ডাকঘর (dakghar)

     

    মাধব দত্ত।
    মুশকিলে পড়ে গেছি। যখন ও ছিল না, তখন ছিলই না -- কোনো ভাবনাই ছিল না। এখন ও কোথা থেকে এসে আমার ঘর জুড়ে বসল; ও চলে গেলে আমার এ ঘর যেন আর ঘরই থাকবে না। কবিরাজমশায়, আপনি কি মনে করেন ওকে --
    কবিরাজ।
    ওর ভাগ্যে যদি আয়ু থাকে, তা হলে দীর্ঘকাল বাঁচতেও পারে; কিন্তু আয়ুর্বেদে যেরকম লিখছে তাতে তো --
    মাধব দত্ত।
    বলেন কী!
    কবিরাজ।
    শাস্ত্রে বলছেন, পৈত্তিকান্‌ সন্নিপাতজান্‌ কফবাতসমুদ্ভবান্‌--
    মাধব দত্ত।
    থাক্‌ থাক্‌, আপনি আর ঐ শ্লোকগুলো আওড়াবেন না -- ওতে আরো আমার ভয় বেড়ে যায়। এখন কী করতে হবে সেইটে বলে দিন।
    কবিরাজ।
    (নস্য লইয়া) খুব সাবধানে রাখতে হবে।
    মাধব দত্ত।
    সে তো ঠিক কথা, কিন্তু কী বিষয়ে সাবধান হতে হবে সেইটে স্থির করে দিয়ে যান।
    কবিরাজ।
    আমি তো পূর্বেই বলেছি, ওকে বাইরে একেবারে যেতে দিতে পারবেন না।
    মাধব দত্ত।
    ছেলেমানুষ, ওকে দিনরাত ঘরের মধ্যে ধরে রাখা যে ভারি শক্ত।
    কবিরাজ।
    তা কী করবেন বলেন। এই শরৎকালের রৌদ্র আর বায়ু দুই-ই ঐ বালকের পক্ষে বিষবৎ -- কারণ কিনা শাস্ত্রে বলছে, অপস্মারে জ্বরে কাশে কামলায়াং হলীমকে --
    মাধব দত্ত।
    থাক্‌ থাক্‌, আপনার শাস্ত্র থাক্‌। তা হলে ওকে বন্ধ করেই রেখে দিতে হবে --অন্য কোনো উপায় নেই?
    কবিরাজ।
    কিছু না, কারণ, পবনে তপনে চৈব --
    মাধব দত্ত।
    আপনার ও চৈব নিয়ে আমার কী হবে বলেন তো। ও থাক্‌-না -- কী করতে হবে সেইটে বলে দিন। কিন্তু আপনার ব্যবস্থা বড়ো কঠোর। রোগের সমস্ত দুঃখ ও-বেচারা চুপ করে সহ্য করে -- কিন্তু আপনার ওষুধ খাবার সময় ওর কষ্ট দেখে আমার বুক ফেটে যায়।
    কবিরাজ।
    সেই কষ্ট যত প্রবল তার ফলও তত বেশি -- তাই তো মহর্ষি চ্যবন বলেছেন, ভেষজং হিতবাক্যঞ্চ তিক্তং আশুফলপ্রদং। আজ তবে উঠি দত্তমশায়!
    [ প্রস্থান
    ঠাকুরদার প্রবেশ
    মাধব দত্ত।
    ঐ রে ঠাকুরদা এসেছে! সর্বনাশ করলে!
    ঠাকুরদা।
    কেন? আমাকে তোমার ভয় কিসের?
    মাধব দত্ত।
    তুমি যে ছেলে খেপাবার সদ্দার।
    ঠাকুরদা।
    তুমি তো ছেলেও নও, তোমার ঘরেও ছেলে নেই -- তোমার খেপবার বয়সও গেছে -- তোমার ভাবনা কী।
    মাধব দত্ত।
    ঘরে যে ছেলে একটি এনেছি।
    ঠাকুরদা।
    সে কী-রকম!
    মাধব দত্ত।
    আমার স্ত্রী যে পোষ্যপুত্র নেবার জন্যে ক্ষেপে উঠেছিল।
    ঠাকুরদা।
    সে তো অনেকদিন থেকে শুনছি, কিন্তু তুমি যে নিতে চাও না।
    মাধব দত্ত।
    জান তো ভাই, অনেক কষ্টে টাকা করেছি, কোথা থেকে পরের ছেলে এসে আমার বহু পরিশ্রমের ধন বিনা পরিশ্রমে ক্ষয় করতে থাকবে, সে কথা মনে করলেও আমার খারাপ লাগত। কিন্তু এই ছেলেটিকে আমার যে কিরকম লেগে গিয়েছে --
    ঠাকুরদা।
    তাই এর জন্যে টাকা যতই খরচ করছ, ততই মনে করছ, সে যেন টাকার পরম ভাগ্য।
    মাধব দত্ত।
    আগে টাকা রোজগার করতুম, সে কেবল একটা নেশার মতো ছিল -- না করে কোনোমতে থাকতে পারতুম না। কিন্তু এখন যা টাকা করছি, সবই ঐ ছেলে পাবে জেনে উপার্জনে ভারি একটা আনন্দ পাচ্ছি।
    ঠাকুরদা।
    বেশ, বেশ ভাই, ছেলেটি কোথায় পেলে বলো দেখি।
    মাধব দত্ত।
    আমার স্ত্রীর গ্রামসম্পর্কে ভাইপো। ছোটোবেলা থেকে বেচারার মা নেই। আবার সেদিন তার বাপও মারা গেছে।
    ঠাকুরদা।
    আহা! তবে তো আমাকে তার দরকার আছে।
    মাধব দত্ত।
    কবিরাজ বলছে তার ঐটুকু শরীরে একসঙ্গে বাত পিত্ত শ্লেষ্মা যে-রকম প্রকুপিত হয়ে উঠেছে, তাতে তার আর বড়ো আশা নেই। এখন একমাত্র উপায় তাকে কোনোরকমে এই শরতের রৌদ্র আর বাতাস থেকে বাঁচিয়ে ঘরে বন্ধ করে রাখা। ছেলেগুলোকে ঘরের বার করাই তোমার এই বুড়োবয়সের খেলা -- তাই তোমাকে ভয় করি।
    ঠাকুরদা।
    মিছে বল নি -- একেবারে ভয়ানক হয়ে উঠেছি আমি, শরতের রৌদ্র আর হাওয়ারই মতো। কিন্তু ভাই, ঘরে ধরে রাখবার মতো খেলাও আমি কিছু জানি। আমার কাজকর্ম একটু সেরে আসি, তার পরে ঐ ছেলেটির সঙ্গে ভাব করে নেব।
    [ প্রস্থান
    অমল গুপ্তের প্রবেশ
    অমল।
    পিসেমশায়!
    মাধব দত্ত।
    কী অমল?
    অমল।
    আমি কি ঐ উঠোনটাতেও যেতে পারব না?
    মাধব দত্ত।
    না বাবা!
    অমল।
    ঐ যেখানটাতে পিসিমা জাঁতা দিয়ে ডাল ভাঙেন। ঐ দেখো-না, যেখানে ভাঙা ডালের খুদগুলি দুই হাতে তুলে নিয়ে লেজের উপর ভর দিয়ে বসে কাঠবিড়ালি কুটুস কুটুস করে খাচ্ছে -- ওখানে আমি যেতে পারব না?
    মাধব দত্ত।
    না বাবা!
    অমল।
    আমি যদি কাঠবিড়ালি হতুম তবে বেশ হত। কিন্তু পিসেমশায়, আমাকে কেন বেরোতে দেবে না?
    মাধব দত্ত।
    কবিরাজ যে বলেছে বাইরে গেলে তোমার অসুখ করবে।
    অমল।
    কবিরাজ কেমন করে জানলে?
    মাধব দত্ত।
    বল কী অমল! কবিরাজ জানবে না! সে যে এত বড়ো বড়ো পুঁথি পড়ে ফেলেছে!
    অমল।
    পুঁথি পড়লেই কি সমস্ত জানতে পারে?
    মাধব দত্ত।
    বেশ! তাও বুঝি জান না!
    অমল।
    (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) আমি যে পুঁথি কিছুই পড়ি নি -- তাই জানি নে।
    মাধব দত্ত।
    দেখো, বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা সব তোমারই মতো -- তারা ঘর থেকে তো বেরোয় না।
    অমল।
    বেরোয় না?
    মাধব দত্ত।
    না, কখন বেরোবে বলো। তারা বসে বসে কেবল পুঁথি পড়ে -- আর-কোনো দিকেই তাদের চোখ নেই। অমলবাবু, তুমিও বড়ো হলে পণ্ডিত হবে -- বসে বসে এই এত বড়ো বড়ো সব পুথিঁ পড়বে -- সবাই দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে।
    অমল।
    না, না পিসেমশায়, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমি পণ্ডিত হব না -- পিসেমশায়, আমি পণ্ডিত হব না।
    মাধব দত্ত।
    সে কী কথা অমল! যদি পণ্ডিত হতে পারতুম, তা হলে আমি তো বেঁচে যেতুম।
    অমল।
    আমি, যা আছে সব দেখব -- কেবলি দেখে বেড়াব।
    মাধব দত্ত।
    শোনো একবার! দেখবে কী? দেখবার এত আছেই বা কী?
    অমল।
    আমাদের জানলার কাছে বসে সেই-যে দূরে পাহাড় দেখা যায় -- আমার ভারি ইচ্ছে করে ঐ পাহাড়টার পার হয়ে চলে যাই।
    মাধব দত্ত।
    কী পাগলের মতো কথা! কাজ নেই কর্ম নেই, খামকা পাহাড়টা পার হয়ে চলে যাই! কী যে বলে তার ঠিক নেই। পাহাড়টা যখন মস্ত বেড়ার মতো উঁচু হয়ে আছে তখন তো বুঝতে হবে ওটা পেরিয়ে যাওয়া বারণ -- নইলে এত বড়ো বড়ো পাথর জড়ো করে এতবড়ো একটা কাণ্ড করার দরকার কী ছিল!
    অমল।
    পিসেমশায়, তোমার কি মনে হয় ও বারণ করছে? আমার ঠিক বোধ হয় পৃথিবীটা কথা কইতে পারে না, তাই অমনি করে নীল আকাশে হাত তুলে ডাকছে। অনেক দূরের যারা ঘরের মধ্যে বসে থাকে তারাও দুপুরবেলা একলা জানলার ধারে বসে ঐ ডাক শুনতে পায়। পণ্ডিতরা বুঝি শুনতে পায় না?
    মাধব দত্ত।
    তারা তো তোমার মতো খেপা নয় -- তারা শুনতে চায়ও না।
    অমল।
    আমার মতো খেপা আমি কালকে একজনকে দেখেছিলুম।
    মাধব দত্ত।
    সত্যি নাকি? কী রকম শুনি।
    অমল।
    তার কাঁধে এক বাঁশের লাঠি। লাঠির আগায় একটা পুঁটুলি বাঁধা। তার বাঁ হাতে একটা ঘটি। পুরানো একজোড়া নাগরাজুতো পরে সে এই মাঠের পথ দিয়ে ঐ পাহাড়ের দিকেই যাচ্ছিল। আমি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলুম, তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বললে, কী জানি, যেখানে হয়। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কেন যাচ্ছ? সে বললে, কাজ খুঁজতে যাচ্ছি। আচ্ছা পিসেমশায়, কাজ কি খুঁজতে হয়?
    মাধব দত্ত।
    হয় বৈকি। কত লোক কাজ খুঁজে বেড়ায়।
    অমল।
    বেশ তো। আমিও তাদের মতো কাজ খুঁজে বেড়াব।
    মাধব দত্ত।
    খুঁজে যদি না পাও।
    অমল।
    খুঁজে যদি না পাই তো আবার খুঁজব। তার পরে সেই নাগরাজুতো পরা লোকটা চলে গেল -- আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলুম। সেই যেখানে ডুমুরগাছের তলা দিয়ে ঝরনা বয়ে যাচ্ছে, সেইখানে সে লাঠি নামিয়ে রেখে ঝরনার জলে আস্তে আস্তে পা ধুয়ে নিলে -- তার পরে পুঁটুলি খুলে ছাতু বের করে জল দিয়ে মেখে নিয়ে খেতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে আবার পুঁটুলি বেঁধে ঘাড়ে করে নিলে -- পায়ের কাপড় গুটিয়ে নিয়ে সেই ঝরনার ভিতর নেমে জল কেটে কেটে কেমন পার হয়ে চলে গেল। পিসিমাকে বলে রেখেছি ঐ ঝরনার ধারে গিয়ে একদিন আমি ছাতু খাব।
    মাধব দত্ত।
    পিসিমা কী বললে?
    অমল।
    পিসিমা বললেন, তুমি ভালো হও, তার পর তোমাকে ঐ ঝরনার ধারে নিয়ে গিয়ে ছাতু খাইয়ে আনব। কবে আমি ভালো হব?
    মাধব দত্ত।
    আর তো দেরি নেই বাবা!
    অমল।
    দেরি নেই? ভালো হলেই কিন্তু আমি চলে যাব।
    মাধব দত্ত।
    কোথায় যাবে?
    অমল।
    কত বাঁকা বাঁকা ঝরনার জলে আমি পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে পার হতে হতে চলে যাব -- দুপুরবেলায় সবাই যখন ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে, তখন আমি কোথায় কতদূরে কেবল কাজ খুঁজে খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে চলে যাব।
    মাধব দত্ত।
    আচ্ছা বেশ, আগে তুমি ভালো হও, তার পরে তুমি --
    অমল।
    তার পরে আমাকে পণ্ডিত হতে বোলো না পিসেমশায়!
    মাধব দত্ত।
    তুমি কী হতে চাও বলো।
    অমল।
    এখন আমার কিছু মনে পড়ছে না -- আচ্ছা আমি ভেবে বলব।
    মাধব দত্ত।
    কিন্তু তুমি অমন করে যে-সে বিদেশী লোককে ডেকে ডেকে কথা বোলো না।
    অমল।
    বিদেশী লোক আমার ভারি ভালো লাগে।
    মাধব দত্ত।
    যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যেত?
    অমল।
    তা হলে তো সে বেশ হত। কিন্তু আমাকে তো কেউ ধরে নিয়ে যায় না -- সব্বাই কেবল বসিয়ে রেখে দেয়।
    মাধব দত্ত।
    আমার কাজ আছে আমি চললুম -- কিন্তু বাবা দেখো, বাইরে যেন বেরিয়ে যেয়ো না।
    অমল।
    যাব না। কিন্তু পিসেমশায়, রাস্তার ধারের এই ঘরটিতে আমি বসে থাকব।

    অমল শয্যাগত
    অমল।
    পিসেমশায়, আজ আর আমার সেই জানলার কাছেও যেতে পারব না? কবিরাজ বারণ করেছে?
    মাধব দত্ত।
    হাঁ বাবা। সেখানে রোজ রোজ বসে থেকেই তো তোমার ব্যামো বেড়ে গেছে।
    অমল।
    না পিসেমশায়, না -- আমার ব্যামোর কথা আমি কিছুই জানি নে কিন্তু সেখানে থাকলে আমি খুব ভালো থাকি।
    মাধব দত্ত।
    সেখানে বসে বসে তুমি এই শহরের যত রাজ্যের ছেলেবুড়ো সকলের সঙ্গেই ভাব করে নিয়েছ -- আমার দরজার কাছে রোজ যেন একটা মস্ত মেলা বসে যায় -- এতেও কি কখনো শরীর টেকে! দেখো দেখি, আজ তোমার মুখখানা কী রকম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে!
    অমল।
    পিসেমশায়, আমার সেই ফকির হয়তো আজ আমাকে জানলার কাছে না দেখতে পেয়ে চলে যাবে।
    মাধব দত্ত।
    তোমার আবার ফকির কে?
    অমল।
    সেই যে রোজ আমার কাছে এসে নানা দেশবিদেশের কথা বলে যায় -- শুনতে আমার ভারি ভালো লাগে।
    মাধব দত্ত।
    কই আমি তো কোনো ফকিরকে জানি নে।
    অমল।
    এই ঠিক তার আসবার সময় হয়েছে -- তোমার পায়ে পড়ি, তুমি তাকে একবার বলে এসো না, সে যেন আমার ঘরে এসে একবার বসে।
    ফকিরবেশে ঠাকুরদার প্রবেশ
    অমল।
    এই-যে, এই-যে ফকির -- এসো আমার বিছানায় এসে বসো।
    মাধব দত্ত।
    এ কী। এ যে --
    ঠাকুরদা।
    (চোখ ঠারিয়া) আমি ফকির।
    মাধব দত্ত।
    তুমি যে কী নও তা তো ভেবে পাই নে!
    অমল।
    এবারে তুমি কোথায় গিয়েছিলে ফকির?
    ফকির।
    আমি ক্রৌঞ্চদ্বীপে গিয়েছিলুম -- সেইখান থেকেই এইমাত্র আসছি।
    মাধব দত্ত।
    ক্রৌঞ্চদ্বীপে?
    ফকির।
    এতে আশ্চর্য হও কেন? তোমাদের মতো আমাকে পেয়েছ? আমার তো যেতে কোনো খরচ নেই। আমি যেখানে খুশি যেতে পারি।
    অমল।
    (হাততালি দিয়া) তোমার ভারি মজা। আমি যখন ভালো হব তখন তুমি আমাকে চেলা করে নেবে বলেছিলে, মনে আছে ফকির?
    ঠাকুরদা।
    খুব মনে আছে। বেড়াবার এমন সব মন্ত্র শিখিয়ে দেব যে সমুদ্রে পাহাড়ে অরণ্যে কোথাও কিছুতে বাধা দিতে পারবে না।
    মাধব দত্ত।
    এ-সব কী পাগলের মতো কথা হচ্ছে তোমাদের!
    ঠাকুরদা।
    বাবা অমল, পাহাড়-পর্বত-সমুদ্রকে ভয় করি নে -- কিন্তু তোমার এই পিসেটির সঙ্গে যদি আবার কবিরাজ এসে জোটেন তা হলে আমার মন্ত্রকে হার মানতে হবে।
    অমল।
    না, না, পিসেমশায়, তুমি কবিরাজকে কিছু বোলো না। -- এখন আমি এইখানেই শুয়ে থাকব, কিচ্ছু করব না -- কিন্তু যেদিন আমি ভালো হব সেইদিনই আমি ফকিরের মন্ত্র নিয়ে চলে যাব -- নদী-পাহাড়-সমুদ্রে আমাকে আর ধরে রাখতে পারবে না।
    মাধব দত্ত।
    ছি, বাবা, কেবলই অমন যাই-যাই করতে নেই -- শুনলে আমার মন কেমন খারাপ হয়ে যায়।
    অমল।
    ক্রৌঞ্চদ্বীপ কী-রকম দ্বীপ আমাকে বলো-না ফকির!
    ঠাকুরদা।
    সে ভারি আশ্চর্য জায়গা। সে পাখিদের দেশ -- সেখানে মানুষ নেই। তারা কথা কয় না, চলে না, তারা গান গায় আর ওড়ে।
    অমল।
    বাঃ, কী চমৎকার! সমুদ্রের ধারে?
    ঠাকুরদা।
    সমুদ্রের ধারে বই কি।
    অমল।
    সব নীল রঙের পাহাড় আছে?
    ঠাকুরদা।
    নীল পাহাড়েই তো তাদের বাসা। সন্ধের সময় সেই পাহাড়ের উপর সূর্যাস্তের আলো এসে পড়ে আর ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ রঙের পাখি তাদের বাসায় ফিরে আসতে থাকে -- সেই আকাশের রঙে পাখির রঙে পাহাড়ের রঙে সে এক কাণ্ড হয়ে ওঠে।
    অমল।
    পাহাড়ে ঝরনা আছে?
    ঠাকুরদা।
    বিলক্ষণ! ঝরনা না থাকলে কি চলে! একেবারে হীরে গালিয়ে ঢেলে দিচ্ছে। আর তার কী নৃত্য! নুড়িগুলোকে ঠুং-ঠাং ঠুং-ঠাং করে বাজাতে বাজাতে কেবই কল্‌ কল্‌ ঝর্‌ ঝর্‌ করতে করতে ঝরনাটি সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে। কোনো কবিরাজের বাবার সাধ্য নেই তাকে একদণ্ড কোথাও আটকে রাখে। পাখিগুলো আমাকে নিতান্ত তুচ্ছ একটা মানুষ বলে যদি একঘরে করে না রাখত তা হলে ঐ ঝরনার ধারে তাদের হাজার হাজার বাসার একপাশে বাসা বেঁধে সমুদ্রের ঢেউ দেখে দেখে সমস্ত দিনটা কাটিয়ে দিতুম।
    অমল।
    আমি যদি পাখি হতুম তা হলে --
    ঠাকুরদা।
    তা হলে একটা ভারি মুশকিল হত। শুনলুম, তুমি নাকি দইওআলাকে বলে রেখেছ বড়ো হলে তুমি দই বিক্রি করবে -- পাখিদের মধ্যে তোমার দইয়ের ব্যবসাটা তেমন বেশ জমত না। বোধ হয় ওতে তোমার কিছু লোকসানই হত।
    মাধব দত্ত।
    আর তো আমার চলল না। আমাকে সুদ্ধ তোমরা খেপিয়ে দেবে দেখছি। আমি চললুম।
    অমল।
    পিসেমশায়, আমার দইওআলা এসে চলে গেছে?
    মাধব দত্ত।
    গেছে বৈকি। তোমার ঐ শখের ফকিরের তলপি বয়ে ক্রৌঞ্চদ্বীপের পাখির বাসায় উড়ে বেড়ালে তার তো পেট চলে না। সে তোমার জন্য এক ভাঁড় দই রেখে গেছে। বলে গেছে, তাদের গ্রামে তার বোনঝির বিয়ে -- তাই সে কলমিপাড়ায় বাঁশির ফরমাশ দিতে যাচ্ছে -- তাই বড়ো ব্যস্ত আছে।
    অমল।
    সে যে বলেছিল, আমার সঙ্গে তার ছোটো বোনঝিটির বিয়ে দেবে।
    ঠাকুরদা।
    তবে তো বড়ো মুশকিল দেখছি।
    অমল।
    বলেছিল, সে আমার টুকটুকে বউ হবে -- তার নাকে নোলক, তার লাল ডুরে শাড়ি। সে সকালবেলা নিজের হাতে কালো গোরু দুইয়ে নতুন মাটির ভাঁড়ে আমাকে ফেনাসুদ্ধ দুধ খাওয়াবে, আর সন্ধের সময় গোয়ালঘরে প্রদীপ দেখিয়ে এসে আমার কাছে বসে সাত ভাই চম্পার গল্প করবে।
    ঠাকুরদা।
    বা, বা, খাসা বউ তো! আমি যে ফকির মানুষ আমারই লোভ হয়। তা বাবা ভয় নেই, এবারকার মতো বিয়ে দিক-না, আমি তোমাকে বলছি, তোমার দরকার হলে কোনোদিন ওর ঘরে বোনঝির অভাব হবে না।
    মাধব দত্ত।
    যাও, যাও। আর তো পারা যায় না।
    [ প্রস্থান
    অমল।
    ফকির, পিসেমশাই তো গিয়েছেন -- এইবার আমাকে চুপিচুপি বলো না ডাকঘরে কি আমার নামে রাজার চিঠি এসেছে।
    ঠাকুরদা।
    শুনেছি তো তাঁর চিঠি রওনা হয়ে বেরিয়েছে। সে-চিঠি এখন পথে আছে।
    অমল।
    পথে? কোন্‌ পথে! সেই যে বৃষ্টি হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে অনেক দূরে দেখা যায়, সেই ঘন বনের পথে?
    ঠাকুরদা।
    তবে তো তুমি সব জান দেখছি, সেই পথেই তো।
    অমল।
    আমি সব জানি ফকির!
    ঠাকুরদা।
    তাই তো দেখতে পাচ্ছি -- কেমন করে জানলে?
    অমল।
    তা আমি জানি নে। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই -- মনে হয় যেন আমি অনেকবার দেখেছি -- সে অনেকদিন আগে -- কতদিন তা মনে পড়ে না। বলব? আমি দেখতে পাচ্ছি, রাজার ডাক-হরকরা পাহাড়ের উপর থেকে একলা কেবলই নেমে আসছে -- বাঁ হাতে তার লণ্ঠন, কাঁধে তার চিঠির থলি। কত দিন কত রাত ধরে সে কেবলই নেমে আসছে। পাহাড়ের পায়ের কাছে ঝরনার পথ যেখানে ফুরিয়েছে সেখানে বাঁকা নদীর পথ ধরে সে কেবলই চলে আসছে -- নদীর ধারে জোয়ারির খেত, তারই সরু গলির ভেতর দিয়ে দিয়ে সে কেবল আসছে -- তার পরে আখের খেত -- সেই আখের খেতের পাশ দিয়ে উঁচু আল চলে গিয়েছে, সেই আলের উপর দিয়ে সে কেবলই চলে আসছে -- রাতদিন একলাটি চলে আসছে; খেতের মধ্যে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে -- নদীর ধারে একটিও মানুষ নেই, কেবল কাদাখোঁচা লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে বেড়াচ্ছে -- আমি সমস্ত দেখতে পাচ্ছি। যতই সে আসছে দেখছি, আমার বুকের ভিতরে ভারি খুশি হয়ে হয়ে উঠছে।
    ঠাকুরদা।
    অমন নবীন চোখ তো আমার নেই তবু তোমার দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমিও দেখতে পাচ্ছি।
    অমল।
    আচ্ছা ফকির, যাঁর ডাকঘর তুমি সেই রাজাকে জান?
    ঠাকুরদা।
    জানি বৈকি। আমি যে তাঁর কাছে রোজ ভিক্ষা নিতে যাই।
    অমল।
    সে তো বেশ! আমি ভালো হয়ে উঠলে আমিও তাঁর কাছে ভিক্ষা নিতে যাব। পারব না যেতে?
    ঠাকুরদা।
    বাবা, তোমার আর ভিক্ষার দরকার হবে না, তিনি তোমাকে যা দেবেন অমনিই দিয়ে দেবেন।
    অমল।
    না, না, আমি তাঁর দরজার সামনে পথের ধারে দাঁড়িয়ে জয় হোক বলে ভিক্ষা চাইব -- আমি খঞ্জনি বাজিয়ে নাচব -- সে বেশ হবে, না?
    ঠাকুরদা।
    সে খুব ভালো হবে। তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে আমারও পেট ভরে ভিক্ষা মিলবে। তুমি কী ভিক্ষা চাইবে?
    অমল।
    আমি বলব, আমাকে তোমার ডাক-হরকরা করে দাও, আমি অমনি লণ্ঠন হাতে ঘরে ঘরে তোমার চিঠি বিলি করে বেড়াব। জান ফকির, আমাকে একজন বলেছে আমি ভালো হয়ে উঠলে সে আমাকে ভিক্ষা করতে শেখাবে। আমি তার সঙ্গে যেখানে খুশি ভিক্ষা করে বেড়াব।
    ঠাকুরদা।
    কে বলো দেখি?
    অমল।
    ছিদাম।
    ঠাকুরদা।
    কোন্‌ ছিদাম?
    অমল।
    সেই যে অন্ধ খোঁড়া। সে রোজ আমার জানলার কাছে আসে। ঠিক আমার মতো একজন ছেলে তাকে চাকার গাড়িতে করে ঠেলে ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। আমি তাকে বলেছি, আমি ভালো হয়ে উঠলে তাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে বেড়াব।
    ঠাকুরদা।
    সে তো বেশ মজা হবে দেখছি।
    অমল।
    সেই আমাকে বলেছে কেমন করে ভিক্ষা করতে হয় আমাকে শিখিয়ে দেবে। পিসেমশায়কে আমি বলি ওকে ভিক্ষা দিতে, তিনি বলেন ও মিথ্যা কানা, মিথ্যা খোঁড়া। আচ্ছা, ও যেন মিথ্যা কানা-ই হল, কিন্তু চোখে দেখতে পায় না --সেটা তো সত্যি।
    ঠাকুরদা।
    ঠিক বলেছ বাবা, ওর মধ্যে সত্যি হচ্ছে ওইটুকু যে, ও চোখে দেখতে পায় না -- তা ওকে কানা বল আর না-ই বল। তা ও ভিক্ষা পায় না, তবে তোমার কাছে বসে থাকে কী করতে।
    অমল।
    ওকে যে আমি শোনাই কোথায় কী আছে। বেচারা দেখতে পায় না। তুমি যে-সব দেশের কথা আমাকে বল সে-সব আমি ওকে শুনিয়ে দিই। তুমি সেদিন আমাকে সেই যে হালকা দেশের কথা বলেছিলে, যেখানে কোনো জিনিষের কোনো ভার নেই -- যেখানে একটু লাফ দিলেই অমনি পাহাড় ডিঙিয়ে চলে যাওয়া যায়,সেই হালকা দেশের কথা শুনে ও ভারি খুশি হয়ে উঠেছিল। আচ্ছা ফকির, সে দেশে কোন্‌ দিক দিয়ে যাওয়া যায়?
    ঠাকুরদা।
    ভিতরের দিক দিয়ে সে একটা রাস্তা আছে, সে হয়তো খুঁজে পাওয়া শক্ত।
    অমল।
    ও বেচারা যে অন্ধ, ও হয়তো দেখতেই পাবে না -- ওকে কেবল ভিক্ষাই করে বেড়াতে হবে। তাই নিয়ে ও দুঃখ করছিল -- আমি ওকে বললুম ভিক্ষা করতে গিয়ে তুমি যে কত বেড়াতে পাও, সবাই তো সে পায় না।
    ঠাকুরদা।
    বাবা, ঘরে বসে থাকলেই বা এত কিসের দুঃখ?
    অমল।
    না, না, দুঃখ নেই। প্রথমে যখন আমাকে ঘরের মধ্যে বসিয়ে রেখে দিয়েছিল আমার মনে হয়েছিল যেন দিন ফুরোচ্ছে না, আমাদের রাজার ডাকঘর দেখে অবধি এখন আমার রোজই ভালো লাগে -- এই ঘরের মধ্যে বসে বসেই ভালো লাগে -- একদিন আমার চিঠি এসে পৌঁছোবে, সে কথা মনে করলেই আমি খুব খুশি হয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারি। কিন্তু রাজার চিঠিতে কী যে লেখা থাকবে তা তো আমি জানি নে।
    ঠাকুরদা।
    তা না-ই জানলে। তোমার নামটি তো লেখা থাকবে -- তা হলেই হল।
    মাধব দত্তের প্রবেশ
    মাধব দত্ত।
    তোমরা দুজনে মিলে এ কী ফেসাদ বাধিয়ে বসে আছ বলো দেখি?
    ঠাকুরদা।
    কেন হয়েছে কী?
    মাধব দত্ত।
    শুনছি, তোমরা নাকি রটিয়েছ, রাজা তোমাদেরই চিঠি লিখবেন বলে ডাকঘর বসিয়েছেন।
    ঠাকুরদা।
    তাতে হয়েছে কী?
    মাধব দত্ত।
    আমাদের পঞ্চানন মোড়ল সেই কথাটি রাজার কাছে লাগিয়ে বেনামি চিঠি লিখে দিয়েছে।
    ঠাকুরদা।
    সকল কথাই রাজার কানে ওঠে, সে কি আমরা জানি নে?
    মাধব দত্ত।
    তবে সামলে চল না কেন। রাজাবাদশার নাম করে অমন যা-তা কথা মুখে আনো কেন? তোমরা যে আমাকে সুদ্ধ মুশকিলে ফেলবে।
    অমল।
    ফকির, রাজা কি রাগ করবে?
    ঠাকুরদা।
    অমনি বললেই হল! রাগ করবে! কেমন রাগ করে দেখি-না। আমার মতো ফকির আর তোমার মতো ছেলের উপর রাগ ক'রে সে কেমন রাজাগিরি ফলায় তা দেখা যাবে।
    অমল।
    দেখো ফকির, আজ সকালবেলা থেকে আমার চোখের উপর থেকে-থেকে অন্ধকার হয়ে আসছে; মনে হচ্ছে সব যেন স্বপ্ন। একেবারে চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করছে। কথা কইতে আর ইচ্ছে করছে না। রাজার চিঠি কি আসবে না? এখনই এই ঘর যদি সব মিলিয়ে যায় -- যদি --
    ঠাকুরদা।
    (অমলকে বাতাস করিতে করিতে) আসবে, চিঠি আজই আসবে।
    কবিরাজের প্রবেশ
    কবিরাজ।
    আজ কেমন ঠেকছে?
    অমল।
    কবিরাজমশায়, আজ খুব ভালো বোধ হচ্ছে -- মনে হচ্ছে যেন সব বেদনা চলে গেছে।
    কবিরাজ।
    (জনান্তিকে মাধব দত্তের প্রতি) ঐ হাসিটি তো ভালো ঠেকছে না। ওই যে বলছে খুব ভালো বোধ হচ্ছে ঐটেই হল খারাপ লক্ষণ। আমাদের চক্রধর দত্ত বলছেন --
    মাধব দত্ত।
    দোহাই কবিরাজমশায়, চক্রধর দত্তের কথা রেখে দিন। এখন বলুন ব্যাপারখানা কী।
    কবিরাজ।
    বোধ হচ্ছে, আর ধরে রাখা যাবে না। আমি তো নিষেধ করে গিয়েছিলুম কিন্তু বোধ হচ্ছে বাইরের হাওয়া লেগেছে।
    মাধব দত্ত।
    না কবিরাজমশায়, আমি ওকে খুব করেই চারি দিক থেকে আগলে সামলে রেখেছি। ওকে বাইরে যেতে দিই নে -- দরজা তো প্রায়ই বন্ধই রাখি।
    কবিরাজ।
    হঠাৎ আজ একটা কেমন হাওয়া দিয়েছে -- আমি দেখে এলুম, তোমাদের সদর-দরজার ভিতর দিয়ে হু হু করে হাওয়া বইছে। ওটা একেবারেই ভালো নয়। ও-দরজাটা বেশ ভালো করে তালাচাবি-বন্ধ করে দাও। না-হয় দিন দুই-তিন তোমাদের এখানে লোক-আনাগোনা বন্ধই থাক্‌ না। যদি কেউ এসে পড়ে খিড়কি-দরজা আছে। ঐ-যে জানলা দিয়ে সূর্যাস্তের আভাটা আসছে, ওটাও বন্ধ করে দাও, ওতে রোগীকে বড়ো জাগিয়ে রেখে দেয়।
    মাধব দত্ত।
    অমল চোখ বুজে রয়েছে, বোধ হয় ঘুমোচ্ছে। ওর মুখ দেখে মনে হয় যেন -- কবিরাজমশায়, যে আপনার নয় তাকে ঘরে এনে রাখলুম, তাকে ভালোবাসলুম, এখন বুঝি আর তাকে রাখতে পারব না।
    কবিরাজ।
    ওকী তোমার ঘরে যে মোড়ল আসছে! এ কী উৎপাত! আমি আসি ভাই! কিন্তু তুমি যাও, এখনই ভালো করে দরজাটা বন্ধ করে দাও। আমি বাড়ি গিয়েই একটা বিষবড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি -- সেইটে খাইয়ে দেখো -- যদি রাখবার হয় তো সেইটেতেই টেনে রাখতে পারবে।
    [ মাধব দত্ত ও কবিরাজের প্রস্থান
    মোড়লের প্রবেশ
    মোড়ল।
    কী রে ছোঁড়া!
    ঠাকুরদা।
    (তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আরে আরে, চুপ চুপ!
    অমল।
    না ফকির, তুমি ভাবছ আমি ঘুমোচ্ছি। আমি ঘুমোই নি। আমি সব শুনছি। আমি যেন অনেক দূরের কথাও শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে, আমার মা আমার বাবা যেন শিয়রের কাছে কথা কচ্ছেন।
    মাধব দত্তের প্রবেশ
    মোড়ল।
    ওহে মাধব দত্ত, আজকাল তোমাদের যে খুব বড়ো বড়ো লোকের সঙ্গে সম্বন্ধ।
    মাধব দত্ত।
    বলেন কী, মোড়লমশায়! এমন পরিহাস করবেন না। আমরা নিতান্তই সামান্য লোক।
    মোড়ল।
    তোমাদের এই ছেলেটি যে রাজার চিঠির জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
    মাধব দত্ত।
    ও ছেলেমানুষ, ও পাগল, ওর কথা কি ধরতে আছে!
    মোড়ল।
    না-না, এতে আর আশ্চর্য কী? তোমাদের মতো এমন যোগ্য ঘর রাজা পাবেন কোথায়? সেইজন্যেই দেখছ না, ঠিক তোমাদের জানলার সামনেই রাজার নতুন ডাকঘর বসেছে? ওরে ছোঁড়া, তোর নামে রাজার চিঠি এসেছে যে।
    অমল।
    (চমকিয়া উঠিয়া) সত্যি!
    মোড়ল।
    এ কি সত্যি না হয়ে যায়! তোমার সঙ্গে রাজার বন্ধুত্ব! (একখানা অক্ষরশূন্য কাগজ দিয়া) হা হা হা হা, এই যে তাঁর চিঠি।
    অমল।
    আমাকে ঠাট্টা কোরো না। ফকির, ফকির, তুমি বলো-না, এই কি সত্যি তাঁর চিঠি?
    ঠাকুরদা।
    হাঁ বাবা, আমি ফকির তোমাকে বলছি এই সত্য তাঁর চিঠি।
    অমল।
    কিন্তু,আমি যে এতে কিছুই দেখতে পাচ্ছি নে -- আমার চোখে আজ সব সাদা হয়ে গেছে! মোড়লমশায়, বলে দাও-না, এ-চিঠিতে কী লেখা আছে।
    মোড়ল।
    রাজা লিখছেন, আমি আজকালের মধ্যেই তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি, আমার জন্যে তোমাদের মুড়িমুড়কির ভোগ তৈরি করে রেখো -- রাজভবন আর আমার এক দণ্ড ভালো লাগছে না। হা হা হা হা!
    মাধব দত্ত।
    (হাত জোড় করিয়া) মোড়লমশায়, দোহাই আপনার, এ-সব কথা নিয়ে পরিহাস করবেন না।
    ঠাকুরদা।
    পরিহাস! কিসের পরিহাস! পরিহাস করেন, এমন সাধ্য আছে ওঁর!
    মাধব।
    আরে। ঠাকুরদা, তুমিও খেপে গেলে নাকি।
    ঠাকুরদা।
    হাঁ, আমি খেপেছি। তাই আজ এই সাদা কাগজে অক্ষর দেখতে পাচ্ছি। রাজা লিখছেন তিনি স্বয়ং অমলকে দেখতে আসছেন, তিনি তাঁর রাজ-কবিরাজকেও সঙ্গে করে আনছেন।
    অমল।
    ফকির, ওই যে, ফকির, তাঁর বাজনা বাজছে, শুনতে পাচ্ছ না?
    মোড়ল।
    হা হা হা হা! উনি আরো একটু না খেপলে তো শুনতে পাবেন না।
    অমল।
    মোড়লমশায়, আমি মনে করতুম,তুমি আমার উপর রাগ করেছ -- তুমি আমাকে ভালোবাস না। তুমি যে সত্যি রাজার চিঠি আনবে এ আমি মনে করি নি--দাও আমাকে তোমার পায়ের ধুলো দাও।
    মোড়ল।
    না, এ ছেলেটার ভক্তিশ্রদ্ধা আছে। বুদ্ধি নেই বটে, কিন্তু মনটা ভালো।
    অমল।
    এতক্ষণে চার প্রহর হয়ে গেছে বোধ হয়। ঐ যে ঢং ঢং ঢং -- ঢং ঢং ঢং। সন্ধ্যাতারা কি উঠেছে ফকির? আমি কেন দেখতে পাচ্ছি নে?
    ঠাকুরদা।
    ওরা যে জানলা বন্ধ করে দিয়েছে, আমি খুলে দিচ্ছি।
    বাহিরে দ্বারে আঘাত
    মাধব দত্ত।
    ওকি ও! ও কে ও! এ কী উৎপাত?
    (বাহির হইতে) খোলো দ্বার।
    মাধব দত্ত।
    কে তোমরা?
    (বাহির হইতে) খোলো দ্বার।
    মাধব দত্ত।
    মোড়লমশায়, এ তো ডাকাত নয়!
    মোড়ল।
    কে রে? আমি পঞ্চানন মোড়ল। তোদের মনে ভয় নেই নাকি।
    দেখো একবার, শব্দ থেমেছে। পঞ্চাননের আওয়াজ পেলে আর রক্ষা নেই যত বড়ো ডাকাতই হোক না --
    মাধব দত্ত।
    (জানলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া) দ্বার যে ভেঙে ফেলেছে, তাই আর শব্দ নেই।
    রাজদূতের প্রবেশ
    রাজদূত।
    মহারাজ আজ রাত্রে আসবেন।
    মোড়ল।
    কী সর্বনাশ!
    অমল।
    কত রাত্রে দূত? কত রাত্রে?
    দূত।
    আজ দুই প্রহর রাত্রে।
    অমল।
    যখন আমার বন্ধু প্রহরী নগরের সিংহদ্বারে ঘণ্টা বাজাবে ঢং ঢং ঢং, ঢং ঢং ঢং -- তখন?
    দূত।
    হাঁ, তখন। রাজা তাঁর বালক-বন্ধুটিকে দেখবার জন্যে তাঁর সকলের চেয়ে বড়ো কবিরাজকে পাঠিয়েছেন।
    রাজকবিরাজের প্রবেশ
    রাজকবিরাজ।
    একি! চারি দিকে সমস্তই যে বন্ধ! খুলে দাও, খুলে দাও, যত দ্বার-জানলা আছে সব খুলে দাও। -- (অমলের গায়ে হাত দিয়া) বাবা, কেমন বোধ করছ।
    অমল।
    খুব ভালো, খুব ভালো কবিরাজমশাই। আমার আর কোনো অসুখ নেই, কোনো বেদনা নেই। আঃ, সব খুলে দিয়েছ -- সব তারাগুলি দেখতে পাচ্ছি --অন্ধকারের ওপারকার সব তারা।
    রাজকবিরাজ।
    অর্ধরাত্রে যখন রাজা আসবেন তখন তুমি বিছানা ছেড়ে উঠে তাঁর সঙ্গে বেরোতে পারবে?
    অমল।
    পারব, আমি পারব। বেরোতে পারলে আমি বাঁচি। আমি রাজাকে বলব, এই অন্ধকার আকাশে ধ্রুবতারাটিকে দেখিয়ে দাও। আমি সে তারা বোধ হয় কতবার দেখেছি কিন্তু সে যে কোন্‌টা সে তো আমি চিনি নে।
    রাজকবিরাজ।
    তিনি সব চিনিয়ে দেবেন। (মাধবের প্রতি) এই ঘরটি রাজার আগমনের জন্যে পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখো। (মোড়লকে নির্দেশ করিয়া) ঐ লোকটিকে তো এ-ঘরে রাখা চলবে না।
    অমল।
    না, না, কবিরাজমশায়, উনি আমার বন্ধু। তোমরা যখন আস নি উনিই আমাকে রাজার চিঠি এনে দিয়েছিলেন।
    রাজকবিরাজ।
    আচ্ছা, বাবা, উনি যখন তোমার বন্ধু তখন উনিও এ-ঘরে রইলেন।
    মাধব দত্ত।
    (অমলের কানে কানে) বাবা, রাজা তোমাকে ভালোবাসেন, তিনি স্বয়ং আজ আসছেন -- তাঁর কাছে আজ কিছু প্রার্থনা কোরো। আমাদের অবস্থা তো ভালো নয়। জান তো সব।
    অমল।
    সে আমি সব ঠিক করে রেখেছি, পিসেমশায় -- সে তোমার কোনো ভাবনা নেই।
    মাধব দত্ত।
    কী ঠিক করেছ বাবা?
    অমল।
    আমি তাঁর কাছে চাইব, তিনি যেন আমাকে তাঁর ডাকঘরের হরকরা করে দেন -- আমি দেশে দেশে ঘরে ঘরে তাঁর চিঠি বিলি করব।
    মাধব দত্ত।
    (ললাটে করাঘাত করিয়া) হায় আমার কপাল।
    অমল।
    পিসেমশায়, রাজা আসবেন, তাঁর জন্যে কী ভোগ তৈরি রাখবে।
    দূত।
    তিনি বলে দিয়েছেন তোমাদের এখানে তাঁর মুড়িমুড়কিরভোগ হবে।
    অমল।
    মুড়িমুড়কি! মোড়লমশায়, তুমি তো আগেই বলে দিয়েছিলে, রাজার সব খবরই তুমি জান! আমরা তো কিছুই জানতুম না।
    মোড়ল।
    আমার বাড়িতে যদি লোক পাঠিয়ে দাও তা হলে রাজার জন্যে ভালো ভালো কিছু --
    রাজকবিরাজ।
    কোনো দরকার নেই। এইবার তোমরা সকলে স্থির হও। এলো, এলো, ওর ঘুম এলো। আমি বালকের শিয়রের কাছে বসব -- ওর ঘুম আসছে। প্রদীপের আলো নিবিয়ে দাও -- এখন আকাশের তারাটি থেকে আলো আসুক, ওর ঘুম এসেছে।
    মাধব দত্ত।
    (ঠাকুরদার প্রতি) ঠাকুরদা, তুমি অমন মূর্তিটির মতো হাতজোড় করে নীরব হয়ে আছ কেন? আমার কেমন ভয় হচ্ছে। এ যা দেখছি এ-সব কি ভালো লক্ষণ! এরা আমার ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে কেন! তারার আলোতে আমার কী হবে।
    ঠাকুরদা।
    চুপ করো অবিশ্বাসী! কথা কোয়ো না।
    সুধার প্রবেশ
    সুধা।
    অমল।
    রাজকবিরাজ।
    ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
    সুধা।
    আমি যে ওর জন্যে ফুল এনেছি -- ওর হাতে কি দিতে পারব না।
    রাজকবিরাজ।
    আচ্ছা, দাও তোমার ফুল।
    সুধা।
    ও কখন জাগবে?
    রাজকবিরাজ।
    এখনই, যখন রাজা এসে ওকে ডাকবেন।
    সুধা।
    তখন তোমরা ওকে একটি কথা কানে কানে বলে দেবে?
    রাজকবিরাজ।
    কী বলব?
    সুধা।
    বোলো যে, সুধা তোমাকে ভোলে নি।
    •  
    •  

    Rendition

    Please Login first to submit a rendition. Click here for help.