এক-চোখো সংস্কার (ek chokho sangskar)
সংস্করণের অর্থ স্বাধীনতা-উপার্জ্জন। বাল্যাবস্থায় সমাজের শত সহস্র বন্ধন থাকে, শত সহস্র অনুশাসনে তাহাকে সংযত করিয়া রাখিতে হয়। সে সময়ে তাহার দিগ্বিদিক্জ্ঞানশূন্য স্ফূর্ত্তিকে দমন করিয়া রাখাই তাহার কল্যাণের হেতু। অবশেষে সে যখন বড় হইতে থাকে তখন একে একে সে এক একটি বন্ধন ছিঁড়িয়া ফেলিতে চায়, শাস্ত্রের এক একটি কঠোর আদেশ কণ্ঠ হইতে অবতারণ করিতে চায়, লোকাচারের এক একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীরের তলে তলে গোপনে ছিদ্র করিয়া দেয় ও অবশেষে একদিন প্রকাশ্যে বারুদ লাগাইয়া সমস্তটা উড়াইয়া দেয়। ইহাকেই বলে সংস্করণ। তাই বলিতেছি সংস্করণের নাম স্বাধীনতার প্রয়াস। গুটিপোকা যখন প্রজাপতি হইয়া তাহার রেশমের কারাগার ভাঙ্গিয়া ফেলে, তখন সে সংস্কার করে। মাকড়সা যখন আপনার রচিত জালে জড়াইয়া পড়িয়া মুক্ত হইবার জন্য যুঝিতে থাকে তখন সে একজন সংস্কারক। দুর্ভাগ্যক্রমে মনুষ্যসমাজ-সংস্কার সাপের খোলোষ ছাড়ার মত একটা সহজ ব্যাপার নহে। খোলোষের প্রতি এত মায়া মনুষ্যসমাজ ব্যতীত আর কাহারো নাই।
সন্তানকে শাসন করা, সন্তানকে পালন করা তাহার শিশু-অবস্থার উপযোগী; কিন্তু সে অবস্থা অতীত হইলেও অনেক পিতা মাতা তাহাদিগকে শাসন করেন, তাহাদিগকে বলপূর্ব্বক পালন করেন, তাহাদিগকে যথোপযোগী স্বাধীনতা দেন না। সন্তানের বর্ষে বর্ষে পরিবর্ত্তন আছে, অথচ পিতা মাতার কর্ত্তব্যের পরিবর্ত্তন নাই। ইহার ফল হয় এই যে, একদিন সহসা তাঁহারা দেখিলেন -- সন্তান তাঁহাদের একটি আদেশ শুনিল না, মাঝে মাঝে এক একটা বিষয়ে তাঁহাদের অবাধ্যতা করিতে লাগিল। তাঁহাদের কখন এরূপ অভ্যাস ছিল না; বরাবর তাঁহাদের আদেশ পালিত হইয়া আসিতেছে, আজ সহসা তাহার অন্যথা দেখিয়া তাঁহাদের গায়ে সহ্য হয় না। উভয় পক্ষে একটা সংঘর্ষ বাধিয়া যায়। ইহাকেই বলে বিপ্লব। অবশেষে একে একে সে পিতা মাতার একটি একটি শাসন হইতে আপনাকে মুক্ত করিতে থাকে, তাহার স্বাধীনতার সীমা পদে পদে বৃদ্ধি করিতে থাকে ও অবশেষে স্বাতন্ত্র্য লাভ করে -- ইহাকেই বলে সংস্কার। বৃদ্ধ লোকেরা আক্ষেপ করিতে থাকেন যে, সন্তানদের অবনতি হইল; স্বাধীনতাই লাভ করুক, আর আত্মনির্ভরই শিখুক, আর আলস্যই পরিহার করুক, যখন গুরুজনের অবাধ্য হইল তখন আর তাহাদের শ্রেয়ঃ কোথায়? অবাধ্য না হইলেই ভাল ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু সংসারে যদি কোন মঙ্গল না যুঝিয়া না পাওয়া যায়, সকলি যদি কাড়িয়া লইতে হয়, কিছুই যদি চাহিয়া না পাওয়া যায়, তাহা হইলে অবাধ্য না হইয়া আর গতি কোথায়?
উপরের কথাটা আর একটু বিস্তৃত করিয়া বলা আবশ্যক। পৃথিবীতে কিছুই সর্ব্বতোভাবে পাওয়া যায় না। সাধারণতঃ বলিতে গেলে অধীনতা মাত্রই অশুভ, স্বাধীনতা মাত্রই শুভ। মানুষের প্রাণপণ চেষ্টা -- যাহাতে যথাসম্ভব স্বাধীনতা পায়। কিন্তু মনুষ্যের পক্ষে পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া অসম্ভব। পৃথিবীতে যথাসম্ভব স্বাধীনতা পাইতে গেলেই নিজেকে অধীন করিতে হয়। দুর্ব্বলপদ বৃদ্ধ স্বাধীন ভাবে বিচরণ করিতে ইচ্ছা করিলে যষ্টির অধীনতা স্বীকার করেন। তেমনি রাজার (Government) অধীনে না থাকিলে প্রজার স্বাধীনতা রক্ষা হয় না, আবার প্রজার অধীনে না থাকিলে রাজাও অধিক দিন স্বাধীনতা রাখিতে পারেন না। আমরা যথাসম্ভব স্বাধীন হইবার অভিপ্রায়ে সমাজের শত সহস্র নিয়মের অধীনতা স্বীকার করি। যে ব্যক্তি সমাজের প্রত্যেক নিয়ম দাসভাবে পালন করে, আমরা তাহাকে প্রশংসা করি; যে তাহার একটি নিয়ম উচ্ছেদ করে, আমরা তাহাকে উচ্ছেদ করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হই। এইরূপে অধীনতাকে আমরা পূজা করি এবং সাধারণ লোকে মনে করে যে -- অধীনতা পূজনীয় কেননা সে অধীনতা; রাজার প্রতি অন্ধনির্ভর পূজনীয়, কেননা তাহা রাজভক্তি; সমাজের নিয়ম-পালন পূজনীয়, কেননা তাহা সমাজের নিয়ম। কিন্তু তাহা ত নয়। অসম্পূর্ণ পৃথিবীতে অধীনতা স্বাধীনতার সোপান বলিয়াই তাহার যা গৌরব। সে কার্য্যের যখনি সে অনুপযোগী ও প্রতিরোধী হইবে তখনি তাহাকে পদাঘাতে ভাঙ্গিয়া ফেলা উচিত। আমাদের এমনি কপাল, যে, কণ্টক বিঁধাইয়া কণ্টককে উদ্ধার করিতে হয়, কিন্তু তাই বলিয়া উদ্ধার হইয়া গেলেও যে অপর কণ্টকটিকে কৃতজ্ঞতার সহিত ক্ষতস্থানে বিঁধাইয়া রাখিতে হইবে, এমন কোন কথা নাই। যখন স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রাজশাসনের আবশ্যক থাকিবে না বরঞ্চ বিপরীত হইবে, তখন রাজাকে দূর কর, রাজভক্তি বিসর্জ্জন কর। যখন সমাজের কোন নিয়ম আমাদের স্বাধীনতা-রক্ষার সাহায্য না করিবে, তখন নিয়মরক্ষার জন্য যে সে নিয়ম রক্ষা করিতে হইবে তাহা নহে। তাহা যদি করিতে হয়, তবে এক অধীনতার হস্ত হইতে দ্বিতীয় অধীনতার হস্তে পড়িতে হয়। অসহায় স্যাক্সনেরা যেমন শত্রু অত্যাচার হইতে রক্ষা পাইবার জন্য প্রবলতর শত্রুকে আহ্বান করিয়াছিল -- স্বাধীনতা পাইবার জন্য, অস্তিত্ব প্রবল করিবার জন্য, স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব উভয়ই বিসর্জ্জন দিয়াছিল --সমাজেরও ঠিক তাহাই হয়। ইহাই সংস্কারের গোড়ার কথা।
এক দল লোক বিলাপ করিবেই। বোধ করি এমন কাল কোন কালে ছিল না, যখন এক দল লোক স্মৃতি-বিস্মৃতি-বিজড়িত কুহেলিকাময় অতীত কালের জন্য দীর্ঘ নিশ্বাস না ফেলিয়াছে ও বর্ত্তমান কালের মধ্যে সর্ব্বনাশের, প্রলয়ের বীজ না দেখিয়াছে। সত্যযুগ কোন কালে বর্ত্তমান ছিল না, চিরকাল অতীত ছিল। তৃতীয় নেপোলিয়নকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, "আপনি কি হইতে ইচ্ছা করেন? ' তিনি উত্তর করিয়াছিলেন, "আমি আমার পৌত্র হইতে ইচ্ছা করি! ' ভবিষ্যৎ তাঁহার চক্ষে এমন লোভনীয় বলিয়া ঠেকিয়াছিল! কিন্তু কত শত সহস্র লোক আছেন, তাঁহাদের উক্ত প্রশ্ন করিলে উত্তর করেন, "আমি আমার পিতামহ হইতে ইচ্ছা করি! ' ইঁহাদের পৌত্রেরাও আবার ঠিক তাহাই ইচ্ছা করিবে। ইঁহাদের পিতামহেরাও তাহাই ইচ্ছা করিয়াছিলেন।
এক দল লোক আছেন, তাঁহারা পরিবর্ত্তন মাত্রেরই বিরোধী নহেন। তাঁহারা আংশিক পরিবর্ত্তন করিতে চাহেন। তাঁহাদের বিষয় লেখাই বর্ত্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। তাঁহারা বলেন, বিধবাবিবাহে আমাদের মত নাই; তবে, সংস্কার করিতে হয় ত বিধবাদের অবস্থা-সংস্কার কর -- তাহাদের উপবাস করিতে না হয়, তাহাদের মৎস্য মাংস খাইতে নিষেধ না থাকে, বেশবিন্যাস বিষয়ে তাহাদের ইচ্ছাকে অন্যায় বাধা না দেওয়া হয়। এক কথায়, বিধবাদের প্রতি সমাজের যত প্রকার অত্যাচার আছে তাহা দূর হউক, কিন্তু তাহাই বলিয়া বিধবারা সধবা হইতে পারিবে না। তাঁহারা বলিবেন,-- "অসবর্ণ বিবাহ! কি সর্ব্বনাশ! কিন্তু অনুরাগমূলক বিবাহে আমাদের আপত্তি নাই। পিতামাতাদের দ্বারা বধূ নির্ব্বাচিত না হইয়া প্রণয়াকৃষ্ট বিবাহেচ্ছুক যদি স্বয়ং আপনার উপযোগী পাত্রী স্থির করে ত ভাল হয়। কিন্তু অসবর্ণ বিবাহ নৈব নৈবচ।' তাঁহারা পুত্রের বয়স অধিক না হইলে বিবাহ দিতে অনুমতি করেন না, কিন্তু কন্যাকে অল্প বয়সে বিবাহ দেন। তাঁহারা স্ত্রীশিক্ষার আবশ্যকতা বুঝিয়াছেন কিন্তু স্ত্রী-স্বাধীনতাকে ডরান। লোকাচারবিশেষের উপর তাঁহাদের বিরাগ নাই, তাহার আনুষঙ্গিক দুই একটা অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁহাদের আক্রোশ। তাঁহারা বুঝেন না যে, সেই অনুষ্ঠানগুলি সেই লোকাচারের স্তম্ভ। তাঁহারা যাহা বলেন তাহার মর্ম্ম এই -- "সমস্ত বৃক্ষটির উপর আমাদের বিদ্বেষ নাই; কিন্তু উহার কতকগুলা জটিল শিকড় যত অনর্থের মূল। আমরা শুদ্ধ কেবল ঐ শিকড়গুলা ছেদন করিব। আহা, গাছটি বাঁচিয়া থাক্! '
যদি তুমি বিধবাবিবাহ দিতে প্রস্তুত না থাক, তবে বিধবারা যেমন আছে তেমনি থাক্। সমাজ যে বিধবাদের উপবাস করিতে বলে, মাছ মাংস খাইতে -- বেশভূষা করিতে নিষেধ করে, তাহার কারণ সমাজের খামখেয়ালী অত্যাচারস্পৃহা নহে। সমাজ বিধবাদিগকে বিধবা রাখিবার জন্যই এই কঠোর উপায় অবলম্বন করিয়াছে। যদি তুমি চিরবৈধব্য ব্রত ভালবাস, তবে আর এ সম্বন্ধে কথা কহিও না। তুমি মনে করিতেছ ঐ বাঁকাচোরা শিকড়গুলা গাছের কতকগুলা অর্থহীন গলগ্রহ মাত্র; তাহা নয় -- উহারাই আশ্রয়, উহারাই প্রাণ। যদি অসবর্ণ বিবাহে তোমার আপত্তি থাকে, তবে পূর্ব্বরাগমূলক বিবাহকে খবরদার প্রশ্রয় দিও না। ইহা সকলেই জানেন, অনুরাগের হিসাব-কিতাবের জ্ঞান কিছু মাত্র নাই। সে, ঘর বুঝিয়া, দর করিয়া, গোত্র জানিয়া পাত্রবিশেষকে আশ্রয় করে না। তাহার নিকট রাঢ় বারেন্দ্র নাই; গোত্র-প্রভেদ নাই; ব্রাক্ষ্ণণ শূদ্র নাই। অতএব অনুরাগের উপর বিবাহের ঘটকালি-ভার অর্পণ করিলে সে জাতি বিজাতিকে একত্র করিবে, ইহা নিশ্চয়। অতএব, হয়, অসবর্ণ বিবাহ দেও, নয়, পিতামাতার প্রতি সন্তানের বিবাহভার থাক্। কিন্তু এই পরাধীন বিবাহপ্রথা রক্ষা করিতে হইলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে আবার আরো অনেকগুলি আনুষঙ্গিক প্রথা রক্ষা করিতে হয়। যেমন বাল্যবিবাহ ও অবরোধপ্রথা। যদি স্ত্রীলোকেরা অন্তঃপুরের বহির্দ্দেশে বিচরণ করিতে পায়, ও অধিক বয়সে বিবাহপ্রথা প্রচলিত হয়, তবে অসবর্ণ বিবাহ আরম্ভ হইবেই। যখন যৌবনকালে কুমার কুমারী-যুগলের পরস্পরের প্রতি অনুরাগ জন্মাইবে, তখন কি পিতামাতার ও চিরন্তন প্রথার নীরস আদেশ তাহারা মান্য করিবে? তাহা ব্যতীতও বাল্যবিবাহের আর একটি অর্থ আছে। বালককাল হইতে দম্পতির একত্রে বর্দ্ধন, একত্রে অবস্থান হইলে, উভয়ে এক রকম মিশ খাইয়া যায়, বনিয়া যায়। কিন্তু যখন পাত্র ও পাত্রী উভয়ে বয়স্ক, উভয়েরই যখন চরিত্র সংগঠিত ও মতামত স্থিরীকৃত হইয়া গিয়াছে ও কচি-অবস্থার নমনীয়তা চলিয়া গিয়াছে ও পাকা-অবস্থার দৃঢ়তা জন্মিয়াছে, তখন অমন দুই ব্যক্তিকে অনুরাগ ব্যতীত আর কিছুতেই জুড়িতে পারে না -- না বাসসামীপ্য, না বিবাহের মন্ত্র। তাহাদের যতই বলপূর্ব্বক একত্র করিতে চেষ্টা করিবে, ততই তাহারা দ্বিগুণ বলে তফাৎ হইতে থাকিবে। অনুরাগ করা তাহাদের পক্ষে কর্ত্তব্য কার্য্য বলিয়াই অনুরাগ করা তাহাদের পক্ষে দ্বিগুণ দুঃসাধ্য হইয়া পড়িবে। অতএব যদি অসবর্ণ বিবাহ না দেও তবে পূর্ব্বরাগমূলক বিবাহ দিও না, বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাক্, অবরোধপ্রথা উঠাইও না। তুমি যে মনে করিতেছ, "সুবিধামত আমি সমাজ হইতে লোকাচারের একটি মাত্র ইঁট খসাইয়া লইব, আর অধিক নয়', তোমার কি ভ্রম! ঐ একটি ইঁট খসিলে কতগুলি ইঁট খসিবে ও প্রাচীরে কতখানি ছিদ্র হইবে তাহা তুমি জান না।
অতএব দেখা যাইতেছে দুই দল লোক সমাজসংস্কার করে। এক -- যাহারা লোকাচারকে একেবারে মূল হইতে উৎপাটন করে, আর -- যাহা লোকাচারের একটি একটি করিয়া শিকড় কাটিয়া দেয় ও অবশেষে কপালে করাঘাত করিয়া বলে, "এ কি হইল। গাছ শুকাইল কেন? ' ইহাদের উভয়েরই আবশ্যক। প্রথম দল যখন কোন একটা লোকাচার আমূলতঃ বিনাশ করিতে চায়, তখন সমাজ কোমর বাঁধিয়া রুখিয়া দাঁড়ায়। কিন্তু তাহাই বলিয়া যে সংস্কারকদের সমস্ত প্রয়াস বিফল হয় তাহা নহে। তাহার একটা ফল থাকিয়া যায়। মনে কর যেখানে অবরোধপ্রথা একাবারে তুচ্ছ করিয়া পাঁচ জন সংস্কারক তাঁহাদের পত্নীদিগকে গাড়ি চড়াইয়া রাস্তা দিয়া লইয়া যান, সেখানে দশ জন স্ত্রীলোক পাল্কী চড়িয়া যাইবার সময় দরজা খুলিয়া রাখিলেও তাঁহাদের কেহ নিন্দা করে না। কেবল মাত্র যে তাঁহাদের নিন্দা করে না, তাহা নহে; তাঁহাদের লক্ষ্য করিয়া সকলে বলাবলি করে, "হাঁ, এ ত বেশ! ইহাতে ত আমাদের কোন আপত্তি নাই! কিন্তু মেয়ে মানুষে গাড়ি চড়িবে সে কি ভয়ানক! " আপত্তি যে নাই, তাহার কারণ, আর পাঁচ জন গাড়ি চড়ে। নহিলে বিষম আপত্তি হইত। সমাজ যখন দেখে দশ জন লোক হোটেলে গিয়া খানা খাইতেছে, তখন যে বিশ জন লোক ব্রাক্ষ্ণণকে দিয়া মুরগী রাঁধাইয়া খায়, তাহাদিগকে দ্বিগুণ আদরে বুকে তুলিয়া লয়। ইহাই দেখিয়া অদূরদর্শীগণ আমূল-সংস্কারকদিগকে বলিয়া থাকে, "দেখ দেখি, তোমরাও যদি এইরূপ অল্পে অল্পে আরম্ভ করিতে, সমাজ তোমাদেরও কোন নিন্দা করিত না।'
এক কালে যে লোকাচারের প্রাচীরটি আশ্রয়স্বরূপ ছিল, আর এক কালে তাহাই কারাগার হইয়া দাঁড়ায়। এক দল কামান লইয়া বলে, "ভাঙ্গিয়া ফেলিব।' আর-এক দল রাজমিস্ত্রির যন্ত্রাদি আনিয়া বলে, "না, ভাঙ্গিয়া কাজ নাই, গোটাকতক খিড়্কির দরজা তৈরি করা যাক।' অমনি সমাজ হাঁপ ছাড়িয়া বলে, "হাঁ, এ বেশ কথা! ' এই রূপে আমাদের অসংখ্য লোকাচারের প্রাচীরে খিড়্কির দরজা বসিয়াছে। প্রত্যহ একটি একটি করিয়া বাড়িতেছে; অবশেষে যখন দেখিবে তাহার নিয়মসমূহে এত খিড়্কির দরজা হইয়াছে যে তাহার প্রাচীরত্ব আর রক্ষা হয় না, তখন সমস্তটা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে আর আপত্তি করিবে না, এমন-কি, তখন ভাঙ্গিয়া ফেলাও আর আবশ্যক হইবে না। এইরূপে এক-চোখো সংস্কারকগণ নিজের উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে যতটা সমাজসংস্কার করেন, এমন অল্প সংস্কারকই করিয়া থাকেন। ইঁহারা রক্ষণশীল-দলভুক্ত হইয়াও উৎপাটনশীলদিগকে সাহায্য করেন।