গুরু (guru)
সহহে অভিনয়যোগ্য করিবার অভিপ্রায় অচলায়তন নাটকটি "গুরু" নামে এবং কিঞ্চিত রূপান্তরিত এবং লঘুতর আকারে প্রকাশ করা হইল।
শান্তিনিকেতন শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১লা ফাল্গুন
১৩২৪
১
অচলায়তন
একদল বালক
প্রথম।
ওরে ভাই শুনেছিস?
দ্বিতীয়।
শুনেছি -- কিন্তু চুপ কর!
তৃতীয়।
কেন বল দেখি?
দ্বিতীয়।
কী জানি বললে যদি অপরাধ হয়?
প্রথম।
কিন্তু উপাধ্যায়মশায় নিজে যে আমাকে বলেছেন।
তৃতীয়।
কী বলেছেন বল না।
প্রথম।
গুরু আসছেন।
সকলে।
গুরু আসছেন!
তৃতীয়।
ভয় করছে না ভাই?
দ্বিতীয়।
ভয় করছে।
প্রথম।
আমার ভয় করছে না, মনে হচ্ছে মজা।
তৃতীয়।
কিন্তু ভাই গুরু কী?
দ্বিতীয়।
তা জানি নে।
তৃতীয়।
কে জানে?
দ্বিতীয়।
এখানে কেউ জানে না।
প্রথম।
শুনেছি গুরু খুব বড়ো, খুব মস্ত বড়ো।
তৃতীয়।
তাহলে এখানে কোথায় ধরবে?
প্রথম।
পঞ্চকদাদা বলেন অচলায়তনে তাঁকে কোথাও ধরবে না।
তৃতীয়।
কোথাও না?
প্রথম।
কোথাও না।
তৃতীয়।
তাহলে কী হবে?
প্রথম।
ভারি মজা হবে।
[প্রস্থান
পঞ্চকের প্রবেশ
পঞ্চক।।
গান
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে কেউ তা জানে না।
আমার মন যে কাঁদে আপন মনে কেউ তা মানে না॥
ওরে ভাই, কে আছিস ভাই। কাকে ডেকে বলব, গুরু আসছেন।
সঞ্জীবের প্রবেশ
সঞ্জীব।
তাই তো শুনেছি। কিন্তু কে এসে খবর দিলে বলো তো।
পঞ্চক।
কে দিলে তা তো কেউ বলে না।
সঞ্জীব।
কিন্তু গুরু আসছেন বলে তুমি তো তৈরি হচ্ছ না, পঞ্চক?
পঞ্চক।
বাঃ, সেই জন্যেই তো পুঁথিপত্র সব ফেলে দিয়েছি।
সঞ্জীব।
সেই বুঝি তোমার তৈরি হওয়া?
পঞ্চক।
আরে, গুরু যখন না থাকেন তখনই পুঁথিপত্র। গুরু যখন আসবেন তখন ওই সব জঞ্জাল সরিয়ে দিয়ে সময় খোলসা করতে হবে। আমি সেই পুঁথি বন্ধ করবার কাজে ভয়ানক ব্যস্ত।
সঞ্জীব।
তাই তো দেখছি।
[প্রস্থান
পঞ্চক।।
গান
ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না।
ওহে জয়োত্তম, তুমি কাঁধে কিসের বোঝা নিয়ে চলেছ? বোঝা ফেলো। গুরু আসছেন যে।
জয়োত্তম।
আরে ছুঁয়ো না, এ-সব মাঙ্গল্য। গুরুর জন্যে সিংহদ্বার সাজাতে চলেছি।
পঞ্চক।
গুরু কোন্ দ্বার দিয়ে ঢুকবেন তা জানবে কী করে?
জয়োত্তম।
তা তো বটেই। অচলায়তনে জানবার লোক কেবল তুমিই আছ।
পঞ্চক।
তোমরাও জান না আমিও জানি নে -- তফাতটা এই যে, তোমরা বোঝা বয়ে মর, আমি হালকা হয়ে বসে আছি।
জয়োত্তম।
আচ্ছা, এখন পথ ছাড়ো, আমার সময় নেই।
[প্রস্থান
পঞ্চক।।
গান
বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর, কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,
বাহির হতে দুয়ারে কর কেউ তো হানে না।
মহাপঞ্চকের প্রবেশ
মহাপঞ্চক।
গান! অচলায়তনে গান! মতিভ্রম হয়েছে!
পঞ্চক।
এবার দাদা স্বয়ং তোমাকেও গান ধরতে হবে। একধার থেকে মতিভ্রমের পালা আরম্ভ হল।
মহাপঞ্চক।
আমি মহাপঞ্চক গান ধরব! ঠাট্টা আমার সঙ্গে!
পঞ্চক।
ঠাট্টা নয়। অচলায়তনে এবার মন্ত্র ঘুচে গান আরম্ভ হবে। এই বোবা পাথরগুলো থেকে সুর বেরোবে।
মহাপঞ্চক।
কেন বলো তো?
পঞ্চক।
গুরু আসছেন যে! তাই আমার কেবলই মন্তরে ভুল হচ্ছে!
মহাপঞ্চক।
গুরু এলে তোমার জন্যে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।
পঞ্চক।
তার জন্যে ভাবনা কী। নির্লজ্জ হয়ে একলা আমিই মুখ দেখাব!
মহাপঞ্চক।
মন্তরে ভুল হলে গুরু তোমাকে আয়তন থেকে দূর করে দেবেন।
পঞ্চক।
সেই ভরসাতেই তার জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
মহাপঞ্চক।
অমিতায়ুর্ধারণী মন্ত্রটা --
পঞ্চক।
সেই মন্ত্রটা স্বয়ং গুরুর কাছ থেকে শিখব বলেই তো আগাগোড়া ভোলবার চেষ্টায় আছি। সেই জন্যেই গান ধরেছি দাদা।
মহাপঞ্চক।
ওই শঙ্খ বাজল। এখন আমার সপ্তকুমারিকা গাথা পাঠের সময়। কিন্তু বলে যাচ্ছি সময় নষ্ট ক'রো না। গুরু আসছেন।
পঞ্চক।।
গান
আকাশে কার ব্যাকুলতা বাতাস বহে কার বারতা,
এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো আনে না॥
প্রস্থান ও বালক সুভদ্রকে লইয়া পুনঃ প্রবেশ
পঞ্চক।
তোর কোনো ভয় নেই ভাই, কোনো ভয় নেই। তুই আমার কাছে বল -- কী হয়েছে বল।
সুভদ্র।
আমি পাপ করেছি।
পঞ্চক।
পাপ করেছিস? কী পাপ?
সুভদ্র।
সে আমি বলতে পারব না। ভয়ানক পাপ। আমার কী হবে?
পঞ্চক।
তোর সব পাপ আমি কেড়ে নেব, তুই বল।
সুভদ্র।
আমি আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের --
পঞ্চক।
উত্তর দিকের?
সুভদ্র।
হাঁ, উত্তর দিকের জানলা খুলে --
পঞ্চক।
জানলা খুলে কী করলি?
সুভদ্র।
বাইরেটা দেখে ফেলেছি!
পঞ্চক।
দেখে ফেলেছিস? শুনে লোভ হচ্ছে যে।
সুভদ্র।
হাঁ পঞ্চকদাদা। কিন্তু বেশিক্ষণ না -- একবার দেখেই তখনই বন্ধ করে ফেলেছি। কোন্ প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার পাপ যাবে?
পঞ্চক।
ভুলে গেছি ভাই। প্রায়শ্চিত্ত বিশ-পঁচিশ হাজার রকম আছে; -- আমি যদি এই আয়তনে না আসতুম তাহলে তার বারো আনাই কেবল পুঁথিতে লেখা থাকত -- আমি আসার পর প্রায় তার সব-কটাই ব্যবহারে লাগাতে পেরেছি, কিন্তু মনে রাখতে পারি নি।
বালকদলের প্রবেশ
প্রথম।
অ্যাঁ! সুভদ্র। তুমি বুঝি এখানে!
দ্বিতীয়।
জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র কী ভয়ানক পাপ করেছে?
পঞ্চক।
চুপ চুপ। ভয় নেই সুভদ্র, কাঁদছিস কেন ভাই? প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তো করবি। প্রায়শ্চিত্ত করতে ভারি মজা। এখানে রোজই একঘেয়ে রকমের দিন কাটে, প্রায়শ্চিত্ত না থাকলে তো মানুষ টিঁকতেই পারত না।
প্রথম।
(চুপিচুপি) জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র উত্তর দিকের জানলা--
পঞ্চক।
আচ্ছা, আচ্ছা, সুভদ্রের মতো তোদের অত সাহস আছে?
দ্বিতীয়।
আমাদের আয়তনের উত্তর দিকটা যে একজটা দেবীর!
তৃতীয়।
সেদিক থেকে আমাদের আয়তনে যদি একটুও হাওয়া ঢোকে তাহলে যে সে--
পঞ্চক।
তাহলে কী?
তৃতীয়।
সে যে ভয়ানক।
পঞ্চক।
কী ভয়ানক শুনিই না।
তৃতীয়।
জানি নে, কিন্তু সে ভয়ানক।
সুভদ্র।
পঞ্চকদাদা, আমি আর কখনো খুলব না পঞ্চকদাদা। আমার কী হবে?
পঞ্চক।
শোন বলি সুভদ্র, কিসে কী হয় আমি ভাই কিছুই জানি নে -- কিন্তু যা-ই হ'ক না, আমি তাতে একটুও ভয় করি নে।
সুভদ্র।
ভয় কর না?
সকল ছেলে।
ভয় কর না?
পঞ্চক।
না, আমি তো বলি, দেখিই না কী হয়।
সকলে।
(কাছে ঘেঁষিয়া) আচ্ছা দাদা, তুমি বুঝি অনেক দেখেছ?
পঞ্চক।
দেখেছি বই কি। ও-মাসে শনিবারে যেদিন মহাময়ূরী দেবীর পূজা পড়ল, সেদিন আমি কাঁসার থালায় ইঁদুরের গর্তের মাটি রেখে, তার উপর পাঁচটা শেয়ালকাঁটার পাতা আর তিনটে মাষকলাই সাজিয়ে নিজে আঠারো বার ফুঁ দিয়েছি।
সকলে।
অ্যাঁ। কী ভয়ানক। আঠারো বার!
সুভদ্র।
পঞ্চকদাদা, তোমার কী হল?
পঞ্চক।
তিন দিনের দিন যে সাপটা এসে আমাকে নিশ্চয় কামড়াবে কথা ছিল, সে আজ পর্যন্ত আমাকে খুঁজে বের করতে পারে নি।
প্রথম।
কিন্তু ভয়ানক পাপ করেছ তুমি।
দ্বিতীয়।
মহাময়ূরী দেবী ভয়ানক রাগ করেছেন।
পঞ্চক।
তাঁর রাগটা কী রকম সেইটে দেখবার জন্যেই তো এ কাজ করেছি।
সুভদ্র।
কিন্তু পঞ্চকদাদা, যদি তোমাকে সাপে কামড়াত।
পঞ্চক।
তাহলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথাও কোনো সন্দেহ থাকত না। -- ভাই সুভদ্র, জানলা খুলে তুই কী দেখলি বল দেখি।
দ্বিতীয়।
না না, বলিস নে।
তৃতীয়।
না, সে আমরা শুনতে পারব না -- কী ভয়ানক।
প্রথম।
আচ্ছা, একটু, -- খুব একটুখানি বল ভাই।
সুভদ্র।
আমি দেখলুম সেখানে পাহাড়, গোরু চরছে --
বালকগণ।
(কানে আঙুল দিয়া) ও বাবা, না না, আর শুনব না। আর ব'লো না সুভদ্র। ওই যে উপাধ্যায়মশায় আসছেন। চল চল -- আর না।
পঞ্চক।
কেন? এখন তোমাদের কী?
প্রথম।
বেশ, তাও জান না বুঝি? আজ যে পূর্বফাল্গুনী নক্ষত্র--
পঞ্চক।
তাতে কী?
দ্বিতীয়।
আজ কাকিনী সরোবরের নৈঋa কোণে ঢোঁড়া সাপের খোলস খুঁজতে হবে না?
পঞ্চক।
কেন রে?
প্রথম।
তুমি কিছু জান না পঞ্চকদাদা। সেই খোলস কালো রঙের ঘোড়ার লেজের সাতগাছি চুল দিয়ে বেঁধে পুড়িয়ে ধোঁয়া করতে হবে যে।
দ্বিতীয়।
আজ যে পিতৃপুরুষেরা সেই ধোঁয়া ঘ্রাণ করতে আসবেন।
পঞ্চক।
তাতে তাঁদের কষ্ট হবে না?
প্রথম।
পুণ্য হবে যে, ভয়ানক পুণ্য।
[সুভদ্র ব্যতীত বালকগণের প্রস্থান
উপাধ্যায়ের প্রবেশ
সুভদ্র।
উপাধ্যায়মশায়।
পঞ্চক।
আরে পালা পালা। উপাধ্যায়মশায়ের কাছ থেকে একটু পরমার্থতত্ত্ব শুনতে হবে এখন বিরক্ত করিস নে, একেবারে দৌড়ে পালা।
উপাধ্যায়।
কী সুভদ্র, তোমার বক্তব্য কী শীঘ্র বলে যাও।
সুভদ্র।
আমি ভয়ানক পাপ করেছি।
পঞ্চক।
ভারি পণ্ডিত কিনা। পাপ করেছি! পালা বলছি।
উপাধ্যায়।
(উৎসাহিত হইয়া) পাপ করেছ? ওকে তাড়া দিচ্ছ কেন? সুভদ্র শুনে যাও।
পঞ্চক।
আর রক্ষা নেই, পাপের একটুকু গন্ধ পেলে একেবারে মাছির মতো ছোটে।
উপাধ্যায়।
কী বলছিলে?
সুভদ্র।
আমি পাপ করেছি।
উপাধ্যায়।
পাপ করেছ? আচ্ছা বেশ। তাহলে বসো। শোনা যাক।
সুভদ্র।
আমি আয়তনের উত্তর দিকের --
উপাধ্যায়।
বলো, বলো, উত্তর দিকের দেয়ালে আঁক কেটেছ?
সুভদ্র।
না, আমি উত্তর দিকের জানলায় --
উপাধ্যায়।
বুঝেছি, কনুই ঠেকিয়েছ। তাহলে তো সেদিকে আমাদের যতগুলি যজ্ঞের পাত্র আছে সমস্তই ফেলা যাবে। সাত মাসের বাছুরকে দিয়ে ওই জানলা না চাটাতে পারলে শোধন হবে না।
পঞ্চক।
এটা আপনি ভুল বলছেন। ক্রিয়াসংগ্রহে আছে ভূমিকূষ্মাণ্ডের বোঁটা দিয়ে একবার --
উপাধ্যায়।
তোমার তো স্পর্ধা কম দেখি নে। কুলদত্তের ক্রিয়াসংগ্রহের অষ্টাদশ অধ্যায়টি কি কোনদিন খুলে দেখা হয়েছে।
পঞ্চক।
(জনান্তিকে) সুভদ্র যাও তুমি। -- কিন্তু কুলদত্তকে তো আমি --
উপাধ্যায়।
কুলদত্তকে মান না? আচ্ছা, ভরদ্বাজ মিশ্রের প্রয়োগপ্রজ্ঞপ্তি তো মানতেই হবে -- তাতে --
সুভদ্র।
উপাধ্যায় মশায় আমি ভয়ানক পাপ করেছি।
পঞ্চক।
আবার! সেই কথাই তো হচ্ছে। তুই চুপ কর।
উপাধ্যায়।
সুভদ্র, উত্তরের দেয়ালে যে আঁক কেটেছ সে চতুষ্কোণ, না গোলাকার?
সুভদ্র।
আঁক কাটি নি। আমি জানলা খুলে বাইরে চেয়েছিলুম।
উপাধ্যায়।
(বসিয়া পড়িয়া) আঃ সর্বনাশ। করেছিস কী। আজ তিন-শ পঁয়তাল্লিশ বছর ওই জানলা কেউ খোলে নি তা জানিস?
সুভদ্র।
আমার কী হবে।
পঞ্চক।
(সুভদ্রকে আলিঙ্গন করিয়া) তোমার জয়জয়কার হবে সুভদ্র। তিন-শ পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ। তোমার এই অসামান্য সাহস দেখে উপাধ্যায়-মশায়ের মুখে আর কথা নেই। গুরু আসার পথ তুমিই প্রথম খোলসা করে দিলে।
[সুভদ্রকে টানিয়া লইয়া প্রস্থান
উপাধ্যায়।
জানি নে কী সর্বনাশ হবে। উত্তরের অধিষ্ঠাত্রী যে একজটা দেবী! বালকের দুই চক্ষু মুহূর্তেই পাথর হয়ে গেল না কেন তাই ভাবছি। যাই আচার্যদেবকে জানাই গে!
[প্রস্থান
আচার্য ও উপাচার্যের প্রবেশ
আচার্য।
এতকাল পরে আমাদের গুরু আসছেন।
উপাচার্য।
তিনি প্রসন্ন হয়েছেন।
আচার্য।
প্রসন্ন হয়েছেন? তা হবে। হয়তো প্রসন্নই হয়েছেন। কিন্তু কেমন করে জানব।
উপাচার্য।
নইলে তিনি আসবেন কেন।
আচার্য।
এক-এক সময়ে মনে ভয় হয় যে, হয়তো অপরাধের মাত্রা পূর্ণ হয়েছে বলেই তিনি আসছেন।
উপাচার্য।
না, আচার্যদেব, এমন কথা বলবেন না। আমরা কঠোর নিয়ম সমস্তই নিঃশেষে পালন করেছি -- কোনো ত্রুটি ঘটে নি।
আচার্য।
কঠোর নিয়ম? হাঁ, সমস্তই পালিত হয়েছে।
উপাচার্য।
বজ্রশুদ্ধিব্রত আমাদের আয়তনে এইবার নিয়ে ঠিক সাতাত্তর বার পূর্ণ হয়েছে। আর কোনো আয়তনে এ কি সম্ভবপর হয়।
আচার্য।
না আর কোথাও হতে পারে না।
উপাচার্য।
কিন্তু তবু আপনার মনে এমন দ্বিধা হচ্ছে কেন?
আচার্য।
সূতসোম, তোমার মনে কি তুমি শান্তি পেয়েছ?
উপাচার্য।
আমার তো একমুহূর্তের জন্যে অশান্তি নেই।
আচার্য।
অশান্তি নেই?
উপাচার্য।
কিছুমাত্র না। আমার অহোরাত্র একেবারে নিয়মে বাঁধা। এর চেয়ে আর শান্তি কী হতে পারে?
আচার্য।
ঠিক, ঠিক -- ঠিক বলেছ সূতসোম। অচেনার মধ্যে গিয়ে কোথায় তার অন্ত পাব? এখানে সমস্তই জানা, সমস্তই অভ্যস্ত -- এখানকার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানকারই সমস্ত শাস্ত্রের ভিতর থেকে পাওয়া যায় -- তার জন্যে একটুও বাইরে যাবার দরকার হয় না। এই তো নিশ্চল শান্তি!
উপাচার্য।
আচার্যদেব, আপনাকে এমন বিচলিত হতে কখনো দেখি নি।
আচার্য।
কী জানি, আমার কেমন মনে হচ্ছে কেবল একলা আমিই না, চারি দিকে সমস্তই বিচলিত হয়ে উঠছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের এখানকার দেয়ালের প্রত্যেক পাথরটা পর্যন্ত বিচলিত। তুমি এটা অনুভব করতে পারছ না সূতসোম?
উপাচার্য।
কিছুমাত্র না। এখানকার অটল স্তব্ধতার লেশমাত্র বিচ্যুতি দেখতে পাচ্ছি নে। আমাদের তো বিচলিত হবার কথাও না। আমাদের সমস্ত শিক্ষা কোন্ কালে সমাধা হয়ে গেছে। আমাদের সমস্ত লাভ সমাপ্ত, সমস্ত সঞ্চয় পর্যাপ্ত। ওই যে পঞ্চক আসছে। পাথরের মধ্যে কি ঘাস বেরোয়! এমন ছেলে আমাদের আয়তনে কী করে সম্ভব হল! ওই আমাদের দুর্লক্ষণ। এই আয়তনের মধ্যে ও কেবল আপনাকেই মানে। আপনি ওকে একটু ভর্ৎসনা করে দেবেন।
আচার্য।
আচ্ছা, তুমি যাও। আমি ওর সঙ্গে একটু নিভৃতে কথা কয়ে দেখি।
[উপাচার্যের প্রস্থান
পঞ্চকের প্রবেশ
আচার্য।
(পঞ্চকের গায়ে হাত দিয়া) বৎস, পঞ্চক!
পঞ্চক।
করলেন কী! আমাকে ছুঁলেন?
আচার্য।
কেন, বাধা কী আছে?
পঞ্চক।
আমি যে আচার রক্ষা করতে পারি নি।
আচার্য।
কেন পার নি বৎস?
পঞ্চক।
প্রভু, কেন, তা আমি বলতে পারি নে। আমার পারবার উপায় নেই।
আচার্য।
সৌম্য, তুমি তো জান, এখানকার যে নিয়ম সেই নিয়মকে আশ্রয় করে হাজার বছর হাজার হাজার লোক নিশ্চিন্ত আছে। আমরা যে-খুশি তাকে কি ভাঙতে পারি।
পঞ্চক।
আচার্যদেব, যে-নিয়ম সত্য তাকে ভাঙতে না দিলে তার যে পরীক্ষা হয় না। তাই কি ঠিক নয়?
আচার্য।
যাও বৎস, তোমার পথে তুমি যাও। আমাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা ক'ঞ্চরো না।
পঞ্চক।
আচার্যদেব, আপনি জানেন না কিন্তু আপনিই আমাকে নিয়মের চাকার নিচে থেকে টেনে নিয়েছেন।
আচার্য।
কেমন করে বৎস?
পঞ্চক।
তা জানি নে, কিন্তু আপনি আমাকে এমন একটা-কিছু দিয়েছেন যা আচারের চেয়ে, নিয়মের চেয়ে অনেক বেশি।
আচার্য।
তুমি কী কর না-কর আমি কোনো দিন জিজ্ঞাসা করি নে, কিন্তু আজ একটি কথা জিজ্ঞাসা করব। তুমি কি অচলায়তনের বাইরে গিয়ে যূনক জাতির সঙ্গে মেশ?
পঞ্চক।
আপনি কি এর উত্তর শুনতে চান?
আচার্য।
না না থাক, ব'লো না। কিন্তু যূনকেরা যে অত্যন্ত ম্লেচ্ছ। তাদের সহবাস কি --
পঞ্চক।
তাদের সম্বন্ধে আপনার কি কোনো বিশেষ আদেশ আছে।
আচার্য।
না না, আদেশ আমার কিছুই নেই। যদি ভুল করতে হয় তবে ভুল করো গে -- তুমি ভুল করো গে -- আমাদের কথা শুনো না।
পঞ্চক।
ওই উপাচার্য আসছেন -- বোধ করি কাজের কথা আছে -- বিদায় হই।
[প্রস্থান
উপাধ্যায় ও উপাচার্যের প্রবেশ
উপাচার্য।
(উপাধ্যায়ের প্রতি) আচার্যদেবকে তো বলতেই হবে। উনি নিতান্ত উদ্বিগ্ন হবেন -- কিন্তু দায়িত্ব যে ওঁরই।
আচার্য।
উপাধ্যায়, কোনো সংবাদ আছে নাকি?
উপাধ্যায়।
অত্যন্ত মন্দ সংবাদ।
আচার্য।
অতএব সেটা সত্বর বলা উচিত।
উপাধ্যায়।
আচার্যদেব, সুভদ্র আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের জানলা খুলে বাইরে দৃষ্টিপাত করেছে।
আচার্য।
উত্তর দিকটা তো একজটা দেবীর।
উপাধ্যায়।
সেই তো ভাবনা। আমাদের আয়তনের মন্ত্রপূত রুদ্ধ বাতাসকে সেখানকার হাওয়া কতটা দূর পর্যন্ত আক্রমণ করেছে বলা তো যায় না।
উপাচার্য।
এখন কথা হচ্ছে এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী।
আচার্য।
আমার তো স্মরণ হয় না। উপাধ্যায় বোধ করি --
উপাধ্যায়।
না, আমিও তো মনে আনতে পারি নে। আজ তিন-শ বছর এ প্রায়শ্চিত্তটার প্রয়োজন হয় নি -- সবাই ভুলেই গেছে। ওই যে মহাপঞ্চক আসছে -- যদি কারও জানা থাকে তো সে ওর।
মহাপঞ্চকের প্রবেশ
উপাধ্যায়।
মহাপঞ্চক, সব শুনেছ বোধ করি।
মহাপঞ্চক।
সেই জন্যেই তো এলুম; আমরা এখন সকলেই অশুচি, বাহিরের হাওয়া আমাদের আয়তনে প্রবেশ করেছে।
উপাচার্য।
এর প্রায়শ্চিত্ত কী, আমাদের কারও স্মরণ নেই -- তুমিই হয়তো বলতে পার।
মহাপঞ্চক।
ক্রিয়াকল্পতরুতে এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না -- একমাত্র ভগবান জ্বলনানন্তকৃত আধিকর্মিক বর্ষায়ণে লিখছে, অপরাধীকে ছয় মাস মহাতামস সাধন করতে হবে।
উপাচার্য।
মহাতামস?
মহাপঞ্চক।
হাঁ, ওকে অন্ধকারে রেখে দিতে হবে, আলোকের এক রশ্মিমাত্রও দেখতে পাবে না। কেননা আলোকের দ্বারা যে-অপরাধ অন্ধকারের দ্বারাই তার ক্ষালন।
উপাচার্য।
তা হলে, মহাপঞ্চক, সমস্ত ভার তোমার উপর রইল।
উপাধ্যায়।
চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাই। ততক্ষণ সুভদ্রকে হিঙ্গুমর্দনকুণ্ডে স্নান করিয়ে আনি গে।
[সকলের গমনোদ্যম
আচার্য।
শোনো, প্রয়োজন নেই।
উপাধ্যায়।
কিসের প্রয়োজন নেই?
আচার্য।
প্রায়শ্চিত্তের।
মহাপঞ্চক।
প্রয়োজন নেই বলছেন! আধিকর্মিক বর্ষায়ণ খুলে আমি এখনই দেখিয়ে দিচ্ছি --
আচার্য।
দরকার নেই -- সুভদ্রকে কোনো প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না, আমি আশীর্বাদ করে তার --
মহাপঞ্চক।
এও কি কখনো সম্ভব হয়? যা কোনো শাস্ত্রে নেই আপনি কি তাই --
আচার্য।
না, হতে দেব না, যদি কোনো অপরাধ ঘটে সে আমার। তোমাদের ভয় নেই।
উপাধ্যায়।
এ রকম দুর্বলতা তো আপনার কোনো দিন দেখি নি। এই তো সেবার অষ্টাঙ্গশুদ্ধি উপবাসে তৃতীয় রাত্রে বালক কুশলশীল জল জল করে পিপাসায় প্রাণত্যাগ করলে কিন্তু তবু তার মুখে যখন এক বিন্দু জল দেওয়া গেল না, তখন তো আপনি নীরব হয়ে ছিলেন। তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তো চিরকালের।
সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের প্রবেশ
পঞ্চক।
ভয় নেই সুভদ্র, তোর কোনো ভয় নেই। -- এই শিশুটিকে অভয় দাও প্রভু।
আচার্য।
বৎস, তুমি কোনো পাপ কর নি। যারা বিনা অপরাধে তোমাকে হাজার হাজার বৎসর ধরে মুখ বিকৃত করে ভয় দেখাচ্ছে পাপ তাদেরই। এসো পঞ্চক।
[সুভদ্রকে কোলে লইয়া পঞ্চকের সঙ্গে প্রস্থান
উপাধ্যায়।
এ কী হল উপাচার্যমশায়?
[উপাচার্যের প্রস্থান
মহাপঞ্চক।
আমরা অশুচি হয়ে রইলুম, আমাদের যাগযজ্ঞ ব্রত-উপবাস সমস্তই পণ্ড হতে থাকল, এ তো সহ্য করা শক্ত।
উপাধ্যায়।
এ সহ্য করা চলবেই না। আচার্য কি শেষে আমাদের ম্লেচ্ছের সঙ্গে সমান করে দিতে চান?
মহাপঞ্চক।
উনি আজ সুভদ্রকে বাঁচাতে গিয়ে সনাতন ধর্মকে বিনাশ করবেন! এ কী রকম বুদ্ধিবিকার ওঁর ঘটল? এ অবস্থায় ওঁকে আচার্য বলে গণ্য করাই চলবে না।
সঞ্জীব, বিশ্বম্ভর, জয়োত্তমের প্রবেশ
সঞ্জীব।
এতদিন এখানে সব ঠিক চলছিল। যেই গুরু আসবেন রব উঠল অমনি কেন এই সব অনাচার ঘটতে লাগল?
বিশ্বম্ভর।
আচার্য অদীনপুণ্য যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন, তবে তিনি যেমন আছেন থাকুন কিন্তু আমরা তাঁর কোনো অনুশাসন মানব না।
জয়োত্তম।
তিনি বলেন, তাঁর গুরু তাঁকে যে আসনে বসিয়েছেন তাঁর গুরুই তাঁকে সেই আসন থেকে নামিয়ে দেবেন, সেই জন্যে তিনি অপেক্ষা করছেন।
অধ্যেতার প্রবেশ
উপাধ্যায়।
কী গো অধ্যেতা, ব্যাপার কী?
অধ্যেতা।
সুভদ্রকে মহাতামসে বসায় কার সাধ্য?
মহাপঞ্চক।
কেন, কী বিঘ্ন ঘটেছে।
অধ্যেতা।
মূর্তিমান বিঘ্ন রয়েছে তোমার ভাই!
মহাপঞ্চক।
পঞ্চক?
অধ্যেতা।
হাঁ। আমি ডাকতেই সুভদ্র ছুটে এল কিন্তু পঞ্চক তাকে কেড়ে নিয়ে গেল।
মহাপঞ্চক।
না, এই নরাধমকে নিয়ে আর চলল না। অনেক সহ্য করেছি। এবার ওকে নির্বাসন দেওয়াই স্থির। কিন্তু অধ্যেতা, তুমি এটা সহ্য করলে?
অধ্যেতা।
আমি কি তোমার পঞ্চককে ভয় করি? স্বয়ং আচার্য অদীনপুণ্য এসে তাকে আদেশ করলেন তাই তো সে সাহস পেলে।
সঞ্জীব।
স্বয়ং আমাদের আচার্য!
বিশ্বম্ভর।
ক্রমে এ-সব হচ্ছে কী! এতদিন এই আয়তনে আছি কখনো তো এমন অনাচারের কথা শুনি নি। আর স্বয়ং আমাদের আচার্যের এই কীর্তি!
জয়োত্তম।
তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেই দেখা যাক-না।
বিশ্বম্ভর।
না না, আচার্যকে আমরা --
মহাপঞ্চক।
কী করবে আচার্যকে, বলেই ফেলো।
বিশ্বম্ভর।
তাই তো ভাবছি কী করা যায়। তাকে না হয় -- আপনি বলে দিন না কী করতে হবে।
মহাপঞ্চক।
আমি বলছি তাঁকে সংযত করে রাখতে হবে।
সঞ্জীব।
কেমন করে?
মহাপঞ্চক।
কেমন করে আবার কী! মত্ত হস্তীকে যেমন করে সংযত করতে হয় তেমনি করে।
জয়োত্তম।
আমাদের আচার্যদেবকে কি তা হলে --
মহাপঞ্চক।
হাঁ, তাঁকে বন্ধ করে রাখতে হবে। চুপ করে রইলে যে! পারবে না?
আচার্যের প্রবেশ
আচার্য।
বৎস, এতদিন তোমরা আমাকে আচার্য বলে মেনেছ, আজ তোমাদের সামনে আমার বিচারের দিন এসেছে। আমি স্বীকার করছি অপরাধের অন্ত নেই, অন্ত নেই, তার প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে।
সঞ্জীব।
তবে আর দেরি করেন কেন। এ দিকে যে আমাদের সর্বনাশ হয়।
আচার্য।
গুরু চলে গেলেন আমরা তাঁর জায়গায় পুঁথি নিয়ে বসলুম; সেই জীর্ণ পুঁথির ভাণ্ডারে প্রতিদিন তোমরা দলে দলে আমার কাছে তোমাদের তরুণ হৃদয়টি মেলে ধরে কী চাইতে এসেছিলে? অমৃতবাণী? কিন্তু আমার তালু যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে! রসনায় যে রসের লেশমাত্র নেই! এবার নিয়ে এস সেই বাণী, গুরু, নিয়ে এস হৃদয়ের বাণী! প্রাণকে প্রাণ দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে যাও!
পঞ্চক।
(ছুটিয়া প্রবেশ করিয়া) তোমার নববর্ষার সজল হাওয়ায় উড়ে যাক সব শুকনো পাতা -- আয় রে নবীন কিশলয় -- তোরা ছুটে আয়, তোরা ফুটে বেরো। ভাই জয়োত্তম, শুনছ না, আকাশের ঘন নীল মেঘের মধ্যে মুক্তির ডাক উঠেছে -- আজ নৃত্য কর রে নৃত্য কর।
গান
ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে
তারে আজ থামায় কে রে।
সে যে আকাশ পানে হাত পেতেছে
তারে আজ নামায় কে রে।
প্রথম জয়োত্তমের, পরে বিশ্বম্ভরের, পরে সঞ্জীবের নৃত্যগীতে যোগ
মহাপঞ্চক।
পঞ্চক, নির্লজ্জ বানর কোথাকার, থাম বলছি, থাম।
গান
পঞ্চক।
ওরে আমার মন মেতেছে
আমারে থামায় কে রে।
মহাপঞ্চক।
উপাধ্যায়, আমি তোমাকে বলি নি একজটা দেবীর শাপ আরম্ভ হয়েছে? দেখছ, কী করে তিনি আমাদের সকলের বুদ্ধিকে বিচলিত করে তুলছেন -- ক্রমে দেখবে অচলায়তনের একটি পাথরও আর থাকবে না।
পঞ্চক।
না, থাকবে না, থাকবে না, পাথরগুলো সব পাগল হয়ে যাবে; তারা কে কোথায় ছুটে বেরিয়ে পড়বে, তারা গান ধরবে --
ওরে ভাই, নাচ রে ও ভাই নাচ রে --
আজ ছাড়া পেয়ে বাঁচ রে --
লাজভয় ঘুচিয়ে দে রে।
তোরে আজ থামায় কে রে!
মহাপঞ্চক।
উপাধ্যায়, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী! সর্বনাশ শুরু হয়েছে, বুঝতে পারছ না! ওরে সব ছিন্নমতি মূর্খ, অভিশপ্ত বর্বর, আজ তোদের নাচবার দিন?
পঞ্চক।
সর্বনাশের বাজনা বাজলেই নাচ শুরু হয় দাদা।
মহাপঞ্চক।
চুপ কর্ লক্ষ্মীছাড়া! ছাত্রগণ, তোমরা আত্মবিস্মৃত হ'ঞ্চয়োনা। ঘোর বিপদ আসন্ন সে-কথা স্মরণ রেখো।
বিশ্বম্ভর।
আচার্যদেব পায়ে ধরি, সুভদ্রকে আমাদের হাতে দিন, তাকে তার প্রায়শ্চিত্ত থেকে নিরস্ত করবেন না।
আচার্য।
না বৎস, এমন অনুরোধ ক'রো না।
সঞ্জীব।
ভেবে দেখুন, সুভদ্রের কতবড়ো ভাগ্য। মহাতামস ক-জন লোকে পারে। ও যে ধরাতলে দেবত্ব লাভ করবে।
আচার্য।
গায়ের জোড়ে দেবতা গড়বার পাপে আমাকে লিপ্ত ক'রো না। সে মানুষ, সে শিশু, সেই জন্যেই সে দেবতাদের প্রিয়।
জয়োত্তম।
দেখুন আপনি আমাদের আচার্য, আমাদের প্রণম্য, কিন্তু যে অন্যায় আজ করছেন, তাতে আমরা বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হব।
আচার্য।
করো, বলপ্রয়োগ করো, আমাকে মেনো না, আমাকে মারো, আমি অপমানেরই যোগ্য, তোমাদের হাত দিয়ে আমার যে শাস্তি আরম্ভ হল তাতেই বুঝতে পারছি গুরুর আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু সেই জন্যেই বলছি শাস্তির কারণ আর বাড়তে দেব না। সুভদ্রকে তোমাদের হাতে দিতে পারব না।
বিশ্বম্ভর।
পারবেন না?
আচার্য।
না।
মহাপঞ্চক।
তা হলে আর দ্বিধা করা নয়। বিশ্বম্ভর, এখন তোমাদের উচিত ওঁকে জোর করে ধরে নিয়ে ঘরে বন্ধ করা। ভীরু, কেউ সাহস করছ না? আমাকেই তবে এ কাজ করতে হবে?
জয়োত্তম।
খবরদার -- আচার্যদেবের গায়ে হাত দিতে পারবে না।
বিশ্বম্ভর।
না না, মহাপঞ্চক, ওঁকে অপমান করলে আমরা সইতে পারব না।
সঞ্জীব।
আমরা সকলে মিলে পায়ে ধরে ওঁকে রাজি করাব। একা সুভদ্রের প্রতি দয়া করে উনি কি আমাদের সকলের অমঙ্গল ঘটাবেন?
বিশ্বম্ভর।
এই অচলায়তনের এমন কত শিশু উপবাসে প্রাণত্যাগ করেছে -- তাতে ক্ষতি কী হয়েছে!
সুভদ্রের প্রবেশ
সুভদ্র।
আমাকে মহাতামস ব্রত করাও।
পঞ্চক।
সর্বনাশ করলে। ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আমি এখানে এসেছিলুম, কখন জেগে চলে এসেছে।
আচার্য।
বৎস সুভদ্র, এস আমার কোলে। যাকে পাপ বলে ভয় করছ সে পাপ আমার -- আমিই প্রায়শ্চিত্ত করব।
বিশ্বম্ভর।
না না, আয় রে আয় সুভদ্র, তুই মানুষ না, তুই দেবতা।
সঞ্জীব।
তুই ধন্য।
বিশ্বম্ভর।
তোর বয়সে মহাতামস করা আর কারো ভাগ্যে ঘটে নি। সার্থক তোর মা তোকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন।
উপাধ্যায়।
আহা সুভদ্র, তুই আমাদের অচলায়তনেরই বালক বটে।
মহাপঞ্চক।
আচার্য, এখনও কি তুমি জোর করে এই বালককে এই মহাপূণ্য থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছ?
আচার্য।
হায় হায়, এই দেখেই তো আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তোমরা যদি ওকে কাঁদিয়ে আমার হাত থেকে ছিঁড়ে কেড়ে নিয়ে যেতে তা হলেও আমার এত বেদনা হত না। কিন্তু দেখছি হাজার বছরের নিষ্ঠুর মুষ্টি অতটুকু শিশুর মনকেও চেপে ধরেছে, একেবারে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে রে। কখন সময় পেল সে। সে কি গর্ভের মধ্যেও কাজ করে।
পঞ্চক।
সুভদ্র, আয় ভাই, প্রায়শ্চিত্ত করতে যাই -- আমিও যাব তোর সঙ্গে।
আচার্য।
বৎস, আমিও যাব।
সুভদ্র।
না না, আমাকে যে একলা থাকতে হবে -- লোক থাকলে যে পাপ হবে!
মহাপঞ্চক।
ধন্য শিশু, তুমি তোমার ওই প্রাচীন আচার্যকে আজ শিক্ষা দিলে। এস তুমি আমার সঙ্গে।
আচার্য।
না, আমি যতক্ষণ তোমাদের আচার্য আছি ততক্ষণ আমার আদেশ ব্যতীত কোনো ব্রত আরম্ভ বা শেষ হতেই পারে না। আমি নিষেধ করছি। সুভদ্র, আচার্যের কথা অমান্য ক'রো না -- এস পঞ্চক, ওকে কোলে করে নিয়ে এস।
[সুভদ্রকে লইয়া পঞ্চকের ও আচার্যের এবং উপাধ্যায়ের প্রস্থান
মহাপঞ্চক।
ধিক্! তোমাদের মতো ভীরুদের দুর্গতি হতে রক্ষা করে এমন সাধ্য কারও নেই। তোমরা নিজেও মরবে অন্য সকলকেও মারবে।
পদাতিকের প্রবেশ
পদাতিক।
স্থবিরপত্তনের রাজা আসছেন।
মহাপঞ্চক।
ব্যাপারখানা কী। এ যে আমাদের রাজা মন্থরগুপ্ত।
রাজার প্রবেশ
রাজা।
নরদেবগণ, তোমাদের সকলকে নমস্কার।
সকলে।
জয়োস্তু রাজন্।
মহাপঞ্চক।
কুশল তো?
রাজা।
অত্যন্ত মন্দ সংবাদ। প্রত্যন্তদেশের দূতেরা এসে খবর দিল যে দাদাঠাকুরের দল এসে আমাদের রাজ্যসীমার কাছে বাসা বেঁধেছে।
মহাপঞ্চক।
দাদাঠাকুরের দল কারা?
রাজা।
ঐ-যে যূনকরা।
মহাপঞ্চক।
যূনকরা যদি একবার আমাদের প্রাচীর ভাঙে তা হলে যে সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে দেবে।
রাজা।
সেই জন্যেই তো ছুটে এলুম। চণ্ডক বলে একজন যূনক আমাদের স্থবিরক সম্প্রদায়ের মন্ত্র পাবার জন্যে গোপনে তপস্যা করছিল। আমি সংবাদ পেয়েই তার শিরশ্ছেদ করেছি।
মহাপঞ্চক।
ভালোই করেছেন। কিন্তু এদিকে আমাদের অচলায়তনের মধ্যেই যে পাপ প্রবেশ করেছে তার কী করলেন? আমাদের পরাভবের আর দেরি কী।
রাজা।
সে কী কথা।
সঞ্জীব।
আয়তনে একজটা দেবীর শাপ লেগেছে।
রাজা।
একজটা দেবীর শাপ! সর্বনাশ! কেন তাঁর শাপ।
মহাপঞ্চক।
যে উত্তর দিকে তাঁর অধিষ্ঠান এখানে একদিন সেই দিককার জানালা খোলা হয়েছে।
রাজা।
(বসিয়া পড়িয়া) তবে তো আর আশা নেই।
মহাপঞ্চক।
আচার্য অদীনপুণ্য এ-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দিচ্ছেন না।
বিশ্বম্ভর।
তিনি জোর করে আমাদের ঠেকিয়ে রেখেছেন।
রাজা।
দাও, দাও, অদীনপূণ্যকে এখনই নির্বাসিত করে দাও।
মহাপঞ্চক।
আগামী অমাবস্যায় --
রাজা।
না না, এখন তিথিনক্ষত্র দেখবার সময় নেই। বিপদ আসন্ন। সংকটের সময় আমি আমার রাজ-অধিকার খাটাতে পারি -- শাস্ত্রে তার বিধান আছে।
মহাপঞ্চক।
হাঁ আছে। কিন্তু আচার্য কে হবে?
রাজা।
তুমি, তুমি। এখনই আমি তোমাকে আচার্যের পদে প্রতিষ্ঠিত করে দিলুম। দিক্পালগণ সাক্ষী, এই ব্রহ্মচারিগণ সাক্ষী।
মহাপঞ্চক।
অদীনপুণ্যকে কোথায় নির্বাসিত করতে চান?
রাজা।
আয়তনের বাহিরে নয়। কী জানি যদি যূনকদের সঙ্গে যোগ দেন। আয়তনের প্রান্তে যে দর্ভক পাড়া আছে সেইখানে তাঁকে বদ্ধ করে রেখো।
জয়োত্তম।
আচার্য অদীনপুণ্যকে দর্ভকদের পাড়ায়? তারা যে অন্ত্যজজাতি -- অশুচি পতিত!
মহাপঞ্চক।
যিনি স্পর্ধাপূর্বক আচার লঙ্ঘন করেন, অনাচারীদের মধ্যে নির্বাসনই তাঁর উচিত দণ্ড। মনে ক'ঞ্চরো না আমার ভাই বলে পঞ্চককে ক্ষমা করব। তারও সেই দর্ভকপাড়ায় গতি।
দূতের প্রবেশ
দূত।
শুনলুম গুরু খুব কাছে এসেছেন।
রাজা।
কে বললে?
দূত।
চারিদিকেই কথা উঠেছে।
রাজা।
তাহলে তো তাঁর অভ্যর্থনার আয়োজন করতে হবে। মহাপঞ্চক, অচলায়তনের সমস্ত জানলা বন্ধ করে শুদ্ধিমন্ত্র পাঠ করাতে থাকো।
মহাপঞ্চক।
জানলা বন্ধ সম্বন্ধে ভাববেন না। মন্ত্রের ভার আমি নিচ্ছি।
[রাজার প্রস্থান
পঞ্চক কোথায়?
জয়োত্তম।
শুনলুম সে প্রাচীর ডিঙিয়ে যূনকদের কাছে গেছে।
মহাপঞ্চক।
পাষণ্ড। আর যেন সে আয়তনে ফিরে না আসে। গুরু আসবার আগেই এখানকার সমস্ত উপদ্রব দূর করা চাই। ওহে ব্রহ্মচারিগণ, মন্ত্র পড়বার জন্যে স্নান করে প্রস্তুত হয়ে এস।
২
পাহাড়-মাঠ
পঞ্চকের গান
এ পথ গেছে কোন্খানে গো কোন্খানে --
তা কে জানে তা কে জানে।
কোন্ পাহাড়ের পারে, কোন্ সাগরের ধারে,
কোন্ দুরাশার দিকপানে --
তা কে জানে তা কে জানে।
এ পথ দিয়ে কে আসে যায় কোন্খানে
তা কে জানে তা কে জানে।
কেমন যে তার বাণী, কেমন হাসিখানি,
যায় সে কাহার সন্ধানে
তা কে জানে তা কে জানে।
পশ্চাতে আসিয়া যূনকদলের নৃত্য
পঞ্চক।
ও কী রে। তোরা কখন পিছনে এসে নাচতে লেগেছিস।
প্রথম যূনক।
আমরা নাচবার সুযোগ পেলেই নাচি, পা দুটোকে স্থির রাখতে পারি নে।
দ্বিতীয় যূনক।
আয় ভাই ওকে সুদ্ধ কাঁধে করে নিয়ে একবার নাচি।
পঞ্চক।
আরে না না, আমাকে ছুঁস নে রে ছুঁস নে।
তৃতীয় যূনক।
ওই রে। ওকে অচলায়তনের ভূতে পেয়েছে। যূনককে ও ছোঁবে না।
পঞ্চক।
জানিস, আমাদের গুরু আসবেন?
প্রথম যূনক।
সত্যি নাকি। তিনি মানুষটি কী রকম? তাঁর মধ্যে নতুন কিছু আছে?
পঞ্চক।
নতুনও আছে, পুরোনোও আছে।
দ্বিতীয় যূনক।
আচ্ছা, এলে খবর দিয়ো -- একবার দেখব তাঁকে।
পঞ্চক।
তোরা দেখবি কী রে। সর্বনাশ। তিনি তো যূনকদের গুরু নন। তাঁর কথা তোদের কানে পাছে এক অক্ষরও যায় সেজন্যে তোদের দিকের প্রাচীরের বাইরে সাত সার রাজার সৈন্য পাহারা দেবে। তোদেরও তো গুরু আছে -- তাকে নিয়েই --
তৃতীয় যূনক।
গুরু! আমাদের আবার গুরু কোথায়! আমরা তো হলুম দাদাঠাকুরের দল। এ পর্যন্ত আমরা তো কোনো গুরুকে মানি নি।
প্রথম যূনক।
সেই জন্যেই তো ও জিনিসটা কী রকম দেখতে ইচ্ছা করে।
দ্বিতীয় যূনক।
আমাদের মধ্যে একজন, তার নাম চণ্ডক -- তার কী জানি ভারি লোভ হয়েছে; সে ভেবেছে তোমাদের কোনো গুরুর কাছে মন্ত্র নিয়ে আশ্চর্য কী একটা ফল পাবে -- তাই সে লুকিয়ে চলে গেছে!
তৃতীয় যূনক।
কিন্তু যূনক ব'লে কেউ তাকে মন্ত্র দিতে চায় না। সেও ছাড়বার ছেলে নয়, সে লেগেই রয়েছে! তোমরা মন্ত্র দাও না বলেই মন্ত্র আদায় করবার জন্যে তার এত জেদ।
প্রথম যূনক।
কিন্তু পঞ্চকদাদা, আমাদের ছুঁলে কি তোমার গুরু রাগ করবেন?
পঞ্চক।
বলতে পারি নে -- কী জানি যদি অপরাধ নেন। ওরে, তোরা যে সবাই সব রকম কাজই করিস -- সেইটে যে বড়ো দোষ। তোরা চাষ করিস তো?
প্রথম যূনক।
চাষ করি বই কী, খুব করি। পৃথিবীতে জন্মেছি পৃথিবীকে সেটা খুব কষে বুঝিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ি।
গান
আমরা চাষ করি আনন্দে।
মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে!
রৌদ্র ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, বাঁশের বনে পাতা নড়ে,
বাতাস ওঠে ভরে ভরে চষা মাটির গন্ধে।
সবুজ প্রাণের গানের লেখা, রেখায় রেখায় দেয় রে দেখা,
মাতে রে কোন্ তরুণ কবি নৃত্যদোদুল ছন্দে।
ধানের শিষে পুলক ছোটে, সকল ধরা হেসে ওঠে,
অঘ্রাণেরই সোনার রোদে পূর্ণিমারি চন্দ্রে।
পঞ্চক।
আচ্ছা, না হয় তোরা চাষই করিস সেও কোনো মতে সহ্য হয় -- কিন্তু কে বলছিল তোরা কাঁকুড়ের চাষ করিস।
প্রথম যূনক।
করি বই কি।
পঞ্চক।
কাঁকুড়! ছি ছি! খেঁসারিডালেরও চাষ করিস বুঝি?
তৃতীয় যূনক।
কেন করব না? এখান থেকেই তো কাঁকুড় খেঁসারিডাল তোমাদের বাজারে যায়।
পঞ্চক।
তা তো যায়, কিন্তু জানিস নে কাঁকুড় আর খেঁসারিডাল যারা চাষ করে তাদের আমরা ঘরে ঢুকতে দিই নে।
প্রথম যূনক।
কেন?
পঞ্চক।
কেন কী রে! ওটা যে নিষেধ।
প্রথম যূনক।
কেন নিষেধ?
পঞ্চক।
শোনো একবার! নিষেধ, তার আবার কেন! সাধে তোদের মুখদর্শন পাপ! এই সহজ কথাটা বুঝিস নে যে কাঁকুড় আর খেঁসারিডালের চাষটা ভয়ানক খারাপ।
দ্বিতীয় যূনক।
কেন? ওটা কি তোমরা খাও না?
পঞ্চক।
খাই বই কি, খুব আদর করে খাই -- কিন্তু ওটা যারা চাষ করে তাদের ছায়া মাড়াই নে।
দ্বিতীয় যূনক।
কেন?
পঞ্চক।
ফের কেন! তোরা যে এতবড়ো নিরেট মূর্খ তা জানতুম না। আমাদের পিতামহ বিষ্কম্ভী কাঁকুড়ের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে খবর রাখিস নে বুঝি?
দ্বিতীয় যূনক।
কাঁকুড়ের মধ্যে কেন?
পঞ্চক।
আবার কেন? তোরা যে ওই এক কেনর জ্বালায় আমাকে অতিষ্ঠ করে তুললি।
তৃতীয় যূনক।
আর, খেঁসারির ডাল?
পঞ্চক।
একবার কোন্ যুগে একটা খেঁসারিডালের গুঁড়ো উপবাসের দিন কোন এক মস্ত বুড়োর ঠিক গোঁফের উপর উড়ে পড়েছিল; তাতে তাঁর উপবাসের পুণ্যফল থেকে ষষ্টিসহস্র ভাগের এক ভাগ কম পড়ে গিয়েছিল; তাই তখনই সেইখানে দাঁড়িয়ে উঠে তিনি জগতের সমস্ত খেঁসারিডালের ক্ষেতের উপর অভিশাপ দিয়ে গেছেন। এত-বড়ো তেজ! তোরা হলে কী করতিস বল দেখি!
প্রথম যূনক।
আমাদের কথা বল কেন? উপবাসের দিনে খেঁসারিডাল যদি গোঁফের উপর পর্যন্ত এগিয়ে আসে তা হলে তাকে আরও একটু এগিয়ে নিই।
পঞ্চক।
আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সত্যি করে বলিস -- তোরা কি লোহার কাজ করে থাকিস?
প্রথম যূনক।
লোহার কাজ করি বই কি, খুব করি।
পঞ্চক।
রাম রাম। আমরা সনাতন কাল থেকে কেবল তামা-পিতলের কাজ করে আসছি। লোহা গলাতে পারি কিন্তু সব দিন নয়। ষষ্ঠীর দিনে যদি মঙ্গলবার পড়ে তবেই স্নান করে আমরা হাপর ছুঁতে পারি কিন্তু তাই বলে লোহা পিটোনো সে তো হতেই পারে না।
প্রথম যূনক।
কেন, লোহা কী অপরাধটা করেছে?
পঞ্চক।
আরে, ওটা যে লোহা সে তো তোকে মানতেই হবে।
প্রথম যূনক।
তা তো হবে।
পঞ্চক।
তবে আর কি -- এই বুঝে নে না।
দ্বিতীয় যূনক।
তবু একটা তো কারণ আছে।
পঞ্চক।
কারণ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু কেবল সেটা পুঁথির মধ্যে। আচ্ছা, তোদের মন্ত্র কেউ পড়ায় নি?
দ্বিতীয় যূনক।
মন্ত্র! কিসের মন্ত্র।
পঞ্চক।
এই মনে কর যেমন বজ্রবিদারণ মন্ত্র -- তট তট তোতয় তোতয় --
তৃতীয় যূনক।
ওর মানে কী?
পঞ্চক।
আবার! মানে! তোর আস্পর্ধা তো কম নয়। সব কথাতেই মানে! কেয়ূরী মন্ত্রটা জানিস?
প্রথম যূনক।
না।
পঞ্চক।
মরীচী?
প্রথম যূনক।
না।
পঞ্চক।
মহাশীতবতী?
প্রথম যূনক।
না।
পঞ্চক।
উষ্ঞীষবিজয়?
প্রথম যূনক।
না।
পঞ্চক।
নাপিত ক্ষৌর করতে করতে যেদিন তোদের বাঁ গালে রক্ত পাড়িয়ে দেয় সেদিন করিস কী।
তৃতীয় যূনক।
সেদিন নাপিতের দুই গালে চড় কষিয়ে দিই।
পঞ্চক।
না রে না, আমি বলছি সেদিন নদী পার হবার দরকার হলে তোরা খেয়া-নৌকোয় উঠতে পারিস?
তৃতীয় যূনক।
খুব পারি।
পঞ্চক।
ওরে, তোরা আমাকে মাটি করলি রে। আমি আর থাকতে পারছি নে। তোদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে আর সাহস হচ্ছে না। এমন জবাব যদি আর-একটা শুনতে পাই তা হলে তোদের বুকে করে পাগলের মতো নাচব, আমার জাত-মান কিছু থাকবে না। ভাই, তোরা সব কাজই করতে পাস? তোদের দাদাঠাকুর কিছুতেই তোদের মানা করে না?
যূনকগণের গান
সব কাজে হাত লাগাই মোরা সব কাজেই
বাধাবাঁধন নেই গো নেই।
দেখি, খুঁজি, বুঝি,
কেবল ভাঙি, গড়ি, যুঝি,
মোরা সব দেশেতেই বেড়াই ঘুরে সব সাজেই।
পারি, নাই বা পারি,
না হয় জিতি কিংবা হারি,
যদি অমনিতে হাল ছাড়ি, মরি সেই লাজেই।
আপন হাতের জোরে
আমরা তুলি সৃজন করে,
আমরা প্রাণ দিয়ে ঘর বাঁধি, থাকি তার মঝেই।
পঞ্চক।
সর্বনাশ করলে রে -- আমার সর্বনাশ করলে। আমার আর ভদ্রতা রাখলে না। এদের তালে তালে আমারও পা দুটো নেচে উঠছে। আমাকে সুদ্ধ এরা টানবে দেখছি। কোন্দিন আমিও লোহা পিটোব রে, লোহা পিটোব -- কিন্তু খেঁসারির ডাল -- না না, পালা ভাই, পালা তোরা। দেখছিস না পড়ব ব'লে পুঁথি সংগ্রহ করে এনেছি।
আর একদল যূনকের প্রবেশ
প্রথম যূনক।
ও ভাই পঞ্চক, দাদাঠাকুর আসছে।
দ্বিতীয় যূনক।
এখন রাখো তোমার পুঁথি রাখো -- দাদাঠাকুর আসছে।
দাদাঠাকুরের প্রবেশ
প্রথম যূনক।
দাদাঠাকুর!
দাদাঠাকুর।
কী রে।
দ্বিতীয় যূনক।
দাদাঠাকুর।
দাদাঠাকুর।
কী চাই রে।
তৃতীয় যূনক।
কিছু চাই নে -- একবার তোমাকে ডেকে নিচ্ছি।
পঞ্চক।
দাদাঠাকুর!
দাদাঠাকুর।
কী ভাই, পঞ্চক যে।
পঞ্চক।
ওরা সবাই তোমায় ডাকছে, আমারও কেমন ডাকতে ইচ্ছে হল। যতই ভাবছি ওদের দলে মিশব না ততই আরও জড়িয়ে পড়ছি।
প্রথম যূনক।
আমাদের দাদাঠাকুরকে নিয়ে আবার দল কিসের। উনি আমাদের সব দলের শতদল পদ্ম।
পঞ্চক।
ও ভাই, তোদের দাদাঠাকুরকে নিয়ে তোরা তো দিনরাত মাতামাতি করছিস, একবার আমাকে ছেড়ে দে, আমি একটু নিরালায় বসে কথা কই। ভয় নেই, ওঁকে আমাদের অচলায়তনে নিয়ে গিয়ে কপাট দিয়ে রাখব না।
প্রথম যূনক।
নিয়ে যাও না। সে তো ভালোই হয়। তা হলে কপাটের বাপের সাধ্য নেই বন্ধ থাকে। উনি গেলে তোমাদের অচলায়তনের পাথরগুলো সুদ্ধ নাচতে আরম্ভ করবে, পুঁথিগুলোর মধ্যে বাঁশি বাজবে।
পঞ্চক।
দাদাঠাকুর, শুনছি আমাদের গুরু আসছেন।
দাদাঠাকুর।
গুরু! কী বিপদ। ভারি উৎপাত করবে তা হলে তো।
পঞ্চক।
একটু উৎপাত হলে যে বাঁচি। চুপচাপ থেকে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে।
দাদাঠাকুর।
আচ্ছা বেশ, তোমার গুরু এলে তাঁকে দেখে নেওয়া যাবে। এখন তুমি আছ কেমন বলো তো?
পঞ্চক।
ভয়ানক টানাটানির মধ্যে আছি ঠাকুর। মনে মনে প্রার্থনা করছি গুরু এসে যে দিকে হ'ঞ্চক এক দিকে আমাকে ঠিক করে রাখুন -- হয় এখানকার খোলা হাওয়ার মধ্যে অভয় দিয়ে ছাড়া দিন, নয় তো খুব কষে পুঁথি চাপা দিয়ে রাখুন; মাথা থেকে পা পর্যন্ত আগাগোড়া একেবারে সমান চ্যাপটা হয়ে যাই।
একদল যূনকের প্রবেশ
দাদাঠাকুর।
কী রে, এত ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলি কেন?
প্রথম যূনক।
চণ্ডককে মেরে ফেলেছে।
দাদাঠাকুর।
কে মেরেছে?
দ্বিতীয় যূনক।
স্থবিরপত্তনের রাজা।
পঞ্চক।
আমাদের রাজা? কেন, মারতে গেল কেন?
দ্বিতীয় যূনক।
স্থবিরক হয়ে ওঠবার জন্যে চণ্ডক বনের মধ্যে এক পোড়ো মন্দিরে তপস্যা করেছিল। ওদের রাজা মন্থরগুপ্ত সেই খবর পেয়ে তাকে কেটে ফেলেছে।
তৃতীয় যূনক।
আগে ওদের দেশের প্রাচীর পঁয়ত্রিশ হাত উঁচু ছিল, এবার আশি হাত উঁচু করবার জন্যে লোক লাগিয়ে দিয়েছে, পাছে পৃথিবীর সব লোক লাফ দিয়ে গিয়ে হঠাৎ স্থবিরক হয়ে ওঠে।
চতুর্থ যূনক।
আমাদের দেশ থেকে দশজন যূনক ধরে নিয়ে গেছে, হয়তো ওদের কালঝন্টি দেবীর কাছে বলি দেবে।
দাদাঠাকুর।
চলো তবে।
প্রথম যূনক।
কোথায়?
দাদাঠাকুর।
স্থবিরপত্তনে!
দ্বিতীয় যূনক।
এখনই?
দাদাঠাকুর।
হাঁ, এখনই।
সকলে।
ওরে চল্ রে চল্।
দাদাঠাকুর।
আমাদের রাজার আদেশ আছে ওদের পাপ যখন প্রাচীরের আকার ধরে আকাশের জ্যোতি আচ্ছন্ন করতে উঠবে তখন সেই প্রাচীর ধুলোয় লুটিয়ে দিতে হবে।
প্রথম যূনক।
দেব ধুলোয় লুটিয়ে।
সকলে।
দেব লুটিয়ে।
দাদাঠাকুর।
ওদের সেই ভাঙা প্রাচীরের উপর দিয়ে রাজপথ তৈরি করে দেব।
সকলে।
হাঁ, রাজপথ তৈরি করে দেব।
দাদাঠাকুর।
আমাদের রাজার বিজয়রথ তার উপর দিয়ে চলবে।
সকলে।
হাঁ, চলবে, চলবে।
পঞ্চক।
দাদাঠাকুর, এ কী ব্যাপার?
প্রথম যূনক।
চলো, পঞ্চক, তুমি চলো।
দাদাঠাকুর।
না না, পঞ্চক না। যাও ভাই তুমি তোমার অচলায়তনে ফিরে যাও। যখন সময় হবে দেখা হবে।
পঞ্চক।
কী জানি ঠাকুর, যদিও আমি কোনো কর্মের না, তবুও ইচ্ছে করছে তোমাদের সঙ্গে ছুটে বেরিয়ে পড়ি।
দাদাঠাকুর।
না পঞ্চক, তোমার গুরু আসবেন, তুমি অপেক্ষা করো গে।
[প্রস্থান
৩
দর্ভকপল্লী
পঞ্চক ও দর্ভকদল
পঞ্চক।
নির্বাসন, আমার নির্বাসন রে! বেঁচে গেছি, বেঁচে গেছি!
প্রথম দর্ভক।
তোমাদের কী খেতে দেব ঠাকুর?
পঞ্চক।
তোদের যা আছে তাই আমরা খাব।
দ্বিতীয় দর্ভক।
আমাদের খাবার? সে কি হয়? সে যে সব ছোঁওয়া হয়ে গেছে।
পঞ্চক।
সেজন্যে ভাবিস নে ভাই। পেটের খিদে যে আগুন, সে কারও ছোঁওয়া মানে না, সবই পবিত্র করে। ওরে তোরা সকালবেলায় করিস কী বল তো। ষড়ক্ষরিত দিয়ে একবার ঘটশুদ্ধি করে নিবি নে?
তৃতীয় দর্ভক।
ঠাকুর, আমরা নীচ দর্ভক জাত -- আমরা ও-সব কিছুই জানি নে। আজ কত পুরুষ ধরে এখানে বাস করে আসছি, কোনো দিন তো তোমাদের পায়ের ধুলা পড়ে নি। আজ তোমাদের মন্ত্র পড়ে আমাদের বাপ-পিতামহকে উদ্ধার করে দাও ঠাকুর।
পঞ্চক।
সর্বনাশ! বলিস কী! এখানেও মন্ত্র পড়তে হবে! তা হলে নির্বাসনের দরকার কী ছিল? তা, সকাল বেলা তোরা কী করিস বল্ তো?
প্রথম দর্ভক।
আমরা শাস্ত্র জানি নে, আমরা নাম গান করি।
পঞ্চক।
সে কী রকম ব্যাপার? শোনা দেখি একটা।
দ্বিতীয় দর্ভক।
ঠাকুর, সে তুমি শুনে হাসবে।
পঞ্চক।
আমিই তো ভাই এতদিন লোক হাসিয়ে আসছি -- তোরা আমাকেও হাসাবি! শুনেও মন খুশি হয়। কিছু ভাবিস নে -- নির্ভয়ে শুনিয়ে দে।
প্রথম দর্ভক।
আচ্ছা ভাই আয় তবে -- গান ধর।
গান
ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি,
ও অনাথের নাথ, ও পতিতের পতি!
ও নয়নের আলো, ও রসনার মধু,
ও রতনের হার, ও পরানের বঁধু!
ও অপরূপ রূপ, ও মনোহর কথা,
ও চরমের সুখ, ও মরমের ব্যথা!
ও ভিখারির ধন, ও অবোলার বোল --
ও জনমের দোলা, ও মরণের কোল!
পঞ্চক।
দে ভাই, আমার মন্ত্রতন্ত্র সব ভুলিয়ে দে, আমার বিদ্যাসাধ্যি সব কেড়ে নে, দে আমাকে তোদের ঐ গান শিখিয়ে দে!
আচার্যের প্রবেশ
প্রথম দর্ভক।
বাবাঠাকুর, আমাদের সমস্ত পাড়া আজ ত্রাণ পেয়ে গেল। এতদিন তোমার চরণধুলো তো এখানে পড়ে নি।
আচার্য।
সে আমার অভাগ্য, সে আমারই অভাগ্য।
দ্বিতীয় দর্ভক।
বাবা, তোমার স্নানের জল কাকে দিয়ে তোলাব। এখানে তো --
আচার্য।
বাবা, তোরাই তুলে আনবি।
প্রথম দর্ভক।
আমরা তুলে আনব -- সে কী হয়।
আচার্য।
হাঁ বাবা, তোদের তোলা জলে আজ আমার অভিষেক হবে।
দ্বিতীয় দর্ভক।
ওরে চল্ তবে ভাই চল্। আমাদের পাটলা নদী থেকে জল আনি গে।
[দর্ভকদলের প্রস্থান
পঞ্চক।
মনে হচ্ছে যেন ভিজে মাটির গন্ধ পাচ্ছি, কোথায় যেন বর্ষা নেমেছে।
আচার্য।
ওই পঞ্চক শুনতে পাচ্ছ কি?
পঞ্চক।
কী বলুন দেখি?
আচার্য।
আমার মনে হচ্ছে যেন সুভদ্র কাঁদছে।
পঞ্চক।
এখান থেকে কি শোনা যাবে? এ বোধ হয় আর কোনো শব্দ।
আচার্য।
তা হবে পঞ্চক, আমি তার কান্না আমার বুকের মধ্যে করে এনেছি। তার কান্নাটা এমন করে আমাকে বেজেছে কেন জান? সে-যে কান্না রাখতে পারে না তবু কিছুতে মানতে চায় না সে কাঁদছে।
পঞ্চক।
এতক্ষণে ওরা তাকে মহাতামসে বসিয়েছে -- আর সকলে মিলে খুব দূরে থেকে বাহবা দিয়ে বলছে শুভদ্র দেবশিশু। আর কিছু না, আমি যদি রাজা হতুম তা হলে ওদের সবাইকে কানে ধরে দেবতা করে দিতুম -- কিছুতে ছাড়তুম না।
আচার্য।
ওরা ওদের দেবতাকে কাঁদাচ্ছে পঞ্চক। সেই দেবতারই কান্নায় এ রাজ্যের সকল আকাশ আকুল হয়ে উঠেছে। তবু ওদের পাষাণের বেড়া এখনও শতধা বিদীর্ণ হয়ে গেল না।
দর্ভকদলের প্রবেশ
পঞ্চক।
কী ভাই, তোরা এত ব্যস্ত কিসের?
প্রথম দর্ভক।
শুনছি অচলায়তনে কারা সব লড়াই করতে এসেছে।
আচার্য।
লড়াই কিসের? আজ তো গুরু আসবার কথা।
দ্বিতীয় দর্ভক।
না না, লড়াই হচ্ছে খবর পেয়েছি। সমস্ত ভেঙেচুরে একাকার করে দিলে যে।
তৃতীয় দর্ভক।
বাবাঠাকুর, তোমরা যদি হুকুম কর আমরা যাই ঠেকাই গিয়ে।
আচার্য।
ওখানে তো লোক ঢের আছে, তোমাদের ভয় নেই বাবা।
প্রথম দর্ভক।
লোক তো আছে, কিন্তু তারা লড়াই করতে পারবে কেন?
দ্বিতীয় দর্ভক।
শুনেছি কতরকম মন্ত্রলেখা তাগাতাবিজ দিয়ে তারা দুখানা হাত আগাগোড়া কষে বেঁধে রেখেছে। খোলে না, পাছে কাজ করতে গেলেই তাদের হাতের গুণ নষ্ট হয়।
পঞ্চক।
আচার্যদেব, এদের সংবাদটা সত্যই হবে। কাল সমস্ত রাত মনে হচ্ছিল চার দিকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন ভেঙেচুরে পড়ছে। ঘুমের ঘোরে ভাবছিলুম স্বপ্ন বুঝি।
আচার্য।
তবে কি গুরু আসেন নি?
পঞ্চক।
হয়তো বা দাদা ভুল করে আমার গুরুরই সঙ্গে লড়াই বাধিয়ে বসেছেন! আটক নেই। রাত্রে তাঁকে হঠাৎ দেখে হয়তো যমদূত বলে ভুল করেছিলেন।
প্রথম দর্ভক।
আমরা শুনেছি কে বলছিল গুরুও এসেছেন।
আচার্য।
গুরুও এসেছেন? সে কী রকম হল?
পঞ্চক।
তবে লড়াই করতে কারা এসেছে বল তো?
প্রথম দর্ভক।
লোকের মুখে শুনি তাদের নাকি বলে দাদাঠাকুরের দল।
পঞ্চক।
দাদাঠাকুরের দল! বল বল শুনি, ঠিক বলছিস তো রে?
প্রথম দর্ভক।
বাবাঠাকুর, হুকুম করো, একবার ওদের সঙ্গে লড়ে আসি -- দেখিয়ে দিই এখানে মানুষ আছে।
পঞ্চক।
আয় না ভাই আমিও তোদের সঙ্গে চলব রে।
দ্বিতীয় দর্ভক।
তুমিও লড়বে নাকি ঠাকুর?
পঞ্চক।
হাঁ, লড়ব।
আচার্য।
কী বলছ পঞ্চক! তোমাকে লড়তে কে ডাকছে?
মালীর প্রবেশ
মালী।
আচার্যদেব, আমাদের গুরু আসছেন।
আচার্য।
বলিস কী? গুরু? তিনি এখানে আসছেন? আমাকে আহ্বান করলেই তো আমি যেতুম।
প্রথম দর্ভক।
এখানে তোমাদের গুরু এলে তাঁকে বসাব কোথায়?
দ্বিতীয় দর্ভক।
বাবাঠাকুর, তুমি এখানে তাঁর বসবার জায়গাকে একটু শোধন করে নাও -- আমরা তফাতে সরে যাই।
আর-একদল দর্ভকের প্রবেশ
প্রথম দর্ভক।
বাবাঠাকুর, এ তোমাদের গুরু নয় -- সে এ পাড়ায় আসবে কেন? এ যে আমাদের গোঁসাই!
দ্বিতীয় দর্ভক।
আমাদের গোঁসাই?
প্রথম দর্ভক।
হাঁ রে হাঁ, আমাদের গোঁসাই। এমন সাজ তার আর কখনো দেখি নি। একেবারে চোখ ঝলসে যায়।
তৃতীয় দর্ভক।
ঘরে কী আছে রে ভাই সব বের কর।
দ্বিতীয় দর্ভক।
বনের জাম আছে রে।
চতুর্থ দর্ভক।
আমার ঘরে খেজুর আছে।
প্রথম দর্ভক।
কালো গোরুর দুধ শিগ্গির দুয়ে আন দাদা।
দাদাঠাকুরের প্রবেশ
আচার্য।
(প্রণাম করিয়া) জয় গুরুজির জয়!
পঞ্চক।
এ কী! এ যে দাদাঠাকুর! গুরু কোথায়?
দর্ভকদল।
গোঁসাই ঠাকুর। প্রণাম হই। খবর দিয়ে এলে না কেন? তোমার ভোগ যে তৈরি হয় নি।
দাদাঠাকুর।
কেন ভাই, তোদের ঘরে আজ রান্না চড়ে নি নাকি? তোরাও মন্ত্র নিয়ে উপোস করতে আরম্ভ করেছিস্ নাকি রে?
প্রথম দর্ভক।
আমরা আজ শুধু মাষকলাই আর ভাত চড়িয়েছি। ঘরে আর কিছু ছিল না।
দাদাঠাকুর।
আমারও তাতেই হয়ে যাবে।
পঞ্চক।
দাদাঠাকুর, আমার ভারি গর্ব ছিল রাজ্যে একলা আমিই কেবল চিনি তোমাকে। কারও যে চিনতে আর বাকি নেই।
প্রথম দর্ভক।
ওই তো আমাদের গোঁসাই, পূর্ণিমার দিনে এসে আমাদের পিঠে খেয়ে গেছে, তার পর এই কতদিন পরে দেখা। চল ভাই, আমাদের যা আছে সব সংগ্রহ করে আনি।
[প্রস্থান
দাদাঠাকুর।
আচার্য, তুমি এ কী করেছ?
আচার্য।
কী যে করেছি তা বোঝবারও শক্তি আমার নেই। তবে এইটুকু বুঝি -- আমি সব নষ্ট করেছি।
দাদাঠাকুর।
যিনি তোমাকে মুক্তি দেবেন তাঁকেই তুমি কেবল বাঁধবার চেষ্টা করেছ।
আচার্য।
কিন্তু বাঁধতে তো পারি নি ঠাকুর। তাঁকে বাঁধছি মনে করে যতগুলো পাক দিয়েছি সব পাক কেবল নিজের চারি দিকেই জড়িয়েছি। যে হাত দিয়ে সেই বাঁধন খোলা যেতে পারত সেই হাতটা সুদ্ধ বেঁধে ফেলেছি।
দাদাঠাকুর।
যিনি সব যায়গায় আপনি ধরা দিয়ে বসে আছেন তাঁকে একটা জায়গায় ধরতে গেলেই তাঁকে হারাতে হয়।
আচার্য।
আদেশ করো প্রভু। ভুল করেছিলুম জেনেও সে ভুল ভাঙতে পারি নি। পথ হারিয়েছি তা জানতুম, যতই চলছি ততই পথ হতে কেবল বেশি দূরে গিয়ে পড়ছি তাও বুঝতে পেরেছিলুম, কিন্তু ভয়ে থামতে পারছিলুম না। এই চক্রে হাজার বার ঘুরে বেড়ানোকেই পথ খুঁজে পাবার উপায় বলে মনে করেছিলুম।
দাদাঠাকুর।
যে চক্র কেবল অভ্যাসের চক্র, যা কোনো জায়গাতেই নিয়ে যায় না, কেবল নিজের মধ্যেই ঘুরিয়ে মারে, তার থেকেই বের করে সোজা রাস্তায় বিশ্বের সকল যাত্রীর সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্যেই আমি আজ এসেছি।
আচার্য।
ধন্য করেছ। -- কিন্তু এতদিন আস নি কেন প্রভু? আমাদের আয়তনের পাশেই এই দর্ভকপাড়ায় তুমি আনাগোনা করছ আর কত বৎসর হয়ে গেল আমাদের আর দেখা দিলে না?
দাদাঠাকুর।
এদের দেখা দেওয়ার রাস্তা যে সোজা। তোমাদের সঙ্গে দেখা করা তো সহজ করে রাখ নি।
পঞ্চক।
ভালোই করেছি, তোমার শক্তি পরীক্ষা করে নিয়েছি। তুমি আমাদের পথ সহজ করে দেবে, কিন্তু তোমার পথ সহজ নয়। এখন, আমি ভাবছি তোমাকে ডাকব কী বলে? দাদাঠাকুর, না গুরু?
দাদাঠাকুর।
যে জানতে চায় না যে আমি তাকে চালাচ্ছি আমি তার দাদাঠাকুর, আর যে আমার আদেশ নিয়ে চলতে চায় আমি তার গুরু।
পঞ্চক।
প্রভু, তুমি তা হলে আমার দুইই। আমাকে আমিই চালাচ্ছি, আর আমাকে তুমিই চালাচ্ছ এই দুটোই আমি মিশিয়ে জানতে চাই। আমি তো যূনক নই, তোমাকে মেনে চলতে ভয় নেই। তোমার মুখের আদেশকেই আনন্দে আমার মনের ইচ্ছা করে তুলতে পারব। এবার তবে তোমার সঙ্গে তোমারই বোঝা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ঠাকুর।
দাদাঠাকুর।
আমি তোমার জায়গা ঠিক করে রেখেছি।
পঞ্চক।
কোথায় ঠাকুর?
দাদাঠাকুর।
ঐ অচলায়তনে।
পঞ্চক।
আবার অচলায়তনে? আমার কারাদণ্ডের মেয়াদ ফুরোয় নি?
দাদাঠাকুর।
কারাগার যা ছিল সে তো আমি ভেঙে ফেলেছি, এখন সেই উপকরণ দিয়ে সেইখানেই তোমাকে মন্দির গেঁথে তুলতে হবে।
পঞ্চক।
কিন্তু অচলায়তনের লোকে যে আমাকে আপন বলে গ্রহণ করবে না প্রভু।
দাদাঠাকুর।
ওরা তোমাকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না, সেই জন্যেই ওখানে তোমার সব চেয়ে দরকার। ওরা তোমাকে ঠেলে দিচ্ছে বলেই তুমি ওদের ঠেলতে পারবে না।
পঞ্চক।
আমাকে কী করতে হবে?
দাদাঠাকুর।
যে যেখানে ছড়িয়ে আছে সবাইকে ডাক দিয়ে আনতে হবে।
পঞ্চক।
সবাইকে কি কুলোবে?
দাদাঠাকুর।
না যদি কুলোয় তাহলে দেয়াল আবার আর-একদিন ভাঙতেই হবে। আমি এখন চললুম অচলায়তনের দ্বার খুলতে।
[প্রস্থান
৪
অচলায়তন
মহাপঞ্চক, সঞ্জীব, বিশ্বম্ভর, জয়োত্তম
মহাপঞ্চক।
তোমরা অত ব্যস্ত হয়ে পড়ছ কেন! কোনো ভয় নেই।
বিশ্বম্ভর।
তুমি তো বলছ ভয় নেই, এই যে খবর এল শত্রুসৈন্য অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করে দিয়েছে।
মহাপঞ্চক।
এ-কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। শিলা জলে ভাসে! ম্লেচ্ছরা অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করে দেবে! পাগল হয়েছ!
সঞ্জীব।
কে যে বললে দেখে এসেছে।
মহাপঞ্চক।
সে স্বপ্ন দেখেছে।
জয়োত্তম।
আজই তো আমাদের গুরুর আসবার কথা।
মহাপঞ্চক।
তার জন্যে সমস্ত আয়োজন ঠিক হয়ে গেছে; কেবল যে ছেলের মাবাপ ভাইবোন কেউ মরে নি এমন নবম গর্ভের সন্তান এখনও জুটিয়ে আনতে পারলে না -- দ্বারে দাঁড়িয়ে কে যে মহারক্ষা পড়বে ঠিক করতে পারছি নে।
সঞ্জীব।
গুরু এলে তাঁকে চিনে নেবে কে? আচার্য অদীনপুণ্য তাঁকে জানতেন। আমরা তো কেউ তাঁকে দেখি নি।
মহাপঞ্চক।
আমাদের আয়তনে যে শাঁখ বাজায় সেই বৃদ্ধ তাঁকে দেখেছে। আমাদের পূজার ফুল যে জোগায় সেও তাঁকে জানে।
বিশ্বম্ভর।
ওই যে উপাধ্যায় ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসছেন।
মহাপঞ্চক।
নিশ্চয় গুরু আসবার সংবাদ পেয়েছেন। কিন্তু মহারক্ষা-পাঠের কী করা যায়। ঠিক লক্ষণসম্পন্ন ছেলে তো পাওয়া গেল না।
উপাধ্যায়ের প্রবেশ
মহাপঞ্চক।
কত দূর?
উপাধ্যায়।
কতদূর কী? এসে পড়েছে যে!
মহাপঞ্চক।
কই দ্বারে তো এখনো শাঁক বাজালে না।
উপাধ্যায়।
বিশেষ দরকার দেখি নে -- কারণ দ্বারের চিহ্নও দেখতে পাচ্ছি নে -- ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
মহাপঞ্চক।
বল কী? দ্বার ভেঙেছে?
উপাধ্যায়।
শুধু দ্বার নয়, প্রাচীরগুলোকে এমনি সমান করে শুইয়ে দিয়েছে যে তাদের সম্বন্ধে আর কোনো চিন্তা করবার নেই। ওই দেখছ না আলো।
মহাপঞ্চক।
কিন্তু আমাদের দৈবজ্ঞ যে গণনা করে স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়ে গেল যে --
উপাধ্যায়।
তার চেয়ে ঢের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শত্রুসৈন্যদের রক্তবর্ণ টুপিগুলো। এই যে সব ফাঁক হয়ে গেছে।
ছাত্রগণ।
কী সর্বনাশ!
সঞ্জীব।
কিসের মন্ত্র তোমার মহাপঞ্চক?
বিশ্বম্ভর।
আমি তো তখনই বলেছিলুম, এ-সব কাজ এই কাঁচা বয়সের পুঁথিপড়া অকালপক্কদের দিয়ে হবার নয়।
সঞ্জীব।
কিন্তু এখন করা যায় কী?
জয়োত্তম।
আমাদের আচার্যদেবকে এখনই ফিরিয়ে আনি গে। তিনি থাকলে এ বিপত্তি ঘটতেই পারত না। হাজার হ'ক লোকটা পাকা।
সঞ্জীব।
কিন্তু দেখো মহাপঞ্চক, আমাদের আয়তনের যদি কোনো বিপত্তি ঘটে তা হলে তোমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।
উপাধ্যায়।
সে পরিশ্রমটা তোমাদের করতে হবে না, উপযুক্ত লোক আসছে।
মহাপঞ্চক।
তোমরা মিথ্যা বিচলিত হচ্ছ। বাইরের প্রাচীর ভাঙতে পারে, কিন্তু ভিতরের লোহার দরজা বন্ধ আছে। সে যখন ভাঙবে তখন চ#ন্দ্রসূর্য নিবে যাবে। আমি অভয় দিচ্ছি তোমরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে অচলায়তনের রক্ষক-দেবতার আশ্চর্য শক্তি দেখে নাও।
উপাধ্যায়।
তার চেয়ে দেখি কোন্ দিক দিয়ে বেরোবার রাস্তা।
বিশ্বম্ভর।
আমাদেরও তো সেই ইচ্ছা। কিন্তু এখান থেকে বেরোবার পথ যে জানিই নে। কোনোদিন বেরোতে হবে বলে স্বপ্নেও মনে করি নি।
সঞ্জীব।
শুনছ -- ওই শুনছ, ভেঙে পড়ল সব।
ছাত্রগণ।
কী হবে আমাদের! নিশ্চয় দরজা ভেঙেছে। এই যে একেবারে নীল আকাশ।
বালকদলের প্রবেশ
উপাধ্যায়।
কী রে তোরা সব নৃত্য করছিস কেন?
প্রথম বালক।
আজ এ কী মজা হল।
উপাধ্যায়।
মজাটা কী রকম শুনি?
দ্বিতীয় বালক।
আজ চার দিক থেকেই আলো আসছে -- সব যেন ফাঁক হয়ে গেছে।
তৃতীয় বালক।
এত আলো তো আমরা কোনোদিন দেখি নি।
প্রথম বালক।
কোথাকার পাখির ডাক এখান থেকেই শোনা যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বালক।
এ-সব পাখির ডাক আমরা তো কোনোদিন শুনি নি। এ তো আমাদের খাঁচার ময়নার মতো একেবারেই নয়।
প্রথম বালক।
আজ আমাদের খুব ছুটতে ইচ্ছে করছে। তাতে কি দোষ হবে মহাপঞ্চকদাদা?
মহাপঞ্চক।
আজকের কথা ঠিক বলতে পারছি নে। আজ কোনো নিয়ম রক্ষা করা চলবে বলে বোধ হচ্ছে না।
প্রথম বালক।
আজ তা হলে আমাদের ষড়াসন বন্ধ?
মহাপঞ্চক।
হাঁ বন্ধ।
সকলে।
ওরে কী মজা রে কী মজা!
দ্বিতীয় বালক।
আজ পংক্তিধৌতির দরকার নেই?
মহাপঞ্চক।
না।
সকলে।
ওরে কী মজা! আঃ আজ চারদিকে কী আলো।
জয়োত্তম।
আমারও মনটা নেচে উঠেছে বিশ্বম্ভর! এ কি ভয়, না আনন্দ, কিছুই বুঝতে পারছি নে।
বিশ্বম্ভর।
আজ একটা অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছে জয়োত্তম।
সঞ্জীব।
কিন্তু ব্যাপারটা যে কী, ভেবে উঠতে পারছি নে। ওরে ছেলেগুলো, তোরা হঠাৎ এত খুশি হয়ে উঠলি কেন বল দেখি।
প্রথম বালক।
দেখছ না, সমস্ত আকাশটা যেন ঘরের মধ্যে দৌড়ে এসেছে।
দ্বিতীয় বালক।
মনে হচ্ছে ছুটি -- আমাদের ছুটি।
[বালকদের প্রস্থান
জয়োত্তম।
দেখো মহাপঞ্চকদাদা, আমার মনে হচ্ছে ভয় কিছুই নেই -- নইলে ছেলেদের মন এমন অকারণে খুশি হয়ে উঠল কেন?
মহাপঞ্চক।
ভয় নেই সে তো আমি বরাবর বলে আসছি।
শঙ্খবাদক ও মালীর প্রবেশ
উভয়ে।
গুরু আসছেন।
সকলে।
গুরু!
মহাপঞ্চক।
শুনলে তো। আমি নিশ্চয় জানতুম তোমাদের আশঙ্কা বৃথা।
সকলে।
ভয় নেই আর ভয় নেই।
বিশ্বম্ভর।
মহাপঞ্চক যখন আছেন তখন কি আমাদের ভয় থাকতে পারে।
সকলে।
জয় আচার্য মহাপঞ্চকের।
যোদ্ধৃবেশে দাদাঠাকুরের প্রবেশ
শঙ্খবাদক ও মালী।
(প্রণাম করিয়া) জয় গুরুজির জয়।
সকলে স্তম্ভিত
মহাপঞ্চক।
উপাধ্যায়, এই কি গুরু?
উপাধ্যায়।
তাই তো শুনছি।
মহাপঞ্চক।
তুমি কি আমাদের গুরু?
দাদাঠাকুর।
হাঁ। তুমি আমাকে চিনবে না, কিন্তু আমিই তোমাদের গুরু।
মহাপঞ্চক।
তুমি গুরু? তুমি আমাদের সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে এ কোন্ পথ দিয়ে এলে? তোমাকে কে মানবে?
দাদাঠাকুর।
আমাকে মানবে না জানি, কিন্তু আমিই তোমাদের গুরু।
মহাপঞ্চক।
তুমি গুরু? তবে এই শত্রুবেশে কেন?
দাদাঠাকুর।
এই তো আমার গুরুর বেশ। তুমি যে আমার সঙ্গে লড়াই করবে -- সেই লড়াই আমার গুরুর অভ্যর্থনা।
মহাপঞ্চক।
কেন তুমি আমাদের প্রাচীর ভেঙে দিয়ে এলে?
দাদাঠাকুর।
তুমি কোথাও তোমার গুরুর প্রবেশের পথ রাখ নি।
মহাপঞ্চক।
তুমি কি মনে করেছ তুমি অস্ত্র হাতে করে এসেছ বলে আমি তোমার কাছে হার মানব?
দাদাঠাকুর।
না, এখনই না। কিন্তু দিনে দিনে হার মানতে হবে, পদে পদে।
মহাপঞ্চক।
আমাকে নিরস্ত্র দেখে ভাবছ আমি তোমাকে আঘাত করতে পারি নে?
দাদাঠাকুর।
আঘাত করতে পার কিন্তু আহত করতে পার না -- আমি যে তোমার গুরু।
মহাপঞ্চক।
উপাধ্যায়, তোমরা এঁকে প্রণাম করবে নাকি?
উপাধ্যায়।
দয়া করে উনি যদি আমাদের প্রণাম গ্রহণ করেন তা হলে প্রণাম করব বই কি -- তা নইলে যে --
মহাপঞ্চক।
না, আমি তোমাকে প্রণাম করব না।
দাদাঠাকুর।
আমি তোমার প্রণাম গ্রহণ করব না -- আমি তোমাকে প্রণত করব।
মহাপঞ্চক।
তুমি আমাদের পূজা নিতে আস নি?
দাদাঠাকুর।
আমি তোমাদের পূজা নিতে আসি নি, অপমান নিতে এসেছি।
মহাপঞ্চক।
তোমার পশ্চাতে অস্ত্রধারী এ কারা?
দাদাঠাকুর।
এরা আমার অনুবর্তী -- এরা যূনক।
সকলে।
যূনক!
মহাপঞ্চক।
এরাই তোমার অনুবর্তী?
দাদাঠাকুর।
হাঁ।
মহাপঞ্চক।
এই মন্ত্রহীন কর্মকাণ্ডহীন ম্লেচ্ছদল! আমি এই আয়তনের আচার্য -- আমি তোমাকে আদেশ করছি তুমি এখনই ওই ম্লেচ্ছদলকে সঙ্গে নিয়ে বাহির হয়ে যাও।
দাদাঠাকুর।
আমি যাকে আচার্য নিযুক্ত করব সেই আচার্য; আমি যা আদেশ করব সেই আদেশ।
মহাপঞ্চক।
উপাধ্যায়, আমরা এমন করে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। এস আমরা এদের এখান থেকে বাহির করে দিয়ে আমাদের আয়তনের সমস্ত দরজাগুলো আবার একবার দ্বিগুণ দৃঢ় করে বন্ধ করি।
উপাধ্যায়।
এরাই আমাদের বাহির করে দেবে, সেই সম্ভাবনাটাই প্রবল বোধ হচ্ছে!
প্রথম যূনক।
অচলায়তনের দরজার কথা বলছ -- সে আমরা আকাশের সঙ্গে দিব্যি সমান করে দিয়েছি।
উপাধ্যায়।
বেশ করেছ ভাই। আমাদের ভারি অসুবিধা হচ্ছিল। এত তালা-চাবির ভাবনাও ভাবতে হত!
মহাপঞ্চক।
পাথরের প্রাচীর তোমরা ভাঙতে পার, লোহার দরজা তোমরা খুলতে পার, কিন্তু আমি আমার ইন্দ্রিয়ের সমস্ত দ্বার রোধ করে এই বসলুম -- যদি প্রায়োপবেশনে মরি তবু তোমাদের হাওয়া তোমাদের আলো লেশমাত্র আমাকে স্পর্শ করতে দেব না।
প্রথম যূনক।
এ পাগলটা কোথাকার রে। এই তলোয়ারের ডগা দিয়ে ওর মাথার খুলিটা একটু ফাঁক করে দিলে ওর বুদ্ধিতে একটু হাওয়া লাগতে পারে।
মহাপঞ্চক।
কিসের ভয় দেখাও আমায়। তোমরা মেরে ফেলতে পার, তার বেশি ক্ষমতা তোমাদের নেই।
প্রথম যূনক।
ঠাকুর, এই লোকটাকে বন্দী করে নিয়ে যাই -- আমাদের দেশের লোকের ভারি মজা লাগবে।
দাদাঠাকুর।
ওকে বন্দী করবে তোমরা? এমন কী বন্ধন তোমাদের হাতে আছে।
দ্বিতীয় যূনক।
ওকে কি কোনো শাস্তিই দেব না?
দাদাঠাকুর।
শাস্তি দেবে! ওকে স্পর্শ করতেও পারবে না। ও আজ যেখানে বসেছে সেখানে তোমাদের তলোয়ার পৌঁছোয় না।
বালকদলের প্রবেশ
সকলে।
তুমি আমাদের গুরু?
দাদাঠাকুর।
হাঁ, আমি তোমাদের গুরু।
সকলে।
আমরা প্রণাম করি।
দাদাঠাকুর।
বৎস, তোমরা মহাজীবন লাভ করো।
প্রথম বালক।
ঠাকুর, তুমি আমাদের কী করবে।
দাদাঠাকুর।
আমি তোমাদের সঙ্গে খেলব।
সকলে।
খেলবে?
দাদাঠাকুর।
নইলে তোমাদের গুরু হয়ে সুখ কিসের?
সকলে।
কোথায় খেলবে?
দাদাঠাকুর।
আমার খেলার মস্ত মাঠ আছে।
প্রথম বালক।
মস্ত! এই ঘরের মতো মস্ত?
দাদাঠাকুর।
এর চেয়ে অনেক বড়ো।
দ্বিতীয় বালক।
এর চেয়েও বড়ো? ওই আঙিনাটার মতো?
দাদাঠাকুর।
তার চেয়েও বড়ো।
দ্বিতীয় বালক।
তার চেয়েও বড়ো! উঃ কী ভয়ানক!
প্রথম বালক।
সেখানে খেলতে গেলে পাপ হবে না?
দাদাঠাকুর।
কিসের পাপ?
দ্বিতীয় বালক।
খোলা জায়গায় গেলে পাপ হয় না?
দাদাঠাকুর।
খোলা জায়গাতেই সব পাপ পালিয়ে যায়।
সকলে।
কখন নিয়ে যাবে?
দাদাঠাকুর।
এখানকার কাজ শেষ হলেই।
জয়োত্তম।
(প্রণাম করিয়া) প্রভু, আমিও যাব।
বিশ্বম্ভর।
সঞ্জীব, আর দ্বিধা করলে কেবল সময় নষ্ট হবে। প্রভু, ওই বালকদের সঙ্গে আমাদেরও ডেকে নাও।
সঞ্জীব।
মহাপঞ্চকদাদা, তুমিও এস না।
মহাপঞ্চক।
না, আমি না।
সুভদ্রের প্রবেশ
সুভদ্র।
গুরু।
দাদাঠাকুর।
কী বাবা।
সুভদ্র।
আমি যে পাপ করেছি তার তো প্রায়শ্চিত্ত শেষ হল না।
দাদাঠাকুর।
তার আর কিছু বাকি নেই।
সুভদ্র।
বাকি নেই?
দাদাঠাকুর।
না। আমি সমস্ত চুরমার করে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছি।
সুভদ্র।
একজটা দেবী --
দাদাঠাকুর।
একজটা দেবী! উত্তরের দিকের দেয়ালটা ভাঙবামাত্রই একজটা দেবীর সঙ্গে আমাদের এমনি মিল হয়ে গেল যে, সে আর কোনো দিন জটা দুলিয়ে কাউকে ভয় দেখাবে না। এখন তাকে দেখলে মনে হবে সে আকাশের আলো -- তার সমস্ত জটা আষাঢ়ের নবীন মেঘের মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছে।
সুভদ্র।
এখন আমি কী করব?
পঞ্চক।
এখন তুমি আছ ভাই আর আমি আছি। দুজনে মিলে কেবলই উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিমের সমস্ত দরজা-জানলাগুলো খুলে খুলে বেড়াব।
যূনক ও দর্ভকদলের প্রবেশ ও গুরুকে প্রদক্ষিণ করিয়া গান
ভেঙেছে দুয়ার,এসেছ জ্যোতির্ময়,
তোমারি হউক জয়।
তিমির-বিদার উদার অভ্যুদয়,
তোমারি হউক জয়।
হে বিজয়ী বীর, নবজীবনের প্রাতে
নবীন আশার খড়গ তোমার হাতে,
জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতে,
বন্ধন হ'ক ক্ষয়।
তোমারি হউক জয়।
এস দুঃসহ, এস নির্দয়,
তোমারি হউক জয়।
এস নির্মল, এস এস নির্ভয়,
তোমারি হউক জয়।
প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজে,
দুঃখের পথে তোমার তূর্য বাজে,
অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্তমাঝে
মৃত্যুর হ'ক লয়।
তোমারি হউক জয়।