বসন্তরায়
Others
কেহ কেহ অনুমান করেন, বসন্তরায় আর বিদ্যাপতি একই ব্যক্তি। এই মতের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক প্রমাণ কিছু আছে কি না জানি না, কিন্তু উভয়ের লেখা পড়িয়া দেখিলে উভয়কে স্বতন্ত্র কবি বলিয়া আর সংশয় থাকে না। প্রথমত, উভয়ের ভাষায় অনেক তফাৎ। বিদ্যাপতির লেখায়--ব্রজভাষায় বাঙ্গালা মেশানো, আর রায়বসন্তের লেখায় -- বাঙ্গালায় ব্রজভাষা মেশানো। ভাবে বোধ হয়, যেন ব্রজভাষা আমাদের প্রাচীন কবিদের কবিতার আফিসের বস্ত্র ছিল। শ্যামের বিষয় বর্ণনা করিতে হইলেই অমনি সে আটপৌরে ধুতি চাদর ছাড়িয়া বৃন্দাবনী চাপকানে বত্রিশটা বোতাম আঁটিত ও বৃন্দাবনী শাম্লী মাথায় চড়াইয়া একটা বোঝা বহিয়া বেড়াইত। রায়বসন্ত প্রায় ইহা বরদাস্ত করিতে পারিতেন না। তিনি খানিকক্ষণ বৃন্দাবনী পোষাক পরিয়াই অমনি -- "দূর করো " বলিয়া ফেলিতেন! বসন্তরায়ের কবিতার ভাষাও যেমন কবিতার ভাবও তেমন। সাদাসিধা, উপমার ঘনঘটা নাই, সরল প্রাণের সরল কথা-- সে কথা বিদেশী ভাষায় প্রকাশ করিতে যাওয়াই মিথ্যা। কারণ, সরল প্রাণ বিদেশী ভাষায় কথা কহিতে পারেই না; তাহার ছোট ছোট সুকুমার কথাগুলি, তাহার সূক্ষ্ম স্পর্শকাতর ভাবগুলি বিদেশী ভাষার গোলেমালে একেবারে চুপ করিয়া যায়, বিদেশী ভাষার জটিলতার মধ্যে আপনাদের হারাইয়া ফেলে। তখন আমরা ভাষাই শুনিতে পাই, উপমাই শুনিতে পাই, সে সুকুমার ভাবগুলির প্রাণ-ছোঁওয়া কথা আর শুনিতে পাই না। এমন মানুষ ত সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় যাহাদের দেখিলে মনে হয়-- মানুষটা পোষাক পরে নাই, পোষাকটাই মানুষ পরিয়া বসিয়াছে। পোষাককে এমনি সে সমীহ করিয়া চলে যে, তাহাকে দেখিলে মনে হয়, আপনাকে সে পোষাক ঝুলাইয়া রাখিবার আল্না মাত্র মনে করে, পোষাকের দামেই তাহার দাম। আমার ত বোধ হয়, অনেক স্ত্রীলোকের অলঙ্কার ঘোমটার চেয়ে অধিক কাজ করে, তাহার হীরার সিঁথিটার দিকে লোকে এতক্ষণ চাহিয়া থাকে যে তাহার মুখ দেখিবার আর অবসর থাকে না। কবিতারও সেই দশা আমরা প্রায় মাঝে মাঝে দেখিতে পাই। বিদ্যাপতির সহিত চণ্ডিদাসের তুলনা করিলেই টের পাওয়া যাইবে যে, বিদ্যাপতি অপেক্ষা চণ্ডিদাস কত সহজে সরল ভাব প্রকাশ করিয়াছেন। আবার বিদ্যাপতির সহিত বসন্তরায়ের তুলনা করিলেও দেখা যায়, বিদ্যাপতির অপেক্ষা বসন্ত-রায়ের ভাষা ও ভাব কত সরল। বসন্তরায়ের কবিতায় প্রায় কোনখানেই টানাবোনা তুলনা নাই, তাহার মধ্যে কেবল সহজ কথার যাদুগিরি আছে। যাদুগিরি নহে ত কি? কিছুই বুঝিতে পারি না, এ গান শুনিয়া প্রাণের মধ্যে কেন এমন মোহ উপস্থিত হইল,-- কথাগুলিও ত খুব পরিষ্কার, ভাবগুলিও ত খুব সোজা, তবে উহার মধ্যে এমন কি আছে যাহাতে আমার প্রাণে এতটা আনন্দ, এতটা সৌন্দর্য্য আনিয়া দেয়? এইখানে দুই-একটি উদাহরণ দেওয়া যাক্। প্রথমে বিদ্যাপতির রাধা, শ্যামের রূপ কিরূপে বর্ণনা করিতেছেন তাহা উদ্ধৃত করিয়া দিই --
আর বসন্তরায়ের রাধা শ্যমকে দেখিয়া কি বলিতেছেন? --
এ সখি কি দেখিনু এক অপরূপ,
শুনাইতে মানবি স্বপনস্বরূপ।
কমলযুগল-'পর চাঁদকি মাল,
তা 'পর উপজল তরুণ তমাল।
তা 'পর বেড়ল বিজুরীলতা,
কালিন্দী তীর ধীর চলি যাতা।
শাখাশিখর সুধাকরপাঁতি,
তাহে নবপল্লব অরুণক ভাতি।
বিমল বিম্বফলযুগল বিকাশ,
তা 'পর কির থির করু বাস।
তা 'পর চঞ্চল খঞ্জনযোড়,
তা 'পর সাপিনী ঝাঁপল মোড়।
সজনি, কি হেরনু ও মুখশোভা!
অতুল কমল সৌরভ শীতল
অরুণনয়ন অলি-আভা।
প্রফুল্লিত ইন্দীবর বর সুন্দর
মুকুরকান্তি মনোৎসাহা।
রূপ বরণিব কত ভাবিতে থকিত চিত,
কিয়ে নিরমল শশিশোহা।
বরিহা বকুল ফুল অলিকুল আকুল,
চূড়া হেরি জুড়ায় পরাণ!
অধর বান্ধুলী ফুল শ্রুতি মণিকুণ্ডল
প্রিয় অবতংস বনান।
হাসিখানি তাহে ভায়, অপাঙ্গ-ইঙ্গিতে চায়,
বিদগধ মোহন রায়।
মুরলীতে কিবা গায় শুনি আন নাহি ভায়,
জাতি কুলশীল দিনু তায়।
না দেখিলে প্রাণ কাঁদে দেখিলে না হিয়া বাঁধে,
অনুখন মদনতরঙ্গ।
হেরইতে চাঁদ মুখ মরমে পরম সুখ,
সুন্দর শ্যামর অঙ্গ।
চরণে নূপুরমণি সুমধুর ধ্বনি শুনি
ধরণীকে ধৈরজ ভঙ্গ।
ও রূপসাগরে রস- হিলোলে নয়ন মন
আটকল রায় বসন্ত।
গেলি কামিনী গজবরগামিনী
বিহসি পালটি নেহারি।
ইন্দ্রজালক কুসুমসায়ক
কুহকী ভেল বরনারী।
জোরি ভুজযুগ মোড় বেড়ল,
ততহি বয়ান সুছন্দ।
দামচম্পকে কামপূজল
যৈছে সারদচন্দ।
উরহি অঞ্চল ঝাঁপি চঞ্চল,
আধ পয়োধর হেরু।
পবন-পরভাবে শরদঘন জনু
বেকত কয়েল সুমেরু।
পুনহি দরশনে জীবন জুড়ায়ব,
টুটব বিরহ কওর।
চরণযাবক হৃদয়পাবক
দহই সব অঙ্গ মোর।
সই লো কি মোহন রূপ সুঠাম,
হেরইতে মানিনী তেজই মান।
উজর নীলমণি মরকতছবি জিনি
দলিতাঞ্জন হেন ভাল।
জিনিয়া যমুনার জল নিরমল ঢলঢল
দরপণ নবীন রসাল।
কিয়ে নবনীল নলিনী, কিয়ে উতপল
জলধর নহত সমান।
কমনীয়া কিশোর কুসুম অতি সুকোমল
কেবল রসনিরমাণ।
অমল শশধর জিনি মুখ সুন্দর
সুরঙ্গ অধর পরকাশ।
ঈষৎ মধুর হাস সরসহি সম্ভাষ
রায়বসন্ত-পহু রঙ্গিণী বিলাস।
বড় অপরূপ দেখিনু সজনি
নয়লি কুঞ্জের মাঝে,
ইন্দ্রনীল মণি কেতকে জড়িত
হিয়ার উপরে সাজে।
কুসুমশয়ানে মিলিত নয়ানে
উলসিত অরবিন্দ,
শ্যামসোহাগিনী কোরে ঘুমায়লি
চাঁদের উপরে চন্দ।
কুঞ্জ কুসুমিত সুধাকরে রঞ্জিত
তাহে পিককুল গান --
মরমে মদনবাণ দুঁহে অগেয়ান,
কি বিধি কৈল নিরমাণ।
মন্দ মলয়জ পবন বহে মৃদু
ও সুখ কো করু অন্ত।
সরবস-ধন দোঁহার দুঁহু জন,
কহয়ে রায় বসন্ত।
কমনীয়া কিশোর কুসুম অতি সুকোমল
কেবল রসনিরমাণ
আলো ধনি, সুন্দরি, কি আর বলবি?
তোমা না দেখিয়া আমি কেমনে রহিব?
তোমার মিলন মোর পুণ্যপুঞ্জরাশি,
মরমে লাগিছে মধুর মৃদু হাসি!
আনন্দমন্দির তুমি, জ্ঞান শকতি,
বাঞ্ছাকল্পলতা মোর কামনামূরতি।
সঙ্গের সঙ্গিনী তুমি সুখময় ঠাম।
পাসরিব কেমনে জীবনে রাধা নাম।
গলে বনমালা তুমি, মোর কলেবর।
রায় বসন্ত কহে প্রাণের গুরুতর।
প্রাণনাথ, কেমন করিব আমি?
তোমা বিনে মন করে উচাটন
কে জানে কেমন তুমি।
না দেখি নয়ন ঝরে অনুক্ষণ,
দেখিতে তোমায় দেখি।
সোঙরণে মন মুরছিত-হেন,
মুদিয়া রহিয়ে আঁখি।
শ্রবণে শুনিয়ে তোমার চরিত,
আন না ভাবিয়ে মনে।
নিমিষের আধ পাশরিতে নারি,
ঘুমালে দেখি স্বপনে!
জাগিলে চেতন হারাই যে আমি
তোমা নাম করি কাঁদি।
পরবোধ দেই এ রায়-বসন্ত,
তিলেক থির নাহি বাঁধি।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু
তবু হিয়ে জুড়ন না গেল!
ওহে নাথ, কিছুই না জানি,
তোমাতে মগন মন দিবস রজনী।
জাগিতে ঘুমিতে চিতে তোমাকেই দেখি,
পরাণপুতলী তুমি জীবনের সখি!
অঙ্গ-আভরণ তুমি শ্রবণরঞ্জন,
বদনে বচন তুমি নয়নে অঞ্জন!
নিমিখে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি,
রায় বসন্ত কহে পহু প্রেমরাশি!
আরো দেখুন