রোগীর বন্ধু (rogir bondu)
পৌষ ১২৯২
প্রথম দৃশ্য
রেলগাড়িতে দুঃখীরাম ও বৈদ্যনাথবাবু
বৈদ্যনাথ।
(মাথায় হাত দিয়া) উ--উ--উঃ!
দুঃখীরাম।
(দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) হা--হাঃ!
কাতরভাবে বৈদ্যনাথের প্রতি নিরীক্ষণ
বৈদ্যনাথ।
(দুঃখীরামের মনোযোগ দেখিয়া ) দেখছেন তো মশায়, ব্যামোর কষ্টটা তো দেখছেন!
দুঃখীরাম।
না, আমি তা দেখছি নে। আপনাকে দেখে আমার পুনর্বার ভ্রাতৃশোক উপস্থিত হচ্ছে। হা হাঃ!
নিশ্বাস
বৈদ্যনাথ।
সে কী কথা!
দুঃখীরাম।
হাঁ মশায়! মরবার সময় তার ঠিক আপনার মতো চেহারা হয়ে এসেছিল--
বৈদ্যনাথ।
(শশব্যস্ত হইয়া ) বলেন কী!
দুঃখীরাম।
যথার্থ কথা। ঐরকম তার চোখ বসে গিয়েছিল, গালের মাংস ঝুলে পড়েছিল, হাত-পা সরু হয়ে গিয়েছিল, ঠোঁট সাদা, মুখের চামড়া হলদে--
বৈদ্যনাথ।
(আকুলভাবে) বলেন কী মশায়! আমার কি তবে এমন দশা হয়েছে? এ কথা আমাকে তো কেউ বলে নি--
দুঃখীরাম।
কেনই বা বলবে? এ সংসারে প্রকৃত বন্ধু কেই বা আছে?
দীর্ঘনিশ্বাস
বৈদ্যনাথ।
ডাক্তার তো আমাকে বার বার বলেছে আমার কোনো ভাবনার কারণ নেই।
দুঃখীরাম।
ডাক্তার? ডাক্তারের কথা আপনি এক তিল বিশ্বাস করেন? ডাক্তারকে বিশ্বাস করেই কি আমরা অকূল পাথারে পড়ি নি? যখন আসন্ন বিপদ সেই সময়েই তারা বেশি করে আশ্বাস দেয়, অবশেষে যখন রোগীর হাতে-পায়ে খিল ধরে আসে, তার চোখ উল্টে যায়, তার গা-হাত-পা হিম হয়ে আসে, তার--
বৈদ্যনাথ।
(দুঃখীরামের হাত ধরিয়া) ক্ষমা করুন মশায়, আর বলবেন না মশায়! আমার গা-হাত-পা হিম হয়েই এসেছে। আপনার বর্ণনা সদ্যসদ্যই খেটে যাবে।
(বুকে হাত দিয়া) উ উ উঃ!
দুঃখীরাম।
দেখেছেন মশায়? আমি তো বলেইছি-- ডাক্তারের আশ্বাসবাক্যে কিছুমাত্র বিশ্বাস করবেন না। আচ্ছা, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি-- আপনি কি রাত্রে চিত হয়ে শোন্?
বৈদ্যনাথ।
হাঁ, চিত হয়ে না শুলে আমার ঘুম হয় না।
দুঃখীরাম।
(নিশ্বাস ফেলিয়া) আমার ভায়েরও ঠিক ঐ দশা হয়েছিল। সে একেবারেই পাশ ফিরতে পারত না।
বৈদ্যনাথ।
আমি তো ইচ্ছা করলেই পাশ ফিরতে পারি।
দুঃখীরাম।
এখন পারছেন। কিন্তু ক্রমে আর পারবেন না।
বৈদ্যনাথ।
সত্যি না কি!
দুঃখীরাম।
ক্রমে আপনার বাঁ-দিকের পাঁজরায় একরকম বেদনা ধরবে, ক্রমে পায়ের আঙুলগুলো একেবারে আড়ষ্ট হয়ে যাবে, গাঁঠ ফুলে উঠবে, ক্রমে--
বৈদ্যনাথ।
(গলদ্ঘর্ম হইয়া) দোহাই আপনার, আর বলবেন না। আমার বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করছে!
দুঃখীরাম।
আপনার এইবেলা সাবধান হওয়া উচিত।
বৈদ্যনাথ।
উচিত তা যেন বুঝলুম, কিন্তু কী করব বলুন।
দুঃখীরাম।
আপনি কি অ্যালোপ্যাথি-মতে চিকিৎসা করাচ্ছেন?
বৈদ্যনাথ।
হাঁ।
দুঃখীরাম।
কী সর্বনাশ! অ্যালোপ্যাথরা তো বিষ খাওয়ায়, ব্যামোর চেয়ে ওষুধ ভয়ানক। যমের চেয়ে ডাক্তারকে ডরাই।
বৈদ্যনাথ।
(শঙ্কিত হইয়া) বটে! তা, কী করব? হোমিওপ্যাথি দেখব?
দুঃখীরাম।
হোমিওপ্যাথি তো শুধু জলের ব্যবস্থা।
বৈদ্যনাথ।
তবে কি বদ্যি দেখাব?
দুঃখীরাম।
তার চেয়ে খানিকটা আফিং তুঁতের জলে গুলে হরতেল মিশিয়ে খান-না কেন?
বৈদ্যনাথ।
রাম রাম! তবে কী করা যায় মশায়!
দুঃখীরাম।
কিছু করার নেই, কোনো উপায় নেই এ আপনাকে নিশ্চিত বলছি।
বৈদ্যনাথ।
মশায়, আমি রোগা মানুষ, আমাকে এরকম ভয় দেখানো উচিত হয় না।
দুঃখীরাম।
ভয় কিসের মশায়? এ সংসারে তো কেবলই দুঃখ কষ্ট বিপদ। চতুর্দিক অন্ধকার। বিষাদের মেঘে আচ্ছন্ন! হা-হুতাশ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। এখানে আমরা বিষধর সর্পের গর্তে বাস করছি। এখেন থেকে বিদায় হওয়াই ভালো।
নিশ্বাস
বৈদ্যনাথ।
দেখুন, ডাক্তার আমাকে সর্বদা আমোদে-আহ্লাদ নিয়ে প্রফুল্ল থাকতে বলেছে। আপনার ঐ মুখ দেখেই আমার ব্যামো যেন হুহু করে বেড়ে উঠছে। আমাকে দেখে আপনার ভ্রাতৃশোক জন্মেছিল, কিন্তু আপনার ঐ অন্ধকার দাড়ি ঝাড়া দিলেই দেড় ডজন পুত্রশোক ঝরে পড়ে। আপনি একটা ভালো কথা তুলুন।
এটা কোন্ স্টেশন মশায়?
দুঃখীরাম।
এটা মধুপুর। এখেনে এ বৎসর যেরকম ওলাউঠো হয়েছে সে আর বলবার নয়।
বৈদ্যনাথ।
(ব্যস্ত হইয়া) ওলাউঠো! বলেন কী! এখানে গাড়ি কতক্ষণ থাকে?
দুঃখীরাম।
আধ ঘন্টা। এখেনে পাঁচ মিনিট থাকাও উচিত না।
বৈদ্যনাথ।
(শুইয়া পড়িয়া ) কী সর্বনাশ!
দুঃখীরাম।
ভয় করা বড়ো খারাপ। ভয় ধরলে তাকে ওলাউঠো আগে ধরে। লরি-সাহেবের বইয়ে লেখা আছে--
বৈদ্যনাথ।
আপনি আমাকে ছাড়লে আমার ভয়ও ছাড়ে। আপনি আমার হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়েছেন। আপনি ডাক্তার ডাকুন-- আমার কেমন করছে।
দুঃখীরাম।
ডাক্তার কোথায়?
বৈদ্যনাথ।
তবে স্টেশনমাস্টারকে ডাকুন।
দুঃখীরাম।
গাড়ি যে ছাড়ে-ছাড়ে।
বৈদ্যনাথ।
তবে গার্ড্কে ডাকুন।
দুঃখীরাম।
গার্ড্ আপনার কী করতে পারবে?
দীর্ঘনিশ্বাস
বৈদ্যনাথ।
তবে হরিকে ডাকুন। আমার হয়ে এল।
মুর্ছা
দুঃখীরামের উপর্যুপরি সুদীর্ঘ নিশ্বাসপতন ও গান--
"মনে করো শেষের সে দিন ভয়ংকর'
প্রথম দৃশ্য
রেলগাড়িতে দুঃখীরাম ও বৈদ্যনাথবাবু
বৈদ্যনাথ।
(মাথায় হাত দিয়া) উ--উ--উঃ!
দুঃখীরাম।
(দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) হা--হাঃ!
কাতরভাবে বৈদ্যনাথের প্রতি নিরীক্ষণ
বৈদ্যনাথ।
(দুঃখীরামের মনোযোগ দেখিয়া ) দেখছেন তো মশায়, ব্যামোর কষ্টটা তো দেখছেন!
দুঃখীরাম।
না, আমি তা দেখছি নে। আপনাকে দেখে আমার পুনর্বার ভ্রাতৃশোক উপস্থিত হচ্ছে। হা হাঃ!
নিশ্বাস
বৈদ্যনাথ।
সে কী কথা!
দুঃখীরাম।
হাঁ মশায়! মরবার সময় তার ঠিক আপনার মতো চেহারা হয়ে এসেছিল--
বৈদ্যনাথ।
(শশব্যস্ত হইয়া ) বলেন কী!
দুঃখীরাম।
যথার্থ কথা। ঐরকম তার চোখ বসে গিয়েছিল, গালের মাংস ঝুলে পড়েছিল, হাত-পা সরু হয়ে গিয়েছিল, ঠোঁট সাদা, মুখের চামড়া হলদে--
বৈদ্যনাথ।
(আকুলভাবে) বলেন কী মশায়! আমার কি তবে এমন দশা হয়েছে? এ কথা আমাকে তো কেউ বলে নি--
দুঃখীরাম।
কেনই বা বলবে? এ সংসারে প্রকৃত বন্ধু কেই বা আছে?
দীর্ঘনিশ্বাস
বৈদ্যনাথ।
ডাক্তার তো আমাকে বার বার বলেছে আমার কোনো ভাবনার কারণ নেই।
দুঃখীরাম।
ডাক্তার? ডাক্তারের কথা আপনি এক তিল বিশ্বাস করেন? ডাক্তারকে বিশ্বাস করেই কি আমরা অকূল পাথারে পড়ি নি? যখন আসন্ন বিপদ সেই সময়েই তারা বেশি করে আশ্বাস দেয়, অবশেষে যখন রোগীর হাতে-পায়ে খিল ধরে আসে, তার চোখ উল্টে যায়, তার গা-হাত-পা হিম হয়ে আসে, তার--
বৈদ্যনাথ।
(দুঃখীরামের হাত ধরিয়া) ক্ষমা করুন মশায়, আর বলবেন না মশায়! আমার গা-হাত-পা হিম হয়েই এসেছে। আপনার বর্ণনা সদ্যসদ্যই খেটে যাবে।
(বুকে হাত দিয়া) উ উ উঃ!
দুঃখীরাম।
দেখেছেন মশায়? আমি তো বলেইছি-- ডাক্তারের আশ্বাসবাক্যে কিছুমাত্র বিশ্বাস করবেন না। আচ্ছা, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি-- আপনি কি রাত্রে চিত হয়ে শোন্?
বৈদ্যনাথ।
হাঁ, চিত হয়ে না শুলে আমার ঘুম হয় না।
দুঃখীরাম।
(নিশ্বাস ফেলিয়া) আমার ভায়েরও ঠিক ঐ দশা হয়েছিল। সে একেবারেই পাশ ফিরতে পারত না।
বৈদ্যনাথ।
আমি তো ইচ্ছা করলেই পাশ ফিরতে পারি।
দুঃখীরাম।
এখন পারছেন। কিন্তু ক্রমে আর পারবেন না।
বৈদ্যনাথ।
সত্যি না কি!
দুঃখীরাম।
ক্রমে আপনার বাঁ-দিকের পাঁজরায় একরকম বেদনা ধরবে, ক্রমে পায়ের আঙুলগুলো একেবারে আড়ষ্ট হয়ে যাবে, গাঁঠ ফুলে উঠবে, ক্রমে--
বৈদ্যনাথ।
(গলদ্ঘর্ম হইয়া) দোহাই আপনার, আর বলবেন না। আমার বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করছে!
দুঃখীরাম।
আপনার এইবেলা সাবধান হওয়া উচিত।
বৈদ্যনাথ।
উচিত তা যেন বুঝলুম, কিন্তু কী করব বলুন।
দুঃখীরাম।
আপনি কি অ্যালোপ্যাথি-মতে চিকিৎসা করাচ্ছেন?
বৈদ্যনাথ।
হাঁ।
দুঃখীরাম।
কী সর্বনাশ! অ্যালোপ্যাথরা তো বিষ খাওয়ায়, ব্যামোর চেয়ে ওষুধ ভয়ানক। যমের চেয়ে ডাক্তারকে ডরাই।
বৈদ্যনাথ।
(শঙ্কিত হইয়া) বটে! তা, কী করব? হোমিওপ্যাথি দেখব?
দুঃখীরাম।
হোমিওপ্যাথি তো শুধু জলের ব্যবস্থা।
বৈদ্যনাথ।
তবে কি বদ্যি দেখাব?
দুঃখীরাম।
তার চেয়ে খানিকটা আফিং তুঁতের জলে গুলে হরতেল মিশিয়ে খান-না কেন?
বৈদ্যনাথ।
রাম রাম! তবে কী করা যায় মশায়!
দুঃখীরাম।
কিছু করার নেই, কোনো উপায় নেই এ আপনাকে নিশ্চিত বলছি।
বৈদ্যনাথ।
মশায়, আমি রোগা মানুষ, আমাকে এরকম ভয় দেখানো উচিত হয় না।
দুঃখীরাম।
ভয় কিসের মশায়? এ সংসারে তো কেবলই দুঃখ কষ্ট বিপদ। চতুর্দিক অন্ধকার। বিষাদের মেঘে আচ্ছন্ন! হা-হুতাশ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। এখানে আমরা বিষধর সর্পের গর্তে বাস করছি। এখেন থেকে বিদায় হওয়াই ভালো।
নিশ্বাস
বৈদ্যনাথ।
দেখুন, ডাক্তার আমাকে সর্বদা আমোদে-আহ্লাদ নিয়ে প্রফুল্ল থাকতে বলেছে। আপনার ঐ মুখ দেখেই আমার ব্যামো যেন হুহু করে বেড়ে উঠছে। আমাকে দেখে আপনার ভ্রাতৃশোক জন্মেছিল, কিন্তু আপনার ঐ অন্ধকার দাড়ি ঝাড়া দিলেই দেড় ডজন পুত্রশোক ঝরে পড়ে। আপনি একটা ভালো কথা তুলুন।
এটা কোন্ স্টেশন মশায়?
দুঃখীরাম।
এটা মধুপুর। এখেনে এ বৎসর যেরকম ওলাউঠো হয়েছে সে আর বলবার নয়।
বৈদ্যনাথ।
(ব্যস্ত হইয়া) ওলাউঠো! বলেন কী! এখানে গাড়ি কতক্ষণ থাকে?
দুঃখীরাম।
আধ ঘন্টা। এখেনে পাঁচ মিনিট থাকাও উচিত না।
বৈদ্যনাথ।
(শুইয়া পড়িয়া ) কী সর্বনাশ!
দুঃখীরাম।
ভয় করা বড়ো খারাপ। ভয় ধরলে তাকে ওলাউঠো আগে ধরে। লরি-সাহেবের বইয়ে লেখা আছে--
বৈদ্যনাথ।
আপনি আমাকে ছাড়লে আমার ভয়ও ছাড়ে। আপনি আমার হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়েছেন। আপনি ডাক্তার ডাকুন-- আমার কেমন করছে।
দুঃখীরাম।
ডাক্তার কোথায়?
বৈদ্যনাথ।
তবে স্টেশনমাস্টারকে ডাকুন।
দুঃখীরাম।
গাড়ি যে ছাড়ে-ছাড়ে।
বৈদ্যনাথ।
তবে গার্ড্কে ডাকুন।
দুঃখীরাম।
গার্ড্ আপনার কী করতে পারবে?
দীর্ঘনিশ্বাস
বৈদ্যনাথ।
তবে হরিকে ডাকুন। আমার হয়ে এল।
মুর্ছা
দুঃখীরামের উপর্যুপরি সুদীর্ঘ নিশ্বাসপতন ও গান--
"মনে করো শেষের সে দিন ভয়ংকর'