প্রকৃতি ও প্রকৃতি! গেল কোথায়! কী জানি কী হল মেয়েটার। ঘরে দেখতেই পাই নে।

এই-যে, মা, এখানেই আছি।

কোথায়!

এই-যে কুয়োতলায়।

আশ্চর্য করলি তুই। বেলা গেল দুপুর পেরিয়ে, কাঠফাটা রোদ, মাটি উঠেছে তেতে, পা ফেলা যায় না। ঘরের জল কোন্‌ সকালে তোলা হয়ে গেছে। পাড়ার মেয়েরা সবাই জল নিয়ে গেল ঘরে। ঐ দেখ্‌, ঠোঁট মেলে গরমে কাক ধুঁকছে আমলকীগাছের ডালে। তুই এই বৈশেখের রোদ পোয়াচ্ছিস বিনি কাজে। পুরাণকথা শুনেছি, উমা তপ করেছিলেন ঘর ছেড়ে বাইরে, রোদে পুড়ে; তোর কি তাই হল।

হাঁ, মা, তপ করছি তো বটে।

অবাক করলে! কার জন্যে।

যে আমাকে ডাক দিয়েছে।

গানযে আমারে দিয়েছে ডাক, দিয়েছে ডাক,

বচনহারা আমাকে যে দিয়েছে বাক্‌।

যে আমারি নাম জেনেছে ওগো তারি

নামখানি মোর হৃদয়ে থাক্‌॥

কিসের ডাক।

আমার মনের মধ্যে বাজিয়ে দিয়ে গেছে "জল দাও'।

পোড়া কপাল! তোকে বলেছে "জল দাও'! কে শুনি। তোর আপন জাতের কেউ?

তাই তো বললেন, তিনি আমার আপন জাতেরই।

জাত লুকোস নি? বলেছিলি যে তুই চণ্ডালিনী?

বলেছিলেম। তিনি বললেন, মিথ্যে কথা। তিনি বললেন, শ্রাবণের কালো মেঘকে চণ্ডাল নাম দিলেই বা কী, তাতে তার জাত বদলায় না, তার জলের ঘোচে না গুণ। তিনি বললেন, নিন্দে কোরো না নিজেকে। আত্মনিন্দা পাপ, আত্মহত্যার চেয়ে বেশি।

তোর মুখে এ-সব কী শুনছি। তোর কি মনে পড়েছে পূর্বজন্মের কোনো কাহিনী।

এ কাহিনী আমার নতুন জন্মের।

হাসালি তুই। নতুন জন্ম! ঘটল কবে।

সেদিন রাজবাড়িতে বাজল বেলা-দুপুরের ঘণ্টা, ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ্‌দুর। মা-মরা বাছুরটাকে নাওয়াচ্ছিলুম কুয়োর জলে। কখন সামনে দাঁড়ালেন বৌদ্ধ ভিক্ষু, পীত বসন তাঁর। বললেন, জল দাও। প্রাণটা উঠল চমকে, শিউরে উঠে প্রণাম করলেম দূর থেকে। ভোর বেলাকার আলো দিয়ে তৈরি তাঁর রূপ। বললেম, আমি চণ্ডালের মেয়ে, কুয়োর জল অশুদ্ধ। তিনি বললেন, যে-মানুষ আমি তুমিও সেই মানুষ; সব জলই তীর্থজল যা তাপিতকে স্নিগ্ধ করে, তৃপ্ত করে তৃষিতকে। প্রথম শুনলুম এমন কথা, প্রথম দিলুম এক গণ্ডূষ জল, যাঁর পায়ের ধুলোর এক কণা নিতে কেঁপে উঠত বুক।

ওরে অবোধ মেয়ে, হঠাৎ এতবড়ো হল তোর বুকের পাটা! এ পাগলামির প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। জানিস নে কোন্‌ কূলে তোর জন্ম?

কেবল একটি গণ্ডূষ জল নিলেন আমার হাত থেকে, অগাধ অসীম হল সেই জল। সাত সমুদ্র এক হয়ে গেল সেই জলে, ডুবে গেল আমার কূল, ধুয়ে গেল আমার জন্ম।

তোর মুখের কথা সুদ্ধু বদলে গেছে যে! জাদু করেছে তোর কথাকে। কী বলিস নিজে বুঝতে পারিস কিছু?

সমস্ত শ্রাবস্তীনগরে আর কি কোথাও জল ছিল না, মা। এলেন কেন এই কুয়োরই ধারে। একেই তো বলি নতুন জন্মের পালা। আমাকে দান করতে এলেন মানুষের তৃষ্ণা মেটাবার শিরোপা। এই মহাপুণ্যই খুঁজছিলেন। যে-জলে ব্রত হল পূর্ণ সে-জল তো আর কোথাও পেতেন না, কোনো তীর্থেই না। তিনি বললেন, বনবাসের গোড়াতেই জানকী এই জলেই স্নান করেছিলেন, সে-জল তুলে এনেছিল গুহক চণ্ডাল। সেই অবধি নেচে উঠছে আমার মন, গভীর কণ্ঠে শুনতে পাচ্ছি দিনরাত--দাও জল, দাও জল।

বলে দাও জল, দাও জল!

দেব আমি, কে দিয়েছে হেন সম্বল।

কালো মেঘ-পানে চেয়ে

এল ধেয়ে

চাতক বিহ্বল--

দাও জল, দাও জল।

ভূমিতলে হারা

উৎসের ধারা

অন্ধকারে

কারাগারে।

কার সুগভীর বাণী

দিল হানি

কালো শিলাতল--

দাও জল, দাও জল॥

কী জানি, বাছা, ভালো ঠেকছে না। ওদের মন্তরের খেলা আমি বুঝি নে আজ তোর কথা চিনছি নে, কাল তোর মুখ চিনতেই পারব না। ওদের এ যে প্রাণবদলানো মন্তর।

চিনতে পার নি এতদিন। যিনি চিনেছেন তিনি চেনাবেন। তাই আছি তাকিয়ে। রাজদুয়ারে দুপুরের ঘণ্টা বাজে, মেয়েরা জল নিয়ে যায় ঘরে, শঙ্ঘচিল একলা ওড়ে দূর আকাশে, আমার ঘট নিয়ে এসে বসি কুয়োতলায় পথের ধারে।

কার জন্যে।

পথিকের জন্যে।

তোর কাছে কোন্‌ পথিক আসবে, পাগলি!

সেই এক পথিক, মা, সেই এক পথিক। তাঁর মধ্যে আছে বিশ্বের সকল পথের সব পথিক। দিনের পর দিন চলে যায়, এলেন না তো। কোনো কথা না ব'লে তবু কথা দিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু রাখলেন না কেন কথা। আমার মন যে হল মরুভূমির মতো; ধু ধু করে সমস্ত দিন, হু হু করে তপ্ত হাওয়া, সে যে পারছে না জল দিতে। কেউ এসে চাইলে না।

চক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো

তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।

আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন,

সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।

ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায়,

মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়,

অবগুণ্ঠন যায় যে উড়ে।

যে-ফুল কানন করত আলো

কালো হয়ে সে শুকাল।

ঝরনারে কে দিল বাধা--

তাপের প্রতাপে বাঁধা

দুঃখের শিখরচূড়ে॥

তোর আজকেকার কথা কিছু বুঝতে পারছি নে, তোকে কী নেশা লেগেছে কী জানি। কী চাস, আমাকে সাদা ক'রে বল্‌।

আমি চাই তাঁকে। তিনি আচমকা এসে আমাকে জানিয়ে গেলেন, আমার সেবাও চলবে বিধাতার সংসারে, এতবড়ো আশ্চর্য কথা! সেবিকা আমি, এই কথাটি নিন তুলে ধুলোর থেকে তাঁর বুকের কাছে, এই ধুতরো ফুলটাকে।

মনে রাখিস, প্রকৃতি, ওদের কথা কানেই শোনবার, কাজে খাটাবার নয়। অদৃষ্টদোষে যে-কূলে জন্মেছিস তার কাদার বেড়া ভাঙতে পারে এমন লোহার খোন্‌তাও নেই কোনখানে। অশুচি তুই, তোর অশুচি হাওয়া ছড়িয়ে বেড়াস নে বাইরে, যেখানে আছিস সেইখানটুকুতেই থাক্‌ সাবধানে। এই জায়গাটুকুর বাইরে সর্বত্রই তোর অপরাধ।

ফুল বলে, ধন্য আমি মাটির 'পরে,

দেবতা ওগো, তোমার সেবা আমার ঘরে।

জন্ম নিয়েছি ধূলিতে,

দয়া করে দাও ভুলিতে,

নাই ধূলি মোর অন্তরে।

নয়ন তোমার নত করো,

দলগুলি কাঁপে থরো থরো।

চরণপরশ দিয়ো দিয়ো,

ধূলির ধনকে করো স্বর্গীয়,

ধরার প্রণাম আমি

তোমার তরে।

বাছা, কিছু কিছু বুঝতে পারি তোর কথা। তুই মেয়েমানুষ, সেবাতেই তোর পুজো, সেবাতেই তোর রাজত্ব। এক নিমিষে জাত ডিঙিয়ে যেতে পারে মেয়েরাই; ধরা পড়ে, সবাই তারা রাজরানীর অংশ, যদি হঠাৎ স'রে পড়ে ভাগ্যের পর্দাটা। সুযোগ তোর তো ঘটেছিল। মৃগয়ায় বেরিয়ে রাজার ছেলে এসেছিল তোরই এই কুয়োতলায়। মনে পড়ে তো?

হাঁ, মনে পড়ে।

কেন গেলি নে রাজার ঘরে। রূপ দেখে সে তো ভুলেছিল।

ভুলেছিল না তো কী। ভুলেইছিল যে, আমি মানুষ। পশু মারতে বেরিয়েছিল; চোখে ঠেকে পশুকেই, তাকেই চায় বাঁধতে সোনার শিকলে।

তবু তো শিকার বলেও ঐ মুখ লক্ষ্য করেছিল সে। আর, ভিক্ষু, সে কি নারী বলে চিনেছে তোমাকে।

বুঝবে না তুমি বুঝবে না। আমি বুঝেছি, এতদিন পরে সে'ই আমাকে প্রথম চিনেছে। সে বড়ো আশ্চর্য।

ওগো, তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্যদৃষ্টি

আমার সত্যরূপ প্রথম করেছ সৃষ্টি।

তোমায় প্রণাম, তোমায় প্রণাম,

তোমায় প্রণাম শতবার।

আমি তরুণ অরুণলেখা

আমি বিমল জ্যোতির রেখা,

আমি নবীন শ্যামল মেঘে

প্রথম প্রসাদবৃষ্টি।

তোমায় প্রণাম, তোমায় প্রণাম,

তোমায় প্রণাম শতবার॥

তাঁকে চাই, মা। নিতান্তই চাই। তাঁর সামনে সাজিয়ে ধরতে চাই আমার এ জন্মের পূজার ডালি। অশুচি হবে না তাতে তাঁর চরণ। দেখুক সবাই আমার স্পর্ধা। গৌরব ক'রে বলতে চাই, আমি তোমার সেবিকা, নইলে সংসারে সবারই পায়ের কাছে চিরদিন বাঁধা পড়ে থাকতে হবে দাসী হয়ে।

মিছে রাগ করিস কেন, বাছা। দাসীজন্মই যে তোর। বিধাতার লিখন খণ্ডাবে কে।

ছি ছি, মা, আবার তোকে বলছি, ভুলিস নে, মিথ্যে নিন্দে রটাস নে নিজের--পাপ সে পাপ! রাজার বংশে কত দাসী জন্মায় ঘরে ঘরে, আমি দাসী নই। ব্রাহ্মণের ঘরে কত চণ্ডাল জন্মায় দেশে দেশে, আমি নই চণ্ডাল।

তোর সঙ্গে কথা কইতে পারি এমন কথা আমি জানি নে। তা ভালো, আমি নিজে যাব তাঁর কাছে। পায়ে ধ'রে বলব, তুমি অন্ন নিয়ে থাক সব ঘর থেকেই, আমার ঘরে কেবল এক গণ্ডূষ জল নিতে এসো।

গাননা না, ডাকব না, ডাকব না অমন করে বাইরে থেকে।

পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাব, আনব ডেকে।

দেবার ব্যথা বাজে আমার বুকের তলে,

নেবার মানুষ জানি নে তো কোথায় চলে,

এই দেওয়া-নেওয়ার মিলন আমার ঘটাবে কে।

মিলবে না কি মোর বেদনা তার বেদনাতে

গঙ্গাধারা মিশবে না কি কালো যমুনাতে।

আপনি কী সুর উঠল বেজে

আপনা হতে এসেছে যে,

গেল যখন আশার বচন গেছে রেখে॥

এ-সব কথা বলে লাভ কী। মেঘ আপনি আসে তো আসে, না আসে তো আসেই না। খেত-খন্দ যদি শুকিয়ে যায় তাতে কার কিসের গরজ। আমরা আকাশে তাকিয়ে থাকি, আর কী করতে পারি।

সে হবে না। তাকিয়ে বসে থাকব না, মন্তর জানিস তুই, সেই মন্তর হোক আমার বাহুবন্ধন, আনুক তাঁকে টেনে।

ওরে সর্বনাশী, বলিস কী! সাহস কেবলই বাড়ছে দেখি! আগুন নিয়ে খেলা! এরা কি সাধারণ মানুষ! মন্তর খাটাব এদের 'পরে? শুনে বুক কেঁপে ওঠে।

রাজার ছেলের বেলায় মন্তর পড়তে চেয়েছিলি কোন্‌ সাহসে।

ভয় করি নে রাজাকে, সে শূলে চড়াতে পারে। কিন্তু, এরা যে কিছুই করে না।

আমি আর কোনো ভয় করি নে; ভয় করি, আবার যাব নেমে, আবার আপনাকে ভুলব, আবার ঢুকব আঁধার কোঠায়। সে যে মরণের বাড়া। আনতেই হবে তাঁকে, এতবড়ো কথা এত জোর করে বলছি, এ কি আশ্চর্য নয়--এই আশ্চর্যই তো ঘটিয়েছে সে। আরো আশ্চর্য কি ঘটবে না, আসবে না কি আমার পাশে। আমার আধো আঁচলে বসবে না?

তাঁকে আনতে পারি হয়তো, তুই তার মূল্য দিতে পারবি? তোর কিচ্ছুই থাকবে না বাকি!

প্রকৃত। না, কিছুই থাকবে না। আমার জন্মজন্মান্তরের সেই দায়, কিচ্ছুই থাকবে না, একেবারে সমস্তই মিটিয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যাব। তাই তো চাই তাঁকে। কিচ্ছু থাকবে না আমার। আমার যুগযুগের অপেক্ষা করে থাকা এই জন্মেই সার্থক হবে, মন কেবলই তাই বলছে। সার্থক হবে। সেইজন্যেই তো শুনলুম এমন আশ্চর্য কথা--জল দাও। আজ জেনেছি, আমিও পারি দিতে। এই কথা সবাই আমাকে ভুলিয়ে রেখেছিল। দেব, দেব, আজ আমার সব কিছু দেব বলেই বসে আছি তাঁর পথ চেয়ে।

তুই ধর্ম মানিস নে?

কী করে বলব! তাঁকেই মানি যিনি আমাকে মানেন। যে-ধর্ম অপমান করে সে-ধর্ম মিথ্যে। অন্ধ ক'রে, মুখ বন্ধ ক'রে সবাই মিলে সেই ধর্ম আমাকে মানিয়েছে। কিন্তু, সেদিন থেকে এই ধর্ম মানা আমার বারণ। কোনো ভয় আর নেই আমার--পড়্‌ তোর মন্তর, ভিক্ষুকে নিয়ে আয় চণ্ডালের মেয়ের পাশে। আমিই দেব তাঁকে সম্মান। এতবড়ো সম্মান আর কেউ দিতে পারবে না।

আমি তারেই জানি তারেই জানি

আমায় যে জন আপন জানে--

তারি দানে দাবি আমার

যার অধিকার আমার দানে।

যে আমারে চিনতে পারে

সেই চেনাতেই চিনি তারে,

একই আলো চেনার পথে

তার প্রাণে আর আমার প্রাণে।

আপন মনের অন্ধকারে ঢাকল যারা

আমি তাদের মধ্যে আপনহারা।

ছুঁইয়ে দিল সোনার কাঠি,

ঘুমের ঢাকা গেল ফাটি,

নয়ন আমার ছুটেছে তার

আলো-করা মুখের পানে॥

শাপ লাগার ভয় করিস নে তুই?

শাপ তো লেগেই আছে জন্মকাল থেকে। এক শাপের বিষে আর-এক শাপের বিষ ক্ষয় হয়ে যায়। কোনো কথাই শুনব না, মা, শুনব না, শুনব না। শুরু করে দে মন্ত্র। পারব না দেরি সইতে।

আচ্ছা, তা হলে কী নাম তাঁর বল্‌।

তাঁর নাম আনন্দ।

আনন্দ? ভগবান বুদ্ধের শিষ্য?

হাঁ, সেই ভিক্ষু।

তুই আমার বুক-চেরা ধন, আমার চোখের মণি--তোর কথাতেই এতবড়ো পাপে হাত দিচ্ছি।

কিসের পাপ! যিনি সবাইকে কাছে আনেন তাঁকে কাছে আনব, তাতে দোষ হয়েছে কী।

ওঁরা পুণ্যের জোরে টেনে আনেন মানুষকে। আমরা মন্তর পড়ে টানি, পশুকে টানে যে-ফাঁসে। আমরা মথন করে তুলি পাঁক।

ভালোই সে ভালোই, নইলে পঙ্কোদ্ধার হয় না।

ওগো, তুমি মহাপুরুষ, অপরাধ করবার শক্তি আমার যত, ক্ষমা করবার শক্তি তোমার তার চেয়ে অনেক বেশি। প্রভু, অসম্মান করতে বসেছি, তবু প্রণাম গ্রহণ করো।

কিসের ভয় তোমার, মা! মন্ত্র আমিই পড়ছি মায়ের মুখ দিয়ে। আমার বেদনা যদি আনে তাঁকে টেনে, আর তাই যদি হয় অপরাধ, তবে করবই অপরাধ, করবই। যে-বিধানে কেবল শাস্তিই আছে, সান্ত্বনা নেই, মানব না সে বিধানকে।

দোষী করো, দোষী করো।

ধুলায়-পড়া ম্লান কুসুম

পায়ের তলায় ধরো।

অপরাধে-ভরা ডালি

নিজ হাতে করো খালি,

তার পরে সেই শূন্য ডালায়

তোমার করুণা ভরো।

তুমি উচ্চ, আমি তুচ্ছ--

ধরব তোমায় ফাঁদে

আমার অপরাধে।

আমার দোষকে তোমার পুণ্য

করবে তো কলঙ্কশূন্য,

ক্ষমায় গেঁথে সকল ত্রুটি

গলায় তোমার পরো।

আচ্ছা সাহস তোর প্রকৃতি!

আমার সাহস! ভেবে দেখ্‌ তাঁর সাহসের জোর! কেউ যে কথা আমার কাছে বলতে পারে নি তিনি সহজেই বললেন, জল দাও। ঐটুকু বাণী, তার তেজ কত--আলো ক'রে দিলে আমার সমস্ত জন্ম; বুকের উপরে কালো পাথরটা চিরকাল চাপা ছিল, দিলে সেটাকে ঠেলে, উছলে উঠল রসের ধারা। মিথ্যে তোর ভয়, তুই যে তাঁকে দেখিস নি। সমস্ত সকাল বেলা ভিক্ষা করলেন শ্রাবস্তীনগরে; এলেন মাঠ পেরিয়ে শ্মশান পেরিয়ে, নদীর তীর বেয়ে, প্রখর রৌদ্র মাথায় করে। কিসের জন্যে। আমার মতো মেয়েকেও কেবল ঐ একটি কথা বলবার জন্যে--জল দাও! মরে যাই, মরে যাই। কোথা থেকে নামল এত দয়া, এত প্রেম! নামল সেই ভীরুর কাছে যে সবার চেয়ে অযোগ্য। আর কিসের ভয় আমার! জল দাও! সেই জল-যে আমার জন্ম ভরে উপচে উঠেছে, না দিতে পারলে তো বাঁচব না। জল দাও! এক নিমেষে জেনেছি, জল আছে আমার, অফুরান জল, সে আমি জানাব কাকে। তাই তো ডাকছি দিনরাত। শুনতে যদি না পান, ভয় নেই, দে তোর মন্তর পড়ে। সইবে তাঁর সইবে।

মাঠপারের রাস্তা দিয়ে ঐ-যে কারা চলেছে, প্রকৃতি, পীতবসন-পরা।

তাই তো, ও যে দেখছি সংঘের সব শ্রমণ। শুনছ না, পড়ছেন মন্ত্র?

                       বুদ্ধো সুসুদ্ধো করুণামহাণ্নবো

                       যোচ্চন্ত সুদ্ধব্বর-ঞানলোচনো।

                       লোকস্‌স পাপূপকিলেসঘাতকো

                       বন্দামি বুদ্ধম্‌ অহমাদরেণ তম্‌॥

মা, ঐ-যে তিনি চলেছেন সবার আগে আগে। এই কুয়োতলার দিকে ফিরে তাকালেন না। আর-একবার তো বলে যেতে পারতেন, জল দাও। মনে হয়েছিল, আমাকে উনি ফেলে যেতে পারবেন না, আমি যে ওঁর নিজের হাতের নতুন সৃষ্টি। (বসে প'ড়ে বার বার মাটিতে মাথা ঠুকে) এই মাটি, এই মাটি, এই মাটিই তোর আপন--হতভাগিনী, কে তোকে আলোতে ফুটিয়ে তুলেছিল এক মুহূর্তের জন্যে। তাকে কি দয়া বলে। শেষে পড়তে হল এই মাটিতেই--চিরদিন মিশিয়ে থাকতে হবে এই মাটিতেই, যত লোক চলে রাস্তায় তাদের পায়ের তলায়।

বাছা, ভুলে যা, ভুলে যা এ সমস্ত-কিছু। তোর এক নিমেষের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে ওরা যাচ্ছে চলে, যাক যাক। যা টেঁকবার নয় তা যত শীঘ্র যায় ততই ভালো।

এই প্রতিদিনের চাই চাই চাই, এই প্রতি মুহূর্তের অপমান, বুকের ভিতরে এই খাঁচার পাখির পাখা-আছড়ে-মরা, একেই বলে স্বপ্ন? যা বুকের সব শিরা কামড়ে ধ'রে থাকে, ছাড়তে চায় না, তাই স্বপ্ন? আর ঐ ওরা, নেই কোনো বাঁধন, নেই কোনো সুখদুঃখ, নেই কোনো সংসারের বোঝা--ভেসে চলে যায় শরৎকালের মেঘের মতো--ওরাই আছে জেগে, ওরাই স্বপ্ন নয়?

তোর কষ্ট দেখতে পারি নে, প্রকৃতি। ওঠ্‌ তুই। আনবই তাঁকে মন্ত্র পড়ে। নিয়ে আসব ধুলোর পথ দিয়েই। "কিছু চাই না' বলার অহংকার ভাঙব তাঁর--"চাই চাই' বলেই আসতে হবে তাঁকে ছুটে।

মা, তোমার মন্ত্র জীবসৃষ্টির আদিকালের। এদের মন্ত্র কাঁচা, এই সেদিনকার। ওরা পারবে না তোমার সঙ্গে। তোমার মন্ত্রের টানে খুলবে ওদের মন্ত্রের গাঁঠ। ওঁকে হারতেই হবে, হারতেই হবে।

কোথায় যাচ্ছে ওরা।

ওরা যায় এইমাত্র জানি, ওরা কোনোখানেই যায় না। বর্ষা আসবে কিছুদিন পরে, তখন বসবে চাতুর্মাস্যে। আবার যাবে, কী জানি কোথায়। একেই ওরা বলে জেগে থাকা!

পাগলি, তবে কী বলছিস মন্তরের কথা। চলে যাচ্ছে কত দূরে--কোথা থেকে আনব ফিরিয়ে।

যেখানেই যাক ফেরাতেই হবে, দূর নেই তোর মন্তরের কাছে।

যায় যদি যাক সাগরতীরে।

আবার আসুক, আবার আসুক, আসুক ফিরে।

রেখে দেব আসন পেতে

হৃদয়েতে,

পথের ধুলো ভিজিয়ে দেব অশ্রুনীরে।

যায় যদি যাক শৈলশিরে।

আসুক ফিরে, আসুক ফিরে।

লুকিয়ে রব গিরিগুহায়,

ডাকব উহায়--

আমার স্বপন ওর জাগরণ রইবে ঘিরে॥

ভাবনা করিস নে। অসাধ্য হবে না। তোকে দেব মায়াদর্পণ। সেইটি হাতে নিয়ে নাচবি। তার ছায়া পড়বে তাতে। সেই আয়নাতেই দেখতে পাবি কী হল তার, কতদূর সে এল।

ঐ দেখ, পশ্চিমে জমল মেঘ, ঝড়ের মেঘ। মন্ত্র খাটবে, মা, খাটবে। উড়ে যাবে শুষ্ক সাধন, শুকনো পাতার মতো। নিববে বাতি। পথ দেখা যাবে না। ঘুরে ঘুরে এসে পড়বে এই দরজায়, নিশীথরাতে ঝড়ে বাসাভাঙা পাখি যেমন ক'রে এসে পড়ে অন্ধকার আঙিনায়। বুক দুর্‌দুর্‌ করছে, মনের মধ্যে ঝিলিক দিচ্ছে বিজুলি, ফেনিয়ে ফেনিয়ে ঢেউ উঠছে যে-সমুদ্রে তার পার দেখি নে।

এখনো ভেবে দেখ্‌। মাঝখানে তো আঁৎকে উঠবি নে ভয়ে? ধৈর্য থাকবে তোর? মন্ত্রের বেগ চ'ড়ে যাবে যখন, হঠাৎ ঠেকাতে গেলে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাবে। জ্বলবার জিনিস সমস্ত যাবে ছাই হয়ে, তবে নিববে আগুন, এই কথাটা মনে রাখিস।

তুই ডরছিস কার জন্যে। সে কি তেমনি মানুষ। কিছুতে কিছু হবে না তার--শেষ পর্যন্তই আসুক সে চলে, আগুনের পথ মাড়িয়ে মাড়িয়ে। আমি মনের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, সামনে প্রলয়ের রাত্রি, মিলনের ঝড়, ভাঙনের আনন্দ।

হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরুগুরু,

ঘন মেঘের ভুরু, কুটিল কুঞ্চিত,

হল রোমাঞ্চিত বন বনান্তর;

দুলিল চঞ্চল বক্ষোহিন্দোলে

মিলনস্বপ্নে সে কোন্‌ অতিথি রে।

সঘন-বর্ষণ-শব্দ-মুখরিত,

বজ্রসচকিত ত্রস্ত শর্বরী,

মালতীবল্লরী কাঁপায় পল্লব

করুণ কল্লোলে,

কানন শঙ্কিত ঝিল্লিঝংকৃত॥

বুক ফেটে যাবে! আমি দেখব না আয়না, দেখতে পারব না। কী ভয়ংকর দুঃখের ঘূর্ণিঝড়। বনস্পতি শেষকালে কি মড়্‌মড়্‌ করে লুটোবে ধুলোয়, অভ্রভেদী গৌরব তার পড়বে ভেঙে?

দেখ্‌, বাছা, এখনো যদি বলিস, ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করি আমার মন্ত্রকে। তাতে আমার নাড়ী ছিঁড়ে যায় যদি, যায় নিজের প্রাণ, সেও ভালো, কিন্তু ঐ মহাপ্রাণ রক্ষে পাক।

সেই ভালো, মা, থাক্‌ তোমার মন্ত্র। আর কাজ নেই।--না না না না--পথ আর কতখানিই বা! শেষ পর্যন্ত আসতে দে তাকে, আসতে দে, আমার এই বুকের কাছ পর্যন্ত। তার পরে সব দুঃখ দেব মিটিয়ে, আমার বিশ্বসংসার উজাড় করে দিয়ে। গভীর রাত্রে এসে পৌঁছবে পথিক, সমস্ত বুকের জ্বালা দিয়ে জ্বালিয়ে দেব প্রদীপ, আছে সুধার ঝরনা গভীর অন্তরে, তার জলে অভিষেক হবে তার--যে শ্রান্ত, যে তপ্ত, যে ক্ষতবিক্ষত। আর-একবার সে চাইবে, জল দাও--আমার হৃদয়-সমুদ্রের জল! আসবে সেই দিন। তোর মন্ত্র চলুক, চলুক।

দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার,

স্নান করাব অতল জলে বিপুল বেদনার।

মোর সংসার দিব যে জ্বালি,

শোধন হবে এ মোহের কালি,

মরণব্যথা দিব তোমার চরণে উপহার॥

এত দেরি হবে জানতুম না, বাছা। আমার মন্ত্র শেষ হল বুঝি। আমার প্রাণ যে কণ্ঠে এসেছে।

ভয় নেই, মা আর-একটু সয়ে থাক্‌। একটুখানি। বেশি দেরি নেই।

আষাঢ় তো পড়েছে, ওঁদের চার্তুমাস্য তো আরম্ভ হল।

ওঁরা গেছেন বৈশালীতে গোশিরসংঘে।

কী নিষ্ঠুর তুই! সে যে অনেক দূর।

বহুদূর নয়। সাত দিনের পথ। পনেরো দিন তো কেটে গেল। এতদিনে মনে হচ্ছে, টলেছে আসন, আসছে আসছে, যা বহুদূর, যা লক্ষযোজন দূর, যা চন্দ্রসূর্য পেরিয়ে, আমার দূ হাতের নাগাল থেকে যা অসীম দূরে তাই আসছে কাছে। আসছে, কাঁপছে আমার বুক ভূমিকম্পে।

মন্ত্রের সব অঙ্গ পূর্ণ করেছি, এতে বজ্রপাণি ইন্দ্রকে আনতে পারত টেনে। তবু দেরি হচ্ছে। কী মরণান্তিক যুদ্ধই চলছে। কী দেখেছিলি তুই আয়নাতে।

প্রথম দেখেছি, আকাশজোড়া কুয়াশা, দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত দেবতার ফ্যাকাশে মুখের মতো। কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে বেরোচ্ছে আগুন। তার পরে কুয়াশাটা স্তবকে স্তবকে ছিড়ে ছিঁড়ে গেল--ফুলে-ওঠা ফেটে-পড়া প্রকাণ্ড বিষ-ফোড়ার মতো--লাল হয়ে উঠল রঙ। সেদিন গেল। পরের দিন দেখি, পিছনে ঘন কালো মেঘ, বিদ্যুৎ খেলছে, সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, জ্বলছে আগুন সর্বাঙ্গ ঘিরে। আমার রক্ত এল হিম হয়ে। ছুটে তোকে বলতে গেলুম, এখনি দে তোর মন্ত্র বন্ধ করে। গিয়ে দেখি তুই শিবনেত্র, কাঠের মতো বসে, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে, জ্ঞান নেই। মনে হল, তোর মধ্যেও কোনোখানে দাউ-দাউ জ্বলছে আগুন। যে-পাবক দিয়ে তিনি ঢেকেছেন আপনাকে তোর অগ্নিনাগিনী ফোঁস্‌ ফোঁস্‌ করে তাকে ছোবল মারছে, চলছে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ফিরে এসে আয়না তুলে দেখি, আলো গেছে--শুধু দুঃখ দুঃখ দুঃখ, অসীম দুঃখের মূর্তি।

মরে পড়ে গেলি নে তাই দেখে! তারই তো ঝলক লেগেছিল আমার প্রাণের মধ্যে; মনে হল, আর সইবে না।

যে দুঃখের রূপ দেখেছি সে তো তাঁর একলার নয়, সে আমারও; আমাদের দুজনের। ভীষণ আগুনে গ'লে মিশেছে সোনার সঙ্গে তাঁবা।

ভয় হল না তোর মনে?

ভয়ের চেয়ে অনেক বেশি--মনে হল দেখলুম, সৃষ্টির দেবতা প্রলয়ের দেবতার চেয়ে ভয়ংকর--আগুনকে চাবকাচ্ছেন তাঁর কাজে, আর আগুন কেবলই গোম্‌রাচ্ছে গর্জাচ্ছে। সপ্তধাতুর কৌটোতে কী আছে তাঁর পায়ের সামনে--প্রাণ না মৃত্যু? আমার মনে ফুলতে লাগল একটা আনন্দ। তাকে কী বলব? নতুন সৃষ্টির বিরাট বৈরাগ্য। ভাবনা নেই, ভয় নেই, দয়া নেই, দুঃখ নেই--ভাঙছে, জ্বলে উঠছে, গলে যাচ্ছে, ছিটকে পড়ছে স্ফুলিঙ্গ। থাকতে পারলুম না, আমার সমস্ত শরীর-মন নেচে নেচে উঠল অগ্নিশিখার মতো।

হে মহাদুঃখ, হে রুদ্র, হে ভয়ংকর,

ওহে শংকর, হে প্রলয়ংকর।

হোক জটানিঃসৃত অগ্নিভুজঙ্গম-

দংশনে জর্জর স্থাবর জঙ্গম,

ঘন ঘন ঝন-ঝন, ঝন-নন ঝন-নন

পিণাক টংকরো॥

কী রকম দেখলি তোর ভিক্ষুকে।

দেখলুম, তাঁর অনিমেষ দৃষ্টি বহুদূরে তাকিয়ে, গোধূলি-আকাশের তারার মতো। ইচ্ছে হল, আপনার কাছ থেকে চলে যাই অনন্তযোজন দূরে।

তুই আয়নার সামনে তখন নাচছিলি--তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন?

ধিক্‌ ধিক্‌, কী লজ্জা! মনে হচ্ছিল, থেকে থেকে চোখ লাল হয়ে উঠছে, অভিশাপ দিতে যাচ্ছেন। আবার তখনি পা দিয়ে মাড়িয়ে দলে ফেলছেন রাগের অঙ্গারগুলো। শেষকালে দেখলেম, তাঁর রাগ ফিরল কাঁপতে কাঁপতে শেলের মতো নিজের দিকে, বিঁধল গিয়ে মর্মের মধ্যে।

সমস্ত সহ্য করলি তুই?

আশ্চর্য হয়ে গেলুম। আমি, এই আমি, এই তোমার মেয়ে, কোথাকার কে তার ঠিকানা নেই--তাঁর দুঃখ আর এর দুঃখ আজ এক। কোন্‌ সৃষ্টির যজ্ঞে এমন ঘটে--এতবড়ো কথা কেউ কোনোদিন ভাবতে পারত!

এই উৎপাত শান্ত হবে কতদিনে।

যতদিন-না আমার দুঃখ শান্ত হবে। ততদিন দুঃখ তাঁকে দেবই। আমি মুক্তি যদি না পাই তিনি মুক্তি পাবেন কী করে।

তোর আয়না শেষ দেখেছিস কবে।

কাল সন্ধেবেলায়। বৈশালীর সিংহদরজা পেরিয়েছেন কিছুদিন আগে,গভীর রাত্রে। বোধ হয় গোপনে, শ্রমণদের না জানিয়ে। তার পরে কখনো দেখেছি, নদী পেরলেন খেয়া নৌকোয়; দেখেছি দুর্গম পাহাড়ে; দেখেছি সন্ধে হয়ে এসেছে, মাঠে তিনি একা; দেখেছি অন্ধকারে, গভীর রাত্রে, বনের পথে। যত যাচ্ছে দিন, স্বপ্নের ঘোর আসছে ঘন হয়ে, চলেছেন কোনো বিচার না করে, নিজের সঙ্গে সমস্ত দ্বন্দ্ব শেষ করে দিয়ে। মুখে একটা বিহ্বলতা, দেহে একটা শৈথিল্য দুই চোখের সামনে যেন বস্তু নেই; নেই সত্যমিথ্যা, নেই ভালোমন্দ; আছে চিন্তাহীন অন্ধ লক্ষ্য, নেই তার কোনো অর্থ।

আজ কোথায় এসেছেন আন্দাজ করতে পারিস?

কাল সন্ধ্যার সময় দেখেছি উপলী নদীর ধারে পাটল গ্রামে। নববর্ষায় জলের ধারা উন্মত্ত, ঘাটের কাছে পুরোনো পিপুল গাছ, জোনাকি জ্বলছে ডালে ডালে তলায় শেওলা-ধরা বেদী--সেইখানে এসেই হঠাৎ চমকে দাঁড়ালেন। অনেকদিনের চেনা জায়গা; শুনেছি, ঐখানে বসে ভগবান বুদ্ধ একদিন রাজা সুপ্রভাসকে উপদেশ দিয়েছিলেন। দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন, স্বপ্ন বুঝি ভাঙল হঠাৎ। তখনি ছুঁড়ে ফেলে দিলেম আয়না, ভয় হল কী জানি কী দেখব। তার পরে গেছে সমস্ত দিন, কিছু জানতে চাই নি, আশা করছি, আশা ছাড়ছি--এমনি করে আছি বসে। এখন রাত আসছে অন্ধকার হয়ে। প্রহরী হাঁক দিয়ে চলেছে রাস্তায়, এক প্রহর গেল বুঝি কেটে! আর সময় নেই, সময় নেই, মা, এ রাত ব্যর্থ করিস নে। তোর সব জোরটা দে ঐ মন্ত্রে।

আর পারছি নে, বাছা। মন্ত্র দুর্বল হয়ে এল, আমার প্রাণ ও শরীর এসেছে অবশ হয়ে।

দুর্বল হলে চলবে না। দিস নে হাল ছেড়ে। ফেরবার দিকে মুখ ফিরিয়েছেন বা, বাঁধনে শেষ টান পড়েছে--হয়তো টিঁকবে না। হয়তো বেরিয়ে যাবেন আমার এ জন্মের সংসার থেকে, আর পাব না নাগাল কিছুতেই। তখন আমারই স্বপ্নের পালা, আবার চণ্ডালিনীর মায়ামূর্তি। পারব না সইতে সেই মিথ্যে। পায়ে পড়ি, মা, দে একবার তোর সমস্ত শক্তি। এবার শুরু কর্‌ তোর বসুন্ধরামন্ত্র, টলতে থাক্‌ পুণ্যবানদের তুষিত স্বর্গলোক।

আমি তোমারি মাটির কন্যা,

জননী বসুন্ধরা।

তবে আমার মানবজন্ম

কেন বঞ্চিত করা।

পবিত্র জানি যে তুমি

পবিত্র জন্মভূমি--

মানবকন্যা আমি যে ধন্যা

প্রাণের পুণ্যে ভরা।

কোন স্বর্গের তরে

ওরা তোমায় তুচ্ছ করে,

রহি তোমার বক্ষ-'পরে।

আমি যে তোমারি আছি

নিতান্ত কাছাকাছি--

তোমার মোহিনীশক্তি দাও আমারে

হৃদয়প্রাণ-হরা।

যেমন বলেছিলেম তেমনি প্রস্তুত হয়েছ তো?

হয়েছি! কাল ছিল শুক্লাদ্বিতীয়ার রাত, করেছি গম্ভীরায় অবগাহন-স্নান। এই তো চাল দিয়ে, দাড়িমের ফুল দিয়ে, সিঁদুর দিয়ে, সাতটি রত্ন দিয়ে, চক্র এঁকেছি আঙিনায়। পুঁতেছি হলদে কাপড়ের ধ্বজাগুলি, থালায় রেখেছি মালাচন্দন, জ্বালিয়েছি বাতি। স্নানের পর কাপড় পরেছি ধানের অঙ্কুরের রঙ, চাঁপার রঙের ওড়না। পুব দিকে আসন করে সমস্ত রাত ধ্যান করেছি তাঁর মূর্তি। ষোলোটি সোনালি সুতোয় ষোলোটি গ্রন্থি দিয়ে রাখী পরেছি বাঁ হাতে।

আচ্ছা, তবে নাচো তোমার সেই আহ্বানের নাচ--প্রদক্ষিণ করো। আমি বেদীর কাছে মন্ত্র পড়ছি।

প্রকৃতি।

মম রুদ্ধ মুকূলদলে এসো।

সৌরভ-অমৃতে।

মম অখ্যাত তিমিরতলে এসো

গৌরবনিশীথে।

এই মূল্যহারা মম শুক্তি,

এসো মুক্তাকণায় তুমি মুক্তি।

মম মৌনী বীণার তারে তারে

এসো সংগীতে।

নব-অরুণের এসো আহ্বান--

চিররজনীর হোক অবসান, এসো।

এসো শুভস্মিত শুকতারায়,

এসো শিশির-অশ্রুধারায়,

সিন্দুর পরাও উষারে

তব রশ্মিতে॥

প্রকৃতি, এইবার তোমার আয়নাটা নিয়ে দেখো। দেখছ--কালো ছায়া পড়েছে বেদীটার উপরে? আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে, পারছি নে। দেখো আয়নাটা--আর কত দেরি।

না, দেখব না, দেখব না, আমি শুনব মনের মধ্যে--ধ্যানের মধ্যে। হঠাৎ সামনে দেখব যদি দেখা দেন। আর-একটু সয়ে থাকো, মা--দেবেন দেখা, নিশ্চয় দেবেন। ঐ দেখো, হঠাৎ এল ঝড়, আগমনীর ঝড়, পদভরে পৃথিবী কাঁপছে থর্‌থরিয়ে, বুক উঠছে গুর্‌গুর্‌ করে।

আনছে তোর অভিশাপ হতভাগিনী। আমাকে তো মেরে ফেললে! ছিঁড়ল বুঝি শিরাগুলো।

অভিশাপ নয়, অভিশাপ নয়, আনছে আমার জন্মান্তর, মরণের সিংহদ্বার খুলছে, বজ্রের হাতুড়ি মেরে। ভাঙল দরজা, ভাঙল প্রাচীর, ভাঙল আমার এ জন্মের সমস্ত মিথ্যে। ভয়ে কাঁপছে আমার মন, আনন্দে দুলছে আমার প্রাণ। ও আমার সর্বনাশ, ও আমার সর্বস্ব, তুমি এসেছ--আমার সমস্ত অপমানের চূড়ায় তোমাকে বসাব, গাঁথব তোমার সিংহাসন। আমার লজ্জা দিয়ে, ভয় দিয়ে, আনন্দ দিয়ে।

সময় হয়ে আসছে আমার। আর পারছি নে। শিগ্‌গির দেখ্‌ তোর আয়নাটা।

মা, ভয় হচ্ছে। তাঁর পথ আসছে শেষ হয়ে--তার পরে? তার পরে কী। শুধু এই আমি! আর কিচ্ছু না। এতদিনের নিষ্ঠুর দুঃখ এতেই ভরবে? শুধু আমি? কিসের জন্যে এত দীর্ঘ, এত দুর্গম পথ! শেষ কোথায় এর! শুধু এই আমাতে!

পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়,

কী আছে শেষে।

এত কামনা এত সাধনা কোথায় মেশে।

ঢেউ ওঠে-পড়ে কাঁদার,

সম্মুখে ঘন আঁধার--

পার আছে কোন্‌ দেশে।

আজ ভাবি মনে মনে,

মরীচিকা-অন্বেষণে

বুঝি তৃষ্ণার শেষ নেই--

মনে ভয় লাগে সেই,

হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা

চলেছে নিরুদ্দেশে॥

ও নিষ্ঠুর মেয়ে, দয়া কর্‌ আমাকে, আমার আর সহ্য হয় না। শিগ্‌গির আয়নাটা দেখ্‌।

(আয়নাটা দেখেই ফেলে দিল) মা, ওমা, ওমা রাখ্‌ রাখ্‌ রাখ্‌ রাখ্‌, ফিরিয়ে নে ফিরিয়ে নে তোর মন্ত্র! এখনি, এখনি। ওরে ও রাক্ষুসী, কী করলি, কী করলি, তুই মরলি নে কেন! কী দেখলেম! ওগো, কোথায় আমার সেই দীপ্ত উজ্জ্বল, সেই শুভ্র নির্মল, সেই সুদূর স্বর্গের আলো! কী ম্লান, কী ক্লান্ত, আত্মপরাজয়ের কী প্রকাণ্ড বোঝা নিয়ে এল আমার দ্বারে! মাথা হেঁট করে এল! যাক্‌, যাক, এ-সব যাক (পা দিয়ে মন্ত্রের উপকরণ ভেঙে ছড়িয়ে ফেললে)--ওরে, তুই চণ্ডালিনী না হোস যদি, অপমান করিস নে বীরের। জয় হোক তাঁর জয় হোক।

আনন্দের প্রবেশ

প্রভু, এসেছ আমাকে উদ্ধার করতে--তাই এত দুঃখই পেলে--ক্ষমা করো, ক্ষমা করো। অসীম গ্লানি পদাঘাতে দূর করে দাও। টেনে এনেছি তোমাকে মাটিতে, নইলে কেমন করে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে তোমার পুণ্যলোকে! ওগো নির্মল, পায়ে তোমার ধুলো লেগেছে, সার্থক হবে সেই ধুলো-লাগা। আমার মায়া-আবরণ পড়বে খসে তোমার পায়ে, ধুলো সব নেবে মুছে। জয় হোক, তোমার জয় হোক, তোমার জয় হোক!

জয় হোক, প্রভু। আমার পাপ আর আমার প্রাণ দুই পড়ল তোমার পায়ে, আমার দিন ফুরল ঐখানেই--তোমার ক্ষমার তীরে এসে।

               বুদ্ধো সুসুদ্ধো করুণামহাণ্নবো

               যোচ্চন্ত সুদ্ধব্বর-ঞানলোচনো।

               লোকস্‌স পাপূপকিলেসঘাতকো।

               বন্দামি বুদ্ধম্‌ অহমাদরেণ তম্‌॥