ভারতী, শ্রাবণ, ১২৮৪


 

মেঘনাদবধ কাব্য (meghnadbodh kabyo)


বঙ্গীয় পাঠকসমাজে যে-কোনো গ্রন্থকার অধিক প্রিয় হইয়া পড়েন, তাঁহার গ্রন্থ নিরপেক্ষভাবে সমালোচনা করিতে কিঞ্চিৎ সাহসের প্রয়োজন হয়। তাঁহার পুস্তক হইতে এক বিন্দু দোষ বাহির করিলেই, তাহা ন্যায্য হউক বা অন্যায্যই হউক, পাঠকেরা অমনি ফণা ধরিয়া উঠেন। ভীরু সমালোচকরা ইঁহাদের ভয়ে অনেক সময়ে আপনার মনের ভাব প্রকাশ করিতে সাহস করেন না। সাধারণ লোকদিগের প্রিয় মতের পোষকতা করিয়া লোকরঞ্জন করিতে আমাদের বড়ো একটা বাসনা নাই। আমাদের নিজের যাহা মত তাহা প্রকাশ্যভাবে বলিতে আমরা কিছুমাত্র সংকুচিত হইব না বা যদি কেহ আমাদের মতের দোষ দেখাইয়া দেন তবে তাহা প্রকাশ্যভাবে স্বীকার করিতে আমরা কিছুমাত্র লজ্জিত হইব না। এখনকার পাঠকদের স্বভাব এই যে, তাঁহারা ঘটনাক্রমে এক-একজন লেখকের অত্যন্ত অনুরক্ত হইয়া পড়েন, এরূপ অবস্থায় তাঁহারা সে লেখকের রচনায় কোনো দোষ দেখিতে পান না, অথবা কেহ যদি তাহার কোনো দোষ দেখাইয়া দেয় সে দোষ বোধগম্য ও যুক্তিযুক্ত হইলেও তাঁহারা সেগুলিকে গুণ বলিয়া বুঝাইতে ও বুঝিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া থাকেন। আবার এমন অনেক ভীরু-স্বভাব পাঠক আছেন, যাঁহারা খ্যাতনামা লেখকের রচনা পাঠকালে কোনো দোষ দেখিলে তাহাকে দোষ বলিয়া মনে করিতে ভয় পান, তাঁহারা মনে করেন এগুলি গুণই হইবে, আমি ইহার গভীর অর্থ বুঝিতে পারিতেছি না।

 

আমাদের পাঠকসমাজের রুচি ইংরাজি-শিক্ষার ফলে একাংশে যেমন উন্নত হইয়াছে অপরাংশে তেমনি বিকৃতি প্রাপ্ত হইয়াছে। ভ্রমর, কোকিল, বসন্ত লইয়া বিরহ বর্ণনা করিতে বসা তাঁহাদের ভালো না লাগুক, কবিতার অন্যসকল দোষ ইংরাজি গিল্‌টিতে আবৃত করিয়া তাঁহাদের চক্ষে ধরো তাঁহারা অন্ধ হইয়া যাইবেন। ইঁহারা ভাববিহীন মিষ্ট ছত্রের মিলনসমষ্টি বা শব্দাড়ম্বরের ঘনঘটাচ্ছন্ন শ্লোককে মুখে কবিতা বলিয়া স্বীকার করিতে লজ্জিত হন কিন্তু কার্যে তাহার বিপরীতাচরণ করেন। শব্দের মিষ্টতা অথবা আড়ম্বর তাঁহাদের মনকে এমন আকৃষ্ট করে যে ভাবের দোষ তাঁহাদের চক্ষে প্রচ্ছন্ন হইয়া পড়ে। কুশ্রী ব্যক্তিকে মণি-মাণিক্যজড়িত সুদৃশ্য পরিচ্ছদে আবৃত করিলে আমাদের চক্ষু পরিচ্ছদের দিকেই আকৃষ্ট হয়, ওই পরিচ্ছদ সেই কুশ্রী ব্যক্তির কদর্যতা কিয়ৎ পরিমাণে প্রচ্ছন্ন করিতেও পারে কিন্তু তাহা বলিয়া তাহাকে সৌন্দর্য অর্পণ করিতে পারে না।

 

আমরা এবারে যে মেঘনাদবধের একটি রীতিমতো সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহা পাঠ করিয়া অনেক পাঠক বিরক্ত হইয়া কহিবেন যে অত সূক্ষ্ম সমালোচনা করিয়া পুস্তকের দোষগুণ ধরা অনাবশ্যক, মোটের উপর পুস্তক ভালো লাগিলেই হইল। আমরা বলি এমন অনেক চিত্রকর আছেন, যাঁহারা বর্ণপ্রাচুর্যে তাঁহাদের চিত্র পূর্ণ করেন, সে চিত্র দূর হইতে সহসা নয়ন আকর্ষণ করিলেও প্রকৃত শিল্পরসজ্ঞ ব্যক্তি সে চিত্রকরেরও প্রশংসা করেন না, সে চিত্রেরও প্রশংসা করেন না, তাঁহারা বিশেষ বিশেষ করিয়া দেখেন যে, চিত্রে ভাব কেমন সংরক্ষিত হইয়াছে, এবং ভাবসুদ্ধ চিত্র দেখিলেই তাঁহারা তৃপ্ত হন। কাব্য সম্বন্ধেও ওইরূপ বলিতে পারা যায়। আমরা অধিক ভূমিকা করিতে অতিশয় অনিচ্ছুক, এখন যে সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া গিয়াছে তাহারই অবতারণা করা যাক।

 

লক্ষ্ণণ, ইন্দ্রজিৎ, রাবণ, সীতা, প্রমীলা, ইন্দ্র, দুর্গা, মায়াদেবী, লক্ষ্মী ইঁহারাই মেঘনাদবধের প্রধান চরিত্র। ইহার মধ্যে কতকগুলি চরিত্র সুচিত্রিত হয় নাই, এবং কতকগুলি আমাদের মনের মতো হয় নাই। প্রথম, পুস্তক আরম্ভ করিতেই রাবণকে পাই। প্রথমে আমরা ভাবিলাম, কী একটি ভীষণ চিত্রই পাইব, গগনস্পর্শী বিশাল দশানন গম্ভীর, ভীষণ, অন্ধকারময় মূর্তিতে উচ্চ প্রকাণ্ড সভামণ্ডপে আসীন, কিন্তু তাহা নহে, তাহা খুঁজিয়া পাই না। পাঠক প্রথমে একটি স্ফটিকময় রত্নরাজিসমাকুল সভায় প্রবেশ করো; সেখানে বসন্তের বাতাস বহিতেছে, কুসুমের গন্ধ আসিতেছে, চন্দ্রাননা চারুলোচনা কিংকরী চামর ঢুলাইতেছে, মদনের প্রতিরূপ ছত্রধর ছত্র ধরিয়া আছে, যাহা এক ভীষণের মধ্যে আছে দৌবারিক, কিন্তু দৌবারিককে মনে করিতে গিয়া শিবের রুদ্রভাব কমাইতে হয়। কবি পাণ্ডবশিবির-দ্বারে শূলপাণি রুদ্রেশ্বরের সহিত দ্বারবানের তুলনা দিয়াছেন। পুষ্করিণীর সহিত সমুদ্রের তুলনা দিলে সমুদ্রকেই ছোটো বলিয়া মনে হয়। কেহ বলিবেন যে, রামায়ণের রাবণ রত্নরাজিসমাকুলিত সভাতেই থাকিত, সুতরাং মেঘনাদবধে অন্যরূপ কী করিয়া বর্ণিত হইবে? আমরা বলি রত্নরাজিসংকুল সভায় কি গাম্ভীর্য অর্পণ করা যায় না? বাল্মীকি রাবণের সভা বর্ণনা করিয়া বলিয়াছেন, "রাবণের সভা তরঙ্গসংকুল, নক্রকুম্ভীর ভীষণ সমুদ্রের ন্যায় গম্ভীর। বাংলার একটি ক্ষুদ্র কাব্যের সহিত বাল্মীকির বিশাল কাব্যের তুলনা করিতে যাওয়াও যা, আর মহাদেবের সহিত একটা দ্বারবানের তুলনা করাও তা, কিন্তু কী করা যায়, কোনো কোনো পাঠকের চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া না দেখাইলে তাঁহারা বুঝিবেন না।

 

                       ভূতলে অতুল সভা-- ফটিকে গঠিত;

                       তাহে শোভে রত্নরাজি, মানসসরসে

                       সরস কমলকুল বিকশিত যথা।

                       শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত স্তম্ভ সারি সারি

                       ধরে উচ্চ স্বর্ণ ছাদ, ফণীন্দ্র যেমতি,

                       বিস্তারি অযুত ফণা, ধরেন আদরে

                       ধরারে। ঝুলিছে ঝলি ঝালরে মুকুতা,

                       পদ্মরাগ, মরকত, হীরা, যথা ঝোলে

                       খচিত মুকুলে ফুলে পল্লবের মালা

                       ব্রতালয়ে।  ইত্যাদি

 

 

ইহা কি রাবণের সভা? ইহা তো নাট্যশালার বর্ণনা!

 

কতকগুলি পাঠকের আবার পাত্রাপাত্র জ্ঞান নাই, তাঁহারা জিজ্ঞাসা করিবেন রাবণের সভা মহান করিতেই হইবে তাহার অর্থ কী? না-হয় সুন্দরই হইল, ইঁহাদের কথার উত্তর দিতে আমাদের অবকাশ নাই এবং ইচ্ছাও নাই। এককথায় বলিয়া রাখি যে, কবি ব্রজাঙ্গনায় যথাসাধ্য কাকলি, বাঁশরি, স্বরলহরী, গোকুল, বিপিন প্রভৃতি ব্যবহার করিতে পারিতেন, কিন্তু মহাকাব্য রচনায়, বিশেষ রাবণের সভা-বর্ণনায় মিষ্টভাবের পরিবর্তে তাঁহার নিকট হইতে আমরা উচ্চ, প্রকাণ্ড, গম্ভীর ভাব প্রার্থনা করি। এই সভার বর্ণনা পাঠ করিয়া দেখি রাবণ কাঁদিতেছেন, রাবণের রোদনে পুস্তকের প্রারম্ভভাগ যে নষ্ট হইয়া গেল, তাহা আর সুরুচি পাঠকদের বুঝিইয়া দিতে হইবে না। ভালো, এ দোষ পরিহার করিয়া দেখা যাউক, রাবণ কী ভয়ানক শোকেই কাঁদিতেছেন ও সে রোদনই বা কী অসাধারণ; কিন্তু তাহার কিছুই নয়, রীববাহুর শোকে রাবণ কাঁদিতেছেন। অনেকে কহিবেন, ইহা অপেক্ষা আর শোক কী আছে। কিন্তু তাঁহারা ভাবিয়া দেখুন, বীরবাহুর পূর্বে রাবণের কত পুত্র হত হইয়াছে, সকল ক্লেশের ন্যায় শোকও অভ্যস্ত হইয়া যায়, এখন দেখা যাউক রাবণের রোদন কী প্রকার। প্রকাণ্ড দশানন, কাঁদিতেছেন কিরূপে--

 

                       এ হেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি,

                       বাক্যহীন পুত্রশোকে! ঝর ঝর ঝরে,

                       অবিরল অশ্রুধারা-- তিতিয়া বসনে

                                                       ইত্যাদি

 

 

রানী মন্দোদরীকে কাঁদাইতে গেলে ইহা অপেক্ষা অধিক বাক্যব্যয় করিতে হইত না। ইহা পড়িলেই আমাদের মনে হয় গালে হাত দিয়া একটি বিধবা স্ত্রীলোক কাঁদিতেছেন। একজন সাধারণ নায়ক এরূপ কাঁদিতে বসিলে আমাদের গা জ্বলিয়া যায়, তাহাতে ইনি মহাকাব্যের নায়ক, যে-সে নায়ক নয়, যিনি বাহুবলে স্বর্গপুরী কাঁপাইয়াছিলেন, এবং যাঁহার এতদূর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল যে, তাঁহার চক্ষের উপরে একটি একটি করিয়া পুত্র, পৌত্র, ভ্রাতা নিহত হইল, ঐশ্বর্যশালী জনপূর্ণ কনকলঙ্কা ক্রমে ক্রমে শ্মশানভূমি হইয়া গেল, অবশেষে যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করিলেন তথাপি রামের নিকট নত হন নাই, তাঁহাকে এইরূপ বালিকাটির ন্যায় কাঁদাইতে বসানো অতি ক্ষুদ্র কবির উপযুক্ত। ভাবুক মাত্রেই স্বীকার করিবেন যে, মন্দোদরীই বিলাপ করিতে হইলে বলিতেন যে--

 

                    হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীরচূড়ামণি!

                    কী পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?

                    কী পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,

                    হরিলি এ ধন তুই? হায় রে কেমনে

                    সহি এ যাতনা আমি? কে আর রাখিবে

                    এ বিপুল কুল-মান এ কালসমরে?

                                                       ইত্যাদি

 

 

রাবণের ক্রন্দন দেখিয়া "সচিবশ্রেষ্ঠ বুধঃ সারণ' সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন,

 

এ ভবমণ্ডল

মায়াময়, বৃথা এর সুখ দুঃখ যত।

 

 

রাবণ কহিলেন, "কিন্তু জেনে শুনে তবু কাঁদে এ-পরাণ অবোধ'। ইহার পর দূত যে বীরবাহুর যুদ্ধের বর্ণনা করিলেন তাহা মন্দ নহে, তাহাতে কবি কথাগুলি বেশ বাছিয়া বসাইয়াছেন। তাহার পরে দূত বীরবাহুর মৃত্যু স্মরণ করিয়া কাঁদিল-- "কাঁদে যথা বিলাপী স্মরিয়া পূর্ব দুঃখ'-- এ কথাটি অতিশয় অযথা হইয়াছে। অমনি সভাসুদ্ধ কাঁদিল, রাবণ কাঁদিল, আমার মনে হইল আমি একরাশি স্ত্রীলোকের মধ্যে বসিয়া পড়িলাম।

 

                        অশ্রুময় আঁখি পুনঃ কহিলা রাবণ,

                        মন্দোদরী মনোহর,

 

 

একে তো অশ্রুময় আঁখি রাবণ, তাহাতে আবার "মন্দোদরী মনোহর', আমরা বাল্কীকির রাবণকে হারাইয়া ফেলিলাম। বড়ো বড়ো কবিরা এক-একটি বিশেষণে তাঁহাদের বর্ণনীয় বিষয়ের স্বপক্ষে এক-এক আকাশ ভাব আনিয়া দেন। রোদনের সময় রাবণের "মন্দোদরী মনোহর' বিশেষণ দিবার প্রয়োজন কী? যখন কবি রাবণের সৌন্দর্য বুঝাইবার জন্য কোনো বর্ণনা করিবেন তখন "মন্দোদরী মনোহর' রাবণের বিশেষণ অর্থে ব্যবহৃত হইতে পারে। তৎপরে দূত তেজের সহিত বীরবাহুর মৃত্যু বর্ণনা করিলেন, তখন রাবণের বীরত্ব ফিরিয়া আসিল, কেননা ডমরুধ্বনি না শুনিলে  ফণী কখনো উত্তেজিত হয় না। তাহার পরে শ্মশানে বীরবাহুর মৃতকায় দেখিয়া--

 

                      মহাশোকে শোকাকুল কহিলা রাবণ।

                      যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ কুমার

                      প্রিয়তম, বীরকুলসাধ এ শয়নে

                      সদা! রিপুদল বলে দলিয়া সমরে

                      জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?

                      যে ডরে ভীরু সে মূঢ় শত ধিক্‌ তারে।

 

 

এতদূর পড়িয়া আশা হয় যে এবার বুঝি রাবণের উপযুক্ত রোদনই হইবে কিন্তু তাহার পরেই আছে--

 

                        তবু বৎস যে হৃদয় মুগধ--

                        কোমল সে ফুলসম। এ বজ্র আঘাতে

                        কত যে কাতর সে, তা জানেন সে জন

                        অন্তর্যামী যিনি; আমি কহিতে অক্ষম।

                        হে বিধি, এ ভবভূমি তব লীলাস্থলী।

                        পরের যাতনা কিন্তু দেখি কি হে তুমি

                        হও সুখী? পিতা সদা পুত্র দুঃখে দুঃখী;

                        তুমি হে জগতপিতা, এ কী রীতি তব?

                        হা পুত্র! হা বীরবাহু! বীরেন্দ্র কেশরী

                        কেমনে ধরিব প্রাণ তোমার বিহনে?

 

 

সুরুচি পাঠকেরা কখনোই বলিবেন না যে ইহা রাবণের উপযুক্ত রোদন হইয়াছে।

 

                        এইরূপে আক্ষেপিয়া রাক্ষস ঈশ্বর

                        রাবণ, ফিরায়ে আঁখি দেখিলেন দূরে

                        সাগর

 

 

ভাবিলাম মহাকবি সাগরের কী একটি মহান গম্ভীর চিত্রই করিবেন, অন্য কোনো কবি এ সুবিধা ছাড়িতেন না। সমুদ্রের গম্ভীর চিত্র দূরে থাক্‌, কবি কহিলেন--

 

                        বহিছে জলস্রোত কলরবে

                        স্রোতঃপথে জল যথা রবিষার কালে

 

 

যাঁহাদের কবি আখ্যা দিতে পারি তাঁহাদের মধ্যে কেহই এরূপ নীচ বর্ণনা করিতে পারেন না, তাঁহাদের মধ্যে কেহই বিশাল সমুদ্রের ভাব এত ক্ষুদ্র করিয়া ভাবিতে পারেন না। এই স্থলে পাঠকগণের কৌতূহল চরিতার্থ করিবার জন্য রামায়ণ হইতে একটি উৎকৃষ্ট সমুদ্র বর্ণনা উদ্‌ধৃত করিয়া দিলাম।

 

"বিস্তীর্ণ মহাসমুদ্র প্রচণ্ড বায়ুবেগে নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলিত হইতেছে। উহার কোথাও উদ্দেশ নাই, চতুর্দিক অবাধে প্রসারিত হইয়া আছে। উহা ঘোর জলজন্তুগণে পূর্ণ; প্রদোষকালে অনবরত ফেন বিকাশপূর্বক যেন হাস্য করিতেছে এবং তরঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনপূর্বক যেন নৃত্য করিতেছে। তৎকালে চন্দ্র উদিত হওয়াতে মহাসমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস বর্ধিত হইয়াছে এবং প্রতিবিম্বিত চন্দ্র উহার বক্ষে ক্রীড়া করিতেছে। সমুদ্র পাতালের ন্যায় ঘোর গভীরদর্শন; উহার ইতস্ততঃ তিমি তিমিঙ্গিল প্রভৃতি জলজন্তুসকল প্রচণ্ডবেগে সঞ্চরণ করিতেছে। স্থানে স্থানে প্রকাণ্ড শৈল; উহা অতলস্পর্শ; ভীম অজগরগণ গর্ভে লীন রহিয়াছে। উহাদের দেহ জ্যোতির্ময়, সাগরবক্ষে যেন অগ্নিচূর্ণ প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। সমুদ্রের জলরাশি নিরবচ্ছিন্ন উঠিতেছে ও পড়িতেছে। সমুদ্র আকাশতুল্য এবং আকাশ সমুদ্রতুল্য; উভয়ের কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য নাই; আকাশে তারকাবলী এবং সমুদ্রে মুক্তাস্তবক; আকাশে ঘনরাজি এবং সমুদ্রে তরঙ্গজাল; আকাশে সমুদ্র ও সমুদ্রে আকাশ মিশিয়াছে। প্রবল তরঙ্গের পরস্পর সংঘর্ষ নিবন্ধন মহাকাশে মহাভেরীর ন্যায় অনবরত ভীম রব শ্রুত হইতেছে। সমুদ্র যেন অতিমাত্র ক্রুদ্ধ; উহা রোষভরে যেন উঠিবার চেষ্টা করিতেছে এবং উহার ভীম গম্ভীর রব বায়ুতে মিশ্রিত হইতেছে।"

 

রাবণ সমুদ্রকে সম্বোধন করিয়া যাহা কহিলেন তাহা সুন্দর লাগিল। রাবণ পুনরায় সভায় আসিয়া,

 

                    শোকে মগ্ন বসিলা নীরবে

                    মহামতি, পাত্র, মিত্র, সভাসদ্‌ আদি

                    বসিলা চৌদিকে, আহা নীরব বিষাদে!

 

 

হেনকালে রোদনের "মৃদু নিনাদ' ও কিঙ্কিণীর "ঘোর রোল' তুলিয়া চিত্রাঙ্গদা আইলেন, কবি তখন একটি ঝড় বাধাইলেন, এই ঝড়ের রূপকটি অতিশয় হাস্যজনক।

 

                    সুরসুন্দরীর রূপে শোভিল চৌদিকে

                    বামাকুল; মুক্তকেশ মেঘমালা, ঘন

                    নিশ্বাস প্রলয় বায়ু; অশ্রুবারিধারা

                    আসার, জীমূত-মন্দ্র হাহাকার রব।

 

 

এই ঝড় উপস্থিত হইতেই অমনি নেত্রনীরসিক্তা কিংকরী দূরে চামর ফেলিয়া দিল এবং ছত্রধর ছত্র ফেলিয়া দিয়া কাঁদিতে বসিল, আর পাত্র-মিত্র সভাসদ আদি অধীর হইয়া "ঘোর কোলাহলে' কাঁদিতে লাগিল। রাবণের সভায় এত কান্না তো আর সহ্য হয় না, পাত্র-মিত্র সভাসদ আদিকে এক-একটি খেলেনা দিয়া থামাইতে ইচ্ছা করে। একটু শোকে কিংকরী চামর ছুঁড়িয়া ফেলিল, একটু শোকে ছত্রধর ছত্র ফেলিয়া কাঁদিতে বসিল। একে তো ইহাতে রাজসভার এক অপূর্ব ভাব মনে আসে, দ্বিতীয়ত ক্রোধেই চামর আদি দূরে ফেলিয়া দিবার সম্ভাবনা, শোকে বরং হস্ত হইতে অজ্ঞাতে খসিয়া পড়িতে পারে। মহিষী বারণকে যাহা কহিলেন তাহা ভালো লাগিল, রাবণ কহিলেন,

 

                        বরজে সজারু পশি বারুইর যথা

                        ছিন্নভিন্ন করে তারে, দশরথাত্মজ

                        মজাইছে লঙ্কা মোর।

 

 

এই উদাহরণটি অতিশয় সংকীর্ণ হইয়াছে; যদি সাহিত্যদর্পণকার জীবিত থাকিতেন তবে দোষ-পরিচ্ছেদে যেখানে সূর্যের সহিত কুপিত কপি কপোলের তুলনা উদ্‌ধৃত করিয়াছেন সেইখানে এইটি প্রযুক্ত হইতে পারিত। দূতের ডমরুধ্বনিতে, চিত্রাঙ্গদার শোকার্ত ভর্ৎসনায় রাবণ শোকে অভিমানে "ত্যজি সুকনকাসন উঠিল গর্জিয়া'। সুকনকাসন, সুসিন্দূর, সুসমীরণ, সুআরাধনা, সুকবচ, সুউচ্চ, সুমনোহর কথাগুলি কাব্যের স্থানে স্থানে ব্যবহৃত হইয়াছে, এগুলি তেমন ভালো শুনায় না। ইহার পরে রাবণ সৈন্যদের সজ্জিত হইতে আদেশ করিলেন, রণসজ্জার বর্ণনা তেমন কিছু চিত্রিতবৎ হয় নাই, নহিলে উদ্‌ধৃত করিতাম।

 

যাহা হউক, প্রথম সর্গের এতখানি পড়িয়া যদি আমাদের রাবণের চরিত্র বুঝিতে হয় তো কী বুঝিব? রাবণকে কি মন্দোদরী বলিয়া আমাদের ভ্রম হইবে না? কোথায় রাবণ বীরবাহুর মৃত্যু শুনিয়া পদাহত সিংহের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিবেন, না সভাসুদ্ধ কাঁদাইয়া কাঁদিতে বসিলেন! কোথায় পুত্রশোক তাঁহার কৃপাণের শান-প্রস্তর হইবে, কোথায় প্রতিহিংসা তাঁহার শোকের ঔষধি হইবে, না তিনি স্ত্রীলোকের শোকাগ্নি নির্বাণের উপায় অশ্রুজলের আশ্রয় লইয়াছেন। কোথায় যখন দূত বীরবাহুর মৃত্যু স্মরণ করিয়া কাঁদিবে তখন তিনি বলিবেন যে, আমার বীরবাহুর মৃত্যু হয় নাই তো তিনি অমর হইয়াছেন, না সারণ তাঁহাকে বুঝাইবে যে, "এ ভব মণ্ডল মায়াময়' আর তিনি উত্তর দিবেন, "তাহা জানি তবু জেনে শুনে কাঁদে এ পরাণ অবোধ!' যখন রাবণ রীববাহুর মৃতকায় দেখিয়া বলিতেছেন, "যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ কুমার, বীরকুলসাধ এ শয়নে সদা' তখন মনে করিলাম, বুঝি এতক্ষণে মন্দোদরীর পরিবর্তে রাবণকে পাইলাম, কিন্তু তাহা নয়, আবার রাবণ কাঁদিয়া উঠিলেন। রাবণের সহিত যদি বৃত্রসংহারের বৃত্রের তুলনা করা যায় তবে স্বীকার করিতে হয় যে, রাবণের অপেক্ষা বৃত্রের মহান ভাব আছে। বৃত্র সভায় প্রবেশ করিবামাত্র কবি তাহার চিত্র আমাদের সম্মুখে ধরিলেন, তাহা দেখিয়াই বৃত্রকে প্রকাণ্ড দৈত্য বলিয়া চিনিতে পারিলাম।

 

                        নিবিড় দেহের বর্ণ মেঘের আভাস

                        পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ।

                        নিশান্তে গগনপথে ভানুর ছটায়

                        বৃত্রাসুর প্রবেশিল তেমতি সভায়।

                        ভ্রূকুটি করিয়া দর্পে ইন্দ্রাসন-'পরে

                        বসিল, কাঁপিল গৃহ দৈত্যপদভরে।

 

 

মেঘনাদবধের প্রথম সর্গের উপসংহার ভাগে যখন ইন্দ্রজিৎ রাবণের নিকট যুদ্ধে যাইবার প্রার্থনা করিলেন, তখন রাবণ কহিলেন, "এ কাল সমরে নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা বারংবার'। কিন্তু বৃত্রপুত্র রুদ্রপীড় যখন পিতার নিকট সেনাপতি হইবার প্রার্থনা করিলেন তখন বৃত্র কহিলেন,

 

                        রুদ্রপীড়! তব চিত্তে যত অভিলাষ,

                        পূর্ণ কর যশোরশ্মি বাঁধিয়া কিরীটে;

                        বাসনা আমার নাই করিতে হরণ

                        তোমার সে যশঃপ্রভা পুত্র যশোধর!

                        ত্রিলোকে হয়েছ ধন্য, আরও ধন্য হও

                        দৈত্যকুল উজ্জ্বলিয়া, দানবতিলক!

                        তবে যে বৃত্রের চিত্রে সমরের সাধ

                        অদ্যাপি প্রজ্বল এত, হেতু সে তাহার

                        যশোলিপ্সা নহে, পুত্র, অন্য সে লালসা,

                        নারি ব্যক্ত করিবারে বাক্যে বিন্যাসিয়া।

                        অনন্ত তরঙ্গময় সাগর গর্জন,

                        বেলাগর্ভে দাঁড়াইলে, যথা সুখকর;

                        গভীর শর্বরীযোগে গাঢ় ঘনঘটা

                        বিদ্যুতে বিদীর্ণ হয়, দেখিলে যে সুখ;

                        কিংবা সে গঙ্গোত্রীপার্শ্বে একাকী দাঁড়ায়ে

                        নিরখি যখন অম্বুরাশি ঘোর-নাদে

                        পড়িছে পর্বতশৃঙ্গ স্রোতে বিলুণ্ঠিয়া,

                        ধরাধর ধরাতল করিয়া কম্পিত!

                        তখন অন্তরে যথা, শরীর পুলকি,

                        দুর্জয় উৎসাহে হয় সুখ বিমিশ্রিত;

                        সমরতরঙ্গে পশি, খেলি যদি সদা,

                        সেই সুখ চিত্তে মম হয় রে উত্থিত।

 

 

ইহার মধ্যে ভয়ভাবনা কিছুই নাই, বীরোচিত তেজ। মেঘনাদবধ কাব্যে অনেকগুলি "প্রভঞ্জন' "কলম্বকুল' প্রভৃতি দীর্ঘপ্রস্থ কথায় সজ্জিত ছত্রসমূহ পাঠ করিয়া তোমার মন ভারগ্রস্ত হইয়া যাইবে, কিন্তু এমন ভাবপ্রধান বীরোচিত বাক্য অল্পই খুঁজিয়া পাইবে। অনেক পাঠকের স্বভাব আছে যে তাঁহারা চরিত্রে চিত্রে কী অভাব কী হীনতা আছে তাহা দেখিবেন না, কথার আড়ম্বরে তাঁহারা ভাসিয়া যান, কবিতার হৃদয় দেখেন না, কবিতার শরীর দেখেন। তাঁহারা রাবণের ক্রন্দন অশ্রু আকর্ষণ করিলেই তৃপ্ত হন, কিন্তু রাবণের ক্রন্দন করা উচিত কি না তাহা দেখিতে চান না, এইজন্যই বঙ্গদেশময় মেঘনাদবধের এত সুখ্যাতি। আমরা দেখিতেছি কোনো কোনো পাঠক ভাবিয়া ভাবিয়া মাথা ঘুরাইবেন যে, সমালোচক রাবণকে কেন তাহার কাঁদিবার অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতে চাহেন? একজন চিত্রকর একটি কালীর মূর্তি অঙ্কিত করিয়াছিল, আমি সেই মূর্তিটি দেখিয়াছিলাম; পাঠকেরা জানেন পুরাণে কালীর কীরূপ ভীষণ চিত্রই অঙ্কিত আছে, অমাবস্যার অন্ধকার নিশীথে যাঁহার পূজা হয়, আলুলিত কুন্তলে বিকট হাস্যে যিনি শ্মশানভূমিতে নৃত্য করেন, নরমুণ্ডমালা যাঁহার ভূষণ, ডাকিনী যোগিনীগণ যাঁহার সঙ্গিনী, এমন কালীর চিত্র আঁকিয়া চিত্রকর তাঁহাকে আপাদমস্তক স্বর্ণালংকারে বিভূষিত করিয়াছে, অনেক কৃতবিদ্য ব্যক্তি এই চিত্রটির বড়োই প্রশংসা করিয়াছিলেন, যাঁহারা সংহারশক্তিরূপিণী কালিকার স্বর্ণভূষণে কোনো দোষ দেখিতে পান না তাঁহারা রাবণের ক্রন্দনে কী দোষ আছে ভাবিয়া পাইবেন না, কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, তাঁহাদের জন্য এই সমালোচনা লিখিত হইতেছে না। মূল কথা এই, বঙ্গদেশে এখন এমনই সৃষ্টিছাড়া শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত হইয়াছে যে তাহাতে শিক্ষিতেরা বিজ্ঞান-দর্শনের কতকগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সাল-ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলী মুখস্থ করিতে পারিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাতে তাঁহাদের রুচিরও উন্নতি করিতে পারেন নাই বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও শিখেন নাই। বাল্মীকির রামায়ণে শোকের সময় রাবণের কীরূপ অবস্থা বর্ণিত আছে, এ স্থলে তাহা অনুবাদ করিয়া পাঠকদের গোচরার্থে লিখিলাম, ইহাতে পাঠকেরা দেখিবেন বাল্মীকির রাবণ হইতে মেঘনাদবধের রাবণের কত বিভিন্নতা।

 

অনন্তর হনুমান-কর্তৃক অক্ষ নিহত হইলে রাক্ষসাধিপতি মনঃসমাধানপূর্বক শোক সংবরণ করিয়া ইন্দ্রজিৎকে রণে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন। মনঃসমাধানপূর্বক শোক সংবরণ করার মধ্যে রাবণের যে মহান ভাব প্রকাশিত হইতেছে, তাহা যদি ইংরাজি-পুথি-সর্বস্ব-পাঠকেরা দেশীয় কবি বাল্মীকি লিখিয়াছেন বলিয়া বুঝিতে না পারেন, এইজন্য ইংরাজি কবি মিলটন হইতে তাহার আংশিক সাদৃশ্য উদ্‌ধৃত করিয়া দিতেছি,

 

Thrice he essay'd and thrice, in spite of scorn,

Tears, such as angels weep, burst forth : --

 

 

ধূম্রাক্ষ নিহত হইয়াছেন শুনিয়া রাবণ ক্রোধে হতজ্ঞান হইয়া কৃতাঞ্জলিবদ্ধ সৈন্যাধ্যক্ষকে কহিলেন, অকম্পনকে সেনাপতি করিয়া শীঘ্র যুদ্ধবিশারদ ঘোরদর্শন দুর্ধর্ষ রাক্ষসগণ যুদ্ধার্থে নির্গত হউক।

 

অতঃপর ক্রুদ্ধ রাবণ অকম্পন হত হইয়াছেন শুনিয়া কিঞ্চিৎ দীনভাবে চিন্তা করিতে লাগিলেন। রাক্ষসপতি মুহূর্তকাল মন্ত্রীদিগের সহিত চিন্তা করিয়া ক্রোধে উষ্ণ নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে গৃহ হইতে নির্গত হইলেন।

 

অতিকায় নিহত হইলে তাহাদের বচন শুনিয়া শোকবিহ্বল, বন্ধুনাশবিচেতন, আকুল রাবণ কিছুই উত্তর দিলেন না। সেই রাক্ষসশ্রেষ্ঠকে শোকাভিপ্লুত দেখিয়া কেহই কিছু কহিলেন না; সকলেই চিন্তামগ্ন হইয়া রহিলেন।

 

নিকুম্ভ ও কুম্ভ হত হইয়াছেন শুনিয়া রাবণ ক্রোধে প্রজ্বলিত অনলের ন্যায় হইলেন।

 

স্ববল ক্ষয় এবং বিরূপাক্ষবধ শ্রবণে রাক্ষসেশ্বর রাবণ দ্বিগুণ ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন। এইসকল বর্ণনায় শোকের অপেক্ষা ক্রোধের ভাব অধিক ব্যক্ত হইয়াছে।

 

ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে যাইবার নিমিত্ত পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিলে রাবণ কহিলেন,

 

                    কুম্ভকর্ণ বলি

                        ভাই মম, তায় আমি জাগানু অকালে

                    ভয়ে; হায় দেহ তার, দেখো সিন্ধুতীরে

                    ভূপতিত, গিরিশৃঙ্গ কিংবা তরু যথা

                    বজ্রাঘাতে

 

 

বজ্রাঘাতে ভূপতিত গিরিশৃঙ্গসম, এই উদাহরণটি তো বেশ হইল, কিন্তু আবার "কিংবা তরু' দিয়া কমাইবার কী প্রয়োজন ছিল, যেন কবি গিরিশৃঙ্গেও প্রকাণ্ডভাব বুঝাইতে না পারিয়া "কিংবা তরু' দিয়া আরও উচ্চ করিয়াছেন।

 

                                তবে যদি একান্ত সমরে

                         ইচ্ছা তব, বৎস, আগে পূজ ইষ্টদেবে

 

 

প্রভৃতি বলিয়া রাবণ ইন্দ্রজিৎকে সেনাপতিপদে বরণ করিলেন, তখন বন্দীদের একটি গানের পর প্রথম সর্গ শেষ হইল।

 

সপ্তম সর্গে বর্ণিত আছে, মহাদেব রাবণকে ইন্দ্রজিতের নিধনবার্তা জানাইতে ও রুদ্রতেজে পূর্ণ করিতে বীরভদ্রকে রাবণসমীপে প্রেরণ করিলেন।

 

                    চলিলা আকাশপথে বীরভদ্র বলী

                    ভীমাকৃতি; ব্যোমচর নামিলা চৌদিকে

                    সভয়ে, সৌন্দর্যতেজে হীনতেজা রবি,

                    সুধাংশু নিরংশু যথা সে রবির তেজে।

                    ভয়ংকরী শূল ছায়া পড়িল ভূতলে।

                    গম্ভীর নিনাদে নাদি অম্বুরাশিপতি

                    পূজিলা ভৈরব দূতে। উতরিলা রথী

                    রক্ষঃপুরে; পদচাপে থর থর থরি

                    কাঁপিল কনকলঙ্কা, বৃক্ষশাখা যথা

                    পক্ষীন্দ্র গরুড় বৃক্ষে পড়ে উড়ি যবে।

 

 

মেঘনাদবধ কাব্যে মহান ভাবোত্তেজক যে তিন-চারিটি মাত্র বর্ণনা আছে তন্মধ্যে ইহাও একটি। রাবণের সভায় গিয়া এই "সন্দেশবহ' ইন্দ্রজিতের নিধনবার্তা নিবেদন করিল, অমনি রাবণ মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন; রুদ্রতেজে বীরভদ্রবলী রাবণের মূর্ছাভঙ্গ করিলেন। পরে বীরভদ্র যুদ্ধের বিবরণ বিস্তারিত রূপে বর্ণনা করিয়া কহিলেন,

 

                        প্রফুল্ল হায় কিংশুক যেমনি

                        ভূপতিত, বনমাঝে, প্রভঞ্জনবলে

                        মন্দিরে দেখিনু শূরে।

 

 

বায়ুবলচ্ছিন্ন কিংশুক ফুলটির মতো গৃত মহাবীর মেঘনাদ পড়িয়া আছেন, ইহা তো সমুচিত তুলনা হইল না। একটি মৃত বালিকার দেহ দেখিয়া তুমি ওইরূপ বলিতে পারিতে! নহিলে দূতের বাক্য মর্মস্পৃক্‌ হইয়াছে। পরে দূত উপরি-উক্ত কথাগুলি বলিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। এইবার রাবণ গর্জিয়া উঠিলেন--

 

                        এ কনক-পুরে,

                        ধনুর্ধর আছে যত সাজো শীঘ্র করি

                        চতুরঙ্গে! রণরঙ্গে ভুলিব এ জ্বালা

                        এ বিষয় জ্বালা যদি পারিবে ভুলিতে!

 

 

পাঠকেরা বলিবেন এইবার তো হইয়াছে; এইবার তো রাবণ প্রতিহিংসাকে শোকের ঔষধি করিয়াছেন কিন্তু পাঠক হয়তো দেখেন নাই "তেজস্বী আজি মহারুদ্র তেজে' রাবণ স্বভাবত তো এত তেজস্বী নন, তিনি মহারুদ্রতেজ পাইয়াছেন, সেইজন্য আজ উন্মত্ত। কবি বীরবাহুর শোকে রাবণকে স্ত্রীলোকের ন্যায় কাঁদাইয়াছেন, সুতরাং ভাবিলেন যে রাবণের যেরূপ স্বভাব, তিনি তাঁহার প্রিয়তম পুত্র ইন্দ্রজিতের নিধনবার্তা শুনিলে বাঁচিবেন কীরূপে? এই নিমিত্তই রুদ্রতেজাদির কল্পনা করেন। ইহাতেও রাবণ যে স্ত্রীলোক সেই স্ত্রীলোকই রহিলেন। এই নিমিত্ত ইহার পর রাবণ যে যে স্থলে তেজস্বিতা দেখাইয়াছেন তাহা তাঁহার স্বভাবগুণে নহে তাহা দেব-তেজের গুণে।

 

মেঘনাদবধ কাব্যে কবি যে ইচ্ছাপূর্বক রাক্ষসপতি রাবণকে ক্ষুদ্রতম মনুষ্য করিয়া চিত্রিত করিয়াছেন, তাহা নয়। রাবণকে তিনি মহান চরিত্রের আদর্শ করিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাকে স্ত্রীপ্রকৃতির প্রতিমা করিয়া তুলিয়াছেন; তিনি তাহাকে কঠোর হিমাদ্রিসদৃশ করিতে চাহিয়াছিলেন কিন্তু "কোমল সে ফুলসম' করিয়া গড়িয়াছেন। ইহা আমরা অনুমান করিয়া বলিতেছি না, মাইকেল আমাদের কোনো সম্ভ্রান্ত বন্ধুকে যে পত্র লিখেন তাহার নিম্নলিখিত অনুবাদটি পাঠ করিয়া দেখুন।

 

"এখানকার লোকেরা অসন্তোষের সহিত বলিয়া থাকে যে, মেঘনাদবধ কাব্যে কবির মনের টান রাক্ষসদিগের প্রতি! বাস্তবিক তাহাই বটে। আমি রাম এবং তাঁহার দলবলগুলোকে ঘৃণা করি, রাবণের ভাব মনে করিলে আমার কল্পনা প্রজ্বলিত ও উন্নত হইয়া উঠে। রাবণ লোকটা খুব জমকালো ছিল।'

 

মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণের চরিত্র যেরূপ চিত্রিত হইয়াছে তাহাই যদি কবির কল্পনার চরম উন্নতি হইয়া থাকে তবে তিনি কাব্যের প্রারম্ভভাগে "মধুকরী কল্পনা দেবীর' যে এত করিয়া আরাধনা করিয়াছিলেন তাহার ফল কী হইল? এইখানে আমরা রাবণকে অবসর দিলাম।

 

আমরা গতবারে যখন রাবণের চরিত্র সমালোচনা করিয়াছিলাম, তখন মনে করিলাম যে, রাবণের ক্রন্দন করা যে অস্বাভাবিক, ইহা বুঝাইতে বড়ো একটা অধিক প্রয়াস পাইতে হইবে না; কিন্তু এখন দেখিলাম বড়ো গোল বাধিয়াছে; কেহ কেহ বলিতেছেন "রাবণ পুত্রশোকে কাঁদিয়াছে, তবেই তো তাহার বড়ো অপরাধ!' পুত্রশোকে বীরের কীরূপ অবস্থা হয়, তাঁহারা আপনা-আপনাকেই তাহার আদর্শস্বরূপ করিয়াছেন। ইঁহাদের একটু ভালো করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া আবশ্যক বোধ করিতেছি। পাঠকদের কেহ বা ইচ্ছা করিয়া বুঝিবেন না, তাঁহাদের সঙ্গে যোঝাযুঝি করা আমাদের কর্ম নহে, তবে যাঁহারা সত্য অপ্রিয় হইলেও গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত আছেন তাঁহারা আর-একটু চিন্তা করিয়া দেখুন।

 

সেনাপতি সিউয়ার্ডের পুত্র যুদ্ধে হত হইলে রস্‌ আসিয়া তাঁহাকে নিধন সংবাদ দিলেন। সিউয়ার্ড জিজ্ঞাসা করিলেন, "সম্মুখভাগেই তো তিনি আহত হইয়াছিলেন?'

 

রস।-- হাঁ, সম্মুখেই আহত হইয়াছিলেন।

 

সিউয়ার্ড।-- তবে আর কি! আমার যতগুলি কেশ আছে ততগুলি যদি পুত্র থাকিত, তবে তাহাদের জন্য ইহা অপেক্ষা উত্তম মৃত্যু প্রার্থনা করিতাম না।

 

ম্যাল্‌কম্‌।-- তাঁহার জন্য আরও অধিক শোক করা উচিত।

 

সিউয়ার্ড।-- না, তাঁহার জন্য আর অধিক শোক উপযুক্ত নহে। শুনিতেছি তিনি বীরের মতো মরিয়াছেন, ভালোই, তিনি তাঁহার ঋণ পরিশোধ করিয়াছেন, ঈশ্বর তাঁহার ভালো করুন।

 

--ম্যাক্‌বেথ

 

আমরা দেখিতেছি, মাইকেলের হস্তে যদি লেখনী থাকিত তবে এই স্থলে তিনি বলিতেন যে,

 

                    হা পুত্র, হা সিউয়ার্ড, বীরচূড়ামণি

                    কী পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে!

 

 

অ্যাডিসন তাঁহার নাটকে পুত্রশোকে কেটোকে তো ক্ষুদ্র মনুষ্যের ন্যায় রোদন করান নাই!

 

স্পার্টার বীর-মাতারা পুত্রকে যুদ্ধে বিদায় দিবার সময় বলিতেন না, যে,

 

                                      এ কাল সমরে,

                    নাহি চাহে প্রাণ মন পাঠাইতে

                    তোমা বারংবার!

 

 

তাঁহারা বলিতেন, "হয় জয় নয় মৃত্যু তোমাকে আলিঙ্গন করুক!'

 

রাণা লক্ষ্ণণসিংহ স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন যে, দ্বাদশ রাজপুত্র যুদ্ধে মরিলে জয়লাভ হইবে; তিনি তাঁহার দ্বাদশ পুত্রকেই যুদ্ধে মরিতে আদেশ করিয়াছিলেন। তিনি তো তখন রুদ্যমান পারিষদগণের দ্বারা বেষ্টিত হইয়া সভার মধ্যে

 

                                  ঝর ঝর ঝরে

                        অবিরল অশ্রুধারা তিতিয়া বসনে,

 

 

কাঁদিতে বসেন নাই।

 

রাজস্থানের বীরদিগের সহিত, স্পার্টার বীর-মাতাদের সহিত তুলনা করিলে কল্পনা-চিত্রিত রাবণকে তো স্ত্রীলোকের অধম বলিয়া মনে হয়!

 

কেহ কেহ বলেন, "অন্য কবি যাহা লিখিয়াছেন তাহাই যে মাইকেলকে লিখিতে হইবে এমন কি কিছু লেখাপড়া আছে?' আমরা তাহার উত্তর দিতে চাহি না, কেবল এই কথা বলিতে চাহি যে সকল বিষয়েই তো একটি উচ্চ আদর্শ আছে, কবির চিত্র সেই আদর্শের কত নিকটে পৌঁছিয়াছে এই দেখিয়াই তো আমাদের কাব্য আলোচনা করিতে হইবে। স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক এই দুইটি কথা লইয়া কতকগুলি পাঠক অতিশয় গণ্ডগোল করিতেছেন। তাঁহারা বলেন যাহা স্বাভাবিক তাহাই সুন্দর, তাহাই কবিতা; পুত্রশোকে রাবণকে না কাঁদাইলে অস্বাভাবিক হইত, সুতরাং কবিতার হানি হইত। দুঃখের বিষয়, তাঁহারা জানেন না যে, একজনের পক্ষে যাহা স্বাভাবিক, আর-একজনের পক্ষে তাহাই অস্বাভাবিক। যদি ম্যাক্‌বেথের ডাকিনীরা কাহারও কষ্ট দেখিয়া মমতা প্রকাশ করিত তবে তাহাই অস্বাভাবিক হইত, যদিও সাধারণ মনুষ্যদের পক্ষে তাহা স্বাভাবিক। আমি তো বলিতেছি না যে, বীর কষ্ট পাইবেন না, দুঃখ পাইবেন না; সাধারণ লোক যতখানি দুঃখ-কষ্ট পায় বীর তেমনই পাইবেন অথবা তদপেক্ষা অধিক পাইতেও পারেন, কিন্তু তাঁহার এতখানি মনের বল থাকা আবশ্যক যে, পুরুষের মতো, বীরের মতো তাহা সহ্য করিতে পারেন; শরীরের বল লইয়াই তো বীরত্ব নহে। যে ঝড়ে বৃক্ষ ভাঙিয়া ফেলে সেই ঝড়ই হিমালয়ের শৃঙ্গে আঘাত করে, অথচ তাহা তিলমাত্র বিচলিত করিতে পারে না। কেহ কেহ বলেন "ওইপ্রকার মত পূর্বেকার স্টোয়িকদিগেরই সাজিত, এখন ঊনবিংশ শতাব্দীতে ও কথা শোভা পায় না; স্টোয়িক দার্শনিক যে, অগ্নিতে হাত রাখিয়া স্থিরভাবে দহনজ্বালা সহ্য করিয়াছেন সে তাঁহাদের সময়েরই উপযুক্ত।' শিক্ষিত লোকেরা এরূপ অর্থহীন কথা যে কী করিয়া বলিতে পারেন তাহা আমরা অনেক ভাবিয়াও স্থির করিতে পারিলাম না। তাঁহারা কি বলিতে চাহেন  যে, অগ্নিতে হাত রাখিয়া ক্রন্দন করাই বীরপুরুষের উপযুক্ত! তাঁহাদের যদি এরূপ মত হয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এরূপ বীরত্বের প্রয়োজন নাই, তবে তাঁহাদের সহিত তর্ক করা এ প্রস্তাবে অপ্রাসঙ্গিক, কেবল তাঁহাদিগকে একটি সংবাদ দিতে ইচ্ছা করি যে, বাল্মীকির রামায়ণ পড়িয়া ও অন্যান্য নানাবিধ প্রমাণ পাইয়া আমরা তো এইরূপ ঠিক করিয়াছি যে রাবণ ঊনবিংশ শতাব্দীর লোক নহেন! স্টোয়িকদের ন্যায় সমস্ত মনোবৃত্তিকে নষ্ট করিয়া ফেলা যে বীরত্ব নয় তা কে অস্বীকার করিবে? যেমন বিশেষ বিশেষ রাগ-রাগিণীর বিশেষ বিশেষ বিসম্বাদী সুর আছে, সেই সেই সুর-সংযোগে সেই সেই রাগিণী নষ্ট হয় সেইরূপ এক-একটি স্বভাবের কতকগুলি বিরোধী গুণ আছে, সেই-সকল গুণ বিশেষ বিশেষ চরিত্র নষ্ট করে। বীরের পক্ষে শোকে আকুল হইয়া কাঁদিয়া গড়াগড়ি দেওয়াও সেইপ্রকার বিরোধী গুণ। যাক-- এ-সকল কথা লইয়া অধিক আন্দোলন সময় নষ্ট করা মাত্র। এখন লক্ষ্মীর চরিত্র সমালোচনা করা যাউক।

 

প্রথম সর্গের মধ্যভাগে লক্ষ্মী দেবীর অবতারণা করা হইয়াছে। পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, মেঘনাদবধে কতকগুলি চরিত্র সুচিত্রিত হয় নাই এবং কতকগুলি আমাদের মনের মতো হয় নাই। রাবণের চরিত্র যেমন আমাদের মনের মতো হয় নাই তেমনি লক্ষ্মীর চরিত্র সুচিত্রিত হয় নাই। লক্ষ্মীর চরিত্রচিত্রের দোষ এই যে, তাঁহার চরিত্র কীরূপ আমরা বলিতে পারি না। আমরা যেমন বলিতে পারি যে, মেঘনাদবধের রাবণ স্ত্রীলোকের ন্যায় কোমল-হৃদয়, অসাধারণ পুত্রবৎসল, তেমন কি লক্ষ্মীকে কিছু বিশেষণ দিতে পারি? সে বিষয় সমালোচনা করিয়াই দেখা যাউক।

 

মুরলা আসিয়া লক্ষ্মীকে যুদ্ধের বার্তা জিজ্ঞাসা করিলে, লক্ষ্মী কহিলেন,

 

                    --হায় লো স্বজনি!

                    দিন দিন হীন-বীর্য রাবণ দুর্মতি

                    যাদঃপতি রোধঃ যথা চলোর্মি আঘাতে!

 

 

শেষ ছত্রটিতে ভাবের অনুযায়ী কথা বসিয়াছে, ঠিক বোধ হইতেছে যেন তরঙ্গ বার বার আসিয়া তটভাগে আঘাত করিতেছে। মুরলা জিজ্ঞাসা করিলেন, "ইন্দ্রজিৎ কোথায়?' লক্ষ্মীর তখন মনে পড়িল যে, ইন্দ্রজিৎ প্রমোদ উদ্যানে ভ্রমণ করিতেছেন, এবং মুরলাকে বিদায় করিয়া ইন্দ্রজিতের ধাত্রীবেশ ধরিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। সেখানে ইন্দ্রজিৎকে ভ্রাতার মৃত্যু সংবাদ দিয়া যুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিলেন। এতদূর পড়িয়া আমরা দেবীকে ভক্তবৎসলা বলিতে পারি। কিন্তু আবার পরক্ষণেই ইন্দ্রের নিকট গিয়া বলিতেছেন,

 

                                                 --বহুকালাবধি

                        আছি আমি সুরনিধি স্বর্ণ লঙ্কাধামে,

                        বহুবিধ রত্ন-দানে বহু যত্ন করি,

                        পূজে মোরে রক্ষোরাজ। হায় এত দিনে

                        বাম তার প্রতি বিধি! নিজ কর্ম-দোষে

                        মজিছে সবংশে পাপী; তবুও তাহারে

                        না পারি ছাড়িতে, দেব! বন্দী যে, দেবেন্দ্র,

                        কারাগার দ্বার নাহি খুলিলে কি কভু

                        পারে সে বাহির হতে? যতদিন বাঁচে

                        রাবণ, থাকিব আমি বাঁধা তার ঘরে।

 

 

আর-এক স্থলে--

 

                        না হইলে নির্মূল সমূলে

                        রক্ষঃপতি, ভবতল রসাতলে যাবে!

 

 

অর্থাৎ তুমি কারাগারের দ্বার খুলিবার উপায় দেখো, রাবণকে বিনাশ করো, তাহা হইলেই আমি আস্তে আস্তে বাহির হইয়া আসিব। রাবণ পূজা করে বলিয়া মেঘনাদবধের লক্ষ্মীর তাহার প্রতি অত্যন্ত স্নেহ জন্মিয়াছে, এ নিমিত্ত সহজে তাহাকে ছাড়িয়া আসিতে পারেন না, ভাবিয়া ভাবিয়া একটি সহজ উপায় ঠাওরাইলেন, অর্থাৎ রাবণ সবংশে নিহত হইলেই তিনি মুক্তিলাভ করিবেন। আমাদের সহজ বুদ্ধিতে এইরূপ বোধ হয় যে, রাবণ যদি লক্ষ্মীর স্বভাবটা ভালো করিয়া বুঝিতেন ও ঘুণাক্ষরেও জানিতে পারিতেন যে লক্ষ্মী অবশেষে এইরূপ নিমকহারামি করিবেন, তবে নিতান্ত নির্বোধ না হইলে কখনোই তাঁহাকে

 

                        বহুকালাবধি

                        বহুবিধ রত্নদানে বহু যত্ন করি

 

 

পূজা করিতেন না।

 

লক্ষ্মী ইন্দ্রকে কহিতেছেন,

 

                        মেঘনাদ নামে পুত্র, হে বৃত্রবিজয়ী,

                        রাবণের, বিলক্ষণ জান তুমি তারে।

 

 

ইহার মধ্যে যে একটু তীব্র উপহাস আছে; দেবী হইয়া লক্ষ্মী ইন্দ্রকে যে এরূপ সম্বোধন করেন, ইহা আমাদের কানে ভালো শুনায় না। ওই ছত্র দুটি পড়িলেই আমরা লক্ষ্মীর যে মৃদুহাস্য বিষমাখা একটি মর্মভেদী কটাক্ষ দেখিতে পাই, তাহাতে দেবভাবের মাহাত্ম্য অনেকটা হ্রাস হইয়া যায়। লক্ষ্মী ওইরূপ আর-এক স্থলে ইন্দ্রের কৈলাসে যাইবার সময় তাঁহাকে কহিয়াছিলেন,

 

                    বড়ো ভালো বিরূপাক্ষ বাসেন লক্ষ্মীরে।

                    কহিয়ো বৈকুণ্ঠপুরী বহুদিন ছাড়ি

                    আছয়ে সে লঙ্কাপুরে! কত যে বিরলে

                    ভাবয়ে সে অবিরল, একবার তিনি,

                    কী দোষ দেখিয়া, তারে না ভাবেন মনে?

                    কোন্‌ পিতা দুহিতারে পতিগৃহ হতে

                    রাখে দূরে-- জিজ্ঞাসিয়ো, বিজ্ঞ জটাধরে।

 

 

এখানে "বিজ্ঞ জটাধর' কথাটি পিতার প্রতি কন্যার প্রয়োগ অসহনীয়। ইহার পর ষষ্ঠ সর্গে আর-এক স্থলে লক্ষ্মীকে আনা হইয়াছে। এখানে মায়া আসিয়া লক্ষ্মীকে তেজ সংবরণ করিতে বলিলেন। লক্ষ্মী কহিলেন,

 

                    কার সাধ্য, বিশ্বধ্যেয়া অবহেলে তব

                    আজ্ঞা? কিন্তু প্রাণ মন কাঁদে গো স্মরিলে

                    এ-সকল কথা! হায় কত যে আদরে

                    পূজে মোর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, রানী মন্দোদরী,

                    কী আর কহিব তার?

 

 

ইহাতে লক্ষ্মীকে অত্যন্ত ভক্তবৎসলা বলিয়া মনে হয়, তবে যেন মায়ার আজ্ঞায় ভক্তগৃহ ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছেন। আবার সপ্তম সর্গে তিনিই রাবণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতেছেন। লক্ষ্মী যে কীরূপ দেবতা তাহা আমরা বুঝিতে পারিলাম না এবং কখনো যে তাঁহাকে পূজা করিতে আমাদের সাহস হইবে, তাহারও কোনো সম্ভাবনা দেখিলাম না। মেঘনাদবধে দেবতা ও সাধারণ মনুষ্যের মধ্যে কিছুমাত্র বিভিন্নতা রক্ষিত হয় নাই। ইন্দ্রাদির চরিত্র সমালোচনা-কালে পাঠকেরা তাহার প্রমাণ পাইবেন।

 

গত সংখ্যায় সমালোচনা পড়িয়া কেহ কেহ কহিতেছেন, পুরাণে লক্ষ্মী চপলা বলিয়াই বর্ণিত আছেন। কবি যদি পুরাণেরই অনুসরণ করিয়া থাকেন তাহাতে হানি কী হইয়াছে? তাঁহাদের সহিত একবাক্য হইয়া আমরাও স্বীকার করি যে, লক্ষ্মী পুরাণে চপলারূপেই বর্ণিত হইয়াছেন; কিন্তু চপলা অর্থে কী বুঝায়? আজ আছেন, কাল নাই। পুরাণ লক্ষ্মীকে চপলা অর্থে পুরা এরূপ মনে করেন নাই, যে আমারই পূজা গ্রহণ করিবেন অথচ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিবেন। এ লুকোচুরি, কেবল দেবতা নহে মানব চরিত্রের পক্ষেও কতখানি অসম্মানজনক তাহা কি পাঠকেরা বুঝিতে পারিতেছেন না? কপটতা ও চপলতা দুইটি কথার মধ্যে যে অর্থগত প্রভেদ আছে ইহা বোধ হয় আমাদের নূতন করিয়া বুঝাইতে ইহবে না। মেঘনাদবধের লক্ষ্মীর চরিত্র-মধ্যে দুইটি দোষ আছে, প্রথম কপটতা, দ্বিতীয় পরস্পরবিরোধী ভাব। গুপ্তভাবে রাবণের শত্রুতাসাধন করাতে কপটতা এবং কখনো ভক্তবৎসলা দেখানো ও কখনো তাহার বিপরীতাচারণ করাতে পরস্পরবিরোধী ভাব প্রকাশ পাইতেছে। পাঠকেরা কেহ যদি লক্ষ্মীর পূর্বোক্তরূপ হীনচরিত্র পুরাণ হইতে বাহির করিতে পারেন তবে আমরা আমাদের ভ্রম স্বীকার করিব। কিন্তু যদিও বা পুরাণে ওইরূপ থাকে তথাপি কি রুচিবান কবির নিকট হইতে তাহা অপেক্ষা পরিমার্জিত চিত্র আশা করি না?

 

প্রথম সর্গে যখন ইন্দিরা ইন্দ্রজিৎকে তাঁহার ভ্রাতার নিধন সংবাদ শুনাইলেন তখন

 

                    ছিঁড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী

                    মেঘনাদ, ফেলাইয়া কনক বলয়

                    দূরে, পদতলে পড়ি শোভিলা কুণ্ডল,

                    যথা অশোকের ফুল অশোকের তলে

                    আভাময়! "ধিক্‌ মোরে' কহিলা গম্ভীরে

                    কুমার, "হা ধিক্‌ মোরে!' বৈরিদল বেড়ে

                    স্বর্ণলঙ্কা, হেথা আমি বামাদল মাঝে?

                    এই কি সাজে আমারে, দশাননাত্মজ

                    আমি ইন্দ্রজিৎ; আন রথ ত্বরা করি;

                    ঘুচাব এ অপবাদ বধি রিপুদলে।

 

 

ইন্দ্রজিতের তেজস্বিতা উত্তম বর্ণিত হইয়াছে। রাবণ যখন ইন্দ্রজিৎকে রণে পাঠাইতে কাতর হইতেছেন তখন

 

                        উত্তরিলা বীরদর্পে অসুরারি রিপু;

                        কি ছার সে নর, তারে ডরাও আপনি,

                        রাজেন্দ্র? থাকিতে দাস, যদি যাও রণে

                        তুমি, এ কলঙ্ক, পিতঃ, ঘুষিবে জগতে।

                        হাসিবে মেঘ বাহন, রুষিবেন দেব অগ্নি।

 

 

ইহাতেও ইন্দ্রজিতের তেজ প্রকাশিত হইতেছে, এইরূপে কবি ইন্দ্রজিতের বর্ণনা যেরূপ আরম্ভ করিয়াছেন, তাহা ভালো লাগিল।

 

                                                         সাজিলা রথীন্দ্রর্ষভ বীর আভরণে,

* * *

                                                         মেঘবর্ণ রথ, চক্র বিজলীর ছটা;

                                                         ধ্বজ ইন্দ্র চাপরূপী; তুরঙ্গম বেগে

                                                         আশুগতি।

 

 

পূর্বে কবি রোদনের সহিত ঝড়ের যেরূপ অদ্ভুত তুলনা ঘটাইয়াছিলেন এখানে সেইরূপ রথের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সহিত মেঘবিদ্যুৎ ইন্দ্রধনু বায়ুর তুলনা করিয়াছেন, কাব্যের মধ্যে এরূপ তুলনার অভাব নাই কিন্তু একটিও আমাদের ভালো লাগে না। বর্ণনীয় বিষয়কে অধিকতর পরিস্ফুট করাই তো তুলনার উদ্দেশ্য কিন্তু এই মেঘ বিজলী ইন্দ্রচাপে আমাদের রথের যে কী বিশেষ ভাবোদয় হইল বলিতে পারি না। মেঘনাদবধের অধিকাংশ রচনাই কৌশলময়, কিন্তু কবিতা যতই সরল হয় ততই উৎকৃষ্ট। রামায়ণ হোমার প্রভৃতি মহাকাব্যের অন্যান্য গুণের সহিত সমালোচকেরা তাহাদিগের সরলতারও ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন।

 

                        মানস সকাশে শোভে কৈলাশ-শিখরী

                        আভাময়, তার শিরে ভবের ভবন,

                        শিখি-পুচ্ছ চূড়া যেন মাধবের শিরে!

                        সুশ্যামাঙ্গ শৃঙ্গধর, স্বর্ণফুল শ্রেণী

                        শোভে তাহে, আহা মরি পীতধরা যেন!

                        নির্ঝর-ঝরিত বারিরাশি স্থানে স্থানে--

                        বিশদ চন্দনে যেন চর্চিত সে বপুঃ!

 

 

যে কৈলাস-শিখরী চূড়ায় বসিয়া মহাদেব ধ্যান করিতেছেন কোথায় তাহা উচ্চ হইতেও উচ্চ হইবে, কোথায় তাহার বর্ণনা শুনিলে আমাদের গাত্র রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিবে, নেত্র বিস্ফারিত হইবে, না "শিখি-পুচ্ছ চূড়া যথা মাধবের শিরে!' মাইকেল ভালো এক মাধব শিখিয়াছেন, এক শিখিপুচ্ছ, পীতধরা, বংশীধ্বনি আর রাধাকৃষ্ণ কাব্যময় ছড়াইয়াছেন। কৈলাস-শিখরের ইহা অপেক্ষা আর নীচ বর্ণনা হইতে পারে না। কোনো কবি ইহা অপেক্ষা কৈলাস-শিখরের নীচ বর্ণনা করিতে পারেন না।

 

                    শরদিন্দু পুত্র, বধূ শারদ কৌমুদী;

                    তারা কিরীটিনী নিশি সদৃশী আপনি

                    রাক্ষস-কুল-ঈশ্বরী! অশ্রুবারিধারা

                    শিশির, কপোল পর্ণে পড়িয়া শোভিল।

 

 

এই-সকল টানিয়া বুনিয়া বর্ণনা আমাদের কর্ণে অসম-ভূমি-পথে বাধা-প্রাপ্ত রথচক্রের ঘর্ঘর শব্দের ন্যায় কর্কশ লাগে।

 

                    গজরাজ তেজঃ ভুজে; অশ্বগতি পদে;

                    স্বর্ণরথ শিরঃ চূড়া; অঞ্চল পতাকা

                    রত্নময়; ভেরী, তূরী, দুন্দুভি, দামামা

                    আদি বাক্য সিংহনাদ! শেল, শক্তি, জাটি,

                    তোমর, ভোমর, শূল, মুষল, মুদগর,

                    পট্টিশ, নারাচ, কৌন্ত-- শোভে দন্তরূপে!

                    জনমিলা নয়নাগ্নি সাঁজোয়ার তেজে।

 

 

পাঠকেরা বলুন দেখি এরূপ বর্ণনা সময়ে সময়ে হাস্যজনক হইয়া পড়ে কি না!

 

যখন মেঘনাদ রথে উঠিতেছেন তখন প্রমীলা আসিয়া কাঁদিয়া কহিলেন,

 

                    কোথায় প্রাণ সখে,

                    রাখি এ দাসীরে, কহো, চলিলা আপনি?

                    কেমনে ধরিবে প্রাণ তোমার বিরহে

                    এ অভাগী? হায়, নাথ, গহন কাননে,

                    ব্রততী বাঁধিলে সাধে করি-পদ, যদি

                    তার রঙ্গরসে মনঃ না দিয়া মাতঙ্গ

                    যায় চলি, তবু তারে রাখে পদাশ্রমে

                    যূথনাথ। তবে কেন তুমি, গুণনিধি

                    ত্যজ কিঙ্করীরে আজি?

 

 

হৃদয় হইতে যে ভাব সহজে উৎসারিত উৎস-ধারার ন্যায় উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে তাহার মধ্যে কৃত্রিমতা বাক্য-কৌশল প্রভৃতি থাকে না। প্রমীলার এই "রঙ্গরসের' কথার মধ্যে গুণপনা আছে, বাক্যচাতুরীও আছে বটে, কিন্তু হৃদয়ের উচ্ছ্বাস নাই।

 

ইহার সহিত একটি স্বভাব-কবি-রচিত সহজ হৃদয়ভাবের কবিতার তুলনা করিয়া দেখো, যখন অক্রূর কৃষ্ণকে রথে লইতেছেন, তখন রাধা বলিতেছেন,

 

                    রাধারে চরণে ত্যজিলে রাধানাথ,

                    কী দোষ রাধার পাইলে?

                    শ্যাম, ভেবে দেখো মনে, তোমারি কারণে

                    ব্রজাঙ্গনাগণে উদাসী।

                    নহি অন্য ভাব, শুন হে মাধব

                             তোমারি প্রেমের প্রয়াসী।

                    ঘোরতর নিশি, যথা বাজে বাঁশি,

                             তথা আসি গোপী সকলে,

                                    দিয়ে বিসর্জন কুল শীলে।

                    এতেই হলাম দোষী,   তাই তোমায় জিজ্ঞাসি

                             এই দোষে কি হে ত্যজিলে?

                    শ্যাম, যাও মধুপুরী,         নিষেধ না করি

                             থাকো হরি যথা সুখ পাও।

                    একবার, সহাস্য বদনে       বঙ্কিম নয়নে

                             ব্রজগোপীর পানে ফিরে চাও।

                           জনমের মতো, শ্রীচরণ দুটি,

                                  হেরি হে নয়নে শ্রীহরি,

                           আর হেরিব আশা না করি।

                             হৃদয়ের ধন তুমি গোপিকার

                             হৃদে বজ্র হানি চলিলে?

                                                      --হরু ঠাকুর

 

 

ইহার মধ্যে বাক্‌চাতুরী নাই, কৃত্রিমতা নাই, ভাবিয়া চিন্তিয়া গড়িয়া পিটিয়া ঘর হইতে রাধা উপমা ভাবিয়া আইসেন নাই, সরল হৃদয়ের কথা নয়নের অশ্রুজলের ন্যায় এমন সহজে বাহির হইতেছে যে; কৃষ্ণকে তাহার অর্থ বুঝিতে কষ্ট পাইতে হয় নাই, আর মাতঙ্গ, ব্রততী, পদাশ্রম, রঙ্গরস প্রভৃতি কথা ও উপমার জড়ামড়িতে প্রমীলা হয়তো ক্ষণেকের জন্য ইন্দ্রজিৎকে ভাবাইয়া তুলিয়াছিলেন।

 

ইন্দ্রজিতের উত্তর সেইরূপ কৃত্রিমতাময়, কৌশলময়, ঠিক যেন প্রমীলা খুব এক কথা বলিয়া লইয়াছেন, তাহার তো একটা উপযুক্ত উত্তর দিতে হইবে, এইজন্য কহিতেছেন,

 

                             ইন্দ্রজিতে জিতি তুমি, সতি,

                    বেঁধেছ যে দৃঢ় বাঁধে, কে পারে খুলিতে

                    সে বাঁধে   ইত্যাদি

 

 

সমস্ত মেঘনাদবধ কাব্যে হৃদয়ের উচ্ছ্বাসময় কথা অতি অল্পই আছে, প্রায় সকলগুলিই কৌশলময়। তৃতীয় সর্গে যখন প্রমীলা রামচন্দ্রের ফটক ভেদ করিয়া ইন্দ্রজিতের নিকট আইলেন তখন ইন্দ্রজিৎ কহিলেন,

 

                        রক্তবীজে বধি তুমি এবে বিধুমুখী,

                        আইলা কৈলাস ধামে   ইত্যাদি

 

 

প্রমীলা কহিলেন,

 

                        ও পদ-প্রাসাদে, নাথ, ভববিজয়িনী

                        দাসী, কিন্তু মনমথে না পারি জিনিতে।

                        অবহেলি, শরানলে, বিরহ অনলে

                        (দুরূহ) ডরাই সদা;  ইত্যাদি

 

 

যেন স্ত্রী-পুরুষে ছড়া-কাটাকাটি চলিতেছে। পঞ্চম সর্গের শেষভাগে পুনরায় ইন্দ্রজিতের অবতারণা করা হইয়াছে।

 

                    কুসুমশয়নে যথা সুবর্ণ মন্দিরে,

                    বিরাজে রাজেন্দ্র বলী ইন্দ্রজিৎ, তথা

                    পশিল কূজন ধ্বনি সে সুখ সদনে।

                    জাগিলা বীর কুঞ্জর কুঞ্জবন গীতে।

                    প্রমীলার করপদ্ম করপদ্মে ধরি

                    রথীন্দ্র, মধুর স্বরে, হায় রে, যেমতি

                    নলিনীর কানে অলি কহে গুঞ্জরিয়া

                    প্রেমের রহস্য কথা, কহিলা (আদরে

                    চুম্বি নিমীলিত আঁখি) ডাকিছে কূজনে,

                    হৈমবতী উষা তুমি, রূপসি, তোমারে

                    পাখিকুল! মিল প্রিয়ে, কমললোচন।

                    উঠ, চিরানন্দ মোর, সূর্যকান্ত মণি-

                    সম এ পরান কান্তা, তুমি রবিচ্ছবি;--

                    তেজোহীন আমি তুমি মুদিলে নয়ন।

                    ভাগ্যবৃক্ষে ফলোত্তম তুমি হে জগতে

                    আমার! নয়নতারা! মহার্ঘরতন।

                    উঠি দেখো শশিমুখি, কেমনে ফুটিছে,

                    চুরি করি কান্তি তব মঞ্জুকুঞ্জবনে

                    কুসুম!   ইত্যাদি।

 

 

এই দৃশ্যে মেঘনাদের কোমলতা সুন্দর বর্ণিত হইয়াছে। প্রমীলার নিকট হইতে ইন্দ্রজিতের বিদায়টি সুন্দর হইয়াছে, তাহার মধ্যে বাক্‌চাতুরী কিছুমাত্র নাই। কিন্তু আবার একটি "যথা' আসিয়াছে--

 

                    যথা যবে কুসুমেষু ইন্দ্রের আদেশে

                    রতিরে ছাড়িয়া শূর, চলিলা কুক্ষণে

                    ভাঙিতে শিবের ধ্যান; হায় রে, তেমতি

                    চলিলা কন্দর্পরূপী ইন্দ্রজিৎ বলী,

                    ছাড়িয়া রতি-প্রতিমা প্রমীলা সতীরে।

                    কুলগ্নে করিলা যাত্রা মদন; কুলগ্নে

                    করি যাত্রা গেলা চলি মেঘনাদ বলী--

                    বিলাপিলা যথা রতি প্রমীলা যুবতী।             ইত্যাদি

 

 

বলপূর্বক ইন্দ্রজিৎকে মদন ও প্রমীলাকে রতি করিতেই হইবে। রতির ন্যায় প্রমীলাকে ছাড়িয়া মদনের ন্যায় ইন্দ্রজিৎ চলিলেন, মদন কুলগ্নে যাত্রা করিয়াছিলেন, ইন্দ্রজিৎও তাহাই করিলেন। তখন মদন ও ইন্দ্রজিৎ একই মিলিয়া গেল, আর রতিও কাঁদিয়াছিলেন, রতিরূপিনী প্রমীলাও কাঁদিলেন, তবে তো রতি আর প্রমীলার কিছুমাত্র ভিন্নতা রহিল না।

 

আবার আর-একটি কৃত্রিমতাময় রোদন আসিয়াছে, যখন ইন্দ্রজিৎ গজেন্দ্রগমনে যুদ্ধে যাইতেছেন তখন প্রমীলা তাঁহাকে দেখিতেছেন আর কহিতেছেন--

 

                    জানি আমি কেন তুই গহন কাননে

                    ভ্রমিস্‌রে গজরাজ! দেখিয়া ও গতি--

                    কী লজ্জায় আর তুই মুখ দেখাইবি,

                    অভিমানী? সরু মাজা তোর রে কে বলে,

                    রাক্ষস-কুল-হর্য্যক্ষে হেরে যার আঁখি,

                    কেশরি? তুইও তেঁই সদা বনবাসী।

                    নাশিস্‌ বারণে তুই, এ বীর-কেশরী

                    ভীম প্রহরণে রণে বিমুখে বাসরে, ইত্যাদি

 

 

এই কি হৃদয়ের ভাষা? হৃদয়ের অশ্রুজল? হেমবাবু কহিয়াছেন "বিদ্যাসুন্দর এবং অন্নদামঙ্গল ভারতচন্দ্র-রচিত সর্বোৎকৃষ্ট কাব্য, কিন্তু যাহাতে অন্তর্দাহ হয়, হৃৎকম্প হয়, তাদৃশ ভাব তাহাতে কই?' সত্য, ভারতচন্দ্রের ভাষা কৌশলময়, ভাবময় নহে, কিন্তু "জানি আমি কেন তুই' ইত্যাদি পড়িয়া আমরা ভারতচন্দ্রকে মাইকেলের নিমিত্ত সিংহাসনচ্যুত করিতে পারি না। তাহার পরে প্রমীলা যে ভগবতীর কাছে প্রার্থনা করিয়াছেন তাহা সুন্দর হইয়াছে। ইন্দ্রজিতের মৃত্যুবর্ণনা, লক্ষ্ণণের চরিত্র-সমালোচনাস্থলে আলোচিত হইবে।

 

মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্যে এই ইন্দ্রজিতের চরিত্রই সর্বাপেক্ষা সুচিত্রিত হইয়াছে। তাহাতে একাধারে কোমলতা বীরত্ব উভয় মিশ্রিত হইয়াছে।

 

ইন্দ্রজিতের যুদ্ধযাত্রার সময় আমরা প্রথমে প্রমীলার দেখা পাই, কিন্তু তখন আমরা তাঁহাকে চিনিতে পারি নাই, তৃতীয় সর্গে আমরা প্রমীলার সহিত বিশেষরূপে পরিচিত হই। প্রমীলা পতিবিরহে রোদন করিতেছেন।

 

                    উতরিলা নিশাদেবী প্রমোদ উদ্যানে।

                    শিহরি প্রমীলা সতী, মৃদু কলস্বরে,

                    বাসন্তী নামেতে সখি বসন্ত সৌরভা,

                    তার গলা ধরি কাঁদি কহিতে লাগিলা;

                    "ওই দেখো আইল লো তিমির যামিনী,

                    কাল ভুজঙ্গিনীরূপে দংশিতে আমারে,

                    বাসন্তি! কোথায় সখি, রক্ষঃ কুলপতি,

                    অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ, এ বিপত্তি কালে?'   ইত্যাদি।

 

 

পূর্বে কি বলি নাই মেঘনাদবদে হৃদয়ের কবিতা নাই, ইহার বর্ণনা সুন্দর হইতে পারে, ইহার দুই-একটি ভাব নূতন হইতে পারে, কিন্তু কবিতার মধ্যে হৃদয়ের উচ্ছ্বাস অতি অল্প। আমরা অনেক সময়ে অনেক প্রকার ভাব অনুভব করি, কিন্তু তাহার ক্রমানুযায়ী শৃঙ্খলা খুঁজিয়া পাই না, অনুভব করি অথচ কেন হইল কী হইল কিছুই ভাবিয়া পাই না, কবির অণুবীক্ষণী কল্পনা তাহা আবিষ্কার করিয়া আমাদের দেখাইয়া দেয়। হৃদয়ের প্রত্যেক তরঙ্গ প্রতি-তরঙ্গ যাঁহার কল্পনার নেত্র এড়াইতে পারে না তাঁহাকেই কবি বলি। তাঁহার রচিত হৃদয়ের গীতি আমাদের হৃদয়ে চিরপরিচিত সঙ্গীর ন্যায় প্রবেশ করে। প্রমীলার বিরহ উচ্ছ্বাস আমাদের হৃদয়ের দুয়ারে তেমন আঘাত করে না তো, কালভুজঙ্গিনী-স্বরূপ তিমিরযামিনীর কাল, চন্দ্রমার অগ্নি-কিরণও মলয়ের বিষজ্বালাময় কবিতার সহিত অস্তমিত হইয়াছে।

 

প্রমীলা বাসন্তীকে কহিলেন--

 

                    চলো, সখি, লঙ্কাপুরে যাই মোরা সবে।

 

বাসন্তী কহিল--

 

                                             কেমনে পশিবে

                    লঙ্কাপুরে আজি তুমি? অলঙ্ঘ্য সাগর-

                    সম রাঘবীয় চমূ বেড়িছে তাহায়?

                    রুষিলা দানববালা প্রমীলা রূপসী!

                    কী কহিলি, বাসন্তি? পর্বতগৃহ ছাড়ি

                    বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,

                    কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?

                    দানবনন্দিনী আমি, রক্ষঃ কুলবধূ,

                    রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী--

                    আমি কি ডরাই, সখি, ভিখারী রাঘবে?

                    পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজবলে,

                    দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমণি?

 

 

এখানটি অতি সুন্দর হইয়াছে, তেজস্বিনী প্রমীলা আমাদের চক্ষে অনলের ন্যায় প্রতিভাত হইতেছেন।

 

তৎপরে প্রমীলার যুদ্ধযাত্রার উপকরণ সজ্জিত হইল। মেঘনাদবধের যুদ্ধসজ্জা বর্ণনা, সকলগুলিই প্রায় একই প্রকার। বর্ণনাগুলিতে বাক্যের ঘনঘটা আছে, কিন্তু "বিদ্যুচ্ছটাকৃতি বিশ্বোজ্জ্বল' ভাবচ্ছটা কই? সকলগুলিতেই "মন্দুরায় হ্রেষে অশ্ব' "নাদে গজ বারী মাঝে' "কাঞ্চন কঞ্চুক বিভা' ভিন্ন আর কিছুই নাই।

 

                    চড়িল ঘোড়া একশত চেড়ি

                                   ...

                    ...হ্রেষিল অশ্ব মগন হরষে

                    দানব দলনী পদ্ম পদযুগ ধরি

                    বক্ষে, বিরূপাক্ষ সুখে নাদেন যেমতি!

 

 

শেষ দুই পঙ্‌ক্তিটি আমাদের বড়ো ভালো লাগিল না; এক তো কালিকার পদযুগ বক্ষে ধরিয়া বিরূপাক্ষ নাদেন এ কথা কোনো শাস্ত্রে পড়ি নাই। দ্বিতীয়ত, কালিকার পদযুগ বক্ষে ধরিয়া মহাদেব চিৎকার করিতে থাকেন এ ভাবটি অতিশয় হাস্যজনক। তৃতীয়ত "নাদেন' শব্দটি আমাদের কানে ভালো লাগে না। প্রমীলা সখীবৃন্দকে সম্ভাষণ করিয়া বলিতেছেন--

 

                    লঙ্কাপুরে, শুন লো দানবী

                    অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ বন্দীসম এবে।

                    কেন যে দাসীরে ভুলি বিলম্বেন তথা

                    প্রাণনাথ, কিছু আমি না পারি বুঝিতে?

                    যাইব তাঁহার পাশে, পশিব নগরে

                    বিকট কটক কাটি, জিনি ভুজবলে

                    রঘুশ্রেষ্ঠে;-- এ প্রতিজ্ঞা, বীরাঙ্গনা, মম,

                    নতুবা মরিব রণে-- যা থাকে কপালে!

                    দানব-কুল-সম্ভবা আমরা, দানবী;--

                    দানব কুলের বিধি বধিতে সমরে,

                    দ্বিষৎ শোণিত-নদে নতুবা ডুবিতে!

                    অধরে ধরিলা মধু গরল লোচনে

                    আমরা, নাহি কি বল এ ভুজ-মৃণালে?

                    চলো সবে রাঘবের হেরি বীর-পনা

                    দেখিবে যে রূপ দেখি শূর্পণখা পিসি

                    মাতিল মদন মদে পঞ্চবটী বনে; ইত্যাদি

 

 

প্রমীলা লঙ্কায় যাউন-না কেন, বিকট কটক কাটিয়া রঘুশ্রেষ্ঠকে পরাজিত করুন-না কেন, তাহাতে তো আমাদের কোনো আপত্তি নাই, কিন্তু শূর্পণখা পিসির মদনদেবের কথা, নয়নের গরল, অধরের মধু লইয়া সখীদের সহিত ইয়ার্‌কি দেওয়াটা কেন? যখন কবি বলিয়াছেন--

 

                    কী কহিলে বাসন্তি? পর্বতগৃহ ছাড়ি

                    বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,

                    কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?

 

 

যখন কবি বলিয়াছেন-- "রোষে লাজ ভয় ত্যজি, সাজে তেজস্বিনী প্রমীলা।' তখন আমরা যে প্রমীলার জলন্ত অনলের ন্যায় তেজোময় গর্বিত উগ্র মূর্তি দেখিয়াছিলাম, এই হাস্য-পরিহাসের স্রোতে তাহা আমাদের মন হইতে অপসৃত হইয়া যায়। প্রমীলা এই যে চোক্‌ ঠারিয়া মুচকি হাসিয়া ঢল ঢল ভাবে রসিকতা করিতেছেন, আমাদের চক্ষে ইহা কোনোমতে ভালো লাগে না!

 

                    একেবারে শত শঙ্খ ধরি

                    ধ্বনিলা, টঙ্কারি রোষে শত ভীম ধনু

                    স্ত্রীবৃন্দ, কাঁপিল লঙ্কা আতঙ্কে, কাঁপিল

                    মাতঙ্গে নিষাদী, রথে রথী তুরঙ্গমে

                    সাদীবর; সিংহাসনে রাজা; অবরোধে

                    কুলবধূ; বিহঙ্গম কাঁপিল কুলায়ে;

                    পর্বত গহ্বরে সিংহ; বনহস্তী বনে;

                    ডুবিল অতল জলে জলচর যত।

 

 

সুন্দর হইয়াছে। পশ্চিম দুয়ারে যাইতেই হনু গর্জিয়া উঠিল। অমনি "নৃমুণ্ড মালিনী সখি (উগ্রচণ্ডাধনী)' রোষে হুংকারিয়া সীতানাথকে সংবাদ দিতে কহিলেন। হনুমান অগ্রসর হইয়া সভয়ে প্রমীলাকে দেখিল, এবং মনে মনে কহিল--

 

                    অলঙ্ঘ্য সাগর লঙ্ঘি, উতরিনু যবে

                    লঙ্কাপুরে, ভয়ংকরী হেরিনু ভীমারে,

                    প্রচণ্ডা খর্পর খণ্ডা হাতে মুণ্ডমালী।

                    দানব নন্দিনী যত মন্দোদরী আদি

                    রাবণের প্রণয়িনী, দেখিনু তা সবে।

                    রক্ষঃ-কুল-বালা-দলে, রক্ষঃ কুল-বধূ

                    (শশিকলা সমরূপে) ঘোর নিশাকালে,

                    দেখিনু সকলে একা ফিরি ঘরে ঘরে।

                    দেখিনু অশোক বনে (হায় শোকাকুলা)

                    রঘুকুল কমলেরে,-- কিন্তু নাহি হেরি

                    এ হেন রূপ-মাধুরী কভু এ ভুবনে।

 

 

ভয়ংকরী ভীমা প্রচণ্ড খর্পর খণ্ডা হাতে মুণ্ডমালী এবং রক্ষঃকুলবালাদল শশিকলাসমরূপে, অশোক বনে শোকাকুল রঘুকুলকমল, পাশাপাশি বসিতে পারে না। কবির যদি প্রমীলাকে ভয়ংকরী করিবার অভিপ্রায় ছিল, তবে শশিকলাসম রূপবতী রক্ষঃকুলবালা এবং রঘুকুলকমলকে ত্যাগ করিলেই ভালো হইত। কিংবা যদি তাঁহাকে রূপমাধুরী-সম্পন্না করিবার ইচ্ছা ছিল তবে খর্পর খণ্ডা হস্তে মুণ্ডমালীকে পরিত্যাগ করাই উচিত ছিল।

 

প্রমীলা রামের নিকট নৃমুণ্ডমালিনী-আকৃতি নৃমুণ্ডমালিনীকে দূতী স্বরূপে প্রেরণ করিলেন,

 

                    চমকিলা বীরবৃন্দ হেরিয়া বামারে,

                    চমকে গৃহস্থ যথা ঘোর নিশাকালে

                    হেরি অগ্নিশিখা ঘরে! হাসিলা ভামিনী

                    মনে মনে। এক দৃষ্টে চাহে বীর যত

                    দড়ে রড়ে জড় সবে হয়ে স্থানে স্থানে।

                    বাজিল নূপুর পায়ে কাঞ্চি কটিদেশে।

                    ভীমাকার শূল করে, চলে নিতম্বিনী

                    জরজরি সর্ব জনে কটাক্ষের শরে

                    তীক্ষ্ণতর।

 

 

আমরা ভয়ে জড়সড় হইব, না কটাক্ষে জর-জর হইব এই এক সমস্যায় পড়িলাম।

 

                        নব মাতঙ্গিনী গতি চলিলা রঙ্গিণী,

                        আলো করি দশদিশ, কৌমুদী যেমতি,

                        কুমুদিনী সখী, ঝরেন বিমল সলিলে,

                        কিংবা উষা অংশময়ী গিরিশৃঙ্গ মাঝে।

 

 

নৃমুণ্ডমালিনী আকৃতি উগ্রচণ্ডাধনীও বিমল কৌমুদী ও অংশুময়ী উষা হইয়া দাঁড়াইল! এবং এই অংশুময়ী উষা ও বিমল কৌমুদীকেই দেখিয়া প্রফুল্ল না হইয়া রামের বীর সকল দড়ে রড়ে জড়োসড়ো হইয়া গিয়াছিল।

 

                    হেন কালে হনু সহ উত্তরিলা দূতী

                    শিবিরে। প্রণমি বামা কৃতাঞ্জলি পুটে,

                    (ছত্রিশ রাগিণী যেন মিলি এক তানে)

                    কহিলা--

 

 

উগ্রচণ্ডাধনী কথা কহিলে ছত্রিশ রাগিণী বাজে, মন্দ নহে!

 

                    উত্তরিলা ভীমা-রূপী; বীর শ্রেষ্ঠ তুমি,

                                        ...

                    রক্ষোবধূ মাগে রণ, দেহো রণ তারে,

                    বীরেন্দ্র। রমণী শত মোরা যাহে চাহ,

                    যুঝিবে সে একাকিনী। ধনুর্বাণ ধরো,

                    ইচ্ছা যদি, নরবর, নহে চর্ম অসি,

                    কিংবা গদা, মল্লযুদ্ধে সদা মোরা রত।

 

 

এখানে মল্লযুদ্ধের প্রস্তাবটা আমাদের ভালো লাগিল না। রাম যুদ্ধ করিতে অস্বীকার করিলে প্রমীলা লঙ্কায় গিয়া ইন্দ্রজিতের সহিত মিলিত হইলেন ও তৃতীয় সর্গ শেষ হইল। এখন আর-একটি কথা আসিতেছে, মহাকাব্যে যে-সকল উপাখ্যান লিখিত হইবে, মূল আখ্যানের ন্যায় তাহার প্রাধান্য দেওয়া উচিত নহে এবং উপাখ্যানগুলি মূল আখ্যানের সহিত অসংলগ্ন না হয়। একটি সমগ্র সর্গ লইয়া প্রমীলার প্রমোদ উদ্যান হইতে নগর প্রবেশ করার বর্ণনা লিখিত হইয়াছে তাহার অর্থ কী? এই উপাখ্যানের সহিত মূল আখ্যানের কোনো সম্পর্ক নাই, অথচ একখানা শরতের মেঘের মতো যে অমনি ভাসিয়া গেল তাহার তাৎপর্য কী? এক সর্গ ব্যাপিয়া এমন আড়ম্বর করা হইয়াছে যে আমাদের মনে হইয়াছিল যে প্রমীলা না জানি কী একটা কারখানা বাধাইবেন, অনেক হাঙ্গাম হইল।

 

                    কাঁপিল লঙ্কা আতঙ্কে, কাঁপিল

                    মাতঙ্গে নিষাদী, রথে রথী, তুরঙ্গমে

                    সাদীবর; সিংহাসনে রাজা; অবরোধে

                    কুলবধূ; বিহঙ্গম কাঁপিল কুলায়ে

                    পর্বত গহ্বরে সিংহ; বনহস্তী বনে;

 

 

নৃমুণ্ডমালিনী সখী (উগ্রচণ্ডাধনী) আইলেন, বীর সকল দড়ে রড়ে জড় হইয়া গেল। কোদণ্ড টংকার, ঘোড়া দড়বড়ি, অসির ঝন্‌ঝনি, ক্ষিতি টলমলি ইত্যাদি অনেক গোলযোগের পর হইল কী? না প্রমীলা প্রমোদ উদ্যান হইতে নগরে প্রবেশ করিলেন, একটা সমগ্র সর্গ ফুরাইয়া গেল, সে রাত্রে আবার ভয়ে রামের ঘুম হইল না। আচ্ছা পাঠক বলুন দেখি আমাদের স্বভাবত মনে হয় কিনা, যে, ইন্দ্রজিতের সহিত সাক্ষাৎ ব্যতীতও আরও কিছু প্রধান ঘটনা ঘটিবে। ইন্দ্রজিৎবধ নামক ঘটনার সহিত উপরি-উক্ত উপাখ্যানের কোনো সম্পর্ক নাই, অথচ মধ্য হইতে একটা বিষম গণ্ডগোল বাধিয়া গেল।

 

লক্ষ্মী ইন্দ্রকে আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, ইন্দ্রজিৎ! নিকুম্ভিলা যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছেন।

 

                    কহিলেন স্বরীশ্বর, "এ ঘোর বিপদে

                    বিশ্বনাথ বিনা, মাতঃ কে আর রাখিবে

                    রাঘবে? দুর্বার রণে রাবণ-নন্দন।

                    পন্নগ-অশনে নাগ নাহি ডরে যত,

                    ততোধিক ডরি তারে আমি।'

 

 

ইন্দ্র ইন্দ্রজিতের নিকট শতবার পরাজিত হইতে পারেন, কিন্তু তথাপি

 

                    পন্নগ-অশনে নাগ নাহি ডরে যত,

                    ততোধিক ডরি তারে আমি।

 

 

এ কথা তাঁহার মুখ হইতে বাহির হইতে পারে না। ইন্দ্রজিৎকে বাড়াইবার জন্য ইন্দ্রকে নত করা অন্যায় হইয়াছে; প্রতি-নায়ককে নত করিলেই যে নায়ককে উন্নত করা হয়, তাহা নহে; হিমালয়কে ভূমি অপেক্ষা উচ্চ বলিলে হিমালয়ের উচ্চত্ব প্রতিভাত হয় না, সকল পর্বত হইতে হিমালয়কে উচ্চ বলিলেই তাহাকে যথার্থ উন্নত বলিয়া বোধ হয়। একবার, দুইবার, তিনবার পরাজিত হইলে কাহার মন দমিয়া যায়? পৃথিবী বীরের। সহস্রবার অকৃতকার্য হইলেও কাহার উদ্যম টলে না? স্বর্গের দেবতার। ইন্দ্র ইন্দ্রজিতের অপেক্ষা দুর্বল হইতে পারেন, কিন্তু ভীরু কেন হইবেন? চিত্রের প্রারম্ভ ভাগেই কবি যে ইন্দ্রকে কাপুরুষ করিয়া আঁকিয়াছেন, তাহা বড়ো সুকবি-সংগত হয় নাই।

 

ইন্দ্র শচীর সহিত কৈলাস-শিখরে দুর্গার নিকটে গমন করিলেন এবং রাঘবকে রক্ষা করিতে অনুরোধ করিলেন। এক বিষয়ে আমরা ইন্দ্রের প্রতি বড়ো অসন্তুষ্ট হইলাম, পাঠকের মনে আছে যে, ইন্দ্রের কৈলাসে আসিবার সময় লক্ষ্মী প্রায় মাথার দিব্য দিয়া বলিয়া দিয়াছিলেন যে,

 

                    বড়ো ভালো বিরূপাক্ষ বাসেন লক্ষ্মীরে।

                    কহিয়ো, বৈকুণ্ঠপুরী বহুদিন ছাড়ি

                    আছয়ে সে লঙ্কাপুরে! কত যে বিরলে

                    ভাবয়ে সে অবিরল; একবার তিনি,

                    কী দোষ দেখিয়া তারে না ভাবেন মনে?

                    কোন্‌ পিতা দুহিতারে পতিগৃহ হতে

                    রাখে দূরে জিজ্ঞাসিয়ো বিজ্ঞ জটাধরে!

 

 

পাছে শিবের সহিত দেখা না হয় ও তিনি শিবের বিজ্ঞত্বের উপর যে ভয়ানক কলঙ্ক আরোপ করিয়াছেন তাহা অনর্থক নষ্ট হয়, এই নিমিত্ত তিনি বিশেষ করিয়া বলিয়াছিলেন যে--

 

                    ত্র্যম্বকে না পাও যদি, অম্বিকার পদে

                    কহিয়ো এ-সব কথা।

 

 

লক্ষ্মীর এমন সাধের অনুরোধটি ইন্দ্র পালন করেন নাই।

 

মহাদেবের পরামর্শ মতে ইন্দ্র মায়াদেবীর মন্দিরে উপস্থিত হইলেন।

 

                    সৌর-খরতর-করজাল-সংকলিত--

                    আভাময় স্বর্ণাসনে বসি কুহকিনী

                    শক্তিশ্বরী।

 

 

আমাদের মতে মায়াদেবীর আসন সৌর-খরতর-করজাল-সংকলিত না হইয়া যদি অস্ফুট অন্ধকার-কুজ্‌ঝটিকা-মণ্ডিত জলদময় হইত, তবে ভালো হইত। মায়াদেবীর নিকট হইতে দেব-অস্ত্র লইয়া ইন্দ্র রাম-সমীপে প্রেরণ করিলেন।

 

পঞ্চম সর্গে ইন্দ্রজিতের ভাবনায় ইন্দ্রের ঘুম নাই;

 

                    --কুসুম শয্যা ত্যজি, মৌন-ভাবে

                    বসেন ত্রিদিব-পতি রত্ন-সিংহাসনে;--

                    সুবর্ণ মন্দিরে সুপ্ত আর দেব যত।

 

 

দেবতাদিগের ঘুমটা না থাকিলেই ভালো হইত, যদি বা ঘুম রহিল, তবে ইন্দ্রজিতের ভয়ে ইন্দ্রের রাতটা না জাগিলেই ভালো হইত।

 

শচী ইন্দ্রের ভয় ভাঙিবার জন্য নানাবিধ প্রবোধ দিতে লাগিলেন,

 

                    "পাইয়াছ অস্ত্র কান্ত', কহিলা পৌলমী

                    অনন্ত যৌবনা, "যাহে বধিলা তারকে

                    মহাসুর তারকারি; তব ভাগ্য বলে

                    তব পক্ষ বিরূপাক্ষ; আপনি পার্বতী,

                    দাসীর সাধনে সাধ্বী কহিলা, সুসিদ্ধ

                    হবে মনোরথ কালি; মায়া দেবীশ্বরী

                    বধের বিধান কহি দিবেন আপনি;--

                    তবে এ ভাবনা নাথ কহো কী কারণে?'

 

 

কিন্তু ইন্দ্র কিছুতেই প্রবোধ মানিবার নহেন, দেব-অস্ত্র পাইয়াছেন তাহা সত্য, শিব তাঁহার পক্ষ তাহাও সত্য, কিন্তু তথাপি ইন্দ্রের বিশ্বাস হইতেছে না--

 

                             সত্য যা কহিলে,

                    দেবেন্দ্রাণি, প্রেরিয়াছি অস্ত্র লঙ্কাপুরে,

                    কিন্তু কী কৌশলে মায়া রক্ষিবে লক্ষ্ণণে

                    রক্ষোযুদ্ধে, বিশালাক্ষি, না পারে বুঝিতে।

                    জানি আমি মহাবলী সুমিত্রা নন্দন;

                    কিন্তু দন্তী কবে, দেবি, আঁটে মৃগরাজে?

                    দম্ভোলী নির্ঘোষ আমি শুনি, সুবদনে;

                    মেঘের ঘর্ঘর ঘোর; দেখি ইরম্মদে,

                    বিমানে আমার সদা বাসে সৌদামিনী;

                    তবু থর-থরি হিয়া কাঁপে, দেবি, যবে

                    নাদে রুষি মেঘনাদ,

 

 

পাঠক দেখিলেন তো, ইন্দ্র কোনোমতে শচীর সান্ত্বনা মানিলেন না।

 

                             বিষাদে বিশ্বাসি

                    নীরবিলা সুরনাথ; নিশ্বাসি বিষাদে

                    (পতিখেদে সতী প্রাণ কাঁদেরে সতত।)

                    বসিলা ত্রিদিব-দেবী দেবেন্দ্রের পাশে।

 

 

আহা, অসহায় শিশুর প্রতি আমাদের যেরূপ মমতা জন্মে, ভয় ও বিষাদে আকুল ইন্দ্র বেচারীর উপর আমাদের সেইরূপ জন্মিতেছে।

 

উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, চিত্রলেখা প্রভৃতি অপ্সরারা বিষণ্ণ ইন্দ্রকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।

 

                                সরসে যেমতি

                        সুধাকর কররাশি বেড়ে নিশাকালে

                        নীরবে মুদিত পদ্মে।

 

 

বিষণ্ণ-সৌন্দর্যের তুলনা এখানে সুন্দর হইয়াছে। কিন্তু মাইকেল যেখানেই "কিংবা' আনেন, সেইখানেই আমাদের বড়ো ভয় হয়,

 

                                কিংবা দীপাবলী--

                        অম্বিকার পীঠতলে শারদ পার্বণে

                        হর্ষে মগ্ন বঙ্গ যবে পাইয়া মায়েরে

                        চির বাঞ্ছিতা।

 

 

পূর্বকার তুলনাটির সহিত ইহা সম্পূর্ণ বিপরীত হইয়াছে, দীপাবলী, শারদপার্বণ, সমুদয়গুলিই উল্লাস-সূচক।

 

এমন সময়ে মায়াদেবী আসিয়া কহিলেন,

 

                             যাই, আদিতেয়,

                    লঙ্কাপুরে, মনোরথ তোমার পূরিব;

                    রক্ষঃকুলচূড়ামণি চূর্ণিব কৌশলে।

 

 

এতক্ষণে ইন্দ্র সান্ত্বনা পাইলেন, নিদ্রাতুরা শচী ও অপ্সরীরাও বাঁচিল, নহিলে হয়তো বেচারীদের সমস্ত রাত্রি জাগিতে হইত।

 

ইন্দ্রজিৎ হত হইয়াছেন। লক্ষ্মী ইন্দ্রালয়ে উপস্থিত হইবামাত্র ইন্দ্র আহ্লাদে উৎফুল্ল হইয়া কহিতেছেন,

 

                    দেহো পদধূলি,

                    জননি; নিঃশঙ্ক দাস তোমার প্রসাদে--

                    গত জীব রণে আজি দুরন্ত রাবণি!

                    ভুঞ্জিব স্বর্গের সুখ নিরাপদ এবে।

 

 

বড়ো বাড়াবাড়ি হইয়াছে; ইন্দ্রের ভীরুতা কিছু অতিরিক্ত হইয়াছে। এইবার সকলে কহিবেন যে, পুরাণে ইন্দ্রকে বড়ো সাহসী করে নাই, এক-একটি দৈত্য আসে, আর ইন্দ্র পাতালে পলায়ন করেন ও একবার ব্রহ্মা একবার মহাদেবকে সাধাসাধি করিয়া বেড়ান। তবে মাইকেলের কী অপরাধ? কিন্তু এ আপত্তি কোনো কার্যেরই নহে। মেঘনাদবধের যদি প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত পুরাণের কথা যথাযথরূপে রক্ষিত হইত, তবে তাঁহাদের কথা আমরা স্বীকার করিতাম। কত স্থানে তিনি অকারণে পুরাণ লঙ্ঘন করিয়াছেন, রাবণের মাতুল কালনেমীকে তিনি ইন্দ্রজিতের শ্বশুর করিলেন, প্রমীলার দ্বারা রামের নিকট তিনি মল্লযুদ্ধের প্রস্তাব করিয়া পাঠাইলেন, বীর চূড়ামণি রাবণকে কাপুরুষ বানাইলেন; আর যেখানে পুরাণকে মার্জিত করিবার সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন ছিল, সেখানেই পুরাণের অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন বলিয়া আমরা তাঁহাকে মার্জনা করিতে পারি না। ইন্দ্রের পর দুর্গার অবতারণা করা হইয়াছে।

 

ইন্দ্রজিতের বধোপায় অবধারিত করিবার জন্য ইন্দ্র দুর্গার নিকট উপস্থিত হইলেন। ইন্দ্রের অনুরোধে পার্বতী শিবের নিকট গমনোদ্যত হইলেন। রতিকে আহ্বান করিতেই রতি উপস্থিত হইলেন, এবং রতির পরামর্শে মোহিনী মূর্তি ধরিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

 

দুর্গা মদনকে আহ্বান করিলেন ও কহিলেন,

 

                             চলো মোর সাথে,

                    হে মন্মথ, যাব আমি যথা যোগিপতি

                    যোগে মগ্ন হবে, বাছা; চলো ত্বরা করি।

 

 

"বাছা' কহিলেন--

 

                    কেমনে মন্দির হতে, নগেন্দ্রনন্দিনি,

                    বাহিরিবা, কহো দাসে, এ মোহিনী বেশে,

                    মুহূর্তে মাতিবে, মাতঃ, জগত হেরিলে,

                    ও রূপ মাধুরী সত্য কহিনু তোমারে।

                    হিতে বিপরীত, দেবী, সত্বরে ঘটিবে।

                    সুরাসুর-বৃন্দ যবে মথি জলনাথে,

                    লভিলা অমৃত, দুষ্ট দিতিসুত যত

                    বিবাদিল দেব সহ সুধা-মধু হেতু।

                    মোহিনী মুরতি ধরি আইলা শ্রীপতি।

                    ছদ্মবেশী হৃষিকেশে ত্রিভুবন হেরি।

                    হারাইলা জ্ঞান সবে এ দাসের শরে!

                    অধর-অমৃত-আশে ভুলিলা অমৃত

                    দেব দৈত্য; নাগদল নম্রশিরঃ লাজে,

                    হেরি পৃষ্ঠদেশে বেণী, মন্দর আপনি

                    অচল হইল হেরি উচ্চ কুচ যুগে!

                    স্মরিলে সে কথা, সতি, হাসি আসে মুখে,

                    মলম্বা অম্বরে তাম্র এত শোভা যদি

                    ধরে, দেবি, ভাবি দেখো বিশুদ্ধ কাঞ্চন

                    কান্তি কত মনোহর!

 

 

"বাছা'র সহিত "মাতা'র কী চমৎকার মিষ্টালাপ হইতেছে দেখিয়াছেন? মলম্বা অম্বরের (গিলটি) উদাহরণ দিয়া, মদন কথাটি আরও কেমন রসময় করিয়া তুলিয়াছে দেখিয়াছেন? মহাদেবের নিকট পার্বতী গমন করিলেন,

 

                    মোহিত মোহিনী রূপে; কহিলা হরষে

                    পশুপতি, "কেন হেথা একাকিনী দেখি,

                    এ বিজন স্থলে তোমা, গণেন্দ্র জননি?

                    কোথায় মৃগেন্দ্র তব কিঙ্কর, শঙ্করি?

                    কোথায় বিজয়া, জয়া?' হাসি উত্তরিলা

                    সুচারু হাসিনী উমা; "এ দাসীরে ভুলি,

                    হে যোগীন্দ্র বহু দিন আছ এ বিরলে

                    তেঁই আসিয়াছি নাথ, দরশন আশে

                    পা দুখানি। যে রমণী পতিপরায়ণা,

                    সহচরী সহ সে কি যায় পতিপাশে?'

 

 

পতিপরায়ণা নারীর সহচরীর সহিত পতিসমীপে যাইতে যে নিষেধ আছে, এমন কথা আমরা কোনো ধর্মশাস্ত্রে পড়ি নাই। পুনশ্চ মহাদেবের নিকট দাসীভাবে আত্মনিবেদন করা পার্বতীর পৌরাণিক চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। উচ্চ দেব-ভাবের সহিত দম্পতির একাত্মভাবে যেরূপ সংলগ্ন হয়, উচ্চ-নীচ ভাব সেরূপ নহে।

 

রাবণের সহিত যখন কার্তিকেয়ের যুদ্ধ হইতেছে, তখন দুর্গা কাতর হইয়া সখী বিজয়াকে কহিতেছেন--

 

                    যা লো সৌদামিনী গতি,

                    নিবার কুমারে, সই। বিদরিছে হিয়া

                    আমার, লো সহচরী, হেরি রক্তধারা

                    বাছার কোমল দেহে।   ইত্যাদি।

 

 

অসুরমর্দিনী শক্তিরূপিণী ভগবতীকে "বাছার কোমল দেহে রক্তধারা' দেখিয়া এরূপ অধীর করা বড়ো সুকল্পনা নহে; পৃথিবীতে এমন নারী আছেন, যাঁহারা পুত্রকে যুদ্ধ হইতে নিরত করিবার জন্য সহচরী প্রেরণ করেন না; তবে মহাদেবী, পার্বতীকে এত ক্ষুদ্র করা কতদূর অসংগত হইয়াছে, সুরুচি পাঠকদের তাহা বুঝিবার জন্য অধিক আড়ম্বর করিতে হইবে না।

 

বাল্মীকি রামের চরিত্র-বর্ণনাকালে বলিয়াছেন, "যম ও ইন্দ্রের ন্যায় তাঁহার বল, বৃহস্পতির ন্যায় তাঁহার বুদ্ধি, পর্বতের ন্যায় তাঁহার ধৈর্য।... ক্ষোভের কারণ উপস্থিত হলেও তিনি ক্ষুব্ধ হন না। যখন কৈকয়ী রামকে বনে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন, তখন "মহানুভব রাম কৈকেয়ীর এইরূপ কঠোর বাক্য শুনিয়া কিছুমাত্র ব্যথিত ও শোকাবিষ্ট হইলেন না।... চন্দ্রের যেমন হ্রাস, সেইরূপ রাজ্যনাশ তাঁহার স্বাভাবিক শোভাকে কিছুমাত্র মলিন করিতে পারিল না! জীবন্মুক্ত যেমন সুখে দুঃখে একই ভাবে থাকেন, তিনি তদ্রূপই রহিলেন; ফলতঃ ঐ সময়ে তাঁহার চিত্ত-বিকার কাহারই অণুমাত্র লক্ষিত হইল না।... ঐ সময় দেবী কৌশল্যার অন্তঃপুরে অভিষেক-মহোৎসব-প্রসঙ্গে নানাপ্রকার আমোদ প্রমোদ হইতেছিল। রাম তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়াও এই বিপদে ধৈর্যাবলম্বন করিয়া রহিলেন। জ্যোৎস্নাপূর্ণ শারদীয় শশধর যেমন আপনার নৈসর্গিক শোভা ত্যাগ করেন না; সেইরূপ তিনিও চিরপরিচিত হর্ষ পরিত্যাগ করিলেন না।' সাধারণ্যে রামের প্রজারঞ্জন, এবং বীরত্বের ন্যায় তাঁহার অটল ধৈর্যও প্রসিদ্ধ আছে। বাল্মীকি রামকে মনুষ্যচরিত্রের পূর্ণতা অর্পণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন; তিনি তাঁহাকে কোমলতা ও বীরত্ব, দয়া ও ন্যায়, সহৃদয়তা ও ধৈর্য প্রভৃতি সকল প্রকার গুণের সামঞ্জস্য-স্থল করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। আমরা উপরি-উক্ত আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া মেঘনাদবধ কাব্যের রাম চরিত্র সমালোচনা করিব, অথবা যদি মাইকেল রাম-চরিত-চিত্রের আদিকবির অনুসরণ না করিয়া থাকেন, তবে তাহা কতদূর সংগত হইয়াছে আলোচনা করিয়া দেখিব।

 

যখন প্রমীলার দূতী নৃমুণ্ডমালিনী রামের নিকট অসি, গদা বা মল্লযুদ্ধের প্রস্তাব করিতে গেলেন, তখন রঘুপতি উত্তর দেন যে,

 

                        --শুন সুকেশিনী,

                        বিবাদ না করি আমি কভু অকারণে।

                        অরি মম রক্ষঃপতি, তোমরা সকলে

                        কুলবালা, কুলবধূ; কোন্‌ অপরাধে

                        বৈরিভাব আচরিব তোমাদের সাথে?ইত্যাদি।

 

 

তখন মনে করিলাম যে, রাম ভালোই করিয়াছেন, তিনি বীর, বীরের মর্যাদা বুঝেন; অবলা স্ত্রীলোকদের সহিত অনর্থক বিবাদ করিতেও তাঁহার ইচ্ছা নাই। তখন তো জানিতাম না যে, রাম ভয়ে যুদ্ধ করিতে সাহস করেন নাই।

 

                        দূতীর আকৃতি দেখি ডরিনু হৃদয়ে

                        রক্ষোবর! যুদ্ধসাধ ত্যজিনু তখনি।

                        মূঢ় যে ঘাঁটায় সখে হেন বাঘিনীরে।

 

 

এ রাম যে কী বলিয়া যুদ্ধ করিতে আসিয়াছেন সেই এক সমস্যা!

 

প্রমীলা তো লঙ্কায় চলিয়া যাউন, কিন্তু রামের যে ভয় হইয়াছে তাহা আর কহিবার নয়। তিনি বিভীষণকে ডাকিয়া কহিতেছেন--

 

                        এবে কী করিব, কহো, রক্ষ-কুলমণি?

                        সিংহ সহ সিংহী আসি মিলিল বিপিনে,

                        কে রাখে এ মৃগ পালে?

 

 

রামের কাঁদো কাঁদো স্বর যেন আমরা স্পষ্ট শুনিতে পাইতেছি। লক্ষ্ণণ, দাদাকে একটু প্রবোধ দিলেন; রাম বিভীষণকে কহিলেন--

 

                    কৃপা করি, রক্ষোবর, লক্ষ্ণণেরে লয়ে,

                    দুয়ারে দুয়ারে সখে, দেখো সেনাগণে।

                    কোথায় কে জাগে আজি? মহাক্লান্ত সবে

                    বীরবাহু সহ রণে।...

                    ...এ পশ্চিম দ্বারে

                    আপনি জাগিব আমি ধনুর্বাণ হাতে!

 

 

লক্ষ্ণণ ষষ্ঠ সর্গে রামকে কহিলেন--

 

                        মারি রাবণিরে, দেব, দেহো আজ্ঞা দাসে!

 

রঘুনাথ উত্তর করিলেন--

 

                        হায় রে কেমনে--

                        যে কৃতান্ত দূতে দূরে হেরি, ঊর্ধ্বশ্বাসে

                        ভয়াকুল জীবকুল ধায় বায়ুবেগে

                        প্রাণ লয়ে; দেব-নর ভস্ম যার বিষে;

                        কেমনে পাঠাই তোরে সে সর্প বিবরে,

                        প্রাণাধিক? নাহি কাজ সীতায় উদ্ধারি।

                                                             ইত্যাদি

 

 

লক্ষ্ণণ বুঝাইলেন যে, দেবতারা যখন আমাদের প্রতি সদয়, তখন কিসের ভয়। বিভীষণ কহিলেন যে, লঙ্কার রাজলক্ষ্মী তাঁহাকে স্বপ্নে কহিয়াছিলেন যে, তিনি শীঘ্রই প্রস্থান করিবেন, অতএব ভয় করিবার কোনো প্রয়োজন নাই। কিন্তু রাম কাঁদিয়া উঠিলেন--

 

                    উত্তরিলা সীতানাথ সজল নয়নে;

                    "স্মরিলে পূর্বের কথা রক্ষকুলোত্তম

                    আকুল পরান কাঁদে। কেমনে ফেলিব

                    এ ভ্রাতৃ-রতনে আমি এ অতল জলে?'

                                                              ইত্যাদি

 

 

কিছুতেই কিছু হইল না, রামের ভয় কিছুতেই ঘুচিল না, অবশেষে আকাশবাণী হইল।

 

                    উচিত কি তব, কহো হে বৈদেহীপতি,

                    সংশয়িতে দেববাক্য, দেবকুলপ্রিয়

                    তুমি?

 

 

অবশেষে আকাশে চাহিয়া দেখিলেন যে অজগরের সহিত একটা ময়ূর যুদ্ধ করিতেছে, কিন্তু যুদ্ধে অজগর জয়ী ও ময়ূর নিহত হইল। এতক্ষণে রাম শান্ত হইলেন ও লক্ষ্ণণকে যুদ্ধ-সজ্জায় সজ্জিত করিয়া দিলেন। লক্ষ্ণণ যুদ্ধে যাইবার সময় রাম একবার দেবতার কাছে প্রার্থনা করিলেন, একবার বিভীষণকে কাতরভাবে কহিলেন,

 

                    সাবধানে যাও মিত্র। অমূল রতনে

                    রামের, ভিখারী রাম অর্পিছে তোমারে,

                    রথীবর!

 

 

বিভীষণ কহিলেন, কোনো ভয় নাই। ইন্দ্রজিৎ-শোকে অধীর হইয়া যখন রাবণ সৈন্য-সজ্জায় আদেশ দিলেন, তখন রাক্ষসসৈন্য-কোলাহল শুনিয়া রাম আপনার সৈন্যাধ্যক্ষগণকে ডাকাইয়া আনিলেন ও তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন--

 

                    "পুত্রশোকে আজি

                    বিকল রাক্ষসপতি সাজিছে সত্বরে;

                                   ...

                    রাখো গো রাঘবে আজি এ ঘোর বিপদে।

                    স্ববন্ধু-বান্ধব-হীন বনবাসী আমি

                    ভাগ্য-দোষে; তোমরা হে রামের ভরসা

                    বিক্রম, প্রতাপ, রণে।...

                    কুল, মান, প্রাণ মোর রাখো হে উদ্ধারি

                    রঘুবন্ধু, রঘুবধূ বদ্ধা কারাগারে

                    রক্ষ-ছলে! স্নেহ-পণে কিনিয়াছ রামে

                    তোমরা বাঁধো হে আজি কৃতজ্ঞতাপাশে

                    রঘুবংশে, দাক্ষিণাত্য দাক্ষিণ্য প্রকাশি!'

                    নীরবিলা রঘুনাথ সজল নয়নে।

 

 

এরূপ দুগ্ধপোষ্য বালকের ন্যায় কথায় কথায় সজল নয়নে বিষম ভীরুস্বভাব রাম বনের বানরগুলাকে লইয়া এতকাল লঙ্কায় তিষ্ঠিয়া আছে কীরূপে তাহাই ভাবিতেছি।

 

লক্ষ্ণণের মৃত্যু হইলে রাম বিলাপ করিতে লাগিলেন, সে বিলাপ সম্বন্ধে আমরা অধিক কিছু বলিতে চাহি না, কেবল ইলিয়াড হইতে প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর বন্ধু পেট্রক্লসের মৃত্যুতে একিলিস যে বিলাপ করিয়াছিলেন তাহা উদ্‌ধৃত করিয়া দিলাম, পাঠকেরা বুঝিয়া লইবেন যে কীরূপ বিলাপ বীরের উপযুক্ত। একিলিস তাঁহার দেবীমাতা থেটিস্‌কে কহিতেছেন,

 

He, deeply groaning--"To this cureless grief.

Not even the Thunderer's favour brings relief.

Patroclus-- Ah!-- say, goddess, can I boast

A pleasure now? revenge itself is lost;

Patroclus, loved of all my martial train,

Beyond mankind, beyond myself, is slain!

'Tis not in fate the alternate now to give;

Patroclus dead Achilles hates to live.

Let me revenge it on proud Hector's heart,

Let his last spirit smoke upon my dart;

On these conditions will I breathe; till then,

I blush to walk among the race of men."

A flood of tears at this the goddess shed :

"Ah then, I see thee dying, see thee dead!

When Hector falls, thou diest."--"Let Hector die,

And let me fall! (Achilles made reply)

Far lies Patroclus from his native plain!

He fell, and, falling, wish'd my aid in vain.

Ah then, since from this miserable day

I cast all hope of my return away;

Since unrevenged, a hundred ghosts demand

The fate of Hector from Achilles' hand;

Since here, for brutal courage far renown'd,

I live an idle burden to the ground,

(Others in council famed for nobler skill,

More useful to preserve, than I to kill)

Let me-- But oh! ye gracious powers above!

Wrath and revenge from men and gods remove;

Far, far too dear to every mortal breast,

Sweet to the soul, as honey to the taste :

Gathering like vapours of a noxious kind

Form fiery blood, and darkening all the mind.

Me Agamemnon urged to deadly hate;

'Tis past-- I quell it; I resign to fate.

Yes-- I will meet the murderer of my friend;

Or (if the gods ordain it) meet my end.

The stroke of fate the bravest cannot shun :

The great Alcides, Jore's unequal's son,

To Juno's hate, at length resign'd his breath.

And sunk the victim of all-conquering death.

So shall Achilles fall! Stretch'd pale and dead,

No more the Grecian hope, or Trojan dread!

Let me, this instant, rush into the fields,

And reap what glory life's short harvest yields.

Shall I not force some widow'd dame to tear

With frantic hands her long dishevel'd hair?

Shall I not force her breast to heave with sighs,

And the soft tears to trickle from her eyes?

Yes, I shall give the fair those mournful charms--

In vain you hold me-- Hence! my arms, my arms!--

Soon shall the sanguine torrent spread so wide,

That all shall know, Achilles swells the tide."

 

 

রাম লক্ষ্ণণের ঔষধ আনিবার জন্য যমপুরীতে গমন করিলেন। সেখানে বালীর সহিত দেখা হইল, বালী কহিলেন--

 

                    --কী হেতু হেথা সশরীরে আজি

                    রঘুকুলচূড়ামণি? অন্যায় সমরে

                    সংহারিলে মোরে তুমি তুষিতে সুগ্রীবে;

                    কিন্তু দূর করো ভয়, এ কৃতান্ত পুরে

                    নাহি জানি ক্রোধ মোরা, জিতেন্দ্রিয় সবে।

 

 

পরে দশরথের নিকটে গেলেন;

 

                    হেরি দূরে পুত্রবরে রাজর্ষি, প্রসারি

                    বাহুযুগ, (বক্ষঃস্থল আর্দ্র অশ্রুজলে)

 

 

বালী যেমন দেহের সহিত ক্রোধ প্রভৃতি রিপু পরিত্যাগ করিয়া স্বর্গে সুখভোগ করিতেছেন, তেমনি দশরথ যদি পৃথিবীর অশ্রুজল পৃথিবীতেই রাখিয়া আসিতেন তো ভালো হইত। শরীর না থাকিলে অশ্রুজল থাকা অসম্ভব, আমরা তাহা কল্পনাও করিতে পারি না। এমন-কি, ইহার কিছু পরে রাম যখন দশরথের পদধূলি লইতে গেলেন, তখন তাঁহার পা-ই খুঁজিয়া পান নাই। এমন অশরীরী আত্মার বক্ষঃস্থল কীরূপে যে অশ্রুজলে আর্দ্র হইয়াছিল তাহা বুঝিয়া উঠা কঠিন। যাহা হউক রামের আর অধিক কিছুই নাই। রামের সম্বন্ধে আর-একটি কথা বলিবার আছে। রাম যে কথায় কথায় "ভিখারী রাম' "ভিখারী রাম' করিয়াছেন, সেগুলি আমাদের ভালো লাগে না; এইরূপে নিজের প্রতি পরের দয়া উদ্রেক করিবার চেষ্টা, অতিশয় হীনতা প্রকাশ করা মাত্র। একজন দরিদ্র বলিতে পারে "আমি ভিক্ষুক আমাকে সাহায্য করো।' একজন নিস্তেজ দুর্বল বলিতে পারে, "আমি দুর্বল, আমাকে রক্ষা করো।' কিন্তু তেজস্বী বীর সেরূপ বলিতে পারেন না; তাহাতে আবার রাম ভিখারীও নহেন, তিনি নির্বাসিত বনবাসী মাত্র।

 

                    "ভিখারী রাঘব, দূতি, বিদিত জগতে।"

                                    "অমূল রতনে

                    রামের, ভিখারী রাম অর্পিছে তোমারে।"

                    "বাঁচাও করুণাময়, ভিখারী রাঘবে।"   ইত্যাদি

 

 

যাহা হউক, রামায়ণের নায়ক মহাবীর রাম, মেঘনাদবধ কাব্যের কবি তাঁহার এ-কী দুর্দশা করিয়াছেন। তাঁহার চরিত্রে তিলমাত্র উন্নত-ভাব অর্পিত হয় নাই, এরূপ পরমুখাপেক্ষী ভীরু কোনোকালে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয় নাই। বাল্যকাল হইতে রামের প্রতি আমাদের এরূপ মমতা আছে যে, প্রিয়ব্যক্তির মিথ্যা অপবাদ শুনিলে যেরূপ কষ্ট হয়, মেঘনাদবধ কাব্যে রামের কাহিনী পড়িলে সেইরূপ কষ্ট হয়।

 

পূর্বেই বলা হইয়াছে, রামের চরিত্রে বীরত্ব ও কোমলত্ব সমানরূপে মিশ্রিত আছে। পৌরুষ এবং স্ত্রীত্ব উভয় একাধারে মিশ্রিত হইলে তবে পূর্ণ মনুষ্য সৃজিত হয়, বাল্মীকি রামকে সেইরূপ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। মেঘনাদবধে রামের কোমলতা অংশটুকু অপর্যাপ্তরূপে বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু পাঠক, এমন একটি কথাও কি পাইয়াছেন, যাহাতে তাঁহাকে বীর বলিয়া মনে হয়? প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত কেবল বিভীষণের সহিত পরামর্শ করিয়াছেন, কেবল লক্ষ্ণণের জন্য রোদন করিয়াছেন। ইন্দ্রজিতের সহিত যুদ্ধে প্রেরণ করিবার সময় সংস্কৃত রামায়ণে রাম লক্ষ্ণণকে কহিতেছেন--

 

বৎস, সেই ভয়াবহ দূরাত্মার (ইন্দ্রজিতের) সমস্ত মায়া অবগত আছি। সেই রাক্ষসাধন দিব্য অস্ত্রধারী, এবং সংগ্রামে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবগণকেও বিসংজ্ঞ করিতে পারে। সে রথে আরোহণপূর্বক অন্তরীক্ষে বিচরণ করে, এবং মেঘাচ্ছন্ন সূর্যের ন্যায় তাহার গতি কেহ জ্ঞাত হইতে পারে না। হে সত্যপরাক্রম অরিন্দম, বাণ দ্বারা সেই মহাবীর রাক্ষসকে বধ করো।

 

হে বৎস, সংগ্রামে দুর্মদ যে বীর বজ্রহস্তকেও পরাজিত করিয়াছে, হনুমান, জাম্বুবান ও ঋক্ষসৈন্য দ্বারা পরিবৃত হইয়া যাও-- তাহাকে বিনাশ করো। বিভীষণ তাহার অধিষ্ঠিত স্থানের সমস্ত অবগত আছেন, তিনিও তোমার অনুগমন করিবেন।

 

মূল রামায়ণে লক্ষ্ণণের শক্তিশেল যেরূপে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা অনুবাদিত করিয়া নিম্নে উদ্‌ধৃত করা গেল--

 

ভুজগরাজের জিহ্বার ন্যায় প্রদীপ্ত শক্তি রাবণ দ্বারা নিক্ষিপ্ত হইয়া মহাবেগে লক্ষ্ণণের বক্ষে নিপতিত হইল। লক্ষ্ণণ এই দূরপ্রবিষ্ট শক্তি দ্বারা ভিন্নহৃদয় হইয়া ভূতলে মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন। সন্নিহিত রাম তাঁহার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া ভ্রাতৃস্নেহে বিষণ্ণ হইলেন ও মুহূর্তকাল সাশ্রুনেত্রে চিন্তা করিয়া ক্রোধে যুগান্তবহ্নির ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। "এখন বিষাদের সময় নয়' বলিয়া রাম রাবণ-বধার্থ পুনর্বার যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। ওই মহাবীর অনবরত শরবর্ষণপূর্বক রাবণকে ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন। শর-জালে আকাশ পূর্ণ হইল এবং রাবণ মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন।

 

অনন্তর রাম দেখিলেন, লক্ষ্ণণ শক্তিবিদ্ধ হইয়া শোণিত-লিপ্ত-দেহে সসর্প-পর্বতের ন্যায় রণস্থলে পতিত আছেন। সুগ্রীব, অঙ্গদ ও হনুমান প্রভৃতি মহাবীরগণ লক্ষ্ণণের বক্ষঃস্থল হইতে বহু যত্নেও রাবণ-নিক্ষিপ্ত-শক্তি আকর্ষণ করিতে পারিলেন না। পরে রাম ক্রুদ্ধ হইয়া দুই হস্তে ওই ভয়াবহ শক্তি গ্রহণ ও উৎপাটন করিলেন, শক্তি উৎপাটন-কালে রাবণ তাঁহার প্রতি অনবরত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। কিন্তু মহাবীর রাম তাহা লক্ষ না করিয়া লক্ষ্ণণকে উত্থাপনপূর্বক হনুমান ও সুগ্রীবকে কহিলেন, দেখো, তোমরা লক্ষ্ণণকে পরিবেষ্টনপূর্বক এই স্থানে থাকো এবং ইহাকে অপ্রমাদে রক্ষা করো। ইহা চিরপ্রার্থিত পরাক্রম প্রকাশের অবসর। ওই সেই পাপাত্মা রাবণ, বর্ষার মেঘের ন্যায় গর্জনরত আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে। হে সৈন্যগণ, আমার প্রতিজ্ঞা শ্রবণ করো, আজ জগৎ অরাবণ বা অরাম হইবে। তোমরা কিছুতে ভীত হইয়ো না। আমি সত্যই কহিতেছি এই দুরাত্মাকে নিহত করিয়া রাজ্যনাশ, বনবাস, দণ্ডকারণ্যে পর্যটন ও জানকীবিয়োগ এই-সমস্ত ঘোরতর দুঃখ ও নরক-তুল্য-ক্লেশ নিশ্চয় বিস্মৃত হইব। আমি যাহার জন্য এই কপিসৈন্য আহরণ করিয়াছি, যাহার জন্য সুগ্রীবকে রাজা করিয়াছি, যাহার জন্য সমুদ্রে সেতুবন্ধন করিলাম, সেই পাপ আজ আমার দৃষ্টিপথে উপস্থিত, তাহাকে আজ আমি সংহার করিব। এই পামর আজ দৃষ্টিবিষ ভীষণ সর্পের দৃষ্টিতে পড়িয়াছে, কিছুতেই ইহার নিস্তার নাই। সৈন্যগণ, এক্ষণে তোমরা শৈলশিখরে উপবিষ্ট হইয়া আমাদের এই তুমুল সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করো। আমি আজ এমন ভীষণ কার্য করিব যে, অদ্যকার যুদ্ধে গন্ধর্বেরা, কিন্নরেরা, দেবরাজ ইন্দ্র, চরাচর সমস্ত লোক, স্বর্গের সমস্ত দেবতারা রামের রামত্ব প্রত্যক্ষ করিয়া যতকাল পৃথিবী রহিবে ততকাল তাহা ঘোষণা করিতে থাকিবে।

 

এই বলিয়া মহাবীর রাম মেঘ হইতে জলধারার ন্যায় শরাসন হইতে অনবরত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। উভয়পক্ষের নিক্ষিপ্ত শর গতিপথে সংঘর্ষপ্রাপ্ত হওয়াতে একটি তুমুলশব্দ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল।

 

এই তো রামায়ণ হইতে লক্ষ্ণণের পতনদৃষ্টে রামের অবস্থা বর্ণনা উদ্‌ধৃত করা গেল। এক্ষণে রামায়ণের অনুকরণ করিলে ভালো হইত কিনা, আমরা তৎসম্বন্ধে কিছু বলিতে চাহি না, পাঠকেরা তাহা বিচার করিবেন।

 

রামের নিকট বিদায় লইয়া লক্ষ্ণণ এবার যুদ্ধ করিতে যাইতেছেন, মায়ার প্রসাদে অদৃশ্য হইয়া লক্ষ্ণণ লঙ্কাপুরীতে প্রবেশ করিয়া--

 

                    হেরিলা সভয়ে বলী সর্বভুক্‌রূপী

                    বিরূপাক্ষ মহারক্ষঃ প্রক্ষেড়নধারী।

                                                     ইত্যাদি।

 

 

কবি কাব্যের স্থানে অযত্ন সহকারে, নিশ্চিন্তভাবে দুই-একটি কথা ব্যবহার করিয়াছেন, কিন্তু তাহার ফল বড়ো ভালো হয় নাই। "সভয়ে' কথাটি এখানে না ব্যবহার করিয়াও তিনি সমস্ত বর্ণনাটি সর্বাঙ্গসুন্দররূপে শেষ করিতে পারিতেন।

 

                    প্রবল পবন-বলে বলীন্দ্র পাবনি

                    হনু, অগ্রসরি শূর, দেখিলা সভয়ে

                    বীরাঙ্গনা মাঝে রঙ্গে প্রমীলা দানবী।

 

 

হনুমানের প্রমীলাকে দেখিয়া এত ভয় কেন হইল তাহা জানেন? হনুমান রাবণের প্রণয়িনীদের দেখিয়াছেন, "রক্ষঃকুলবধূ ও রক্ষঃকুলবালাদের' দেখিয়াছেন, শোকাকুলা রঘুকুলকমলকে দেখিয়াছেন, "কিন্তু এহেন রূপ-মাধুরী কভু এ ভুবনে' দেখেন নাই বলিয়াই এত সভয়! "--কুম্ভকর্ণ বলী ভাই মম, তায় আমি জাগানু অকালে ভয়ে।' যাহা হউক এরূপ সভয়ে, সত্রাসে, সজল নয়নে প্রভৃতি অনেক কথা কাব্যের অনেক স্থানে অযথারূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। এরূপ দুটি-একটি ক্ষুদ্র কথার ব্যবহার লইয়া এতটা আড়ম্বর করিতেছি কেন? তাহার অনেক কারণ আছে। তূলিকার একটি সামান্য স্পর্শ মাত্রেই চিত্রের অনেকটা এদিক-ওদিক হইয়া যায়। কবি লিখিবার সময় লক্ষ্ণণের চিত্রটি সমগ্রভাবে মনের মধ্যে অঙ্কিত করিয়া লইতে পারেন নাই; নহিলে যে লক্ষ্ণণ দর্শন ভীষণ "মূর্তি' মহাদেবকে দেখিয়া অস্ত্র উদ্যত করিয়াছিলেন, তিনি প্রক্ষেড়নধারী বিরূপাক্ষ রাক্ষসের প্রতি সভয়ে দৃষ্টিপাত করিলেন কেন? "সভয়ে' এই কথাটির ব্যবহারে আমরা লক্ষ্ণণের ভয়গ্রস্ত মুখশ্রী স্পষ্ট দেখিতেছি, ইহাতে "রঘুজ-অজ-অঙ্গজ' দশরত-তনয় সৌমিত্রির প্রতি যে আমাদের ভক্তি বাড়িতেছে তাহা নহে।

 

ইহার পরে লক্ষ্ণণের সহিত ইন্দ্রজিতের যে যুদ্ধবর্ণনা করা হইয়াছে, তাহাতে যে লক্ষ্ণণের নীচতা, কাপুরুষতা, অক্ষত্রোচিত ব্যবহার স্পষ্ট প্রকাশ পাইয়াছে-- তাহা কে অস্বীকার করিবেন? কবি তাহা ভ্রমক্রমে করেন নাই, ইচ্ছাপূর্বক করিয়াছেন, তিনি একস্থলে ইন্দ্রজিতের মুখ দিয়াই কহিয়াছেন,

 

                    ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষ্ণণ; নহিলে

                    অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?

                    কহো মহারথি, একি মহারথী প্রথা?

                    নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে

                    এ কথা!

 

 

যদি ইচ্ছাপূর্বক করিয়া থাকেন, তবে কেন করিলেন? এ মহাকাব্যে কি মহান চরিত্র যথেষ্ট আছে? রাবণকে কি স্ত্রীলোক করা হয় নাই? ইন্দ্রকে কি ভীরু মনুষ্যরূপে চিত্রিত করা হয় নাই? এ কাব্যের রাম কি একটি কৃপাপাত্র বালক নহেন? তবে এ মহাকাব্যে এমন কে মহান চরিত্র আছেন, যাঁহার কাহিনী শুনিতে শুনিতে আমাদের হৃদয় স্তম্ভিত হয়, শরীর কন্টকিত হয়, মন বিস্ফারিত হইয়া যায়। ইহাতে শয়তানের ন্যায় ভীষণ দুর্দম্য মন, ভীষ্মের ন্যায় উদার বীরত্ব, রামায়ণের লক্ষ্ণণের ন্যায় উগ্র জ্বলন্ত মূর্তি, যুধিষ্ঠিরের ন্যায় মহান শান্তভাব, চিত্রিত হয় নাই। ইহাতে রাবণ প্রথম হইতেই পুত্রশোকে কাঁদিতেছেন, ইন্দ্র ইন্দ্রজিতের ভয়ে কাঁপিতেছেন, রাম বিভীষণের নিকট গিয়া ত্রাহি ত্রাহি করিতেছেন, ইহা দেখিয়া যে কাহার হৃদয় মহান ভাবে বিস্ফারিত হইয়া যায়, জানি না। যখন ইন্দ্রজিৎ লক্ষ্ণণকে কহিলেন,

 

                             নিরস্ত্র যে অরি,

                    নহে রথীকুল প্রথা আঘাতিতে তারে।

                    এ বিধি, হে বীরবর, অবিদিত নহে,

                    ক্ষত্র তুমি, তব কাছে;-- কী আর কহিব?

 

 

তখন

 

                    জলদপ্রতিমস্বনে কহিলা সৌমিত্রি,

                    "আনায় মাঝারে বাঘে পাইলে কি কভু

                    ছাড়ে রে কিরাত তারে? বধিব এখনি,

                    অবোধ তেমনি তোরে! জন্ম রক্ষঃকুলে

                    তোর, ক্ষত্রধর্ম, পাপি, কী হেতু পালিব,

                    তোর সঙ্গে? মারি অরি, পারি যে কৌশলে!'

 

 

এ কথা বলিবার জন্য জলদপ্রতিমস্বনের কোনো আবশ্যক ছিল না।

 

রামায়ণের লক্ষ্ণণ একটি উদ্ধত উগ্র-যুবক, অন্যায় তাঁহার কোনোমতে সহ্য হয় না, তরবারির উপরে সর্বদাই তাঁহার হস্ত পড়িয়া আছে, মনে যাহা অন্যায় বুঝিবেন মুহূর্তে তাহার প্রতিবিধান করিতে প্রস্তুত আছেন, তাহার আর বিবেচনা করিবেন না, অগ্রপশ্চাৎ করিবেন না, তাহার ফল ভালো হইবে কি মন্দ হইবে তাহা জ্ঞান নাই, অন্যায় হইলে আর রক্ষা নাই। অল্পবয়স্ক বীরের উদ্ধত চঞ্চল হৃদয় রামায়ণে সুন্দররূপে চিত্রিত হইয়াছে। যখন দশরথ রামকে বনে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন ও রামও তাহাতে সম্মত হইলেন, তখন লক্ষ্ণণ যাহা কহিতেছেন তাহার কিয়দংশ উদ্‌ধৃত করিয়া দিলাম, ইহাতে পাঠকেরা কিয়ৎপরিমাণে রামায়ণে বর্ণিত লক্ষ্ণণচরিত্র বুঝিতে পারিবেন।

 

"রাম এইরূপ কহিলে মহাবীর লক্ষ্ণণ সহসা দুঃখ ও হর্ষের মধ্যগত হইয়া অবনতমুখে কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিলেন এবং ললাটপট্টে ভ্রূকুটি বন্ধনপূর্বক বিলমধ্যস্থ ভুজঙ্গের ন্যায় ক্রোধভরে ঘন ঘন নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তাঁহার বদনমণ্ডল নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য হইয়া উঠিল এবং কুপিত সিংহের মুখের ন্যায় অতি ভীষণ বোধ হইতে লাগিল। অনন্তর হস্তী যেমন আপনার শুণ্ড বিক্ষেপ করিয়া থাকে, তদ্রূপ তিনি হস্তাগ্র বিক্ষিপ্ত এবং নানাপ্রকার গ্রীবাভঙ্গি করিয়া বক্রভাবে কটাক্ষ নিক্ষেপপূর্বক কহিতে লাগিলেন, আর্য! ধর্মদোষ পরিহার এবং স্বদৃষ্টান্তে লোকদিগকে মর্যাদায় স্থাপন এই দুই কারণে বনগমনে আপনার যে আবেগ উপস্থিত হইয়াছে, তাহা নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক।... আপনি অনায়াসেই দৈবকে প্রত্যাখ্যান করিতে পারেন, তবে কি নিমিত্ত একান্ত শোচনীয় অকিঞ্চিৎকর দৈবের প্রশংসা করিতেছেন?... বীর! এই জঘন্য ব্যাপার আমার কিছুতেই সহ্য হইতেছে না! এক্ষণে আমি মনের দুঃখে যাহা কিছু কহিতেছি, আপনি ক্ষমা করিবেন। আরও আপনি যে ধর্মের মর্ম অনুধাবন করিয়া মুগ্ধ হইতেছেন, যাহার প্রভাবে আপনার মতদ্বৈধ উপস্থিত হইয়াছে আমি সেই ধর্মকেই দ্বেষ করি।  আপনি কর্মক্ষম, তবে কি কারণে সেই স্ত্রৈণ রাজার ঘৃণিত অধর্মপূর্ণ বাক্যের বশীভূত হইবেন? এই যে রাজ্যাভিষেকের বিঘ্ন উপস্থিত হইল, বরদান ছলই ইহার কারণ; কিন্তু আপনি যে তাহা স্বীকার করিতেছেন না, ইহাই আমার দুঃখ; ফলতঃ আপনার এই ধর্মবুদ্ধি নিতান্তই নিন্দনীয় সন্দেহ নাই।... তাঁহারা আপনার রাজ্যাভিষেকে বিঘ্নাচরণ করিলেন, আপনিও তাহা দৈবকৃত বিবেচনা করিতেছেন, অনুরোধ করি, এখনই এরূপ দুর্বুদ্ধি পরিত্যাগ করুন, এই প্রকার দৈব কিছুতেই আমার প্রীতিকর হইতেছে না। যে ব্যক্তি নিস্তেজ, নির্বীর্য, সেইই দৈবের অনুসরণ করে, কিন্তু যাঁহারা বীর, লোকে যাঁহাদিগের বল-বিক্রমের শ্লাঘা করিয়া থাকে, তাঁহারা কদাচই দৈবের মুখাপেক্ষা করেন না। যিনি স্বীয় পৌরুষপ্রভাবে দৈবকে নিরস্ত করিতে সমর্থ হন, দৈববলে তাঁহার স্বার্থহানি হইলেও অবসন্ন হন না। আর্য! আজ লোকে দৈববল এবং পুরুষের পৌরুষ উভয়ই প্রত্যক্ষ করিবে। অদ্য দৈব ও পুরুষকার উভয়েরই বলাবল পরীক্ষা হইবে। যাহারা আপনার রাজ্যাভিষেক দৈবপ্রভাবে প্রতিহত দেখিয়াছে, আজ তাহারাই আমার পৌরুষের হস্তে তাহাকে পরাস্ত দেখিবে। আজ আমি উচ্ছৃঙ্খল দুর্দান্ত মদস্রাবী মত্ত কুঞ্জরের ন্যায় দৈবকে স্বীয় পরাক্রমে প্রতিনিবৃত্ত করিব। পিতা দশরথের কথা দূরে থাকুক, সমস্ত লোকপাল, অধিক কি ত্রিজগতের সমস্ত লোকও আপনার রাজ্যাভিষেকে ব্যাঘাত দিতে পারিবে না। যাহারা পরস্পর একবাক্য হইয়া আপনার অরণ্যবাস সিদ্ধান্ত করিয়াছে, আজ তাহাদিগকেই চতুর্দশ বৎসরের নিমিত্ত নির্বাসিত হইতে হইবে। আপনার অনিষ্ট সাধন করিয়া ভরতকে রাজ্য দিবার নিমিত্ত রাজা ও কৈকেয়ীর যে আশা উপস্থিত হইয়াছে, আজ আমি তাহাই দগ্ধ করিব। যে আমার বিরোধী, আমার দুর্বিষহ পৌরুষ যেমন তাহার দুঃখের কারণ হইবে, তদ্রূপ দৈববল কদাচই সুখের নিমিত্ত হইবেক না।

 

...প্রতিজ্ঞা করিতেছি, আমিই আপনকার রাজ্য রক্ষা করিব, নতুবা চরমে যেন আমার বীরলোক লাভ না হয়। তীরভূমি যেমন মহাসাগরকে রক্ষা করিতেছে, তদ্রূপ আমি আপনার রাজ্য রক্ষা করিব। এক্ষণে আপনি স্বয়ংই যত্নবান হইয়া মাঙ্গলিক দ্রব্যে অভিষিক্ত হউন। ভূপালগণ যদি কোনো প্রকার বিরোধাচরণ করেন, আমি একাকীই তাঁহাদিগকে নিবারণ করিতে সমর্থ হইব। আর্য! আমার যে এই ভুজদণ্ড দেখিতেছেন, ইহা কি শরীরের সৌন্দর্য সম্পাদনার্থ? যে কোদণ্ড দেখিতেছেন, ইহা কি কেবল শোভার্থ? এই খড়্‌গে কি কাষ্ঠবন্ধন, এই শরে কি কাষ্ঠভার অবতরণ করা হয়?-- মনেও করিবেন না; এই চারিটি পদার্থ শত্রুবিনাশার্থই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এক্ষণে বজ্রধারী ইন্দ্রই কেন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হউন-না, বিদ্যুতের ন্যায় ভাস্বর তীক্ষ্ণধার অসি দ্বারা তাঁহাকেও খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিব। হস্তীর শুণ্ড অশ্বের ঊরুদেশ এবং পদাতিক মস্তক আমার খড়্‌গে চূর্ণ হইয়া সমরাঙ্গন একান্ত গহন ও দুরাবগাহ করিয়া তুলিবে। অদ্য বিপক্ষেরা আমার অসিধারায় ছিন্নমস্তক হইয়া শোণিতলিপ্ত দেহে প্রদীপ্ত পাবকের ন্যায় বিদ্যুদ্দামশোভিত মেঘের ন্যায় রণক্ষেত্রে নিপতিত হইবে।... যে হস্ত চন্দন লেপন, অঙ্গদ ধারণ, ধন দান ও সুহৃদ্‌বর্গের প্রতিপালনের সম্যক উপযুক্ত, অদ্য সেই হস্ত আপনার অভিষেক-বিঘাতকদিগের নিবারণ বিষয়ে স্বীয় অনুরূপ কার্য সাধন করিবে। এক্ষণে আজ্ঞা করুন আপনার কোন্‌ শত্রুকে ধন প্রাণ ও সুহৃদ্‌গণ হইতে বিযুক্ত করিতে হইবে। আমি আপনার চিরকিঙ্কর, আদেশ করুন, যেরূপে এই বসুমতী আপনার হস্তগত হয়, আমি তাহারই অনুষ্ঠান করিব।'

 

মূল রামায়ণে ইন্দ্রজিতের সহিত লক্ষ্ণণের যেরূপ যুদ্ধবর্ণনা আছে তাহার কিয়দংশ আমরা পাঠকদিগের গোচরার্থে এইখানে অনুবাদ করিয়া দিতেছি।

 

"তুমি এই স্থানে বয়স কাটাইয়াছ, তুমি আমার পিতার সাক্ষাৎ ভ্রাতা, সুতরাং পিতৃব্য হইয়া কীরূপে আমার অনিষ্ট করিতেছ? জ্ঞাতিত্ব ভ্রাতৃত্ব, জাতি ও সৌহার্দ্যও তোমার নিকট কিছুই নয়। তুমি ধর্মকেও উপেক্ষা করিতেছ। নির্বোধ! তুমি যখন স্বজনকে পরিত্যাগ করিয়া অন্যের দাসত্ব স্বীকার করিয়াছ তখন তুমি শোচনীয় এবং সাধুগণের নিন্দনীয়। আত্মীয়স্বজনের সহবাস ও অপর নীচ ব্যক্তির আশ্রয় এই দুইটির যে কত অন্তর তুমি বুদ্ধিশৈথিল্যে তাহা বুঝিতেছ না। পর যদি গুণবান হয় এবং স্বজন যদি নিগুZও হয় তবুও নিগুZ স্বজন শ্রেষ্ঠ, পর যে সে পরই। স্বজনের প্রতি তোমার যেরূপ নির্দয়তা, ইহাতে তুমি জনসমাজে প্রতিষ্ঠা ও সুখ কদাচই পাইবে না। আমার পিতা গৌরব বা প্রণয়বশতই হউক তোমাকে যেমন কঠোর ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন তেমনই তো আবার সান্ত্বনাও করিয়াছেন। গুরু লোক প্রীতিভরে অপ্রিয় কথা বলেন বটে কিন্তু অবিচারিত মনে আবার তো সমাদরও করিয়া থাকেন। দেখো, যে ব্যক্তি সুশীল মিত্রের বিনাশার্থ শত্রুর বৃদ্ধি কামনা করে ধান্যগুচ্ছের সন্নিহিত শ্যামাকের ন্যায় তাহাকে পরিত্যাগ করা উচিত।'

 

ইন্দ্রজিৎ বিভীষণকে এইরূপ ভর্ৎসনা করিয়া ক্রোধভরে লক্ষ্ণণকে কটূক্তি করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর লক্ষ্ণণ রোষাবিষ্ট হইয়া নির্ভয়ে কহিলেন, রে দুষ্ট! কথা মাত্র কখনো কার্যের পারগামী হওয়া যায় না, যিনি কার্যত তাহা প্রদর্শন করিতে পারেন তিনিই বুদ্ধিমান। তুই নির্বোধ, কোন্‌ দুষ্কর কার্যে কতকগুলি নিরর্থক বাক্য ব্যয় করিয়া আপনাকে কৃতকার্য জ্ঞান করিতেছিস। তুই অন্তরালে থাকিয়া রণস্থলে আমাদিগকে ছলনা করিয়াছিস। কিন্তু দেখ, এই পথটি তস্করের, বীরের নয়। এক্ষণে আত্মশ্লাঘা করিয়া কী হইবে, যদি তুই সম্মুখযুদ্ধে তিষ্ঠিতে পারিস, তবেই আমরা তোর বলবীর্যের পরিচয় পাইব। আমি তোরে কঠোর কথা কহিব না, তিরস্কার কি আত্মশ্লাঘাও করিব না অথচ বধ করিব। দেখ, আমার কেমন বল বিক্রম। অগ্নি নীরবে সমস্ত দগ্ধ করিয়া থাকেন এবং সূর্য নীরবে উত্তাপ প্রদান করিয়া থাকেন। এই বলিয়া মহাবীর লক্ষ্ণণ ইন্দ্রজিতের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •