ্য ব্যক্তিকে ইহারা ভক্তি করে না, গুণে সম্মান করে না, সকলই উড়াইয়া দিতে চায়। মনুষ্যত্বের প্রতি ইহাদের বিশ্বাস নাই কেন? যখনি কোনো বড়ো লোকের নাম করা যায়, তখনি সমাজের নিতান্ত বাজে লোকেরা রাম শ্যাম কার্তিকেরাও কেন বলে, হাঁঃ, অমুক লোকটা হম্বগ, অমুক লোকটা ফাঁকি দিয়া নাম করিয়া লইয়াছে, অমুক লোকটা আর-এক জনকে দিয়া লিখাইয়া লয়, অমুক লোকটা লোকের কাছে খ্যাত বটে, কিন্তু খ্যাতির যোগ্য নহে। ইহারা প্রাণ খুলিয়া ভক্তি করিতে জানে না, ভক্তি করিতে চাহে না, ভক্তিভাজন লোকদিগকে হুট করিতে পারিলেই আপনাদিগকে মস্ত লোক মনে করে, এবং যখন ভক্তি করা আবশ্যক বিবেচনা করে তখন সে কেবল ইংরাজি দস্তুর বলিয়া সভ্যজাতির অনুমোদিত বলিয়া করে, মনে করে দেখিতে বড়ো ভালো হইল! এত অবিশ্বাস কেন, এত অনাদর কেন, এত স্পর্ধা কেন-- অভদ্রতা এত ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে কেন, ছেলেপিলেগুলো দিনরাত্রি এত রুখিয়া আছে কেন, দাম্ভিক ভীরুদিগের ন্যায় অকারণ গায়ে পড়া রূঢ় ব্যবহার ও আড়ম্বরপূর্ণ আস্ফালনের সামান্য অবসর পাইলেই আপনাদিগকে মহাবীর বলিয়া মনে করিতেছে কেন; এই-সকল হঠাৎসভ্য হঠাৎবীরগণ বুকে চাদর বাঁধিয়া মালকোঁচা মারিয়া হাতের আস্তিন গুটাইয়া তোপের বদলে তুড়ি দিয়া ফুঁ দিয়া বিশ্বসংসার উড়াইয়া দিবার সংকল্প করিয়াছেন কেন? তাহার একমাত্র কারণ, ভানের প্রাদুর্ভাব হইয়াছে বলিয়া-- কিছুরই 'পরে যথার্থ শ্রদ্ধা নাই, কিছুরই যে যথার্থ মূল্য আছে তাহা কেহ মনে করে না, সকলই মুখের কথা, আস্ফালনের বিষয় ও মাদকতার সহায় মাত্র। সেইজন্যই সকলেই দেখিতেছেন, আজকাল কেমন একরকম ছিবলেমির প্রাদুর্ভাব হইয়াছে! জগৎ যেন একটা তামশা হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং আমরা কেবল যেন মজা দেখিতেই আসিয়াছি। খুব মিটিং করিতেছি, খুব কথা কহিতেছি, আজ এখানে যাইতেছি, কাল ওখানে যাইতেছি, ভারি মজা হইতেছে। আতসবাজি দেখিলে ছেলেরা যেমন আনন্দে একেবারে অধীর হইয়া উঠে, এক-একজন লোক বক্তৃতা দেয় আর ইহাদের ঠিক তেমনিতরো আনন্দ হইতে থাকে, হাত-পা নাড়িয়া চেঁচাইয়া, করতালি দিয়া আহ্লাদ আর রাখিতে পারে না; বক্তাও উৎসাহ পাইয়া আর কিছুই করেন না, কেবলই মুখ-গহ্বর হইতে তুব্ড়িবাজি ছাড়িতে থাকেন, উপস্থিত ব্যক্তিদিগের আর কোনো উপকার না হউক অত্যন্ত মজা বোধ হয়! মজার বেশি হইলেই অন্ধকার দেখিতে হয়, মজার কম হইলেই মন টেঁকে না, যেমন করিয়া হউক মজাটুকু চাই-ই। যতই গম্ভীর হউক ও যতই পবিত্র হউক-না কেন, জীবনের সমুদয় অনুষ্ঠানই একটা মিটিং, গোটাকতক হাততালি ও খবরের কাগজের প্রেরিত পত্রে পরিণত করিতে হইবে-- নহিলে মজা হইল না! গম্ভীরভাবে অপ্রতিহত প্রভাবে আপনার কাজ আপনি করিব, আপনার উদ্দেশ্যের মহত্ত্বে আপনি পরিপূর্ণ হইয়া তাহারই সাধনায় অবিশ্রাম নিযুক্ত থাকিব, সুদূর লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া দক্ষিণে বামে কোনো দিকে দৃক্পাতমাত্র না করিয়া সিধা রাস্তা ধরিয়া চলিব; চটক লাগাইতে করতালি জাগাইতে চেঁচাইয়া ভূত ভাগাইতে নিতান্তই ঘৃণা বোধ করিব, কোথাকার কোন্ গোরা কী বলে না-বলে তাহার প্রতি কিছুমাত্র মনোযোগ করিব না এমন ভাব আমাদের মধ্যে কোথায়! কেবলই হৈ হৈ করিয়া বেড়াইব ও মনে করিব কী-যেন একটা হইতেছে! মনে করিতেছি, ঠিক এইরকম বিলাতে হইয়া থাকে, ঠিক এইরকম পার্লামেন্টে হয়, এবং আমাদের এই আওয়াজের চোটে গবর্মেন্টের তক্তপোশের নীচে ভূমিকম্প হইতেছে। আমরা গবর্মেন্টের কাছে ভিক্ষা করিতেছি, অথচ সেইসঙ্গে ভান করিতেছি যেন বড়ো বীরত্ব করিতেছি; সুতরাং চোখ রাঙাইয়া ভিক্ষা করি ও ঘরে আসিয়া ভাত খাইতে খাইতে মনে করি হ্যাম্প্ডেন ও ক্রমোয়েলগণ ঠিক এইরূপ করিয়াছিলেন; আহারটা বেশ তৃপ্তিপূর্বক হয়। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, চোখ-রাঙানি ও বুক-ফুলানির যতই ভান কর-না-কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ভিক্ষাবৃত্তিকে আমাদের উন্নতির একমাত্র বা প্রধানতম উপায় বলিয়া গণ্য করিব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের যথার্থ উন্নতি ও স্থায়ী মঙ্গল কখনোই হইবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অলক্ষ্য ও অদৃশ্যভাবে পিছনের দিকেই অগ্রসর হইতে থাকিব। গবর্মেন্ট যতই আমাদিগকে এক-একটি করিয়া অধিকার ও প্রসাদ দান করিতেছেন, ততই দৃশ্যত লাভ হইতেছে বটে, কিন্তু অদৃশ্যে যে লোকসানটা হইতেছে তাহার হিসাব রাখে কে? ততই যে গবর্মেন্টের উপর নির্ভর বাড়িতেছে। ততই যে ঊর্ধ্ব কণ্ঠে বলিতেছি, "জয় ভিক্ষাবৃত্তির জয়'-- ততই যে আমাদের প্রকৃত জাতিগত ভাবের অবনতি হইতেছে। বিশ্বাস হইতেছে চাহিলেই পাওয়া যায়, জাতির যথার্থ উদ্যম বেকার হইয়া পড়িতেছে, কণ্ঠস্বরটাই কেবল অহংকারে ফুলিয়া উঠিতেছে ও হাত-পাগুলো পক্ষাঘাতে জীর্ণ হইতেছে। গবর্মেন্ট যে মাঝে মাঝে আমাদের আশাভঙ্গ করিয়া দেন, আমাদের প্রার্থনা বিফল করিয়া দেন, তাহাতে আমাদের মহৎ উপকার হয়, আমাদের সহসা চৈতন্য হয় যে, পরের উপরে যতখানা নির্ভর করে ততখানাই অস্থির, এবং নিজের উপর যতটুকু নির্ভর করে, ততটুকুই ধ্রুব! এ সময়ে, এই লঘুচিত্ততার নাট্যোৎসবের সময়ে আমাদিগকে যথার্থ মনুষ্যত্ব ও পৌরুষ শিখাইবে কে? অতিশয় সহজসাধ্য ভান দেশহিতৈষিতা হইতে ফিরাইয়া লইয়া যথার্থ গুরুতর কঠোর কর্তব্য সাধনে কে প্রবৃত্ত করাইবে! সাহেবদিগের বাহবাধ্বনির ঘোরতর কুহক হইতে কে মুক্ত করিবে! সে কি এই ভান সাহিত্য! এই ফাঁকা আওয়াজ! সকলেই একতানে ওই একই কথা বলিতেছ কেন? সকলেই একবাক্যে কেন বলিতেছ ভিক্ষা চাও, ভিক্ষা চাও! কেহ কি হৃদয়ের কথা বলিতে জানে না! কেবলই কি প্রতিধ্বনির প্রতিধ্বনি উঠাইতে হইবে! যতবড়ো গুরুতর কথাই হউক-না-কেন, দেশের যতই হিত বা অহিতের কারণ হউক-না-কেন, কথাটা লইয়া কি কেবল একটা রবরের গোলার মতো মুখে মুখে লোফালুফি করিয়া বেড়াইতে হইবে! এ কি কেবল খেলা! এ কি তামাশা, আর কিছুই নয়! হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিবার নাই, বিবেচনা করিবার নাই-- গুলিডাণ্ডা খেলানো ছাড়া তাহার আর কোনো ফলাফল নাই! যথার্থ হৃদয়বান লোক যদি থাকেন, তাঁহারা একবার একবাক্যে বলুন-- যে, যথার্থ কর্তব্য কার্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়া পরের মুখাপেক্ষা না করিয়া পরের প্রশংসাপেক্ষা না করিয়া গম্ভীরভাবে আমরা নিজের কাজ নিজে করিব, সবই যে ফাঁকি, সবই যে তামাশা, সবই যে কণ্ঠস্থ, তাহা নয়-- কর্তব্য যতই সামান্য হউক-না-কেন, তাহার গাম্ভীর্য আছে, তাহার মহিমা আছে, তাহার সহিত ছেলেখেলা করিতে গেলে তাহা অতিশয় অমঙ্গলের নিদান হইয়া উঠে। Agitation করিতে হয় তো করো, কিন্তু দেশের লোকের কাছে করো-- দেশের লোককে তাহাদের ঠিক অবস্থাটি বুঝাইয়া দাও-- বলো যে, গবর্মেন্ট যাহা করিবার তাহা করিতেছেন, কেবল তোমরাই কিছু করিতেছ না! তোমরা শিক্ষা লাভ করো, শিক্ষা দান করো, অবস্থার উন্নতি করো। দেশের যাহা-কিছু অবনতি তাহা তোমাদেরই দোষে, গবর্মেন্টের দোষে নহে। এ কথা বলিবামাত্রই চারি দিকের খুচরা কাগজেপত্রে বড্ড গোলমাল উঠিবে-- তাহারা বলিবে এ কী কথা! ইংলন্ডে তো এরূপ হয় না, Political Agitation বলিতে তো এমন বুঝায় না, Mazzini তো এমন কথা বলেন নাই; Garibaldi যে আর-এক রকম কথা বলিয়াছেন-- Washington-এর কথার সহিত এ কথাটার ঐক্য হইতেছে না, যদি একটা কাজ করিতেই হইল তবে ঠিক পার্ল্যামেন্টের অনুসারে করাই ভালো ইত্যাদি। উহারাও আবার যদি কথা কহিতে আসে তো কহুক-না, উহাদের মাথা চাষ করিলে বালি ওঠে, আবাদ করিলে কচুও হয় না, অতএব বাঁধি বোলের মহাজনী না করিলে উহাদের গুজরান চলে না! কিন্তু হৃদয়ের কথা সমস্ত কোলাহল অতিক্রম করিয়া কানের মধ্যে গিয়া পৌঁছাইবেই ইহা নিশ্চয়ই!
সেদিন কথোপকথনকালে একজন শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তি বলিতেছিলেন যে, রোমকেরা যখন প্রাচীন ইংলন্ডের অকালসভ্য শেল্টদিগকে ফেলিয়া আসিয়াছিল, তখন তাহারা ইংলন্ডেই পড়িয়াছিল, কিন্তু ইংরাজ যদি কখনো ভারতবর্ষ হইতে চলিয়া যায়, তবে জাহাজে গিয়া দেখিবে বাঙালিরা আগেভাগে গিয়া কাপ্তেন নোয়া সাহেবের পা-দুটি ধরিয়া জাহাজের খোলের মধ্যে চাদর মুড়ি দিয়া গুটিসুটি মারিয়া বসিয়া আছে! আর কেহ যাক না-যাক-- আধুনিক বাংলা সাহিত্যটা তো যাইবেই! কারণ ইংরাজি সাহিত্যের গ্যাসলাইট ব্যতীত এ সাহিত্য পড়া যায় না, হৃদয়ের আলোক এখানে কোনো কাজেই লাগিবে না, কারণ, ইহা হৃদয়ের সাহিত্য নহে। আমরা বাংলা পড়ি বটে কিন্তু ইংরাজির সহিত মিলাইয়া পড়ি-- ইংরাজি চলিয়া গেলে এ বাংলা রাশীকৃত কতকগুলো কালো কালো আঁচড়ে পরিণত হইবে মাত্র! সুতরাং সেই হীনাবস্থা হইতে পরিত্রাণ পাইবার জন্য এ যে আগেভাগে জাহাজে গিয়া চড়িয়া বসিবে তাহার কোনো ভুল নাই-- সেখানে গিয়া বাবুর্চিখানার উনুন জ্বালাইবে বটে, কিন্তু তবুও থাকিবে ভালো!
অকাল কুষ্মাণ্ড কাহাকে বলে জানি না, কিন্তু এরূপ সাহিত্যকে কি বলা যায় না!
একটা আশার কথা আছে; এ সাহিত্য চিরদিন থাকিবার নহে। এ সাহিত্য নিজের রোগ নিজে লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এ নিজের বিনাশ নিজে সাধন করিবে-- কেবল দুঃখ এই যে, মরিবার পূর্বে বিস্তর হানি করিয়া তবে মরিবে; অতএব এ পাপ যত শীঘ্র বিদায় হয় ততই ভালো। প্রভাত হইবে কবে, নিশাচরের মতো অন্ধকারে কতকগুলা মশাল জ্বালাইয়া তারস্বরে উৎকট উৎসবে না মাতিয়া, নিশীথের গুহার মধ্যে দল বাঁধিয়া বিশৃঙ্খল অস্বাভাবিক উন্মত্ততা না করিয়া কবে পরিষ্কার দিনের আলোতে বিমল-হৃদয়ে আগ্রহের সহিত, সকলে মিলিয়া নূতন উৎসাহে, স্বাস্থ্যের উল্লাসে, সংসারের যথার্থ কাজগুলি সমাধা করিতে আরম্ভ করিব! সেই দিন প্রভাতে বাঙালির যথার্থ হৃদয়ের সাহিত্য জাগিয়া উঠিবে, অলসদিগকে ঘুম হইতে জাগাইয়া তুলিবে, নিরাশ-হৃদয়েরা পাখির গান শুনিয়া প্রভাতের সমীরণ স্পর্শ করিয়া ও নবজীবনের উৎসব দেখিয়া নূতন প্রাণ লাভ করিবে অর্থাৎ বাংলা দেশ হইতে নিদ্রার রাজত্ব, প্রেতের উৎসব, অস্বাস্থ্যের গুপ্ত সঞ্চরণ একেবারে দূর হইয়া যাইবে। জানি না সে কোন্ শক কোন্ সাল, সেই বৎসরই সাবিত্রী লাইব্রেরির যথার্থ গৌরবের সাংবৎসরিক উৎসব হইবে, সেদিনকার লোক সমাগম, সেদিনকার উৎসাহ, সেদিনকার প্রতিভার দীপ্তি ও কেবলমাত্র বহিস্থিত দর্শকদের জড় কৌতূহলের ভাব নহে যথার্থ প্রাণে প্রাণে মিলন কল্পনাচক্ষে অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখা যাইতেছে!