ফাল্গুন, ১২৯৮


 

পত্রালাপ (potralap)


লোকেন্দ্রনাথ পালিতকে লিখিত

 

 

লেখা সম্বন্ধে তুমি যে প্রস্তাব করেছ সে অতি উত্তম। মাসিক পত্রে লেখা অপেক্ষা বন্ধুকে পত্র লেখা অনেক সহজ। কারণ, আমাদের অধিকাংশ ভাবই বুনো হরিণের মতো, অপরিচিত লোক দেখলেই দৌড় দেয়। আবার পোষা ভাব এবং পোষা হরিণের মধ্যে স্বাভাবিক বন্যশ্রী পাওয়া যায় না।

 

কাজটা দু রকমে নিষ্পন্ন হাতে পারে। এক, কোনো একটা বিশেষ বিষয় স্থির করে দু জনে বাদপ্রতিবাদ করা-- কিন্তু তার একটা আশঙ্কা আছে, মীমাংসা হবার পূর্বেই বিষয়টা ক্রমে একঘেয়ে হয়ে যেতে পারে। আর-এক, কেবল চিঠি লেখা-- অর্থাৎ কোনো উদ্দেশ্য না রেখে লেখা, কেবল লেখার জন্যেই লেখা। অর্থাৎ ছুটির দিনে দুই বন্ধুতে মিলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া; তার পরে যেখানে গিয়ে পড়ি তাতে কিছু আসে যায় না, এবং পথ হারালেও কোনো মনিবের কাছে কৈফিয়ত দেবার নেই।

 

দস্তুরমত রাস্তায় চলতে গেলে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলবার জো থাকে না। কিন্তু প্রাপ্য জিনিসের চেয়ে ফাউ যেমন বেশি ভালো লাগে তেমনি অধিকাংশ সময়েই অপ্রাসঙ্গিক কথাটায় বেশি আমোদ পাওয়া যায়; মূল কথাটার চেয়ে তার আশপাশের কথাটা বেশি মনোরম বোধ হয়; অনেক সময়ে রামের চেয়ে হনুমান এবং লক্ষ্ণণ, যুধিষ্ঠিরের চেয়ে ভীষ্ম এবং ভীম, সূর্যমুখীর চেয়ে কমলমণি বেশি প্রিয় বলে বোধ হয়।

 

অবশ্য, সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কথা বললে একেবারে পাগলামি করা হয়; কিন্তু তাই বলে নিজের নাসাগ্রভাগের সমসূত্র ধরে ভূমিকা থেকে উপসংহার পর্যন্ত একেবারে সোজা লাইনে চললে নিতান্ত কলে-তৈরি প্রবন্ধের সৃষ্টি হয়, মানুষের হাতের কাজের মতো হয় না। সেরকম আঁটা-আঁটি প্রবন্ধের বিশেষ আবশ্যক আছে এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না; কিন্তু সর্বত্র তারই বড়ো বাহুল্য দেখা যায়। সেগুলো পড়লে মনে হয় যেন সত্য তার সমস্ত সুলংলগ্ন যুক্তিপরম্পরা নিয়ে একেবারে সম্পূর্ণভাবে কোথা থেকে আবির্‌ভূত হল। মানুষের মনের মধ্যে সে যে মানুষ হয়েছে, সেখানে তার যে আরো অনেকগুলি সমবয়সী সহোদর ছিল, একটি বৃহৎ বিস্তৃত মানসপুরে যে তার একটি বিচিত্র বিহারভূমি ছিল, লেখকের প্রাণের মধ্যে থেকেই সে যে প্রাণ লাভ করেছে, তা তাকে দেখে মনে হয় না; এমন মনে হয় যেন কোনো ইচ্ছাময় দেবতা যেমন বললেন "অমুক প্রবন্ধ হউক' অমনি অমুক প্রবন্ধ হল: লেট দেয়ার বি লাইট অ্যাণ্ড্‌ দেয়ার ওআজ লাইট। এইজন্য তাকে নিয়ে কেবল আমাদের মাথার খাটুনি হয়, কেবলমাত্র মগজ দিয়ে সেটাকে হজম করবার চেষ্টা করা হয়; আমাদের মানসপুরে যেখানে আমাদের নানাবিধ জীবন্ত ভাব জন্মাচ্ছে খেলছে এবং বাড়ছে সেখানে তার স্বর পরিচিতভাবে প্রবেশ করতে পারে না; প্রস্তুত হয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে হয়, সাবধান হয়ে তার সঙ্গে কথা কইতে হয়; তার সঙ্গে কেবল আমাদের একাংশের পরিচয় হয় মাত্র, ঘরের লোকের মতো সর্বাংশের পরিচয় হয় না।

 

ম্যাপে এবং ছবিতে অনেক তফাত। ম্যাপে পার্‌স্‌পেক্‌টিভ থাকতে পারে না; দূর নিকটের সমান ওজন, সর্বত্রই অপক্ষপাত; প্রত্যেক অংশকেই সূক্ষ্মবিচারমত তার যথাপরিমাণ স্থান নির্দেশ করে দিতে হয়। কিন্তু ছবিতে অনেক জিনিস বাদ পড়ে; অনেক বড়ো ছোটো হয়ে যায়; অনেক ছোটো বড়ো হয়ে ওঠে। কিন্তু তবু ম্যাপের চেয়ে তাকে সত্য মনে হয়, তাকে দেখবামাত্রই এক মুহূর্তে আমাদের সমস্ত চিত্ত তাকে চিনতে পারে। আমরা চোখে যে ভুল দেখি তাকে সংশোধন করতে গেলে ছবি হয় না, ম্যাপ হয়, তাকে মাথা খাটিয়ে আয়ত্ত করতে হয়। কিন্তু এইরকম আংশিক চেষ্টা ভারি শ্রান্তিজনক। যাতে আমাদের সমস্ত প্রকৃতি উৎসাহের সঙ্গে যোগ দেয় না, পরস্পরের ভার লাঘব করে না, নিজ নিজ অংশ বণ্টন করে নেয় না, তাতে আমাদের তেমন পরিপুষ্টি-সাধন হয় না। যে কারণে খনিজ পদার্থের চেয়ে প্রাণিজ পদার্থ আমরা শীঘ্র গ্রহণ এবং পরিপাক করতে পারি, সেই কারণে একেবারে অমিশ্র খাঁটি সত্য কঠিন যুক্তি-আকারে আমাদের অধিকাংশ পাকযন্ত্রের পক্ষেই গুরুপাক। এইজন্য সত্যকে মানবের জীবনাংশের সঙ্গে মিশ্রিত করে দিলে সেটা লাগে ভালো।

 

সেই কাজ করতে গেলেই প্রথমত একটা সত্যকে এক দমে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়া দেওয়া যায় না। কারণ, অধিকাংশ সত্যই আমরা মনের মধ্যে আভাসরূপে পাই এবং তার পশ্চাতে আমাদের মাথাটাকে প্রেরণ ক'রে গ'ড়ে পিটে তার একটা আগা-গোড়া খাড়া করে তুলতে চেষ্টা করি। সেটাকে বেশ একটা সংগত এবং সম্পূর্ণ আকার না দিলে একটা চলনসই প্রবন্ধ হল না, মনে করি। এইজন্যে নানাবিধ কৃত্রিম কাঠ খড় দিয়ে তাকে নিয়ে একটা বড়োগোছের তাল পাকিয়ে তুলতে হয়।

 

আমি ইংরিজি কাগজ এবং বইগুলো যখন পড়ি তখন অধিকাংশ সময়েই আমার এই কথা মনে হয় যে, একটা কথাকে একটা প্রবন্ধ কিম্বা একটা গ্রন্থে পরিণত করতেই হবে এই চেষ্টা থাকাতে প্রতিদিনকার ইংরাজি সাহিত্যে যে কত বাজে বকুনির প্রাদুর্ভাব হয়েছে তার আর সংখ্যা নেই-- এবং সত্যটুকুকে খুঁজে বের করা কত দুঃসাধ্য হয়েছে! যে কথাটা বলা হচ্ছে সেটা আসলে কত সহজ এবং সংক্ষিপ্ত, সেটাকে না-হক কত দুরূহ এবং বৃহৎ করে তোলা হয়! আমার বোধ হয় ইংরাজি সাহিত্যের মাপকাঠিটা বড়ো বেশি বেড়ে গেছে-- তিন ভল্যুম না হলে নভেল হয় না এবং মাসিক-পত্রের এক-একটা প্রবন্ধ দেখলে ভয় লাগে। আমার বোধ হয় "নাইন্টীন্‌থ্‌ সেন্‌চুরি' যদি অত বড়ো আয়তনের কাগজ না হত তা হলে ওর লেখাগুলো ঢের বেশি পাঠ্য এবং খাঁটি হত।

 

আমার তো মনে হয়, বঙ্কিমবাবুর নভেলগুলি ঠিক নভেল যত বড়ো হওয়া উচিত তার আদর্শ। ভাগ্যে তিনি ইংরাজি নভেলিস্টের অনুকরণে বাংলায় বৃহদায়তনের দস্তুর বেঁধে দেন নি! তা হলে বড়ো অসহ্য হয়ে উঠত, বিশেষত সমালোচকের পক্ষে। এক-একটা ইংরাজি নভেলে এত অতিরিক্ত বেশি কথা, বেশি ঘটনা, বেশি লোক যে, আমার মনে হয় ওটা একটা সাহিত্যের বর্বরতা। সমস্ত রাত্রি ধরে যাত্রাগান করার মতো। প্রাচীনকালেই ওটা শোভা পেত। তখন ছাপাখানা এবং প্রকাশকসম্প্রদায় ছিল না, তখন একখানা বই নিয়ে বহুকাল জাওর কাটবার সময় ছিল। এমন-কি, জর্জ্‌ এলিয়টের নভেল যদিও আমার খুব ভালো লাগে, তবু এটা আমার বরাবর মনে হয় জিনিসগুলো বড়ো বেশি বড়ো-- এত লোক, এত ঘটনা, এত কথার হিজিবিজি না থাকলে বইগুলো আরো ভালো হত। কাঁঠাল ফল দেখে যেমন মনে হয়-- প্রকৃতি একটা ফলের মধ্যে ঠেসাঠেসি করে বিস্তর সারবান কোষ পুরতে চেষ্টা করে ফলটাকে আয়তনে খুব বৃহৎ এবং ওজনে খুব ভারী করেছেন বটে এবং একজন লোকের সংকীর্ণ পাকযন্ত্রের পক্ষে কম দুঃসহ করেন নি, কিন্তু হাতের কাজটা মাটি করেছেন। এরই একটাকে ভেঙে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা ফল গড়লে সেগুলো দেখতে ভালো হত। জর্জ এলিয়টের এক-একটি নভেল এক-একটি সাহিত্যকাঁঠাল-বিশেষ। ক্ষমতা দেখে মানুষ আশ্চর্য হয় বটে, কিন্তু সৌন্দর্য দেখে মানুষ খুশি হয়। স্থায়িত্বের পক্ষে সহজতা সরলতা সৌন্দর্য যে প্রধান উপকরণ তার আর সন্দেহ নেই।

 

সত্যকে যথাসাধ্য বাড়িয়ে তুলে তাকে একটা প্রচলিত দস্তুরমত আকার দিয়ে সত্যের খর্বতা করা হয়, অতএব তার কাজ নেই। তা ছাড়া সত্যকে এমনভাবে প্রকাশ করা যাক যাতে লোকে অবিলম্বে জানতে পারে যে সেটা আমারই বিশেষ মন থেকে বিশেষভাবে দেখা দিচ্ছে। আমার ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা, আমার সন্দেহ এবং বিশ্বাস, আমার অতীত এবং বর্তমান তার সঙ্গে জড়িত হয়ে থাক্‌; তা হলেই সত্যকে নিতান্ত জড়পিণ্ডের মতো দেখাবে না।

 

আমার বোধ হয়, সাহিত্যের মূল ভাবটাই তাই। যখন কোনো-একটা সত্য লেখক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দেখা দেয়, যখন সে জন্মভূমির সমস্ত ধূলি মুছে ফেলে এমন ছদ্মবেশ ধারণ করে যাতে ক'রে তাকে একটা অমানুষিক স্বয়ম্ভূ সত্য বলে মনে হয়, তখন তাকে বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস প্রভৃতি নানা নাম দেওয়া হয়। কিন্তু যখন সে সঙ্গে সঙ্গে আপনার জন্মভূমির পরিচয় দিতে থাকে, আপনার মানবাকার গোপন করে না, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং জীবনের আন্দোলন প্রকাশ করে, তখনই সেটা সাহিত্যের শ্রেণীতে ভুক্ত হয়। এইজন্যে বিজ্ঞান দর্শন সবই সাহিত্যের মধ্যে মিশিয়ে থাকতে পারে এবং ক্রমেই মিশিয়ে যায়। প্রথম গজিয়ে তারা দিন-কতক অত্যন্ত খাড়া হয়ে থাকে, তার পরে মানবজীবনের সঙ্গে তারা যতই মিলে যায় ততই সাহিত্যের অন্তর্‌ভূত হতে থাকে, ততই তার উপর সহস্র মনের সহস্র ছাপ পড়ে এবং আমাদের মনোরাজ্যে তাদের আর প্রবাসীভাবে থাকতে হয় না।

 

এইরকম সাহিত্য-আকারে যখন সত্য পাই তখন সে সর্বতোভাবে সাধারণের ব্যবহারোপযোগী হয়।

 

কিন্তু সাধারণের সহজ ব্যবহারোপযোগী হয় বলেই সাধারণের কাছে অনেক সময় তার বিশেষ গৌরব চলে যায়। যেন সত্যকে মানবজীবন দিয়ে মণ্ডিত করে প্রকাশ করা কম কথা। সেটাকে সহজে গ্রহণ করা যায় বলে যেন সেটাকে সৃজন করাও সহজ। তাই আমাদের সারবান সমালোচকেরা প্রায়ই আক্ষেপ করে থাকেন, বাংলায় রাশি রাশি নাটক-নভেল-কাব্যের আমদানি হচ্ছে। কই হচ্ছে! যদি হত তা হলে আমাদের ভাবনা কী ছিল!

 

আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় না আমরা জ্ঞানত কিম্বা অজ্ঞানত মানুষকেই সব চেয়ে বেশি গৌরব দিয়ে থাকি? আমরা যদি কোনো সাহিত্যে অনেকগুলো ভ্রান্ত মতের সঙ্গে একটা জীবন্ত মানুষ পাই সেটাকে কি চিরস্থায়ী করে রেখে দিই নে? জ্ঞান পুরাতন এবং অনাদৃত হয়, কিন্তু মানুষ চিরকাল সঙ্গদান করতে পারে। সত্যকার মানুষ প্রতিদিন যাচ্ছে এবং আসছে; তাকে আমরা খণ্ড খণ্ড ভাবে দেখি এবং ভুলে যাই, এবং হারাই। অথচ মানুষকে আয়ত্ত করবার জন্যেই আমাদের জীবনের সর্বপ্রধান ব্যাকুলতা। সাহিত্যে সেই চঞ্চল মানুষ আপনাকে বদ্ধ করে রেখে দেয়; তার সঙ্গে আপনার নিগূঢ় যোগ চিরকাল অনুভব করতে পারি। জীবনের অভাব সাহিত্যে পূরণ করে। চিরমনুষ্যের সঙ্গ লাভ ক'রে আমাদের পূর্ণ মনুষ্যত্ব অলক্ষিতভাবে গঠিত হয়-- আমরা সহজে চিন্তা করতে, ভালোবাসতে এবং কাজ করতে শিখি। সাহিত্যের এই ফলগুলি তেমন প্রত্যক্ষগোচর নয় ব'লে অনেকে একে শিক্ষার বিষয়ের মধ্যে নিকৃষ্ট আসন দিয়ে থাকেন, কিন্তু আমার বিশ্বাস, সাধারণত দেখলে বিজ্ঞান-দর্শন-ব্যতীতও কেবল সাহিত্যে একজন মানুষ তৈরি হতে পারে, কিন্তু সাহিত্য-ব্যতিরেকে কেবল বিজ্ঞান-দর্শনে মানুষ গঠিত হতে পারে না।

 

কিন্তু আমি তোমাকে কী বলছিলুম, সে কোথায় গেল! আমি বলছিলেম, কোনো-একটা বিশেষ প্রসঙ্গ নিয়ে তার আগাগোড়া তর্ক নাই হল। তার মীমাংসাই বা নাই হল। কেবল দুজনের মনের আঘাত-প্রতিঘাতে চিন্তাপ্রবাহের মধ্যে বিবিধ ঢেউ তোলা, যাতে করে তাদের উপর নানা বর্ণের আলোছায়া খেলতে পারে, এই হলেই বেশ হয়। সাহিত্যে এরকম সুযোগ সর্বদা ঘটে না, সকলেই সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ মত প্রকাশ করতেই ব্যস্ত-- এইজন্যে অধিকাংশ মাসিক পত্র মৃত মতের মিউজিয়াম বললেই হয়। মত-সকল জীবিত অবস্থায় যেখানে নানা ভঙ্গিতে সঞ্চরণ করে সেখানে পাঠকদের প্রবেশলাভ দুর্লভ। অবশ্য, সেখানে কেবল গতি নৃত্য এবং আভাস দেখা যায় মাত্র, জিনিসটাকে সম্পূর্ণ হাতে তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায় না, কিন্তু তাতে যে একরকমের জ্ঞান এবং সুখ পাওয়া যায় এমন অন্য কিছুতে পাবার সুবিধে নেই।

 

 

তুমি আমাকে খানিকটা ভুল বুঝেছ সন্দেহ নেই। আমিও বোধ করি কিঞ্চিৎ ঢিলে রকমে ভাব প্রকাশ করেছিলুম। কিন্তু সেজন্যে আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ, ভুল না বুঝলে অনেক সময় এক কথায় সমস্ত শেষ হয়ে যায়, অনেক কথা বলবার অবসর পাওয়া যায় না। খাবার জিনিস মুখে দেবামাত্র মিলিয়ে গেলে যেমন তার সম্পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করা যায় না তেমনি ভুল না বুঝলে, শোনবামাত্র অবাধে মতের ঐক্য হলে, কথাটা এক দমে উদরস্থ হয়ে যায়-- র'য়ে ব'সে তার সমস্তটার পুরো আস্বাদ পাওয়া যায় না।

 

তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ, সে যে তোমার দোষ তা আমি বলতে চাই নে। আপনার ঠিক মতটি নির্‌ভুল করে ব্যক্ত করা ভারি শক্ত। এক মানুষের মধ্যে যেন দুটো মনুষ্য আছে, ভাবুক এবং লেখক। যে লোকটা ভাবে সেই লোকটাই যে সব সময় লেখে তা ঠিক মনে হয় না। লেখক-মুনষ্যটি ভাবুক-মনুষ্যটির প্রাইভেট সেক্রেটারি। তিনি অনেক সময় অনবধানতা কিম্বা অক্ষমতা -বশত ভাবুকের ঠিক ভাবটি প্রকাশ করেন না। আমি মনে করছি আমার যেটি বক্তব্য আমি সেটি ঠিক লিখে যাচ্ছি এবং সকলের কাছেই সেটা পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠছে, কিন্তু আমার লেখনী যে কখন পাশের রাস্তায় চলে গেছেন আমি হয়তো তা জানতেও পারি নি।

 

কিন্তু তার ভুলের জন্যে আমিই দায়ী; তার উপরে দোষারোপ করে আমি নিষ্কৃতি পেতে পারি নে। এইজন্যে অনেক সময়ে দায়ে পড়ে তার পক্ষ সমর্থন করতে হয়। যেটা ঠিক আমার মত নয় সেইটেকেই আমার মত বলে ধরে নিয়ে প্রাণপণে লড়াই করে যেতে হয়। কারণ, আমার নিজের মধ্যে যে-একটা গৃহবিচ্ছেদ আছে সেটা বাইরের লোকের কাছে প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে না।

 

সাহিত্য যে কেবল লেখকের আত্মপ্রকাশ, আমার চিঠিতে যদি এই কথা বেরিয়ে গিয়ে থাকে তা হলে অগত্যা যতক্ষণ পারা যায় তার হয়ে লড়তে হবে এবং সে কথাটার মধ্যে যতটুকু সত্য আছে তা সমস্তটা আদায় করে নিয়ে তার পরে তাকে ইক্ষুর চর্বিত অংশের মতো ফেলে দিলে কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা যেভাবে চলেছি তাতে তাড়াতাড়ি একটা কথা সংশোধন করবার কোনো দরকার দেখি নে।

 

তুমি বলেছ, সাহিত্য যদি লেখকের আত্মপ্রকাশই হবে, তার শেক্‌সপীয়রের নাটককে কী বলবে। সংক্ষেপে উত্তর দেওয়া অসম্ভব, অতএব একটু খোলসা করে বলি।

 

আত্মরক্ষা এবং বংশরক্ষা এই দুই নিয়ম জীবজগতে কার্য করে। এক হিসাবে দুটোকেই এক নাম দেওয়া যেতে পারে। কারণ, বংশরক্ষা প্রকৃতপক্ষে বৃহৎভাবে ব্যাপকভাবে সুদূরভাবে আত্মরক্ষা। সাহিত্যের কার্যকে তেমনি দুই অংশে ভাগ করা যেতে পারে। আত্মপ্রকাশ এবং বংশপ্রকাশ। গীতিকাব্যকে আত্মপ্রকাশ এবং নাট্যকাব্যকে বংশপ্রকাশ নাম দেওয়া যাক।

 

আত্মপ্রকাশ বলতে কী বোঝায় তার আর বাহুল্য বর্ণনার আবশ্যক নেই। কিন্তু বংশপ্রকাশ কথাটার একটু ব্যাখ্যা আবশ্যক।

 

লেখকের নিজের অন্তরে একটি মানবপ্রকৃতি আছে এবং লেখকের বাহিরে সমাজে একটি মানবপ্রকৃতি আছে, অভিজ্ঞতাসূত্রে প্রীতিসূত্রে এবং নিগূঢ় ক্ষমতা বলে এই উভয়ের সম্মিলন হয়; এই সম্মিলনের ফলেই সাহিত্যে নূতন নূতন প্রজা জন্মগ্রহণ করে। সেই-সকল প্রজার মধ্যে লেখকের আত্মপ্রকৃতি এবং বাহিরের মানবপ্রকৃতি দুইই সম্বন্ধ হয়ে আছে, নইলে কখনোই জীবন্ত সৃষ্টি হতে পারে না। কালিদাসের দুষ্মন্ত-শকুন্তলা এবং মহাভারতকারের দুষ্মন্ত-শকুন্তলা এক নয়, তার প্রধান কারণ কালিদাস এবং বেদব্যাস এক লোক নন, উভয়ের অন্তরপ্রকৃতি ঠিক এক ছাঁচের নয়; সেইজন্য তাঁরা আপন অন্তরের ও বাহিরের মানবপ্রকৃতি থেকে যে দুষ্মন্ত-শকুন্তলা গঠিত করেছেন তাদের আকারপ্রকার ভিন্ন রকমের হয়েছে। তাই বলে বলা যায় না যে, কালিদাসের দুষ্মন্ত অবিকল কালিদাসের প্রতিকৃতি; কিন্তু তবু এ কথা বলতেই হবে তার মধ্যে কালিদাসের অংশ আছে, নইলে সে অন্যরূপ হত। তেমনি শেক্‌স্‌পীয়রের অনেকগুলি সাহিত্যসন্তানের এক একটি ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট হয়েছে বলে যে তাদের মধ্যে শেক্‌স্‌পীয়রের আত্মপ্রকৃতির কোনো অংশ নেই তা আমি স্বীকার করতে পারি নে। সে-রকম প্রমাণ অবলম্বন করতে গেলে পৃথিবীর অধিকাংশ ছেলেকেই পিতৃ-অংশ হতে বিচ্যুত হতে হয়। ভালো নাট্যকাব্যে লেখকের আত্মপ্রকৃতি এবং বাহিরের মানবপ্রকৃতি এমনি অবিচ্ছিন্ন ঐক্য রক্ষা করে মিলিত হয় যে উভয়কে স্বতন্ত্র করা দুঃসাধ্য।

 

অন্তরে বাহিরে এইরকম একীকরণ না করতে পারলে কেবলমাত্র বহুদর্শিতা এবং সূক্ষ্ম বিচারশক্তি -বলে কেবল রস্ফুকো প্রভৃতির ন্যায় মানবচরিত্র ও লোকসংসার সম্বন্ধে পাকা প্রবন্ধ লিখতে পারা যায়। কিন্তু শেক্‌স্‌পীয়র তাঁর নাটকের পাত্রগণকে নিজের জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত করে তুলেছিলেন, অন্তরের নাড়ীর মধ্যে প্রবাহিত প্রতিভার মাতরস পান করিয়েছিলেন, তবেই তারা মানুষ হয়ে উঠেছিল; নইলে তারা কেবলমাত্র প্রবন্ধ হত। অতএব এক হিসাবে শেক্‌স্‌পীয়রের রচনাও আত্মপ্রকাশ কিন্তু খুব সম্মিশ্রিত বৃহৎ এবং বিচিত্র।

 

সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে মানবজীবনের সম্পর্ক। মানুসের মানসিক জীবনটা কোনখানে? যেখানে আমাদের বুদ্ধি এবং হৃদয়, বাসনা এবং অভিজ্ঞতা সবগুলি গলে গিয়ে মিশে গিয়ে একটি সম্পূর্ণ ঐক্যলাভ করেছে। যেখানে আমাদের বুদ্ধি প্রবৃত্তি এবং রুচি সম্মিলিতভাবে কাজ করে। এক কথায়, যেখানে আদত মানুষটি আছে। সেইখানেই সাহিত্যের জন্মলাভ হয়। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় খণ্ড খণ্ড ভাবে প্রকাশ পায়। সেই খণ্ড অংশগুলি বিজ্ঞান দর্শন প্রভৃতি রচনা করে। পর্যবেক্ষণকারী মানুষ বিজ্ঞান রচনা করে, চিন্তাশীল মানুষ দর্শন রচনা করে, এবং সমগ্র মানুষটি সাহিত্য রচনা করে।

 

গেটে উদ্ভিদ্‌তত্ত্ব সম্বন্ধে বই লিখেছেন। তাতে উদ্ভিদ্‌রহস্য প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু গেটের কিছুই প্রকাশ পায় নি অথবা সামান্য এক অংশ প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু গেটে  যে-সমস্ত সাহিত্য রচনা করেছেন তার মধ্যে মূল মানবটি প্রকাশ পেয়েছেন। বৈজ্ঞানিক গেটের অংশও অলক্ষিত মিশ্রিত ভাবে তার মধ্যে আছে। যিনি যাই বলুন শেক্‌স্‌পীয়রের কাব্যের কেন্দ্রস্থলেও একটি অমূর্ত ভাবশরীরী শেক্‌স্‌পীয়রকে পাওয়া যায় যেখান থেকে তাঁর জীবনের সমস্ত দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস বিরাগ অনুরাগ বিশ্বাস অভিজ্ঞতা সহজ জ্যোতির মতো চতুর্দিকে বিচিত্র শিখায় বিবিধ বর্ণে বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছে; যেখান থেকে ইয়াগোর প্রতি বিদ্বেষ, ওথেলোর প্রতি অনুকম্পা, ডেস্‌ডিমোনার প্রতি প্রীতি, ফল্‌স্টাফের প্রতি সকৌতুক সখ্য, লিয়ারের প্রতি সসম্ভ্রম করুণা, কর্ডেলিয়ার প্রতি সুগভীর স্নেহ শেক্‌সপীয়রের মানবহৃদয়কে চিরদিনের জন্য ব্যক্ত ও বিকীর্ণ করেছে।

 

সাহিত্যের সত্য কাকে বলা যেতে পারে এইবার সেটা বলবার অবসর হয়েছে।

 

লেখাপড়া দেখাশোনা কথাবার্তা ভাবাচিন্তা সবসুদ্ধ জড়িয়ে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সমগ্র জীবন দিয়ে নিজের সম্বন্ধে, পরের সম্বন্ধে, জগতের সম্বন্ধে একটা মোট সত্য পাই। সেইটেই আমাদের জীবনের মূল সুর। সমস্ত জগতের বিচিত্র সুরকে আমরা সেই সুরের সঙ্গে মিলিয়ে নিই, এবং আমাদের সমস্ত জীবনসংগীতকে সেই সুরের সঙ্গে বাঁধি। সেই মূলতত্ত্ব অনুসারে আমরা সংসারে বিরক্ত অথবা অনুরক্ত, স্বদেশবদ্ধ অথবা সার্বভৌমিক, পার্থিব অথবা আধ্যাত্মিক, কর্মপ্রিয় অথবা চিন্তাপ্রিয়। আমার জীবনের সেই মূলতত্ত্বটি, জগতের সমস্ত সত্য আমার জীবনের মধ্যে সেই-যে একটি জীবন্ত ব্যক্তিগত পরিণতি লাভ করেছে, সেইটি আমার রচনার মধ্যে প্রকাশ্যে অথবা অলক্ষিতভাবে আত্ম-স্বরূপে বিরাজ করবেই। আমি গীতিকাব্যই লিখি আর যাই লিখি কেবল তাতে যে আমার ক্ষণিক মনোভাবের প্রকাশ হয় তা নয়, আমার মর্মসত্যটিও তার মধ্যে আপনার ছাপ দেয়। মানুষের জীবনকেন্দ্রগত এই মূলসত্য সাহিত্যের মধ্যে আপনাকে নানা আকারে প্রতিষ্ঠিত করে; এইজন্য একেই সাহিত্যের সত্য বলা যেতে পারে, জ্যামিতির সত্য কখনো সাহিত্যের সত্য হতে পারে না। এই সত্যটি বৃহৎ হলে পাঠকের স্থায়ী এবং গভীর তৃপ্তি হয়, এই সত্যটি সংকীর্ণ হলে পাঠকের বিরক্তি জন্মে।

 

দৃষ্টান্তস্বরূপে বলতে পারি, ফরাসি কবি গোতিয়ে রচিত "মাদ্‌মোয়াজেল দ্য মোপ্যাঁ' প'ড়ে (বলা উচিত আমি ইংরাজি অনুবাদ পড়েছিলুম) আমার মনে হয়েছিল, গ্রন্থটির রচনা যেমনই হোক তার মূলতত্ত্বটি জগতের যে অংশকে সীমাবদ্ধ করেছে সেইটুকুর মধ্যে আমরা বাঁচতে পারি নে। গ্রন্থের মূল-ভাবটা হচ্ছে, একজন যুবক হৃদয়কে দূরে রেখে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দেশদেশান্তরে সৌন্দর্যের সন্ধান করে ফিরছে। সৌন্দর্য যেন প্রস্ফুটিত জগৎ-শতদলের উপর লক্ষ্মীর মতো বিরাজ করছে না, সৌন্দর্য যেন মণিমুক্তার মতো কেবল অন্ধকার খনিগহ্বরে ও অগাধ সমুদ্র-তলে প্রচ্ছন্ন; যেন তা গোপনে আহরণ করে আপনার ক্ষুদ্র সম্পত্তির মতো কৃপণের সংকীর্ণ সিন্ধুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখবার জিনিস। এইজন্য এই গ্রন্থের মধ্যে হৃদয় অধিক ক্ষণ বাস করতে পারে না-- রুদ্ধশাস হয়ে তাড়াতাড়ি উপরে বেরিয়ে এসে যখন আমাদের প্রতিদিনের শ্যামল তৃণক্ষেত্র, প্রতিদিনের সূর্যালোক, প্রতিদিনের হাসিমুখগুলি দেখতে পাই তখনই বুঝতে পারি সৌন্দর্য এই তো আমাদের চারি দিকে, সৌন্দর্য এই তো আমাদের প্রতিদিনের ভালোবাসার মধ্যে। এই বিশ্বব্যাপী সত্যকে সংকীর্ণ করে আনাতে পূর্বোক্ত ফরাসী গ্রন্থে সাহিত্যশিল্পের প্রাচুর্য-সত্ত্বেও সাহিত্যসত্যের স্বল্পতা হয়েছে বলা যেতে পারে। মাদ্‌মোয়াজেল দ্য মোপ্যাঁ এবং গোতিয়ে সম্বন্ধে আমার সমালোচনা ভ্রমাত্মক হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে, কিন্তু এই দৃষ্টান্তদ্বারা আমার কথাটা কতকটা পরিষ্কার করা গেল। শেলি বলো, কীট্‌স্‌ বলো, টেনিসন বলো, সকলের লেখাতেই রচনার ভালো-মন্দর মধ্যেও একটা মর্মগত মূল-জিনিস আছে-- তারই উপর ঐ-সকল কবিতার ধ্রুবত্ব ও মহত্ত্ব নির্ভর করে। সেই জিনিসটাই ঐ-সকল কবিতার সত্য। সেটাকে যে আমরা সকল সময়ে কবিতা বিশ্লেষণ করে সমগ্র বের করতে পারি তা নয়, কিন্তু তার শাসন আমরা বেশ অনুভব করতে পারি।

 

গোতিয়ের সহিত ওআর্ডস্‌ওআর্থের তুলনা করা যেতে পারে। ওআর্ডস্‌ওআর্থের কবিতার মধ্যে যে সৌন্দর্যসত্য প্রকাশিত হয়েছে তা পূর্বোক্ত ফরাসিস সৌন্দর্যসত্য অপেক্ষা বিস্তৃত। তাঁর কাছে পুষ্পপল্লব নদীনির্ঝর পর্বতপ্রান্তর সর্বত্রই নব নব সৌন্দর্য উদ্‌ভাসিত হয়ে উঠছে। কেবল তাই নয়-- তার মধ্যে তিনি একটা আধ্যাত্মিক বিকাশ দেখতে পাচ্ছেন, তাতে করে সৌন্দর্য অনন্ত বিস্তার এবং অনন্ত গভীরতা লাভ করেছে। তার ফল এই যে, এরকম কবিতায় পাঠকের শ্রান্তি তৃপ্তি বিরক্তি নেই; ওআর্ডস্‌ওআর্থের কবিতার মধ্যে সৌন্দর্যের এই বৃহৎ সত্যটুকু থাকাতেই তার এত গৌরব এবং স্থায়িত্ব।

 

বৃহৎ সত্য কেন বলছি, অর্থাৎ বৃহৎই বা কেন বলি, সত্যই বা কেন বলি, তা আর-একটু পরিষ্কার করে বলবার চেষ্টা করি। পরিষ্কার হবে কি না বলতে পারি না, কিন্তু যতটা বক্তব্য আছে এই সুযোগে সমস্তটা বলে রাখা ভালো।

 

একটি পুষ্পের মধ্যে আমাদের হৃদয়ের প্রবেশ করবার একটিমাত্র পথ আছে, তার বাহ্য সৌন্দর্য। ফুল চিন্তা করে না, ভালোবাসে না, ফুলের সুখদুঃখ নেই, সে কেবল সুন্দর আকৃতি নিয়ে ফোটে। এইজন্য সাধারণত ফুলের সঙ্গে মানুষের আর-কোনো সম্পর্ক নেই, কেবল আমরা ইন্দ্রিয়যোগে তার সৌন্দর্যটুকু উপলব্ধি করতে পারি মাত্র। এইজন্য সচরাচর ফুলের মধ্যে আমাদের সমগ্র মনুষ্যত্বের পরিতৃপ্তি নেই, তাতে কেবল আমাদের আংশিক আনন্দ; কিন্তু কবি যখন এই ফুলকে কেবলমাত্র জড় সৌন্দর্যভাবে না দেখে এর মধ্যে মানুষের মনোভাব আরোপ করে দেখিয়েছেন তখন তিনি আমাদের আনন্দকে আরো বৃহত্তর গাঢ়তর করে দিয়েছেন।

 

এ কথা একটা চিরসত্য যে, যাদের কল্পনাশক্তি আছে তারা সৌন্দর্যকে নির্জীব ভাবে দেখতে পারে না। তারা অনুভব করে যে, সৌন্দর্য যদিও বস্তুকে অবলম্বন করে প্রকাশ পায়, কিন্তু তা যেন বস্তুর অতীত, তার মধ্যে যেন একটা মনের ধর্ম আছে। এইজন্য মনে হয় সৌন্দর্যে যেন একটা ইচ্ছাশক্তি, একটা আনন্দ, একটা আত্মা আছে। ফুলের আত্মা যেন সৌন্দর্যে বিকশিত প্রফুল্ল হয়ে ওঠে, জগতের আত্মা যেন অপার বহিঃসৌন্দর্যে আপনাকে প্রকাশ করে। অন্তরের অসীমতা যেখানে বাহিরে আপনাকে প্রকাশ করতে পেরেছে সেইখানেই যেন সৌন্দর্য; সেই প্রকাশ যেখানে যত অসম্পূর্ণ সেইখানে তত সৌন্দর্যের অভাব, রূঢ়তা, জড়তা, চেষ্টা, দ্বিধা ও সর্বাঙ্গীণ অসামঞ্জস্য। সে যাই হোক, সামান্যত ফুলের মধ্যে আমাদের সম্পূর্ণ আত্মপরিতৃপ্তি জন্মে না। এইজন্য কেবল ফুলের বর্ণনামাত্র সাহিত্যে সর্বোচ্চ সমাদর পেতে পারে না। আমরা যে কবিতায় একত্রে যত অধিক চিত্তবৃত্তির চরিতার্থতা লাভ করি তাকে ততই উচ্চ শ্রেণীর কবিতা বলে সম্মান করি। সাধারণত যে জিনিসে আমাদের একটিমাত্র বা অল্পসংখ্যক চিত্তবৃত্তির তৃপ্তি হয় কবি যদি তাকে এমনভাবে দাঁড় করাতে পারেন যাতে তার দ্বারা আমাদের অধিকসংখ্যক চিত্তবৃত্তির চরিতার্থতা লাভ হয় তবে কবি আমাদের আনন্দের একটি নূতন উপায় আবিষ্কার করে দিলেন ব'লে তাঁকে সাধুবাদ দিই। বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে আত্মার সৌন্দর্য সংযোগ করে দিয়ে কবি ওআর্ড্‌স্‌ওআর্থ্‌ এই কারণে আমাদের নিকট এত সম্মানাস্পদ হয়েছেন। ওআর্ড্‌স্‌ওআর্থ্‌ যদি সমস্ত জগৎকে অন্ধ যন্ত্রের ভাবে মনে করে কাব্য লিখতেন, তা হলে তিনি যেমনই ভালো ভাষায় লিখুন-না কেন, সাধারণ মানবহৃদয়কে বহুকালের জন্যে আকর্ষণ করে রেখে দিতে পারতেন না। জগৎ জড় যন্ত্র কিম্বা আধ্যাত্মিক বিকাশ এ দুটো মতের মধ্যে কোন্‌টা সত্য সাহিত্য তা নিয়ে তর্ক করে না; কিন্তু এই দুটো ভাবের মধ্যে কোন্‌ ভাবে মানুষের স্থায়ী এবং গভীর আনন্দ সেই সত্যটুকুই কবির সত্য, কাব্যের সত্য।

 

কিন্তু, যতদূর মনে পড়ে, আমার প্রথম পত্রে এ সত্য সম্বন্ধে আমি কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করি নি। কী বলেছি মনে নেই, কিন্তু যা বলতে চেয়েছিলুম তা হচ্ছে এই যে, যদি কোনো দার্শনিক বৈজ্ঞানিক সত্যকে সাহিত্যের অন্তর্গত করতে চাই তবে তাকে আমাদের ভালো-লাগা মন্দ-লাগা আমাদের সন্দেহ-বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত করে আমাদের মানসিক প্রাণপদার্থের মধ্যে নিহিত করে দিতে হবে; নইলে যতক্ষণ তাকে স্বপ্রকাশ সত্যের আকারে দেখাই ততক্ষণ তার অন্য নাম। যেমন নাইট্রোজেন তার আদিম আকারে বাষ্প, উদ্ভিদ অথবা জন্তুশরীরে রূপান্তরিত হলে তবেই সে আমাদের খাদ্য; তেমনি সত্য যখন মানবজীবনের সঙ্গে মিশে যায় তখনই সাহিত্যে ব্যক্ত হতে পারে।

 

কিন্তু আমি যদি বলে থাকি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যের উপযোগিতা নেই তবে সেটা অত্যুক্তি। আমার বলবার অভিপ্রায় এই যে, সাহিত্যের উপযোগিতা সব চেয়ে বেশি। বসন না হলেও চলে (অবশ্য লোকে অসভ্য বলবে,) কিন্তু অশন না হলে চলে না। হার্বার্ট্‌ স্পেন্‌সর উল্টো বলেন। তিনি বলেন সাহিত্য বসন এবং বিজ্ঞান অশন।

 

বিজ্ঞানশিক্ষা আমাদের প্রাণরক্ষা এবং জীবনযাত্রার অনেক সাহায্য করে স্বীকার করি, কিন্তু সে সাহায্য আমরা পরের কাছ থেকে নিতে পারি। ডাক্তারের কাছ থেকে স্বাস্থ্যরক্ষার উপদেশ, কেমিস্টের কাছ থেকে ওষুধপত্র, যান্ত্রিকের কাছ থেকে যন্ত্র আমরা মূল্য দিয়ে নিতে পারি। কিন্তু সাহিত্য থেকে যা পাওয়া যায় তা আর-কারো কাছ থেকে ধার করে কিম্বা কিনে নিতে পারি নে। সেটা আমাদের সমস্ত প্রকৃতি দিয়ে আকর্ষণ করে নিতে হয়, সেটা আমাদের সমস্ত মনুষ্যত্বের পুষ্টিসাধন করে। আমাদের চতুর্দিগ্‌বর্তী মনুষ্যসমাজ তার সমগ্র উত্তাপ প্রয়োগ করে আমাদের প্রত্যেককে প্রতিক্ষণে ফুটিয়ে তুলছে, কিন্তু এই মানবসমাজের বিচিত্র জটিল ক্রিয়া আমরা হিসাব করে পরিষ্কার জমাখরচের মধ্যে ধরে নিতে পারি নে; অথচ একজন ডাক্তার আমার যে উপকারটা করে তা খুব স্পষ্ট ধারণাগম্য। এইজন্যে হঠাৎ মনে হতে পারে, মনুষ্যসমাজ আমাদের বিশেষ কিছু করে না, ডাক্তার তার চেয়ে ঢের বেশি কাজ করে। কিন্তু সমাজের অন্যান্য সহস্র উপকার ছেড়ে দিয়ে; কেবলমাত্র তার সান্নিধ্য, মনুষ্যসাধারণের একটা আকর্ষণ, চারি দিকের হাসিকান্না ভালোবাসা বাক্যালাপ না পেলে আমরা যে মানুষ হতে পারতুম না সেটা আমরা ভুলে যাই। আমরা ভুলে যাই সমাজ নানারকম দুষ্পাচ্য কঠিন আহারকে পরিপাক করে সেটাকে জীবনরসে পরিণত করে আমাদের প্রতিনিয়ত পান করাচ্ছে। সাহিত্য সেইরকম মানসিক সমাজ। সাহিত্যের মধ্যে মানুষের হাসিকান্না, ভালোবাসা, বৃহৎ মনুষ্যের সংসর্গ এবং উত্তাপ, বহুজীবনের অভিজ্ঞতা, বহুবর্ষের স্মৃতি, সবসুদ্ধ মানুষের একটা ঘনিষ্ঠতা, পাওয়া যায়। সেইটেতে বিশেষ কী উপকার করে পরিষ্কার করে বলা শক্ত; এই পর্যন্ত বলা যায়, আমাদের সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বকে পরিস্ফুট করে তোলে।

 

প্রত্যেক মানুষের পক্ষে মানুষ হওয়া প্রথম দরকার। অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে মানুষের যে লক্ষ লক্ষ সম্পর্কসূত্র আছে, যার দ্বারা প্রতিনিয়ত আমরা শিকড়ের মতো বিচিত্র রসাকর্ষণ করছি, সেইগুলোর জীবনীশক্তি বাড়িয়ে তোলা, তার নূতন নূতন ক্ষমতা আবিষ্কার করা, চিরস্থায়ী মনুষ্যত্বের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগ-সাধন করে ক্ষুদ্র মানুষকে বৃহৎ করে তোলা-- সাহিত্য এমনি করে আমাদের মানুষ করছে। সাহিত্যের শিক্ষাতেই আমরা আপনাকে মানুষের এবং মানুষকে আপনার বলে অনুভব করছি। তার পরে আমরা ডাক্তারি শিখে মানুষের চিকিৎসা করি, বিজ্ঞান শিখে মানুষের মধ্যে জ্ঞান প্রচার করতে প্রাণপণ করি। গোড়ায় যদি আমরা মানুষকে ভালোবাসতে না শিখতুম তা হলে সত্যকে তেমন ভালোবাসতে পারতুম কি না সন্দেহ। অতএব সাহিত্য যে সব-গোড়াকার শিক্ষা এবং সাহিত্য যে চিরকালের শিক্ষা আমার তাতে সন্দেহ মাত্র নেই।

 

এই তো গেল মোট কথাটা। ইংরিজি ম্যাগাজিন সম্বন্ধে তুমি যা বলেছ সে কথা ঠিক। তাদের নিতান্ত দরকারি কথা এত বেশি বেড়ে গেছে যে রসালাপের আর বড়ো সময় নেই। বিশেষত সাময়িক পত্রে সাময়িক জীবনের সমালোচনাই যুক্তিসংগত; চিরস্থায়ী সাহিত্যকে ওরকম একটা পত্রিকার প্রবাহের মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া ঠিক শোভা পায় কি না বলা শক্ত।

 

কিন্তু বড়ো লেখা যে বড়ো বেশি বাড়ছে সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নেই। আজকাল ইংরিজিতে বেশ একটু আঁটসাঁট ছিপ্‌ছিপে লেখা দেখলে আশ্চর্য বোধ হয়। ওরা বোধ হয় সময় পায় না। কাজের অতিরিক্ত প্রাচুর্যে ওদের সাহিত্য যেন অপরিচ্ছন্ন মোটাসোটা ঢিলেঢালা প্রৌঢ়া গিন্নির মতো আকার ধারণ করেছে। হৃদয়ের গাঢ়তা আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে সৌন্দর্যের হ্রাস এবং বলের শৈথিল্য প্রকাশ পায়। যত বয়স বাড়ছে ওরা ততই যেন ওদের আদিম জর্মানিক প্রকৃতির দিকে ঝুঁকছে। আমার একটা অন্ধ সংস্কার আছে যে, সত্যকে যে অবস্থায় যতদূর পাওয়া সম্ভব তাকে তার চেয়ে ঢের বেশি পাবার চেষ্টা করে জর্মানেরা তার চার দিকে বিস্তর মিথ্যা স্তূপাকার করে তোলে। ইংরাজেরও হয়তো সে রোগের কিঞ্চিৎ অংশ আছে। বলা বাহুল্য, এটা আমার একটা প্রাইভেট প্রগল্‌ভতা মাত্র, গম্ভীরভাবে প্রতিবাদযোগ্য নয়।

 

 

একটিমাত্র গাছকে প্রকৃতি বলা যায় না। তেমনি কোনো একটিমাত্র বর্ণনাকে যদি সাহিত্য বলে ধর তা হলে আমার কথাটা বোঝানো শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। বর্ণনা সাহিত্যের অন্তর্গত সন্দেহ নেই, কিন্তু তার দ্বারা সাহিত্যকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। একটিমাত্র সূর্যাস্তবর্ণনার মধ্যে লেখকের জীবনাংশ এত অল্প থাকতে পারে যে, হয়তো সেটুকু বোধগম্য হওয়া দুরূহ। কিন্তু উপরি-উপরি অনেকগুলি বর্ণনা দেখলে লেখকের মর্মগত ভাবটুকু আমরা ধরতে পারতুম। আমরা বুঝতে পারতুম লেখক বাহ্যপ্রকৃতির মধ্যে একটা আত্মার সংস্রব দেখেন কি না; প্রকৃতিতে তিনি মানবসংসারের চারিপার্শ্ববর্তী দেয়ালের ছবির মতো দেখেন না মানবসংসারকে এই প্রকাণ্ড রহস্যময়ী প্রকৃতির একান্তবর্তীস্বরূপ দেখেন-- কিম্বা মানবের সহিত প্রকৃতি মিলিত হয়ে, প্রাত্যহিক সহস্র নিকটসম্পর্কে বদ্ধ হয়ে, তাঁর সম্মুখে একটি বিশ্বব্যাপী গার্হস্থ্য দৃশ্য উপস্থিত করে।

 

সেই তত্ত্বটুকুকে জানানোই যে সাহিত্যের উদ্দেশ্য তা নয়, কিন্তু সে অলক্ষিত ভাবে আমাদের মনের উপর কার্য করে-- কখনো বেশি সুখ দেয়, কখনো অল্প সুখ দেয়; কখনো মনের মধ্যে একটা বৃহৎ বৈরাগ্যের আভাস আনে, কখনো-বা অনুরাগের প্রগাঢ় আনন্দ উদ্রেক করে। সন্ধ্যার বর্ণনায় কেবল যে সূর্যাস্তের আভা পড়ে তা নয়, তার সঙ্গে লেখকের মানবহৃদয়ের আভা কখনো ম্লান শ্রান্তির ভাবে কখনো গভীর শান্তির ভাবে স্পষ্টত অথবা অস্পষ্টত মিশ্রিত থাকে এবং সেই আমাদের হৃদয়কে অনুরূপ ভাবে রঞ্জিত করে তোলে। নতুবা, তুমি যেরকম বর্ণনার কথা বলেছ সেরকম বর্ণনা ভাষায় অসম্ভব। ভাষা কখনোই রেখাবর্ণময় চিত্রের মতো অমিশ্র অবিকল প্রতিরূপ আমাদের সম্মুখে আনয়ন করতে পারে না।

 

বলা বাহুল্য, যেমন-তেমন লেখকের যেমন-তেমন বিশেষত্বই যে আমরা প্রার্থনীয় জ্ঞান করি তা নয়। মনে করো, পথ দিয়ে মস্ত একটা উৎসবের যাত্রা চলেছে। আমার এক বন্ধুর বারান্দা থেকে তার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ দেখতে পাই, আর-এক বন্ধুর বারান্দা থেকে বৃহৎ অংশ এবং প্রধান অংশ দেখতে পাই-- আর-এক বন্ধু আছেন তাঁর দোতলায় উঠে যেদিক থেকেই দেখতে চেষ্টা করি কেবল তাঁর নিজের বারান্দাটুকুই দেখি। প্রত্যেক লোক আপন আপন বিশেষত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে জগতের এক-একটা দৃশ্য দেখছে-- কেউ-বা বৃহৎ ভাবে দেখছে, কেউ বা কেবল আপনাকেই দেখছে। যে আপনাকে ছাড়া আর-কিছুই দেখাতে পারে না সাহিত্যের পক্ষে সে বাতায়নহীন অন্ধকার কারাগার মাত্র।

 

কিন্তু এ উপমায় আমার কথাটা পুরো বলা হল না এবং ঠিকটি বলা হল না। আমার প্রধান কথাটা এই-- সাহিত্যের জগৎ মানেই হচ্ছে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশ্রিত জগৎ। সূর্যাস্তকে তিনরকম ভাবে দেখা যাক। বিজ্ঞানের সূর্যাস্ত, চিত্রের সূর্যাস্ত এবং সাহিত্যের সূর্যাস্ত। বিজ্ঞানের সূর্যাস্ত হচ্ছে নিছক সূর্যাস্ত ঘটনাটি; চিত্রের সূর্যাস্ত হচ্ছে কেবল সূর্যের অন্তর্ধানমাত্র নয়, জল স্থল আকাশ মেঘের সঙ্গে মিশ্রিত করে সূর্যাস্ত দেখা; সাহিত্যের সূর্যাস্ত হচ্ছে সেই জল স্থল আকাশ মেঘের মধ্যবর্তী সূর্যাস্তকে মানুষের জীবনের উপর প্রতিফলিত করে দেখা-- কেবলমাত্র সূর্যাস্তের ফোটোগ্রাফ তোলা নয়, আমাদের মর্মের সঙ্গে তাকে মিশ্রিত করে প্রকাশ। যেমন, সমুদ্রের জলের উপর সন্ধ্যাকাশের প্রতিবিম্ব পড়ে একটা অপরূপ সৌন্দর্যের উদ্‌ভব হয়, আকাশের উজ্জ্বল ছায়া জলের স্বচ্ছ তরলতার যোগে একটা নূতন ধর্ম প্রাপ্ত হয়, তেমনি জগতের প্রতিবিম্ব মানবের জীবনের মধ্যে পতিত হয়ে সেখান থেকে প্রাণ ও হৃদয়বৃত্তি লাভ করে। আমরা প্রকৃতিকে আমাদের নিজের সুখদুঃখ আশা-আকাঙক্ষা দান করে একটা নূতন কাণ্ড করে তুলি; অভ্রভেদী জগৎসৌন্দর্যের মধ্যে একটা অমর প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করি-- এবং তখনই সে সাহিত্যের উপযোগিতা প্রাপ্ত হয়।

 

প্রাকৃতিক দৃশ্যে দেখা যায়, সূর্যোদয় সূর্যাস্ত সর্বত্র সমান বৈচিত্র্য ও বিকাশ লাভ করে না। বাঁশতলার পানাপুকুর সকলপ্রকার আলোকে কেবল নিজেকেই প্রকাশ করে, তাও পরিষ্কাররূপে নয়, নিতান্ত জটিল আবিল অপরিচ্ছন্নভাবে; তার এমন স্বচ্ছতা এমন উদারতা নেই যে, সমস্ত প্রভাতের আকাশকে সে আপনার মধ্যে নূতন ও নির্মল করে দেখাতে পারে। সুইজর্‌ল্যাণ্ডের শৈলসরোবর সম্বন্ধে আমার চেয়ে তোমার অভিজ্ঞতা বেশি আছে, অতএব তুমিই বলতে পার সেখানকার উদয়াস্ত কিরকম অনির্বচনীয়শোভাময়। মানুষের মধ্যেও সেইরকম আছে। বড়ো বড়ো লেখকেরা নিজের উদারতা -অনুসারে সকল জিনিসকে এমন করে প্রতিবিম্বিত করতে পারে যে, তার কতখানি নিজের কতখানি বাহিরের, কতখানি বিম্বের কতখানি প্রতিবিম্বের, নির্দিষ্টরূপে প্রভেদ করে দেখানো কঠিন হয়। কিন্তু সংকীর্ণ কুনো কল্পনা যাকেই প্রকাশ করতে চেষ্টা করুন না কেন, নিজের বিশেষ আকৃতিটাকেই সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

 

অতএব লেখকের জীবনের মূলতত্ত্বটি যতই ব্যাপক হবে, মানবসমাজ এবং প্রকৃতির প্রকাণ্ড রহস্যকে যতই সে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ সিদ্ধান্তে টুকরো টুকরো করে না ভেঙে ফেলবে, আপনার জীবনের দশ দিক উন্মুক্ত করে নিখিলের সমগ্রতাকে আপনার অন্তরের মধ্যে আকর্ষণ করে নিয়ে একটি বৃহৎ চেতনার সৃষ্টি করবে, ততই তার সাহিত্যের প্রকাণ্ড পরিধির মধ্যে তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দুটি অদৃশ্য হয়ে যাবে। সেইজন্যে মহৎ রচনার মধ্যে একটি বিশেষ মত একটি ক্ষুদ্র ঐক্য খুঁজে বার করা দায়; আমরা ক্ষুদ্র সমালোচকেরা নিজের ঘর-গড়া মত দিয়ে যদি তাকে ঘিরতে চেষ্টা করি তা হলে পদে পদে তার মধ্যে স্বতোবিরোধ বেধে যায়। কিন্তু একটা অত্যন্ত দুর্গম কেন্দ্রস্থানে তার একটা বৃহৎ মীমাংসা বিরাজ করছে, সেটি হচ্ছে লেখকের মর্মস্থান-- অধিকাংশ স্থলেই লেখকের নিজের পক্ষেও সেটি অনাবিষ্কৃত রাজ্য। শেক্‌স্‌পীয়রের লেখার ভিতর থেকে তাঁর একটা বিশেষত্ব খুঁজে বার করা কঠিন এইজন্যে যে, তাঁর সেটা অত্যন্ত বৃহৎ বিশেষত্ব। তিনি জীবনের যে মূলতত্ত্বটি আপনার অন্তরের মধ্যে সৃজন করে তুলেছেন তাকে দুটি-চারটি সুসংলগ্ন মতপাশ দিয়ে বদ্ধ করা যায় না। এইজন্যে ভ্রম হয় তাঁর রচনার মধ্যে যেন একটি রচয়িতৃ-ঐক্য নেই।

 

কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেইটে যে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা চাই আমি তা বলি নে; কিন্তু সে যে অন্তঃপুরলক্ষ্মীর মতো অন্তরালে থেকে আমাদের হৃদয়ে হৃদয়ে সাহিত্যরস বিতরণ করবে তার আর সন্দেহ নেই।

 

যেমন করেই দেখি, আমরা মানুষকেই চাই, সাক্ষাৎভাবে বা পরোক্ষভাবে। মানুষের সম্বন্ধে কাটাছেঁড়া তত্ত্ব চাই নে, মূল মানুষটিকেই চাই। তার হাসি চাই, তার কান্না চাই; তার অনুরাগ বিরাগ আমাদের হৃদয়ের পক্ষে রৌদ্রবৃষ্টির মতো।

 

কিন্তু, এই হাসিকান্না অনুরাগ-বিরাগ কোথা থেকে উঠছে? ফল্‌স্টাফ ও ডগ্‌বেরি থেকে আরম্ভ করে লিয়র ও হ্যাম্‌লেট পর্যন্ত শেক্‌স্‌পীয়র যে মানবলোক সৃষ্টি করেছেন সেখানে মনুষ্যত্বে চিরস্থায়ী হাসি-অশ্রুর গভীর উৎসগুলি কারো অগোচর নেই। একটা সোসাইটি নভেলের প্রাত্যহিক কথাবার্তা এবং খুচরো হাসিকান্নার চেয়ে আমরা শেক্‌স্‌পীয়রের মধ্যে বেশি সত্য অনুভব করি। যদিচ সোসাইটি নভেলে যা বর্ণিত হয়েছে তা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অবিকল অনুরূপ চিত্র। কিন্তু আমরা জানি আজকের সোসাইটি নভেল কাল মিথ্যা হয়ে যাবে; শেক্‌স্‌পীয়র কখনো মিথ্যা হবে না। অতএব একটা সোসাইটি নভেল যতই চিত্রবিচিত্র করে রচিত হোক, তার ভাষা এবং রচনাকৌশল যতই সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হোক, শেক্‌স্‌পীয়রের একটা নিকৃষ্ট নাটকের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। সোসাইটি নভেলে বর্ণিত প্রাত্যহিক সংসারের যথাযথ বর্ণনার অপেক্ষা শেক্‌স্‌পীয়রে বর্ণিত প্রতিদিনদুর্লভ প্রবল হৃদয়াবেগের বর্ণনাকে আমরা কেন বেশি সত্য মনে করি সেইটে স্থির হলে সাহিত্যের সত্য কাকে বলা যায় পরিষ্কার বোঝা যাবে।

 

শেক্‌স্‌পীয়রে আমরা চিরকালের মানুষ এবং আসল মানুষটিকে পাই, কেবল মুখের মানুষটি নয়। মানুষকে একেবারে তার শেষ পর্যন্ত আলোড়িত করে শেক্‌স্‌পীয়র তার সমস্ত মনুষ্যত্বকে অবারিত করে দিয়েছেন। তার অশ্রুজল চোখের প্রান্তে ঈষৎ বিগলিত হয়ে রুমালের প্রান্তে শুষ্ক হচ্ছে না, তার হাসি ওষ্ঠাধরকে ঈষৎ উদ্ভিন্ন করে কেবল মুক্তাদন্তগুলিকে মাত্র বিকাশ করছে না-- কিন্তু বিদীর্ণ প্রকৃতির নির্ঝরের মতো অবাধে ঝরে আসছে, উচ্ছ্বসিত প্রকৃতির ক্রীড়াশীল উৎসের মতো প্রমোদে ফেটে পড়ছে। তার মধ্যে একটা উচ্চ দর্শনশিখর আছে যেখান থেকে মানবপ্রকৃতির সর্বাপেক্ষা ব্যাপক দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়।

 

গোতিয়ের গ্রন্থ সম্বন্ধে আমি যা বলেছিলুম সে হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত। গোতিয়ে যেখানে তাঁর রচনার মূল পত্তন করেছেন সেখান থেকে আমরা জগতের চিরস্থায়ী সত্য দেখতে পাই নে। যে সৌন্দর্য মানুষের ভালোবাসার মধ্যে চিরকাল বদ্ধমূল, যার শ্রান্তি নেই, তৃপ্তি নেই, যে সৌন্দর্য ভালোবাসার লোকের মুখ থেকে প্রতিফলিত হয়ে জগতের অনন্ত গোপন সৌন্দর্যকে অবারিত করে দেয়, মানুষ চিরকাল যে সৌন্দর্যের কোলে মানুষ হয়ে উঠছে, তার মধ্যে আমাদের স্থাপন না করে তিনি আমাদের একটা ক্ষণিক মায়ামরীচিকার মধ্যে নিয়ে গেছেন; সে মরীচিকা যতই সম্পূর্ণ ও সুনিপুণ হোক, ব্যাপক নয়, স্থায়ী নয়, এইজন্যই সত্য নয়। সত্য নয় ঠিক নয়, অল্প সত্য। অর্থাৎ সেটা একরকম বিশেষ প্রকৃতির বিশেষ লোকের বিশেষ অবস্থার পক্ষে সত্য, তার বাইরে তার আমল নেই। অতএব মনুষ্যত্বের যতটা বেশি অংশ অধিকার করতে পারবে সাহিত্যের সত্য ততটা বেশি বেড়ে যাবে।

 

কিন্তু অনেকে বলেন, সাহিত্যে কেবল একমাত্র সত্য আছে, সেটা হচ্ছে প্রকাশের সত্য। অর্থাৎ যেটি ব্যক্ত করতে চাই সেটি প্রকাশ করবার উপায়গুলি অযথা হলেই সেটা মিথ্যা হল এবং যথাযথ হলেই সত্য হল।

 

এক হিসাবে কথাটা ঠিক। প্রকাশটাই হচ্ছে সাহিত্যের প্রথম সত্য। কিন্তু ঐটেই কি শেষ সত্য?

 

জীবরাজ্যের প্রথম সত্য হচ্ছে প্রটোপ্ল্যাজ্‌ম্‌, কিন্তু শেষ সত্য মানুষ। প্রটোপ্ল্যাজ্‌ম্‌ মানুষের মধ্যে আছে কিন্তু মানুষ প্রটোপ্ল্যাজ্‌ম্‌'এর মধ্যে নেই। এখন, এক হিসাবে প্রটোপ্ল্যাজ্‌ম্‌কে জীবের আদর্শ বলা যেতে পারে, এক হিসাবে মানুষকে জীবের আদর্শ বলা যায়।

 

সাহিত্যের আদিম সত্য হচ্ছে প্রকাশমাত্র, কিন্তু তার পরিণাম-সত্য হচ্ছে ইন্দ্রিয় মন এবং আত্মার সমষ্টিগত মানুষকে প্রকাশ। ছেলেভুলানো ছড়া থেকে শেক্‌স্‌পীয়রের কাব্যের উৎপত্তি। এখন আমরা আদিম আদর্শকে দিয়ে সাহিত্যের বিচার করি নে, পরিণাম-আদর্শ দিয়েই তার বিচার করি। এখন আমরা কেবল দেখি নে প্রকাশ পেলে কি না, দেখি কতখানি প্রকাশ পেলে। দেখি, যেটুকু প্রকাশ পেয়েছে তাতে কেবল আমাদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি হয়, না ইন্দ্রিয় এবং বুদ্ধির তৃপ্তি হয়, না ইন্দ্রিয় বুদ্ধি এবং হৃদয়ের তৃপ্তি হয়। সেই অনুসারে আমরা বলি--অমুক লেখায় বেশি অথবা অল্প সত্য আছে। কিন্তু এটা স্বীকার্য যে, প্রকাশ পাওয়াটা সাহিত্যমাত্রেরই প্রথম এবং প্রধান আবশ্যক। বরঞ্চ ভাবের গৌরব না থাকলেও সাহিত্য হয়, কিন্তু প্রকাশ না পেলে সাহিত্য হয় না। বরঞ্চ মুড়োগাছও গাছ, কিন্তু বীজ গাছ নয়।

 

আমার পূর্বপত্রে এ কথাটাকে বোধ হয় তেমন আমল দিই নি। তোমার প্রতিবাদেই আমার সমস্ত কথা ক্রমে একটা আকার ধারণ করে দেখা দিচ্ছে।

 

কিন্তু যতই আলোচনা করছি ততই অধিক অনুভব করছি যে, সমগ্র মানবকে প্রকাশের চেষ্টাই সাহিত্যের প্রাণ। তাই তুমি যদি একটা টুকরো সাহিত্য তুলে নিয়ে বলো "এর মধ্যে সমস্ত মানুষ কোথা', তবে আমি নিরুত্তর। কিন্তু সাহিত্যের অধিকার যতদূর আছে সবটা যদি আলোচনা করে দেখ তা হলে আমার সঙ্গে তোমার কোনো অনৈক্য হবে না। মানুষের প্রবাহ হূ হূ করে চলে যাচ্ছে; তার সমস্ত সুখদুঃখ আশা-আকাঙক্ষা, তার সমস্ত জীবনের সমষ্টি আর-কোথাও থাকছে না-- কেবল সাহিত্যে থাকছে। সংগীতে চিত্রে বিজ্ঞানে দর্শনে সমস্ত মানুষ নেই। এইজন্যই সাহিত্যের এত আদর। এইজন্যই সাহিত্য সর্বদেশের মনুষ্যত্বের অক্ষয় ভাণ্ডার। এইজন্যই প্রত্যেক জাতি আপন আপন সাহিত্যকে এত বেশি অনুরাগ ও গর্বের সহিত রক্ষা করে।

 

আমার এক-একবার আশঙ্কা হচ্ছে তুমি আমার উপর চটে উঠবে, বলবে-- লোকটাকে কিছুতেই তর্কের লক্ষ্যস্থলে আনা যায় না। আমি বাড়িয়ে-কমিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কেবল নিজের মতটাকে নানারকম করে বলবার চেষ্টা করছি, প্রত্যেক পুনরুক্তিতে পূর্বের কথা কতকটা সম্মার্জন পরিবর্তন করে চলা যাচ্ছে-- তাতে তর্কের লক্ষ্য স্থির রাখা তোমার পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু তুমি পূর্ব হতেই জান, খণ্ড খণ্ড ভাবে তর্ক করা আমার কাজ নয়। সমস্ত মোট কথাটা গুছিয়ে না উঠতে পারলে আমি জোর পাই নে। মাঝে মাঝে সুতীক্ষ্ণ সমালোচনায় তুমি যেখানটা ছিন্ন করছ সেখানকার জীর্ণতা সেরে নিয়ে দ্বিতীয়বার আগাগোড়া ফেঁদে দাঁড়াতে হচ্ছে।-- তার উপরে আবার উপমার জ্বালায় তুমি বোধ হয় অস্থির হয়ে উঠেছ। কিন্তু আমার এ প্রাচীন রোগটিও তোমার জানা আছে। মনের কোনো একটা ভাব ব্যক্ত করবার ব্যাকুলতা জন্মালে আমার মন সেগুলোকে উপমার প্রতিমাকারে সাজিয়ে পাঠায়, অনেকটা বকাবকি বাঁচিয়ে দেয়। অক্ষরের পরিবর্তে হাইরোগ্লিফিক্‌স ব্যবহারের মতো। কিন্তু এরকম রচনাপ্রণালী অত্যন্ত বহুকেলে; মনের কথাকে সাক্ষাৎভাবে ব্যক্ত না করে প্রতিনিধিদ্বারা ব্যক্ত করা। এরকম করলে যুক্তিসংসারের আদানপ্রদান পরিষ্কাররূপে চালানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। যা হোক, আগে থাকতে দোষ স্বীকার করছি, তাতে যদি তোমার মনস্তুষ্টি হয়।

 

তুমি লিখেছ, আমার সঙ্গে এ তর্ক তুমি মোকাবিলায় চোকাতে চাও। তা হলে আমার পক্ষে ভারি মুশকিল। তা হলে কেবল টুকরো নিয়েই তর্ক হয়, মোট কথাটা আজ থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তোমাকে বোঝাতে পারি নে। নিজের অধিকাংশ মতের সঙ্গে নিজের প্রত্যক্ষ পরিচয় থাকে না। তারা যদিচ আমার আচারে ব্যবহারে লেখায় নিজের কাজ নিজে করে যায়, কিন্তু আমি কি সকল সময়ে তাদের খোঁজ রাখি? এইজন্যে তর্ক উপস্থিত হলে বিনা নুটিসে অকস্মাৎ কাউকে ডাক দিয়ে সামনে তলব করতে পারি নে-- নামও জানি নে, চেহারাও চিনি নে। লেখবার একটা সুবিধে এই যে, আপনার মতের সঙ্গে পরিচিত হবার একটা অবসর পাওয়া যায়; লেখার সঙ্গে সঙ্গে অমনি নিজের মতটাকে যেন স্পর্শদ্বারা অনুভব করে যাওয়া যায়-- নিজের সঙ্গে নিজের নূতন পরিচয়ে প্রতি পদে একটা নূতন আনন্দ পাওয়া যায়, এবং সেই উৎসাহে লেখা এগোতে থাকে। সেই নূতন আনন্দের আবেগে লেখা অনেক সময় জীবন্ত ও সরস হয়। কিন্তু তার একটা অসুবিধাও আছে। কাঁচা পরিচয়ে পাকা কথা বলা যায় না। তেমন চেপে ধরলে ক্রমে কথার একটু-আধটু পরিবর্তন করতে হয়। চিঠিতে আস্তে আস্তে সেই পরিবর্তন করবার সুবিধা আছে। প্রতিবাদীর মুখের সামনে মতিস্থির থাকে না এবং অত্যন্ত জিদ বেড়ে যায়। অতএব মুখোমুখি না করে কলমে কলমেই ভালো।

 

 

তুমি লিখেছ যে, প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে তত্ত্বের প্রাদুর্ভাব ছিল না। তখন সাহিত্য অখণ্ডভাবে দেখা দিত, তাকে দ্বিধাবিভক্ত করে তার মধ্যে থেকে তত্ত্ব প্রকাশ হয়ে পড়ত না। সেই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে তুমি বলতে চাও যে, সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের মূলতত্ত্বের কোনো অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ নেই, ওটা কেবল আকস্মিক সম্বন্ধ।

 

এর থেকে বেশ দেখা যাচ্ছে, তোমাতে আমাতে কেবল ভাষা নিয়ে তর্ক চলছে। আমি যাকে মূলতত্ত্ব বলছি তুমি সেটা গ্রহণ কর নি-- এবং অবশেষে সেজন্য আমাকেই হয়তো ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। যদিও মূলতত্ত্ব শব্দটাকে বারম্বার ব্যাখ্যা করতে আমি ত্রুটি করি নি। এবারকার চিঠিতে ঐ কথাটা পরিষ্কার করা যাক।

 

প্রাচীন কালের লোকেরা প্রকৃতিকে এবং সংসারকে যেরকম ভাবে দেখত আমরা ঠিক সে ভাবে দেখি নে। বিজ্ঞান এসে সমস্ত জগৎসংসারের মধ্যে এমন একটা দ্রাবক পদার্থ ঢেলে দিয়েছে যাতে করে সবটা ছিঁড়ে গিয়ে তার ক্ষীর এবং নীর, ছানা এবং মাখন স্বতন্ত্র হয়ে গেছে। সুতরাং বিশ্ব সম্বন্ধে মানুষের মনের ভাব যে অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে তার আর সন্দেহ নেই; বৈদিক কালের ঋষি যে ভাবে উষাকে দেখতেন এবং স্তব করতেন আমাদের কালে উষা সম্বন্ধে সে ভাব সম্পূর্ণ সম্ভব নয়।

 

প্রাচীন কাল এবং বর্তমান কালে প্রধান প্রভেদ হচ্ছে এই যে, প্রাচীন কালে সর্বসাধারণের মধ্যে মতের এবং ভাবের একটা নিবিড় ঐক্য ছিল; গোলাপের কুঁড়ির মধ্যে তার সমস্ত পাপড়িগুলি যেমন আঁট বেঁধে একটিমাত্র সূচ্যগ্র বিন্দুতে আপনাকে উন্মুখ করে রেখে দেয় তেমনি। তখন জীবনের সমস্ত বিশ্বাস টুকরো টুকরো হয়ে যায় নি। তখনকার অখণ্ডজীবনের মধ্যে দিয়ে সাহিত্য সূর্যকিরণের মতো শুভ্র নিরঞ্জন- ভাবে ব্যক্ত হত। এখনকার বিদীর্ণ সমাজ এবং বিভক্ত মনুষ্যত্বের ভিতর দিয়ে সাহিত্যের শুভ্র সম্পূর্ণতা প্রকাশ পায় না। তার সাত রঙ ফেটে বার হয়েছে। ক্লাসিসিজ্‌ম্‌ এবং রোমান্টিসিজ্‌ম্‌'এর মধ্যে সেইজন্য প্রভেদ দাঁড়িয়ে গেছে। ক্লাসিক শুভ্র এবং রোমান্টিক পাঁচ-রঙা।

 

কিন্তু প্রাচীন পিতামহদের অবিশ্লিষ্ট মনে সংসারের সাত রঙ কেন্দ্রীভূত হয়ে যে এক-একটি সুসংহত শুভ্র মূর্তিরূপে প্রকাশ পেত তার একটা কারণ ছিল। তখন সন্দেহ প্রবল ছিল না।

 

সন্দেহের প্রথম কাজ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের মধ্যে বিচ্ছেদ আনয়ন করা। আদিম কালে বিশ্বাসের কনিষ্ঠ ভাই সন্দেহ জন্মগ্রহণ করেন নাই। সেইজন্যে তখন বিশ্বসংসার বিশ্বাস এবং সন্দেহের মধ্যে তুল্যাংশে ভাগ হয়ে যায় নি। কিম্বা সন্দেহ তখন এমনি নাবালক অবস্থায় ছিল যে, সংসারের প্রত্যেক জিনিসের উপর নিজের দাবি উত্থাপন করবার মতো তার বয়স ও বুদ্ধি হয় নি। বিশ্বাসের তখন একাধিপত্য ছিল। তার ফল ছিল এই যে, তখন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ভিন্নতা ছিল না। উষাকে আকাশকে চন্দ্রসূর্যকে আমরা আমাদের থেকে স্বতন্ত্র শ্রেণীর বলে মনে করতে পারতুম না। এমন-কি, যে-সকল প্রবৃত্তির দ্বারা আমরা চালিত হতুম, যারা মনুষ্যত্বের এক-একটি অংশমাত্র, তাদের প্রতিও আমরা স্বতন্ত্র পূর্ণ মনুষ্যত্ব আরোপ করতুম। এখন আমরা এই মনুষ্যত্ব আরোপ করাকে রূপক অলংকার বলে থাকি, কিন্তু তখন এটা অলংকারের স্বরূপ ছিল না। বিশ্বাসের সোনার কাঠিতে তখন সমস্তই জীবন্ত হয়ে জেগে উঠত। বিশ্বাস কোনোরকম খণ্ডতা সহ্য করতে পারে না। সে আপনার সৃজনশক্তির দ্বারা সমস্ত বিচ্ছেদ বিরোধ পূর্ণ ক'রে, সমস্ত ছিদ্র আচ্ছাদন ক'রে ঐক্যনির্মাণের জন্যে ব্যস্ত।

 

অনেকে বলেন পূর্বোক্ত কারণেই প্রাচীন সাহিত্যে বেশি মাত্রায় সাহিত্য-অংশ ছিল। অর্থাৎ মানুষ তখন আপনাকেই সর্বত্র সৃজন করে বসত। তখন মানুষ আপনারই সুখদুঃখ বিরাগ-অনুরাগ বিস্ময়-আনন্দে সমস্ত চরাচর অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল। আমি বরাবর বলে আসছি, মানুষের এই আত্মসৃজনপদ্ধতিই সাহিত্যের পদ্ধতি। অনেকের মতে পুরাকালে এইটে কিছু অধিক ছিল। তখন মানবকল্পনার স্পর্শমাত্রে সমস্ত জিনিস মানুষ হয়ে উঠত। এইজন্যই সাহিত্য অতি সহজেই সাহিত্য হয়ে উঠেছিল।

 

এখন বিজ্ঞান যতই প্রকৃতি ও মানবের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে ততই প্রকৃতি প্রাকৃতভাবে আমাদের কাছে জাগ্রত হয়ে উঠছে। মানুষের সৃজনশক্তি সেখানে আপনার প্রাচীন অধিকার হারিয়ে চলে আসছে। নিজের যে-সকল হৃদয়বৃত্তি তার মধ্যে সঞ্চার করে দিয়েছিলুম সেগুলো ক্রমেই নিজের মধ্যে ফিরে আসছে। পূর্বে মানবত্বের যে অসীম বিস্তার ছিল, দ্যুলোকে ভূলোকে যে একই হৃৎস্পন্দন স্পন্দিত হত, এখন তা ক্রমশই সংকীর্ণ হয়ে ক্ষুদ্র মানবসমাজটুকুর মধ্যেই বদ্ধ হচ্ছে।

 

যাই হোক, মানবের আত্মপ্রকাশ তখনকার সাহিত্যেও ছিল, মানবের আত্মপ্রকাশ এখনকার সাহিত্যেও আছে। বরঞ্চ প্রাচীন সাহিত্যের দৃষ্টান্তেই আমার কথাটা অধিকতর পরিস্ফুট হয়।

 

কিন্তু "তত্ত্ব' শব্দটা ব্যবহার করেই আমি বিষম মুশকিলে পড়েছি। যে মানসিক শক্তি আমাদের চেতনার অন্তরালে বসে কাজ করছে তাকে ঠিক তত্ত্ব নাম দেওয়া যায় না-- যেটা আমাদের গোচর হয়েছে তাকেই তত্ত্ব বলা যেতে পারে-- সেই মানসিক পদার্থকে কেউ-বা আংশিকভাবে জানে, কেউ-বা জানে না অথচ তার নির্দেশানুসারে জীবনের সমস্ত কাজ করে যায়। সে জিনিসটা ভারি একটা মিশ্রিত জিনিস; তত্ত্বের সিদ্ধান্তের মতো ছাঁটাছোঁটা চাঁচাছোলা আটঘাট-বাঁধা নয়। সেটা জ্ঞানের সঙ্গে, ভাবের সঙ্গে, কল্পনার সঙ্গে একটা অবিচ্ছেদ্য মিশ্রণ। অন্তরের প্রকৃতি, বাহিরের জ্ঞান এবং আজন্মের সংস্কার আমাদের জীবনের মূলদেশে মিলিত হয়ে একটি অপূর্ব ঐক্য লাভ করেছে; সাহিত্য সেই অতিদুর্গম অন্তঃপুরের কাহিনী। সেই ঐক্যকে আমি মোটামুটি জীবনের মূলতত্ত্ব নাম দিয়েছি। কারণ, সেটা যদিও লেখক এবং সাহিত্যের দিক থেকে তত্ত্ব নয়, কিন্তু সমালোচকের দিক থেকে তত্ত্ব। যেমন জগতের কার্যপরম্পরা কতকগুলি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, কিন্তু বৈজ্ঞানিক যখনই তার নিত্যতা দেখতে পান তখনই তাকে "নিয়ম' নাম দেন।

 

আমি যে মিলনের কথা বললুম সেটা যত মিলিত ভাবে থাকে মনুষ্যত্ব ততই অবিচ্ছিন্ন সুতরাং আত্মসম্বন্ধে অচেতন থাকে। সেগুলোর মধ্যে যখন বিরোধ উপস্থিত হয় তখনই তাদের পরস্পরের সংঘাতে পরস্পর সম্বন্ধে একটা স্বতন্ত্র চেতনা জন্মায়। তখনই বুঝতে পারি, আমার সংস্কার এক জিনিস, বাস্তবিক সত্য আর-এক জিনিস, আবার আমার কল্পনার ক্ষেত্র স্বতন্ত্র। তখন আমাদের একান্নবর্তী মানসপরিবারকে পৃথক করে দিই এবং প্রত্যেকের স্ব স্ব প্রাধান্য উপলব্ধি করি।

 

কিন্তু শিশুকালে যেখানে এরা একত্র জন্মগ্রহণ করে মানুষ হয়েছিল পৃথক হয়েও সেইখানে এদের একটা মিলনের ক্ষেত্র আছে। সাহিত্য সেই আনন্দসংগমের ভাষা। পূর্বের মতো সাহিত্যের সে আত্মবিস্মৃতি নেই; কেননা এখনকার এ মিলন চিরমিলন নয়, এ বিচ্ছেদের মিলন। এখন আমরা স্বতন্ত্রভাবে বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস আলোচনা করি; তার পরে এক সময়ে সাহিত্যের মধ্যে, মানসিক ঐক্যের মধ্যে, আনন্দ লাভ করি। পূর্বে সাহিত্য অবশ্যম্ভাবী ছিল, এখন সাহিত্য অত্যাবশ্যক হয়েছে। মনুষ্যত্ব বিভক্ত হয়ে গেছে, এইজন্যে সাহিত্যের মধ্যে সে আপনার পরিপূর্ণতার আস্বাদলাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। এখনই সাহিত্যের বড়ো বেশি আবশ্যক এবং তার আদরও বেশি।

 

এখন এই পূর্ণমনুষ্যত্বের সংস্পর্শ সচরাচর কোথাও পাওয়া যায় না। সমাজে আমরা আপনাকে খণ্ডভাবে প্রকাশ করি। বাঁধাবাঁধি নিয়মের মধ্যে যতটা দূর যাওয়া যায় তার বেশি অগ্রসর হতে পারি নে। চুটকি হাসি এবং খুচরো কথার মধ্যে আপনাকে আবৃত করে রাখি। মানুষ সামনে উপস্থিত হবামাত্রই আমরা এমনি সহজে স্বভাবতই আত্মসম্‌বৃত হয়ে বসি যে, একটা গুরুতর ঘটনার দ্বারা অকস্মাৎ অভিভূত না হলে কিম্বা একটা অতিপ্রবল আবেগের দ্বারা সর্ববিস্মৃত না হলে আমরা নিজের প্রকৃত আভাস নিজে পাই নে। শেক্‌স্‌পীয়রের সময়েও এরকম সব আকস্মিক ঘটনা এবং প্রবল আবেগ সচরাচর উদ্‌ভব হতে পারত এবং বিদ্যুৎ-আলোকে মানুষের সমগ্র আগাগোড়া এক পলকে দৃষ্টিগোচর হত; এখন সুসভ্য সুসংযত সমাজে আকস্মিক ঘটনা ক্রমশই কমে আসছে এবং প্রবল আবেগ সহস্র বাঁধে আটকা পড়ে পোষ-মানা ভাল্লুকের মতো নিজের নখদন্ত গোপন করে সমাজের মনোরঞ্জন করবার জন্যে কেবল নৃত্য করে-- যেন সে সমাজের নট, যেন তার একটা প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং রুদ্ধ আক্রোশ ঐ বহুরোমশ আচ্ছাদনের নীচে নিশিদিন জ্বলছে না।

 

সাহিত্যের মধ্যে শেক্‌স্‌পীয়রের নাটকে, জর্জ এলিয়টের নভেলে, সুকবিদের কাব্যে সেই প্রচ্ছন্ন মনুষ্যত্ব মুক্তিলাভ করে দেখা দেয়। তারই সংঘাতে আমাদের আগাগোড়া জেগে ওঠে; আমরা আমাদের প্রতিহত হাড়গোড়-ভাঙা ছাইচাপা অঙ্গহীন জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করি।

 

এইরূপ সুবৃহৎ অনাবরণের মধ্যে অশ্লীলতা নেই। এইজন্যে শেক্‌স্‌পীয়র অশ্লীল নয়, রামায়ণ মহাভারত অশ্লীল নয়। কিন্তু ভারতচন্দ্র অশ্লীল, জোলা অশ্লীল; কেননা তা কেবল আংশিক অনাবরণ।

 

আর-একটু খোলসা করে বলা আবশ্যক।

 

সাহিত্যে আমরা সমগ্র মানুষকে প্রত্যাশা করি। কিন্তু সব সময়ে সবটাকে পাওয়া যায় না, সমস্তটার একটা প্রতিনিধি পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিনিধি কাকে করা যাবে? যাকে সমস্ত মানুষ বলে মানতে আমাদের আপত্তি নেই। ভালোবাসা স্নেহ দয়া ঘৃণা ক্রোধ হিংসা এরা আমাদের মানসিক বৃত্তি; এরা যদি অবস্থানুসারে মানবপ্রকৃতির উপর একাধিপত্য লাভ করে তাতে আমাদের অবজ্ঞা অথবা ঘৃণার উদ্রেক করে না। কেননা এদের সকলেরই ললাটে রাজচিহ্ন আছে; এদের মুখে একটা দীপ্তি প্রকাশ পায়। মানুষের ভালো এবং মন্দ সহস্র কাজে এরা আপনার চিহ্নাঙ্কিত রাজমোহর মেরে দিয়েছে। মানব-ইতিহাসের প্রত্যেক পৃষ্ঠায় এদের সহস্রটা করে সই আছে। অথচ ঔদরিকতাকে যদি সাহিত্যের মধ্যে কোথাও রাজসিংহাসন দেওয়া যায় তবে তাকে কে মানবে? কিন্তু পেটুকতা কি পৃথিবীতে অসত্য? সেটা কি আমাদের অনেকানেক মহৎবৃত্তির চেয়ে অধিকতর সাধারণব্যাপী নয়? কিন্তু তাকে আমাদের সমগ্র মনুষ্যত্বের প্রতিনিধি করতে আমাদের একান্ত আপত্তি, এইজন্যে সাহিত্যে তার স্থান নেই। কিন্তু কোনো "জোলা' যদি পেটুকতাকে তাঁর নভেলের বিষয় করেন এবং কৈফিয়ত দেবার বেলায় বলেন যে, পেটুকতা পৃথিবীতে একটা চিরসত্য, অতএব ওটা সাহিত্যের মধ্যে স্থান না পাবে কেন, তখন আমরা উত্তর দেব: সাহিত্যে আমরা সত্য চাই নে, মানুষ চাই।

 

যেমন পেটুকতা, অন্য অনেক শারীরিক বৃত্তিও তেমনি। তারা ঠিক রাজবংশীয় ক্ষত্রিয় নয়, তারা শূদ্র দাস; তারা দুর্বল দেশে মাঝে মাঝে রাজসিংহাসন হরণ করে নেয়, কিন্তু মানব-ইতিহাসে কখনো কোথাও কোনো স্থায়ী গৌরব লাভ করে নি-- সমাজে তাদের চরম এভোল্যুশন হচ্ছে কেবল ফরাসি রান্না এবং ফরাসি নভেল।

 

সমগ্রতাই যদি সাহিত্যের প্রাণ না হত তা হলে জোলার নভেলে কোনো দোষ দেখতুম না। তার সাক্ষী, বিজ্ঞানে কোনো অশ্লীলতা নেই। সে খণ্ড জিনিসকে খণ্ড ভাবেই দেখায়। আর, সাহিত্য যখন মানবপ্রকৃতির কোনো-একটা অংশের অবতারণা করে তখন তাকে একটা বৃহতের, একটা সমগ্রের প্রতিনিধিস্বরূপে দাঁড় করায়; এইজন্যে আমাদের মানসগ্রামের বড়ো বড়ো মোড়লগুলিকেই সে নির্বাচন করে নেয়।

 

কথাটা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের ঠিক সমরেখায় পড়ল কি না জানি নে। কিন্তু আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা এর দ্বারা কতকটা পরিস্ফুট হবে বলেই এর অবতারণা করা গেছে।

 

অতএব আমার বক্তব্য এই যে, সাহিত্য মোট মানুষের কথা।

 

শেক্‌স্‌পীয়র এবং প্রাচীন কবিরা মানুষ দেখতে পেতেন এবং তাদের প্রতিকৃতি সহজে দিতে পারতেন। এখন আমরা এক-একটা অর্ধচেতন অবস্থায় নিজের অন্তস্তলে প্রবেশ করে গুপ্তমানুষকে দেখতে পাই। সচেতন হলেই চির-অভ্যাস-ক্রমে সে লুকিয়ে পড়ে। এইজন্যে আজকালকার লেখায় প্রায় লেখকের বিশেষত্বের মধ্যেই মনুষ্যত্ব দেখা দেয়। কিম্বা খণ্ড খণ্ড আভাসকে কল্পনাশক্তির দ্বারা জুড়ে এক করে গড়ে তুলতে হয়। অন্তররাজ্যও বড়ো জটিল হয়ে পড়েছে, পথও বড়ো গোপন। যাকে ইংরাজিতে ইন্‌স্‌পিরেশন বলে সে একটা মুগ্ধ অবস্থা; তখন লেখক একটা অর্ধচেতন শক্তির প্রভাবে কৃত্রিম জগতের শাসন অনেকটা অতিক্রম করে এবং মনুষ্যরাজার যেখানে খাস দরবার সেই মর্মসিংহাসনের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়।

 

কিন্তু নিজের সুখদুঃখের দ্বারাই হোক আর অন্যের সুখদুঃখের দ্বারাই হোক, প্রকৃতির বর্ণনা করেই হোক আর মনুষ্যচরিত্র গঠিত করেই হোক, মানুষকে প্রকাশ করতে হবে। আর-সমস্ত উপলক্ষ।

 

প্রকৃতিবর্ণনাও উপলক্ষ; কারণ, প্রকৃতি ঠিকটি কিরূপ তা নিয়ে সাহিত্যের কোনো মাথাব্যথাই নেই, কিন্তু প্রকৃতি মানুষের হৃদয়ে, মানুষের সুখদুঃখের চারি দিকে, কিরকম ভাবে প্রকাশিত হয় সাহিত্য তাই দেখায়। এমন-কি, ভাষা তা ছাড়া আর-কিছু পারে না। চিত্রকর যে রঙ দিয়ে ছবি আঁকে সে রঙের মধ্যে মানুষের জীবন মিশ্রিত হয় নি; কিন্তু কবি যে ভাষা দিয়ে বর্ণনা করে তার প্রত্যেক শব্দ আমাদের হৃদয়ের দোলায় লালিত পালিত হয়েছে। তার মধ্যে থেকে সেই জীবনের মিশ্রণটুকু বাদ দিয়ে ভাষাকে জড় উপাদানে পরিণত করে নিছক বর্ণনাটুকু করে গেলে যে কাব্য হয় এ কথা কিছুতে স্বীকার করা যায় না।

 

সৌন্দর্যপ্রকাশও সাহিত্যের উদ্দেশ্য নয়, উপলক্ষ মাত্র। হ্যাম্‌লেটের ছবি সৌন্দর্যের ছবি নয়, মানবের ছবি; ওথেলোর অশান্তি সুন্দর নয়, মানবস্বভাবগত।

 

কিন্তু সৌন্দর্য কী গুণে সাহিত্যে স্থান পায় বলা আবশ্যক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মানবহৃদয়ের একটা নিত্য মিশ্রণ আছে।  তার মধ্যে প্রকৃতির জিনিস যতটা আছে তার চেয়ে মানবের চিত্ত বেশি। এইজন্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে মানব আপনাকেই অনুভব করে। প্রকৃতির সৌন্দর্য সম্বন্ধে যতই সচেতন হব প্রকৃতির মধ্যে আমারই হৃদয়ের ব্যাপ্তি তত বাড়বে।

 

কিন্তু কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই তো কবির বর্ণনার বিষয় নয়। প্রকৃতির ভীষণত্ব, প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা, সে তো বর্ণনীয়। কিন্তু সেও আমাদের হৃদয়ের জিনিস, প্রকৃতির জিনিস নয়। অতএব, এমন কোনো বর্ণনা সাহিত্যে স্থান পেতে পারে না যা সুন্দর নয়, শান্তিময় নয়, ভীষণ নয়, মহৎ নয়, যার মধ্যে মানবধর্ম নেই কিম্বা যা অভ্যাস বা অন্য কারণে মানবের সঙ্গে নিকটসম্পর্ক বদ্ধ নয়।

 

আমার বোধ হচ্ছে, আমার প্রথম চিঠিতে লেখকেরই নিজত্ব-প্রকাশের উপর এতটা ঝোঁক দিয়েছিলুম যে সেইটেই সাহিত্যের মূল লক্ষ্য এইরকম বুঝিয়ে গেছে। আমার সেই সামান্য আদিম অপরাধ তুমি কিছুতেই মার্জনা করতে পারছ না; তার পরে আমি যে কথাই বলি না কেন তোমার মন থেকে সেটা আর যাচ্ছে না; আদম যেমন প্রথম পাপে তাঁর সমস্ত মানববংশ-সমেত স্বর্গচ্যুত হয়েছিলেন তেমনি আমার সেই প্রথম ত্রুটি ধরে আমার সমস্ত সংস্কার ও যুক্তি-- পরম্পরাসুদ্ধ আমাকে মতচ্যুত করবার চেষ্টায় আছ।

 

আমার বলা উচিত ছিল, লেখকের নিজত্ব নয়, মনুষ্যত্ব-প্রকাশই সাহিত্যের উদ্দেশ্য (আমার মনের মধ্যে নিদেন সেই কথাটাই ছিল) কখনো নিজত্বদ্বারা কখনো পরত্বদ্বারা। কখনো স্বনামে কখনো বেনামে। কিন্তু একটা মনুষ্য-আকারে। লেখক উপলক্ষ মাত্র, মানুষই উদ্দেশ্য। আমার গোড়াকার চিঠিতে যদি এ কথা প্রকাশ হয়ে না থাকে তা হলে জেনো সেটা আমার অনিপুণতাবশত। এতে তত্ত্ব, সাহিত্যের তত্ত্ব, তাতে আবার আমার মতো লোক তার ব্যাখ্যাকারক! কথা আছে একে বোবা, তাতে আবার বোলতায় কামড়েছে-- একে গোঁ গোঁ করা বই আর-কিছু জানে না, তার উপরে কামড়ের জ্বালায় গোঁগাঁনি কেবল বাড়িয়ে তোলে।

 

আমি যে এই আলোচনা করছি, এ যেন মানসিক মৃগয়া করছি। একটা জীবন্ত জিনিসের পশ্চাতে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছি; পদে পদে স্থান পরিবর্তন করছি, কখনো পর্বতের শিখরে, কখনো পর্বতের গুহায়। এইজন্য আমার সমস্ত আলোচনায় যদিও লক্ষ্যে ঐক্য আছে, কিন্তু হয়তো পথের অনৈক্য পাবে। কিন্তু সে-সমস্ত মার্জনা করে তুমিও যদি আমার সঙ্গে যোগ দাও, যদি আমার পাশাপাশি ছোট, তা হলে আমার মৃগটি যদি বা সম্পূর্ণ ধরা না পড়ে নিদেন তোমার দৃষ্টিগোচর হয়। অর্থাৎ আমার প্রার্থনা এই যে, আমি যদি তোমাকে বোঝাতে ভুল করে থাকি তুমি নিজে ঠিকটা বোঝো। অর্থাৎ আমি যদি তোমাকে মাছটা ধরে দিতে না পারি, আমার পুকুরটা ছেড়ে দিচ্ছি, তুমিও জাল ফেলো। কিন্তু কিছু উঠবে কি? সে কথা বলতে পারি নে-- সে তোমার অদৃষ্ট কিম্বা আমার অদৃষ্ট যা'ই বল।

 

কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে আমার একটা নালিশ আছে। তুমি আমারই কথাটাকে কেবল ঝুঁটি ধরে টেনে টেনে বের করছ; নিজের কথাটিকে বরাবর বেশ ঢেকেঢুকে সামলে রেখেছ। আমি যেন কেবল একটি জীবন্ত তলোয়ারের সঙ্গে লড়াই করছি-- কেবল খোঁচা খাচ্ছি, কাউকে খোঁচা ফিরিয়ে দিতে পারছি নে। আমি বারবার যতই বুক ফুলিয়ে ফুলিয়ে দাঁড়াচ্ছি তোমার ততই আঘাত করবার সুবিধে হচ্ছে। কিন্তু এটাকে কি ন্যায়যুদ্ধ বলে?

 

আমি ব্রাহ্মণ, কেবলমাত্র যুদ্ধের উৎসাহে আনন্দ পাই নে। আসল কথাটা কী তাই জানতে পারলেই চুপ করে যাই। আমি তো বলি সাহিত্যের উদ্দেশ্য সমগ্র মানুষকে গঠিত করে তোলা। তুমি কী বল?

 

কিন্তু তুমি শুনছি কলকাতায় আসছ; আমিও সেখানে যাচ্ছি। তা হলে তর্কটা মোকাবিলায় নিষ্পত্তি হবার সম্ভাবনা দেখছি। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে মোকাবিলায় নিষ্পত্তি কুইনাইন দিয়ে জ্বর ঠেকানোর মতো। হয়তো চট করে ছেড়ে যেতে পারে, নয় তো গুমরে গুমরে থেকে যায়-- আবার কিছুদিন বাদে কেঁপে কেঁপে দেখা দেয়।

 

ইতি।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •