(এমারেলড্‌ নাট্যশালায় লড্‌ ক্রসের বিলের বিরুদ্ধে আপত্তি প্রকাশ ঊপলক্ষে যে বিরাটসভা আহুত হয় এই প্রবন্ধ সেই সভাস্থলে  শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক পঠিত হয়। )


 

মন্ত্রি-অভিষেক (mantri abhishek)


আমি যে বিষয় উত্থাপন করিতে প্রবৃত্ত হইতেছি তাহা আপনা হইতেই অনেক দূর পয্যর্ন্ত অগ্রসর হইয়াছে। শ্রোতৃবর্গের মধ্যে এমন কেহই নাই যাঁহাকে এ সম্বন্ধে কিছু নূতন কথা বলিতে পারি বা যাহাঁকে প্রমাণপ্রয়োগ-পূর্ব্বক কিছু বুঝান আবশ্যক। আমরা সকলেই একমত। আমার কর্ত্তব্য কেবল উপস্থিত সকলের হইয়া সেই মত ব্যক্ত করা; সেইজন্যই সাহস-পূর্বক আমি এখানে দন্ডায়মান হইতেছি। নতুবা জটিল রাজনৈতিক অরণ্যের মধ্যে সরল পথ কাটিয়া বাহির করা আমার মত নিতান্ত অব্যবসায়ী লোকের ক্ষুদ্র ক্ষমতার অতীত।

 

বিষয়টা আপাতত যেরূপ আকার ধারণ করিয়াছে  তাহা আমার নিকটেও তেমন দুর্ব্বোধ ঠেকিতেছে না। আমাদের শাসনকর্ত্তারা স্থির করিয়াছেন মন্ত্রীসভায় আরো গুটিকতক ভারতবর্ষীয় লোক নিযুক্ত করা যাইতে পারে। এখন কথাটা কেবল এই দাঁড়াইতেছে, নির্ব্বাচন কে করিবে? গবর্ণমেন্ট করিবেন, না আমরা করিব?

 

মীমাংসা করিবার পূর্ব্বে সহজ-বুদ্ধিতে এই প্রশ্ন উদয় হয়, কাহার সুবিধার জন্য এই নির্বাচনের আবশ্যক হইয়াছে?

 

আমাদেরই সুবিধার জন্য। কারণ, ভরসা করিয়া বলিতে পারি এমন অবিশ্বাসী এ সভায় কেহই নাই যিনি বলিবেন ভারতের উন্নতিই ভারত শাসনের  মুখ্য লক্ষ্য নহে। অবশ্য, ইংরাজের ইহাতে আনুষঙ্গিক লাভ  নাই এমন কথাও বলা যায় না। কিন্তু নিজের স্বার্থকেই যদি ইংরাজ ভারত শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য করিতেন তবে আমাদের এমন দুর্দ্দশা হইত যে ক্রন্দন করিবারও অবসর থাকিত না। তবে কি আশা লইয়া আজ আমরা এখানে সমবেত হইতাম।  তবে আকাঙ্খার লেশমাত্র আমাদের মনে উদয় হইবার বহু পূর্বেই বিলাতের নির্ন্মিত কঠিন পাদুকার তলে তাহা নিরঙ্কুর হইয়া লোপ পাইত।

 

এ পর্য্যন্ত কখনো কখনো দৈববশতঃ দুর্ঘটনাক্রমে উক্ত মর্ম্মঘাতী চর্ম্মখন্ডের তাড়নে আমাদের জীর্ণ প্লীহা বিদীর্ণ হইয়াছে মাত্র, কিন্তু আমাদের শীর্ণ আশালতা ক্রমশঃ সজীব হইয়া উন্নতিদন্ড আশ্রয়-পূর্ব্বক সফলতা লাভের দিকে অগ্রসর হইতেছে, তাহার প্রতি ইহার আক্রোশ কার্য্যে স্পষ্টতঃ প্রকাশ পায় নাই।

 

উপস্থিতক্ষেত্রে আমার এই প্রবন্ধে বিদীর্ণ প্লীহার উল্লেখ করা কালোচিত স্থানোচিত বিজ্ঞোচিত হয় নাই এইরূপ অনেকেরই ধারণা হইতে পারে। বিষয়টা সাধারণতঃ মনোরঞ্জক নহে, এবং ইহার উল্লেখ আমাদের কর্ত্তৃপুরুষদের কর্ণে শিষ্টাচার বিরুদ্ধ বলিয়া আঘাত করিতে পারে।

 

কিন্তু কথাটা পাড়িবার একটু তাৎপর্য আছে। ইংরাজের সাংঘাতিক সংঘর্ষে মাঝে মাঝে আমাদের দুর্ব্বল প্লীহা এবং অনাথ মানসম্ভ্রম শতধা বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছে, এ কথাটা গোপন করিয়া রাখা সহজ হইতে পারে কিন্তু বিস্মৃত হওয়া সহজ নহে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভারতবর্ষীয় ইংরাজের এই স্বাভাবিক রূঢ়তা আমরা যদি চর্ম্মের উপরে ও মর্ম্মের মধ্যে একান্ত প্রাণান্তিকরূপে অনুভব না করিতাম তবে ইংরাজ গবর্মেন্টের উদারতা ও উপকারিতা সম্বন্ধে বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে কত সহজ হইত!

 

মনুষ্যের স্বভাব এই, অপরাধীর প্রতি রাগ করিয়া তাহার সম্পূর্ণ নিরাপরাধী ঊর্দ্ধতন চতুর্দ্দশ পুরুষের প্রতি কাল্পনিক কলঙ্ক আরোপ করিয়া কিয়ৎ-পরিমাণে সান্ত্বনা অনুভব করে। তেমনি আমরা অনেক সময়ে দলিত প্লীহাযন্ত্রের যন্ত্রণায় কোন বিশেষ ইংরাজ কাপুরূষের প্রতি রাগ করিয়া গবর্মেণ্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা বিস্মৃত হই। কারণ, গবর্মেন্টকে আমরা প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে পারি না, অনেকটা শিক্ষা ও কল্পনার সাহায্যে মনের মধ্যে খাড়া করিয়া লইতে হয়। কিন্তু যাহাতে করিয়া জিহ্বা এবং জীবাত্মার অধিকাংশই বহির্গত হইয়া পড়ে অথবা অপমানশেল হৃৎপিন্ডের  শোণিত শোষণ করিতে থাকে, তাহা অত্যন্ত নিকটে অনুভব না করিয়া থাকা যায় না।

 

অতএব ভ্রমের কারণ মন হইতে দূর করিয়া সেই ব্যক্তিগত অপমানজ্বালা বিস্মৃত হইয়া আমরা যদি স্থিরচিত্তে প্রণিধান করিয়া দেখি তবে ইহা নিশ্চয় স্বীকার করিতে হইবে যে ইংরাজ গবর্মেণ্টের নিকট হইতে আমরা এত বহুল সুফল লাভ করিয়াছি যে তাহার নিঃস্বার্থ উপকারিতা সম্বন্ধে অবিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে কৃতঘ্নতা  মাত্র।

 

অতএব সকলেই বলিবেন ভারতশাসনের মূখ্য উদ্দেশ্য ভারতবর্ষেরই উন্নতি। আমাদেরই সুবিধা, আমাদেরই কাজ। সেই আমাদের কাজের জন্য আমাদের লোকের সাহায্য প্রার্থনীয় হইয়াছে। সহজেই মনে হয় আমরা বাছিয়া দিলে কাজটাও ভাল হইবে, আমাদের মনেরও সন্তোষ হইবে।

 

এই সন্তোষ পদার্থটি কিছু উপেক্ষার যোগ্য নহে। ইহাতে কাজ যেমন অগ্রসর করিয়া দেয় এমন আর কিছুতে নহে। রুচিপূর্ব্বক আহার করিলে তবে পরিপাকের সহায়তা হয়। কার্য্যসাধনের সঙ্গে সঙ্গে সন্তোষসাধনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক, নতুবা উপকারের গ্রাসও গলাধঃকরণ করা কঠিন হইয়া উঠে এবং তাহা অন্তরে অন্তরে অন্তর্দংশ বেদনা আনয়ন করে।

 

কিন্তু আমাদের বিরোধী পক্ষীয় ইংরাজি সম্পাদকেরা অতিরিক্ত বুদ্ধিপ্রভাবে বলিতেছেন যে, ভারতবর্ষীয়েরা প্রাচ্যজাতীয়, অতএব তাহাদের হস্তে মন্ত্রি-অভিষেকের ভার দিলে তাহারা নিজেই অসন্তুষ্ট হইবে।

 

আমাদের ইংরাজি সম্পাদক মহাশয় যদি আমার ধৃষ্টতা মার্জ্জনা করেন ত নিভর্য় হইয়া একটা কথা বলি। আমার বিশ্বাস আছে হাস্যরসকুতূহলী ইংরাজ জাতি হাস্যস্পদ হইতে একান্ত ডরাইয়া থাকেন। কিন্তু উপস্থিতক্ষেত্রে তাহার আশ্চর্য্য ব্যাতিক্রম দেখা যাইতেছে। যখন সমস্ত ভারতবর্ষ কন্‌গ্রেসযোগে ইংলণ্ডের নিকটে নিবেদন করিতেছেন যে স্বাধীন মন্ত্রিনিয়োগের অধিকারই তাঁহাদের সর্ব্বপ্রধান প্রার্থনা এবং সেই অধিকার প্রাপ্ত হইলেই তাহাঁদের প্রধান অসন্তোষের কারণ দূর হইবে, তখন কোন্‌ লজ্জায় হাস্যরসতত্ত্বের সমুদয় নিয়ম বিস্মৃত হইয়া ইংল্যান্ডবাসী সম্পাদক এ কথা বলেন যে, এই গৌরবজনক অধিকার লাভে সফল হইলেই প্রাচ্য ভারতবর্ষ অসন্তুষ্ট হইবে! এ বিষয়ে পূর্ব্ব-পশ্চিমের কোন মতভেদ থাকিতে পারে না যে, ব্যথিত ব্যক্তি নিজের বেদনা যতটা বোঝে, স্বয়ং ইংরাজ সম্পাদকও এতটা বোঝেন না।

 

অতএব আমাদের সন্তোষ অসন্তোষের সম্বন্ধে আমরাই প্রামাণ্য সাক্ষী; ইংরাজ সম্পাদকের প্রতিবাদ এ স্থলে কিঞ্চিৎ অসঙ্গত বলিয়া  মনে হয়। তাঁহারা বলেন যুদ্ধপ্রিয় জাতিরা এই মন্ত্রি-অভিষেক-প্রথায় ক্ষুব্ধ হইবেন। কেন হইবেন? তাঁহাদের অধিক পরিমাণে তেজ আছে বলিয়াই কি তাঁহারা রাজনীতিক্ষেত্রে অধিকতর স্বাধীনতা চাহেন না? স্বাধীন অধিকার কি তবে কেবল যুদ্ধপ্রিয় জাতির পক্ষেই অরুচিকর? আমরা যুদ্ধপ্রিয় নহি, কিন্তু অনুমান করি যোদ্ধৃজাতির প্রতি এরূপ কলঙ্ক আরোপ করা সম্পূর্ণ অমূলক ও অন্যায়।

 

তবে যদি এ কথা বল, আমাদের যোদ্ধৃজাতীয়েরা এখনো এতটা দূর বাক্‌পটুতা লাভ করেন নাই যাহাতে করিয়া মন্ত্রিসভায় বসিয়া পরামর্শ দান করিতে পারেন, সুতরাং সেখানে আসন অধিকার করিতে তাঁহারা সক্ষম হইবেন না এবং সক্ষম-শ্রেণীয়দের প্রতি তাঁহাদের অসূয়ার উদ্রেক হইবে--তাহার আর কি প্রতিবাদ করিব? এ কথা কতকগুলি সঙ্কীর্ণ হৃদয়ের ক্ষুদ্রকল্পনাপ্রসূত। ইহাতে আমাদের বীরজাতিদিগকে অপমান করা হয়। তাঁহাদের মধ্যে যোগ্য ব্যক্তি নাই এবং তাঁহাদের জাতীয়েরা যোগ্য ব্যাক্তিকে চিনিতে পারে না, দুইচারিজন ইংরাজের মুখের কথাকে ইহার প্রমাণ বলিয়া ধরা যাইতে পারে না।

 

আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করি - ইংরাজের সুশাসনে আমাদের যোদ্ধৃবর্গের যুদ্ধ করিবার অবসর কোথায়? অতএব যখন যুদ্ধগৌরবের দ্বার রুদ্ধ, তখন কি স্বভাবতঃই  জাতীয় রাজনৈতিক গৌরবের প্রতি তাঁহাদের হৃদয় আকৃষ্ট হইবে না? যদি স্বতঃ না হয় তবে যে কোন উপায়ে হৌক জাতিস্বভাবসুলভ যুদ্ধলালসা হইতে তাঁহাদের চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করিয়া রাজ্যচালন ও শান্তিকার্য্যের মধ্যে তাঁহাদের গৌরবস্পৃহা চরিতার্থ করিতে দিবার চেষ্টা করা কি রাজপুরুষেরা উচিত জ্ঞান করেন না?

 

পূর্ব্ব এবং পশ্চিম যদিও বিপরীত দিক্‌ তথাপি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য মানবপ্রকৃতি সম্পূর্ণ বিরোধীধর্ম্মাবলম্বী নহে। তাহা যদি হইত তবে ইংরাজি শিক্ষা, ইংরাজি শাসনপ্রণালী এ দেশে মরুভুমিতে বীজবপনের ন্যায় আদ্যোপান্ত নিষ্ফল হইত। বিরোধীপক্ষীয়েরা হয়ত অবিশ্বাস করিবার মৌখিক ভাণ করিবেন তথাপি এ কথা আমরা বলিব, যে, যদিও আমরা প্রাচ্য এবং তোমাদের সাহায্য ব্যতীত জাতীয় গৌরব উপার্জ্জন করিতে অক্ষম হইয়াছি তথাপি কোন্‌ অধিকার গৌরবের এবং কোন্‌ নিষেধ অপমানের তাহা আমাদের প্রাচ্য হৃদয়েও অনুভব করিতে পারি। আমাদের মানবপ্রকৃতির এত দূর পর্য্যন্ত বিকার হয় নাই যে, তোমরা যখন মহৎ অধিকার আমাদের হস্তে তুলিয়া দিবে তখন আমরা অসন্তুষ্ট হইব। আমাদের জাতিধর্ম্ম সহিষ্ণুতাকে তোমরা সম্যক্‌ অসাড়তা বলিয়া ভ্রম কর, তাহার কারণ তোমরা আমাদের সুখদুঃখ-বিরাগ অনুরাগপূর্ণ অন্তঃকরণের মধ্যে প্রবেশ করা অনাবশ্যক জ্ঞান করিয়া আসিতেছে। যদিও আমরা দুর্ভাগ্যক্রমে চিরকাল যথেচ্ছাচারী শাসনতন্ত্রের মধ্যে বাস করিয়া আসিতেছি, তথাপি মানবসাধারণের অন্তর্নিহিত স্বাধীনতাপ্রীতির মৃত্যুঞ্জয়ী বীজ আমাদের হৃদয়ে এখনো সম্পূর্ণ নির্জ্জীব হয় নাই।

 

আর কিছু না হৌক তোমাদের নিকটে আমাদের বেদনা, আমাদের অভাব জানাইবার অধিকার আমাদের হস্তে সমর্পণ করিলে অধিকতর সুখসন্তোষের কারণ হইবে এটুকু আমরা পূর্ব্বদিকে বাস করিয়াও এক রকম বুঝিতে পারি। অপেক্ষাকৃত পশ্চিমবাসী যোদ্ধৃজাতীয়দের মানসিক প্রকৃতি যে এ বিষয়ে আমাদের হইতে কিছুমাত্র পৃথক্‌ তাহাও মনে করিতে পারি না। অতএব দুঃখনিবেদনের স্বাধীন অধিকার পাইলে ভারতবর্ষ যে অসন্তুষ্ট হইবে ইংলণ্ডবাসী ভারতহিতৈষীগণকে এরূপ গুরুতর দুশ্চিন্তা হইতে ক্ষান্ত থাকিতে অনুরোধ করিতে পারি।

 

অথচ সন্তোষ-উদ্রেকের জন্য বেশি যে কিছু করিতে হইবে তাহাও নহে। যদি কর্ত্তৃপক্ষেরা বলিতেন তোমরা মন্ত্রিসভায় বসিবার একেবারেই যোগ্য নও, অতএব মিছে কানের কাছে বকিয়ো না। তাহা হইলে আমরা ধমকটি খাইয়া শুষ্কমুখে আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরিয়া যাইতাম।

 

কিন্তু গোড়াকার প্রধান কঠিন সমস্যার মীমাংসা হইয়া গিয়াছে। তোমাদের রাজভক্তের পার্শ্বে আমাদিগকে স্থান দিয়া সম্মানিত করিয়াছ; আরো লোক বাড়াইতে চাও। তোমাদের শাসনতন্ত্রের মধ্যে অনেক বড় বড় পদেও আমাদিগকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছ। আমাদের যোগ্যতার প্রতি যে তোমাদের আন্তরিক বিশ্বাস আছে তাহার সহস্র পরিচয় দিয়াছ। তোমরা আপনা হইতে স্বেচ্ছাপূর্ব্বক আমাদিগকে যে সকল উচ্চ অধিকার দিয়াছ, যে উ্‌ন্নতিমঞ্চে আরোহণ করিয়াছ, তাহা আমাদের পঁচিশ বৎসর পূর্ব্বেকার স্বপেরও অগম্য। আজ আমরা অন্তরের মধ্যে আত্মগৌরব অনুভব করিয়া আত্মবিশ্বাসের সহিত আমাদের লব্ধ অধিকার ঈষৎ বিস্তৃত করিবার প্রার্থনা করিতেছি বলিয়া কেন বিমুখ হইতেছ?

 

আমাদের মধ্যে যে যোগ্যতা আছে তাহা প্রমাণ করিবার অবসর ত তোমরাই দিয়াছ। আমাদের প্রতি তোমরা যখন জেলা শাসনের ভার দিলে তখনই আমরা নিজে জানিলাম যে আমরা শাসনভার লইবার যোগ্য, তোমরা যখন আমাদিগকে সর্ব্বোচ্চ বিচারাসনে স্থান দিলে তখন আমরা আপনারাই দেখিলাম আমরা সে গুরুতর কার্য্যভার ও উচ্চতর সম্মানের অধিকারী, তোমরা যখন ভারতীয় রাজকার্যের পরামর্শের জন্য আমাদিগকে আহ্বান করিলে তখন অমরা প্রমাণ পাইলাম এই বিপুল রাজ্যচালনকার্য্যে আমাদের অভিজ্ঞতাও উপেক্ষণীয় নহে। এইরূপে ক্রমে ক্রমে আমাদের  আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করিয়া, আমাদের আশা উদ্রেক করিয়া, আজ আমাদের শিক্ষা,আকাঙ্খা ও আগ্রহকে কোন্‌ মুখে নিষ্ফল করিবে?

 

যখন প্রার্থনা করি নাই এবং রাজশক্তির নিকট প্রার্থনা করিবার উপায় মাত্র জানিতাম না, তখন তোমরা আমাদের উচ্চ-অধিকারের ঘোষণাপত্র প্রচার করিয়াছ। কিন্তু তদনুরূপ কার্য্য হয় নাই, তাহা তোমরাও স্বীকার করিতেছ এবং আমরাও অনুভব করিতেছি। এক প্রকার উচ্ছৃঙ্খল বদান্যতা আছে যাহা সহসা স্বতঃ উৎসারিত  উচ্ছ্বাসপ্রাচুর্য্যে মুক্তহস্ত হইয়া উঠে, কিন্তু স্বহস্তরচিত ঋণপত্র বা প্রতিশ্রুতিলিপি দেখিলে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মূর্ত্তি ধারণ করে, যাহা আকস্মিক আবেগে বৃহৎ অঙ্গীকারে জড়িত হয় এবং অবশেষে ন্যায্য উপায়-ব্যতীত অন্যান্য সকল প্রকার ছলে বলে সেই স্বেচ্ছাকৃত অঙ্গীকারপাশ হইতে মুক্তি লাভ করিতে চেষ্টা করে।

 

দেখা যাইতেছে, তোমরা স্বেচ্ছাপূর্ব্বক আমাদিগকে বৃহৎ অধিকার দিতে স্বীকার করিয়াছ, এবং কিছু কিছু দিয়াছ। কিন্তু তোমাদের প্রতিজ্ঞাপত্রের আশ্বাস-অনুসারিণী অধিকার প্রার্থনাকে তোমরা রাজভক্তির অভাব বলিয়া অত্যন্ত উষ্ণতা প্রকাশ কর। কিন্তু মনে মনে কি জান না ইহাতেই যথার্থ রাজভক্তি প্রকাশ পায়?

 

তোমাদের নিকট যাহা প্রার্থনা করিতেছি তাহা কোন বিজিত জাতি কোন জেতৃজাতির নিকট বিশ্বাসপূর্ব্বক প্রার্থনা করিতে পারিত না। ইহাই তোমাদের প্রতি যথার্থ ভক্তি, সেলাম করা বা জুতা খোলা নহে।

 

আমাদের মধ্যে কেহ কেহ মুখে যাহাই বলি, যখনি তোমাদের নিকট উন্নত অধিকার প্রত্যাশা করি তখনি তোমাদের মহৎ মনুষ্যত্বের প্রতি কি সুগভীর আন্তরিক ভক্তি প্রকাশ হইয়া পড়ে। তোমরা আপন রক্তপাত করিয়া ভারতবর্ষ অধিকার করিয়াছ এবং আপন প্রচণ্ড বলে এই আসমুদ্র আহিমাচল বিপুল ভারতভূমিকে করতলন্যস্ত আমলকের ন্যায় আয়ত্ত করিয়া রাখিয়াছ। আমাদের মনে এ আশা কোথা হইতে জন্মিল যে তোমাদের ঐ মহিমান্বিত রাজপ্রাসাদের উচ্চ সোপান আমাদের পক্ষে অনধিগম্য নহে? অবশ্যই তোমাদের খাপের মধ্য হইতে যেমন তরবারি মধ্যে মধ্যে মহেন্দ্রের বজ্রের ন্যায় আপন বিদ্যুৎ-আভা প্রকাশ করিয়াছে, তেমনি তোমাদের অন্তরের মধ্যে যে দীপ্ত মনুষ্যত্বের মহিমা বিরাজ ক্‌রিতেছে তাহাও প্রবল শাসনের মধ্য হইতে মাভৈঃ শব্দে আপনাকে প্রকাশ করিয়াছে। নিম্নে ভূমিতলে দ্বারের নিকট যে প্রহরী বন্দুকের উপরে সঙ্গীন চড়াইয়া দাঁড়াইয়া থাকে তাহার অপ্রসন্ন মুখে নিষেধের ভাব দেখা যায়, কিন্তু যে জ্যোতিষ্মান পুরুষ প্রাসাদের শিখরদেশে দাঁড়াইয়া আছে সে আমাদিগকে অভয়দান করিয়া আহ্বান করিতেছে। ঐ দুর্ম্মুখ প্রহরীটাকে আমরা ভয় করি এবং মাঝে মাঝে সুযোগ পাইলেই তাহার শক্তিশেলের লক্ষ্য এড়াইয়া তাহার প্রতি নিষ্ফল কটুকাটব্যও প্রয়োগ করিয়া থাকি, কিন্তু সেই প্রসন্নমূর্ত্তি মহাপুরুষের মুখের দিকে আমরা আশান্বিত চিত্তে চাহিয়া আছি। ইহাকেই কি ভক্তির অভাব বলে!

 

এক ইংরাজ আমাদের প্রতি কট্‌মট্‌ করিয়া তাকায়। আর এক ইংরাজ উপর হইতে আপন মহত্ত্বের প্রতি আমাদিগকে আহ্বান করে। এই জন্য ভয়ের অপেক্ষা ভক্তিই প্রবল হয়। আশঙ্কার উপরে আশাই জয়লাভ করে। এবং আমাদের এই আশাই যথার্থ রাজভক্তি।

 

দুঃখের সহিত বলিতে বাধ্য হইতেছি, আমাদের মধ্যে ক্ষুদ্র এক দল আছেন ইংরাজবিদ্বেষ তাঁহাদের মনে এতই বলবান যে কন্‌গ্রেসের প্রতি কিছুতেই তাঁহারা প্রসন্নদৃষ্টিক্ষেপ করিতে পারেন না। তাঁহারা নীরবে রাজবিদ্বেষ জাগাইয়া রাখিতে চান, ইংরাজের নিকট উপকার প্রত্যাশা করে বলিয়াই তাঁহারা কন্‌গ্রেসের প্রতি বিমুখ। ইঁহাদের সহিত তুলনা করিয়া দেখিলেই কন্‌গ্রেসের যথার্থ ভাব পরিস্ফুট হইয়া উঠিবে।

 

ইঁহারা বলেন ইংরাজ কি তেমনি পাত্র! এত কাল যাহারা তোমাদিগকে কথায় ভুলাইয়া আসিয়াছে তাহারা কি আজ তোমাদের কথায় ভুলিবে! তোমরা এ বিদ্যা কত দিনই বা শিখিয়াছ! উহাদের কথার সহিত কাজের মিল করাইবার জন্য দাবি করিয়া বসিলে লাভে হইতে ফল হইবে এই যে, মিষ্ট কথাটুকু হইতেও বঞ্চিত হইবে। তাহার প্রমাণ হাতে হাতে দেখো। যে অবধি তোমরা উক্ত দেশহিতকর কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছ সেই অবধি পায়োনিয়র-প্রমুখ দেশের ইংরাজি কাগজ খৃষ্টানজনোচিত ভাব সম্পূর্ণ পরিহার করিয়াছে। স্বয়ং বড়কর্ত্তা সালিস্‌বারি আর থাকিতে পারিলেন না, প্রকাশ্যে তোমাদের কালামুখের উপর মুখনাড়া দিলেন। মিষ্টবাক্য মধুর-আশ্বাস এ- সকল সভ্যতার ভূষণ-এগুলোকে তোমরা এত বেশি খাঁটি বলিয়া ধরিয়া লইতেছ যে দায়ে ফেলিয়া অবশেষে ইংরাজের মধুর সভ্যতা এবং শোভন ভদ্রতাটুকুও তাড়াইবে। একদিন দেখিবে মিষ্টান্নও নাই, মিষ্ট বচনও নাই। দেখ-না কেন, কর্ত্তৃজাতীয়দের কেহ কেহ এত দূর পর্যন্ত স্পষ্টবক্তা হইয়াছেন যে, এই ঊনবিংশ খৃষ্টশতাব্দীর অপরাহ্ন-ভাগে তাহাঁরা অসঙ্কোচে এমন কথা বলিতেছেন যে, "তরবারি দ্বারা আমরা জয় করিয়াছি, তরবারিদ্বারা আমরা রক্ষা করিব'। অর্থাৎ, মানবপ্রেম, নিঃস্বার্থ উপচিকীর্ষা এ-সকল ধর্ম্মবচন কেবল নিজের উপরেই প্রয়োগ করা যাইতে পারে, তরবারিলব্ধ ভারতবর্ষের প্রতি এ সকল খৃষ্টীয় বিধান খাটে না! দেখ একবার কী কাণ্ডটা করিয়াছ! স্বয়ং ঊনবিংশ শতাব্দীর বোল ফিরাইয়া দিয়াছ! তবে আর তাহার অবশিষ্ট কি রাখিলে! তাহার তরবারি এবং জিহ্বা দুটোই সমান প্রখর হইয়া উঠিল, ধর্ম্মনীতি কোথাও স্থান পাইল না।

 

কিন্তু কন্‌গ্রেসের ভিত্তি ইংরাজবিশ্বাসের উপর স্থাপিত। কন্‌গ্রেস্‌ বলে, অবশ্য, মনুষ্যচরিত্র একেবারে দেবতুল্য নহে। ক্ষমতালালসা প্রভুত্বপ্রিয়তা স্বার্থপরতা ইংরাজের হৃদয়েও আছে, কিন্তু তাহা ছাড়া আরো এমন কিছু আছে যাহাতে করিয়া ইংরাজের প্রতি আমাদের বিশ্বাস হ্রাস হয় না। প্রতিদিন গালি খাইতেছি, লাঞ্ছনা ভোগ করিতেছি, তবুও কোথা হইতে অন্তরের মধ্যে অভয় প্রাপ্ত হইতেছি।

 

ইংরাজি সংবাদপত্রের সম্পাদকমণ্ডলী "ষড়যন্ত্রকারী বাবুসম্প্রদায়" "মুখসর্ব্বস্ব বাক্যবীর" ইত্যাদি বিশেষণের মধ্যে আপন গাত্রজ্বালা নিহিত করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে সশব্দে আমাদের প্রতি নিক্ষেপ করিতেছেন। আমরা হাসিয়া বলিতেছি, কথা তোমরাও কিছু কম বল না! তোমরা যদি আরম্ভ কর ত আমরা কি তোমাদের সঙ্গে কথায় আঁটিয়া উঠিতে পারি! তোমাদের কাছেই আমাদের শিক্ষা। কথার বায়ব-শক্তিতেই ত তোমাদের এত বড় রাজনৈতিক যন্ত্রটা চলিতেছে। কথা-ভরা-ভরা রাশি রাশি পুঁথি জাহাজে করিয়া প্রতিনিয়ত আমাদের নিকট প্রেরণ করিতেছ,এত দিন মুখস্থ করিয়াও যদি দুটো কথা কহিতে না শিখিলাম তবে আর কি শিখিলাম! তোমাদের নিকট হইতে শিখিয়াছি--কথাই তোমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রহ্মাস্ত্র। কামান বন্দুক ক্রমশঃ নীরব হইয়া আসিতেছে।

 

অবশ্য, ভাল কথা এবং মন্দ কথা দুইই আছে। আমরা যে সব সময়ে মিষ্ট কথাই বলি তাহা নহে। কিন্তু তোমরাও যে বল তাহাও সত্যের অনুরোধে বলিতে পারি না।

 

সকলেই স্বীকার করিবেন, নির্ব্বাপিত জঠরানলে সার্ব্বভৌমিক প্রেম অত্যন্ত সহজ হইয়া আসে। তোমরা প্রভু, তোমরা কর্ত্তা, তোমরা বিজেতা, তোমরা স্বাধীন, আমাদের তুলনায় সর্ব্বতোভাবে সকল প্রকার সুবিধাই তোমাদের আছে-তোমাদের পক্ষে সহিষ্ণু হওয়া, উদার হওয়া, ক্ষমাপরায়ণ হওয়া কত অনায়াসসাধ্য। আমাদের মনে স্বভাবতঃ অনেক সময়ে নৈরাশ্য উপস্থিত হয়, আমরা তোমাদের অপেক্ষা দুর্ভাগ্য, দরিদ্র এবং অসহায়, আমাদের স্বজাতীয়ের প্রতি তোমাদের বিজাতীয় ঘৃণা অথবা কৃপাদৃষ্টি অনেক সময়ে পরিস্ফুট আকারে প্রকাশ পায়, আমরা সে ঘৃণার যোগ্যপাত্র হই বা না হই তাহার অপমানবিষ অনুভব না করিয়া থাকিতে পারি না। অতএব আমরা যদি অসহিষ্ণু হইয়া কখনো অসংযত কথা বলিয়া  ফেলি, অথবা ক্ষুব্ধ অভিমানকে সান্ত্বনা করিবার আশায় মুখে তোমাদিগকে লঙ্ঘন করিবার ভাণ করি, তাহাতে আশ্চর্য্য হইবার কারণ নাই। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তোমাদের পরিপূর্ণ ঐশ্বর্য্যের মধ্যে, ক্ষমতার মধ্যে, সৌভাগ্যসুখের মধ্যে থাকিয়াও অসম্‌বৃত হইয়া তোমরা আমাদের প্রতি এমন রূঢ়ভাষা প্রয়োগ কর যাহাতে তোমাদের আন্তরিক দৈন্য প্রকাশ হইয়া পড়ে। তোমরা নিজের রসনাকে যখনি সংযত করিতে পার না তখনি আমাদিগকে বল বাক্যবাগীশ। আমাদের আবার এমনি দুর্ভাগ্য তোমাদের ভাষা লইয়াই তোমাদের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে হয়, সুতরাং তাহাতেও হার মানিয়া আছি।

 

আরো আশ্চর্য্যের বিষয় এই বাক্যকেই আমরা একমাত্র সম্বল করিতেছি বলিয়া তোমরা এত বিরক্ত হও কেন? আমাদের মুসলমান ভ্রাতৃগণের মধ্যে একদল আছেন তাঁহারা কথা কহিতে চান না; যেটুকু কহেন তাহাতে এত অতিমাত্রায় রাজভক্তির আড়ম্বর যে তাহাতে তোমরাও ভোল না আমরাও ভুলি না; তাঁহারা ইংরাজি শিক্ষার নিকটেও অধিক পরিমাণে ঋণী নহেন, ইংরাজের রাজত্ব আসিয়াও তাঁহাদের গৌরব বা সুখসমৃদ্ধির বৃদ্ধি করে নাই--সামান্য অধিকার এবং সামান্য সম্মানকে তাঁহারা স্বভাবতই উপহাসযোগ্য মনে করেন। তাঁহারা যেরূপ সাবধান চোরা মৌনভাব অবলম্বন করিতে চাহেন, তাঁহারা যেরূপ গবর্মেন্টের সকল কথাতেই অতিরিক্ত পরিমাণ স্কন্ধ-আন্দোলন করিয়া রাজভক্তির প্রচুর আস্ফালন করেন, সেইরূপ ভাবই কি তোমরা প্রার্থনীয় জ্ঞান কর?

 

আমাদের একমাত্র বিশ্বাস কথার উপরে--হয়ত আমাদের কোন কোন মুসলমান ভ্রাতার তাহা নাই--এজন্য বরং তোমাদের নিকট হইতেও আমরা বাক্যবাগীশ নামে অভিহিত হইতে রাজি আছি, তথাপি কন্‌গ্রেসের বিরোধী পক্ষে যোগ দিতে পারিব না। তোমাদের প্রতি ভক্তি আছে বলিয়াই কথা কহি, নহিলে নীরব হইয়া থাকিতাম তাহার আর সন্দেহ নাই। অতএব তোমরা কন্‌গ্রেসের প্রতি সন্দিগ্ধভাব দূর করিয়া কন্‌গ্রেসের চতুর মৌনী বিরোধী পক্ষের প্রতি সন্দেহ স্থাপন করো।

 

কন্‌গ্রেস আর এক উপায়ে রাজভক্তি শিক্ষা দিতেছে।

 

ইংরাজেরই মহিমা কন্‌গ্রেসের অস্থিমজ্জার মধ্যে জীবন সঞ্চার করিতেছে। ইংরাজেরই মহৎ উজ্জ্বল অপূর্ব্ব নিঃস্বার্থ প্রীতি কন্‌গ্রেসের মর্ম্মের মধ্যে প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিয়া তাহাকে অলৌকিক বলে বলীয়ান্‌ করিতেছে। বাহিরে পায়োনিয়রের স্তম্ভে, রাজকর্ম্মচারীদের প্রকাশ্য ও গোপন কার্য্যপ্রণালীর মধ্যে, ইংরাজের যে অনুদারতার পরিচয় পাইতেছি --এ দিকে দুর্ভাগা দরিদ্র জাতির জন্য হিউমের সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জ্জন, ইউল ও বেডার্‌বর্ণের জ্যোতির্ম্ময় সহৃদয়তা আমাদের অত্যন্ত নিকটে থাকিয়া আমাদের অন্তরের সমস্ত আবরণ ভেদ করিয়া তাহার প্রতিবাদ করিতেছে।

 

ইংরাজ জাতি যে কত মহৎ কন্‌গ্রেস না থাকিলে তাহার এমন নিকট প্রমাণ পাইবার আমাদের অবসর হইত না। সেই প্রমাণ পাইবার অতন্ত আবশ্যক হইয়াছিল। ভারতবর্ষে ইংরাজে এবং ভারতবর্ষীয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষ স্বার্থের সংঘর্ষ--এবং ইংরাজ এখানে প্রভুপদে প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতামদে মত্ত, সুতরাং স্বভাবতঃ ইংরাজের ব্যক্তিগত মহত্ব ভারতবর্ষে তেমনি স্ফূর্ত্তি পায় না, বরঞ্চ তাহার ক্ষুদ্রতা নিষ্ঠুরতা ও দানবভাব অনেক সময়ে সজাগ হইয়া উঠে।

 

এ দিকে ইংরাজি সাহিত্যে আমরা ইংরাজি চরিত্রের উচ্চ আদর্শ দেখিতে পাই, অথচ সাক্ষাৎসম্পর্কে ইংরাজের মধ্যে তাহার পরিচয় পাই না --এইরূপে য়ুরোপীয় সভ্যতার উপর আমাদের অবিশ্বাস ক্রমশঃ বদ্ধমূল হইয়া আসিতেছিল। আমাদের শিক্ষিত লোকদের মনে অল্প দিন হইল ইংরাজের ঊনবিংশ শতাব্দীর স্পর্দ্ধিত সভ্যতার উপর এইরূপ একটা ঘোরতর সংশয় জন্মিয়াছে। সমস্ত ফাঁকি বলিয়া মনে হইতেছে। সকলে ভীত হইয়া মনে করিতেছেন আমাদের প্রাচীন রীতিনীতির জীর্ণ দুর্গের মধ্যে আশ্রয় লওয়াই সর্ব্বাপেক্ষা নিরাপদ। ইংরাজি সভ্যতার মধ্যে সহৃদয়তা  ও অকৃত্রিমতা নাই।

 

ইহার প্রধান কারণ ইংরাজের নিকট হইতে সহৃদয়তা প্রত্যাশা করিয়া আমরা নিরাশ হইয়াছি, এবং আমাদের আহত হৃদয়ের বেদনায় ইংরাজি সভ্যতাকে আমরা সম্পূর্ণ অস্বীকার করিতে চেষ্টা  করিতেছি। এমন সময়ে হিউম, ইউল, বেডর্‌বর্ণ কন্‌গ্রেসকে অবলম্বন করিয়া আমাদের সেই নষ্ট বিশ্বাস উদ্ধার করিতে অগ্রসর হইয়াছেন। ইহাতে যে কেবল আমাদের রাজনৈতিক উন্নতি হইবে তাহা নহে, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমরা যে নূতন শিক্ষা নূতন সভ্যতার আশ্রয়ে আনীত হইয়াছি তাহার প্রতি বিশ্বাস বলিষ্ঠ হইয়া তাহার সুফলসকল স্বেচ্ছাপূর্ব্বক অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিব এবং এইরূপে আমাদের সর্ব্বাঙ্গীণ উন্নতি হইবে। আমরা ইতিহাসে ও সাহিত্যে ইংরাজের যে মহৎ আদর্শ লাভ করিয়াছি সেই আদর্শ মূর্ত্তিমান ও জীবন্ত হইয়া আমাদিগকে মনুষ্যত্বের পথে অগ্রসর করিয়া দিবে।

 

আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রের মধ্যে যতই সাধুপ্রসঙ্গ ও সৎশিক্ষা থাক্‌ তাহা এক হিসাবে মৃত, কারণ যে সকল মহাপুরুষেরা সেই সাধুভাব সকলকে প্রদান করিয়াছিলেন এবং তাহা হইতে পুনশ্চ প্রাণলাভ করিয়াছিলেন, তাঁহারা আর বর্ত্তমান নাই--কেবল শুষ্ক শিক্ষায় অসাড় জীবনকে চৈতন্যদান করিতে পারে না। আমরা মানুষ চাই। বর্ত্তমান সভ্যতা যাঁহাদিগকে মহৎজীবন দান করিয়াছে এবং যাঁহারা বর্ত্তমান সভ্যতাকে সেই জীবন প্রত্যর্পণ করিয়া সঞ্জীবিত করিয়া রাখিয়াছেন সেই সকল মহাপুরুষের মহৎ প্রভাব প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে চাই, তবে আমাদের শিক্ষা ও চরিত্র সম্পূর্ণতা লাভ করিবে। হিউম্‌কে নিকটে পাইয়া আমাদের ইংরাজি ইতিহাসশিক্ষার ফল সর্ম্পূণতা প্রাপ্ত হইতেছে--নতুবা আমরা যে-সকল উদাহরণ দেখিয়াছি ও দেখিতেছি, তাহাতে সে শিক্ষা অনেক পরিমাণে নিষ্ফল হইয়া যাইতেছিল।

 

অতএব কন্‌গ্রেসের দ্বারায় উত্তরোত্তর আমাদের যথার্থ রাজভক্তি বৃদ্ধি হইতেছে এবং মহৎ মনুষ্যত্বের নিকট সংস্পর্শ লাভ করিয়া আমাদের জীবনের মধ্যে অলক্ষিতভাবে মহত্ত্ব সঞ্চারিত হইতেছে।

 

আমরা কথা কহি বলিয়া যে ইংরাজি সম্পাদকেরা আমাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন, তাঁহাদের মনের ভাব যে কি তাহা ঠিক জানি না। বোধ করি তাঁহারা বলিতে চান "তোমরা কাজ করো"।

 

ঠিক সেই কথাটাই হইতেছে। কাজ করিতেই চাই। সেই জন্যই আগমন। যখন আমরা কাজ চাহিতেছি তখন তোমরা বলিতেছ, "কথা কহিতেছ  কেন! " আচ্ছা, দাও কাজ।

 

অমনি তোমরা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিবে,"না না, সে কাজের কথা হইতেছে না--তোমরা আপন সমাজের কাজ করো!"

 

আমরা সমাজের কাজ করি কি না করি সে খবর তোমরা রাখ কি? যখনি কাজ চাহিলাম অমনি আমাদের সমাজের প্রতি তোমাদের সহসা একান্ত অনুরাগ জন্মিল। আমাদের সমাজের কাজে যদি আমরা কোন শৈথিল্য করি আমাদের চৈতন্য করাইবার লোক আছে; জানইত বাক্‌শক্তিতে আমরা দুর্ব্বল নহি। অতএব পরামর্শ বিলাত হইতে আমদানি করা নিতান্ত বাহুল্য।

 

যাঁহারা রাজনীতিকে সমাজনীতির অপেক্ষা প্রাধান্য দিয়া থাকেন, যাঁহারা রাজ-পুরুষদের কর্ত্তব্যবুদ্ধি উদ্রেক করাইতে নিরতিশয় ব্যাপৃত থাকিয়া নিজের কর্ত্তব্যকার্য্যে অবহেলা করেন, তাঁহারা অন্যায় করেন এবং সে সম্বন্ধে আমাদের স্বজাতীয়দিগকে সর্তক করিয়া দিবার জন্য আমরা মাঝে মাঝে চেষ্টার ত্রুটি করি না। শ্রোতৃবর্গ বোধ করি বিস্মৃত হইবেন না, বর্ত্তমান বক্তাও ক্ষুদ্রবুদ্ধি ও ক্ষুদ্রশক্তি অনুসারে মধ্যে মধ্যে অগত্যা এইরূপ অপ্রীতিকর চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন।

 

কর্ত্তব্যের আপেক্ষিক গুরুলঘুতা সকল সময়ে সূক্ষ্মভাবে বিচার করিয়া চলা কোন জাতির নিকট হইতে আশা করা যাইতে পারে না। অন্ধতা, হৃদয়ের সঙ্কীর্ণতা বা কৃত্রিম প্রথা দ্বারা নীত হইয়া তোমাদের স্বজাতীয়েরা যখনি যথার্থ পথ পরিত্যাগ করিয়াছে এবং অপ্রকৃতকে প্রকৃতের অপেক্ষা অধিকতর সম্মান দিয়াছে, তখনি তোমাদের চিন্তাশীল পণ্ডিতগণ, তোমাদের কার্লাইল, ম্যাথ্যুআর্ণল্ড, রস্কিন্‌ স্বজাতিকে সতর্ক করিতে ভূয়োভূয়ঃ চেষ্টা করিয়াছেন।

 

তাঁহাদের সে চেষ্টা সফল হইতেছে কি না বলা কঠিন। কারণ, সামাজিক সংস্কারকার্য্য অপেক্ষাকৃত নিঃশব্দে নিগুঢ় অলক্ষিতভাবে সাধিত হইয়া থাকে। নৈসর্গিক জীবন্তশক্তির ন্যায় সে আপনাকে গোপন করিয়া রাখে। তাহার প্রতিদিনের প্রত্যক্ষ হিসাব পাওয়া দুঃসাধ্য।

 

আমাদের সমাজেও সেইরূপ জীবনের কার্য্য চলিতেছে, তাহা বিদেশীয় দৃষ্টিগোচর নহে। এমন-কি স্বদেশীয়ের পক্ষেও সমাজের পরিবর্ত্তন প্রতি মুহূর্ত্তে অনুভবযোগ্য হইতে পারে না।

 

অতএব আমাদের সমাজের ভার আমাদের দেশের চিন্তাশীল লোকদের প্রতি অর্পণ করিয়া যে কথাটা তোমাদের কাছে উঠিয়াছে আপাততঃ তাহারই উপযুক্ত যুক্তি দ্বারা তাহার বিচার কর। বলযে "তোমরা অযোগ্য" অথবা বল যে "আমাদের ইচ্ছা নাই"--কিন্তু "তোমাদের বাল্যবিবাহ আছে" বা "বিধবাবিবাহ নাই" এ কথাটা নিতান্তই অসংলগ্ন হইয়া পড়ে। সামাজিক অসম্পূর্ণতা  তোমাদের দেশেও আছে এবং পূর্ব্বে হয়ত আরো অনেক ছিল, কিন্তু সে কথা বলিয়া তোমাদের বক্তৃতা কেহ বন্ধ করে নাই, তোমাদের রাজনৈতিক প্রার্থনা কেহ নিরাশ করে নাই।

 

তোমরা এমন কথাও বলিতে পারিতে যে "তোমাদের দেশে আমাদের মত এমন সঙ্গীতচর্চ্চা ও চিত্রশিল্পের আদর এখনো হয় নাই অতএব তোমাদের কোন কথাই শুনিতে চাহি না।  ইহা অপেক্ষা বলা ভাল "আমার ইচ্ছা আমি শুনিব না, তাহাতে তোমাদেরও কথা অনেকটা সংক্ষেপ হইয়া আসে। কিন্তু তোমাদের জাতির মধ্যেই তোমাদের অপেক্ষা আরো উচ্চ বিচারশালা আছে, সেই জন্যই আমরা আশা ত্যাগ করি নাই এবং সেই জন্যই আমাদের কন্‌গ্রেস।

 

যদিও আমার এ-সকল কথা তোমাদের কর্ণগোচর হইবার কোন সম্ভবনা নাই--কারণ, আমাদের সমাজের মঙ্গলের প্রতি তোমাদের অত্যন্ত প্রচুর অনুরাগ সত্ত্বেও আমাদের ভাষা তোমরা জান না, জানিতে ইচ্ছাও  কর না--তথাপি দুরাশায় ভর করিয়া আমাদের কন্‌গ্রেসের প্রতি তোমাদের অকারণ অবিশ্বাস দূর করিবার জন্য মাঝে হইতে তৎসম্বন্ধে এতটা কথা বলিলাম। দেখাইলাম তোমাদের প্রতি ভক্তিই কন্‌গ্রেসের একমাত্র আশা ও সম্বল।

 

অতএব কন্‌গ্রেসের নিকট হইতে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হইতেছে তাহার প্রতি এমন ভ্রূকুটি করিয়া থাকা তোমাদের বিবেচনার ভুল। তাহার প্রতি প্রসন্ন কর্ণপাত করা রাজনৈতিক ধর্মনৈতিক সকল প্রকার কারণে তোমাদের কর্ত্তব্য। কারণ, কন্‌গ্রেস জেতৃ ও জিত--জাতির মধ্যে সেতুবন্ধন করিয়া দিতেছে।

 

গবর্নমেন্টের দ্বারা মন্ত্রিনিয়োগ অপেক্ষা সাধারণ লোকের দ্বারা মন্ত্রি-অভিষেক অনেক কারণে আমাদের নিকটে প্রার্থনীয় মনে হয়।

 

পূর্ব্বেই বলিয়াছি সন্তোষ একটি প্রধান কারণ। আমাদের শিক্ষিতমন্ডলী এই অধিকার প্রার্থনা করিতেছে। যদি ইহা দান করিলে গবর্নমেন্টের কোন ক্ষতি না হয় ত প্রজারঞ্জন একটা মহৎলাভ।

 

গবর্ণমেন্ট শব্দটা শুনিবামাত্র হঠাৎ ভ্রম হয় যেন তাহা মানবধর্ম্মবিবর্জ্জিত নির্‌গুণ পদার্থ। যেন তাহা রাগদ্বেষবিহীন। যেন তাহা স্তবে বিচলিত হয় না, বাহ্য চাকচিক্যে ভোলে না, যেন তাহার আত্মপরবিচার নাই, যেন তাহা নিরপেক্ষ কটাক্ষের দ্বারা মন্ত্রবলে মানবচরিত্রের রহস্য ভেদ করিতে পারে। অতএব এরূপ অপক্ষপাতী সর্ব্বদর্শী অলৌকিক পুরুষের হস্তেই নির্ব্বাচনের ভার থাকিলেই যেন ভাল হয়।

 

কিন্তু আমরা নিশ্চয় জানি গবর্ণমেন্ট আমাদেরই ন্যায় অনেকটা রক্তমাংসে গঠিত।উক্ত গবর্ণমেন্ট নিমন্ত্রণে যান, বিনীত সম্ভাষণে আপ্যায়িত হন, লন্‌টেনিস্‌ খেলেন, মহিলাদের সহিত মধুরালাপ করেন এবং অধম আমাদেরই মত সামাজিক স্তুতিনিন্দায় বহুল পরিমাণে বিচলিত হইয়া থাকেন।

 

অতএব, এ স্থলে গবর্ণমেন্টের দ্বারা নির্ব্বাচনের অর্থ আর কিছুই নয়, একটি বা দুইটি বা অল্প সংখ্যক  ইংরাজের দ্বারা নির্ব্বাচন।

 

কিন্তু আমরা পদে পদে প্রমাণ পাইয়াছি ভারতবর্ষীয় ইংরাজেরা নব্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতি একান্ত অনুরক্ত নহেন। কারণ, নব্যরুচি অনুসারে ইঁহারা চশমা ব্যবহার করেন, দাড়ি রাখেন, ইংরাজি জুতা পরেন, এবং সে জুতা সহজে খুলিতে চাহেন না। তদ্ভিন্ন ইঁহাদের স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা, ইঁহাদের ঔদ্ধত্য, ইঁহাদের বক্তৃতাশক্তি প্রভৃতি নানা কারণে তাঁহারা একান্ত উদ্‌বেজিত হইয়া আছেন। অতএব তাঁহাদের হস্তে নির্ব্বাচনের ভার থাকিলে এই শিক্ষিত দলের পক্ষে বড় আশার কারণ নাই। ইঁহাদের দর্প চূর্ণ করা তাঁহারা রাজনৈতিক কর্ত্তব্য জ্ঞান করেন। অতএব শিক্ষিত লোকেরা তাহাঁদের দ্বারে প্রার্থী হইয়া দাঁড়াইলে কেবল যে নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিবেন তাহা নহে, উপরন্তু সাহেবের নিকট দুটো শ্রুতিপরুষ অথচ বাৎসল্যগর্ভ উপদেশ শুনিয়া এবং প্রবেশাধিকারের মূল্যস্বরূপ দ্বারীকে কিঞ্চিত দন্ড দিয়া আসিতে হইবে।

 

কিন্তু ইংরাজি শিক্ষা কিছু এমনি বিড়ম্বনা নহে যে কেবল শিক্ষিত ব্যক্তিরাই সকল প্রকার যোগ্যতা লাভে অক্ষম হইয়াছেন। অতএব শিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রতি ভারতবর্ষীয় ইংরাজের এই-যে বিরাগ তাহা কেবল ব্যক্তিগত রুচিবিকার মাত্র, তাহা যুক্তিসঙ্গত ন্যায়সঙ্গত নহে।

 

তদ্ভিন্ন তাঁহারা কয় জন দেশীয় উপযুক্ত লোককে রীতিমত জানেন?  তাঁহাদের নির্ব্বাচনক্ষেত্রের পরিধি কতই সঙ্কীর্ণ! উপাধিবান রাজা উপরাজার সহিতই তাঁহাদের কিয়ৎপরিমাণ মৌখিক আলাপ আছে মাত্র। মন্ত্রিসভায় আসন পাওয়া যাঁহারা কেবলমাত্র সম্মান বলিয়া জ্ঞান করেন, জীবনের গুরুতর কর্ত্তব্য বলিয়া জ্ঞান করেন না, তাঁহারাই অধিকাংশ সময়ে সেখানে স্থান পাইয়া থাকেন।

 

অবশ্য, সময়ে সময়ে ইহার ব্যতিক্রমও ঘটিয়াছে। অনেক যোগ্য ব্যক্তিও স্থান পাইয়াছেন সন্দেহ নাই। তাঁহাদের মধ্যে কাহারো কাহারো সহিত বর্ত্তমান বক্তার পরম গৌরবের আত্মীয়তাসম্পর্ক আছে। কিন্তু সে-সকল যোগ্য ব্যক্তি সাধারণের অপরিচিত নহেন। সাধারণের দ্বারা তাঁহাদের নির্ব্বাচিত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল।

 

আমার জিজ্ঞাস্য কেবল এই যে, আমাদের অপেক্ষা গবর্ণমেন্টের অর্থাৎ দুই-চারি জন ইংরাজের এ বিষয়ে অধিক অভিজ্ঞতা কোথায়?  আমাদের শিক্ষিতসাধারণে যাঁহাদিগকে বড়লোক বলিয়া জানেন তাঁহাদের অবশ্য কিছু না কিছু যোগ্যতা আছেই। কিন্তু গবর্ণমেন্ট যাঁহাদিগকে বড়লোক বলিয়া জানেন, তাঁহাদের বিপুল ঐশ্বর্য্য, বৃহৎ শিরোপা বা অতিবিনীত সেলামের ক্ষমতা থাকিতে পারে, কিন্তু যথার্থ যোগ্যতা না থাকিতেও পারে।

 

আমরা যতদূর দেখিতে পাই তাহাতে আমাদের বিশ্বাস, মন্ত্রিসভায় দেশীয় মন্ত্রী নিয়োগ গবর্ণমেন্ট তেমন অত্যাবশ্যক মনে করেন না, সুতরাং নিব্বার্চনের সময় যথেষ্ট সাবধান ও বিবেচনার সহিত কাজ করা তাঁহারা অনেকটা বাহুল্য বোধ করিতে পারেন। কিন্তু আমাদের ভাব ঠিক তাহার বিপরীত। গবর্ণমেন্টকে বাস্তবিক সুপরামর্শ দিয়া দেশের হিতসাধন করিতে হইবে এবং স্বজাতির যোগ্যতা প্রমাণ করিয়া গৌরব লাভ করিব, এই আমাদের উদ্দেশ্য, কেবলমাত্র সভাগৃহের শোভাসম্পাদনে আমাদের কোন ফল নাই, স্বার্থ নাই। সুতরাং নির্ব্বাচনের সময় আমাদিগকে সবিশেষ বিবেচনার সহিত কাজ করিতে হইবে।

 

পুনশ্চ,গবর্ণমেন্ট যাঁহাদিগকে নিযুক্ত করেন তাঁহারা গবর্ণমেন্টের অনুগ্রহ-আশ্রয়ে নির্ভয়ে থাকিতে পারেন, আমাদের নির্ব্বাচিত প্রতিনিধির সে আশা নাই, সুতরাং খুব মজবুৎ দেখিয়াই লোক বাছিতে হইবে। অতএব আমাদের হাতে যোগ্য লোক বাছাই হইবার সম্ভবনা অনেক বেশি।

 

অর্থাৎ, গ্রাম্য ভাষায় যাহাকে  "গরজ" বলে তাহার দ্বারা সংসারের অধিকাংশ কাজ হইয়া থাকে। মন্ত্রিসভায় দেশীয় লোক নির্ব্বাচন করিতে গবর্ণমেন্টের কোন গরজ দেখা যাইতেছে না। অর্দ্ধ অনিচ্ছার সহিত তাঁহারা একটা আপোষে মীমাংসা করিতে চাহেন। লর্ড্‌ ক্রস বলেন যদি ভারতশাসনকর্ত্তারা ইচ্ছা করেন ত নিজে গুটিকতক দেশীয় লোক নির্ব্বাচন করিয়া মন্ত্রীসংখ্যা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি করিতে পারেন। আমাদের ভারতরাজকর্ম্মচারীগণও এ বিষয়ে যে বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করিতেছেন তাহা বলিতে পারি না।

 

অতএব যখন দেশীয় মন্ত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি করিতে গবর্ণমেন্টের কিছুমাত্র গরজ নাই, অর্থাৎ তাঁহাদের মতে দুই-চারিটা দেশী লোককে ডাকিলেও চলে, না ডাকিলে হয়ত আরো ভালো চলে, তখন তাঁহাদের হাতে নির্ব্বাচনের ভার কোন্‌ সাহসে দিই! গরজ আমাদেরই। অতএব আমরাই যথার্থ নির্ব্বাচনের অধিকারী।

 

এমন দুরাশাও আমরা করিতেছি না যে, আমাদের প্রতিনিধিদের হস্তে রাজক্ষমতা থাকিবে। তাঁহারা কেবল নিবেদন করিবেন মাত্র ; বিচারের ভার, কার্য্যের ভার তোমাদের। আমরা কেবল জানাইতে চাহি ও জানিতে চাহি। তোমরা আমাদের উপর আইন খাটাইবে। আমরা আমাদের গায়ের মাপ দিতে চাহি। দেখাইতে চাহি কোথায় কষাকষি করিলে আমাদের নিঃশ্বাস রোধ হইয়া আসে, এবং কোথায় ঢিলা হইলে আমাদের অনাবশ্যক ব্যয়বাহুল্য ও আরামের ব্যাঘাত হয়।

 

অতএব আমাদেরই লোক যদি না পাঠাইলাম তবে আমাদের আবশ্যক কে জানাইবে? তোমরা যাহাকে নির্ব্বাচন করিয়া সন্মানিত কর সে স্বাভাবতই কিয়ৎ পরিমাণে তোমাদের অঙ্গভঙ্গীর অনুকরণ করে ও তোমাদেরই ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করে মাত্র। তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কথা জানাইতে সহজে তাহার প্রবৃত্তি হইতেই পারে না।

 

এ সম্বন্ধে আলোচনা করিতে গেলে একটি প্রশ্নের মিমাংসা আবশ্যক। তোমরা যে অতিরিক্ত আরো গুটিকতক দেশীয় লোক মন্ত্রিসভায় আহ্বান করিতেছ তাহার উদ্দেশ্য কি? আমাদের অভাব, আমাদের আবশ্যক, আমাদের লোকের মুখে আরো ভাল করিয়া জানিতে চাও। ইহা ছাড়া দেশীয় মন্ত্রিবৃদ্ধির আর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকিতে পারে না। যদি বাস্তবিক সেই উদ্দেশ্যই থাকে তবে সহজেই বুঝিতে পারিবে তোমাদের নির্ব্বাচনে তাহা সম্পূর্ণ সাধিত হইবার সম্ভবনা অল্প, এবং আমাদের নির্ব্বাচনেই সেই উদ্দেশ্য বাস্তবিক সফল হইবে। আগে একটা উদ্দেশ্য পরিষ্কাররূপে স্থির কর, তার পরে সে উদ্দেশ্য কিসে সিদ্ধ হইবে বিবেচনা করিয়া দেখ।

 

যদি বল "উদ্দেশ্য বিশেষ কিছুই নাই, আমরা দেশীয় মন্ত্রীর কোন আবশ্যক বোধ করিতেছি না, কেবল, তোমরা কিছুদিন হইতে বড় বিরক্ত করিতেছ, তাই অল্পসল্প খোরাক দিয়া তোমাদের মুখ বন্ধ করাই আমাদের উদ্দেশ্য", তবে সে উদ্দেশ্য সফল হয় নাই আজই তাহার প্রমাণ। আজ আমরা এই সহরের যত বক্তা এবং যত শ্রোতা ইন্‌ফ্লয়েঞ্জা শয্যা হইতে কায়ক্লেশে গাত্রোত্থান করিয়া ভগ্নক্ষীণকন্ঠে আপত্তি উত্থাপন করিতে আসিয়াছি, শরীর যতই সুস্থ ও কন্ঠস্বর যতই সবল হইতে থাকিবে আমাদের আপত্তি ততই অধিকতর তেজ ও বায়ুবল লাভ করিতে থাকিবে সন্দেহ নাই।

 

আমাদের ভূতপূর্ব্ব রাজপ্রতিনিধিগণের মধ্যে অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন যে, ভারতরাজ্যতন্ত্রে প্রজাসাধারণের দ্বারা মন্ত্রীনির্ব্বচন কোন না কোন উপায়ে প্রবর্ত্তিত করা যুক্তিসঙ্গত। এ সম্বন্ধে লর্ড্‌ নর্থ ব্রুক, লর্ড্‌ রিপন, লর্ড্‌ ডফারিন, স্যর্‌ রিচার্ড্‌ টেম্প্‌ল প্রভৃতির কথা কতদূর শ্রদ্ধার যোগ্য তাহা বলা বাহুল্য। তাঁহাদের উপরে আমাদের আর নূতন যুক্তি দেখাইবার আবশ্যক করে না।

 

আমরা কেবল এই বলিয়া আক্ষেপ করিব যে, যুক্তি আমাদের পক্ষে, অভিজ্ঞতা আমাদের পক্ষে, সহৃদয়তা আমাদের পক্ষে, বড় বড় সুযোগ্য লোকের মত আমাদের পক্ষে, তথাপি কেন আমাদের ইচ্ছা পূর্ণ হয় না। আমাদের এই দুর্দ্দশা দেখিয়াই আমরা আরো অধিকতর আগ্রহের সহিত প্রার্থনা করিব যে, যে রাজকীয় রহস্যধামে আমাদের ভাগ্য স্থির হয় সেখানে আমাদের আপনার লোক যেন পাঠাইতে পারি--তাহা হইলে যদি কোন প্রার্থনায় নিষ্ফলকাম হই, তবে আর কিছু না হৌক তাহার একটা যুক্তিসঙ্গত উত্তর শুনিবার স্বল্প সুখ হইতে বঞ্চিত হইব না।

 

এইখানেই আমি ক্ষান্ত হইতে চাহি। আলোচ্য প্রস্তাব সম্বন্ধে অনেক প্রমাণ, অনেক তর্ক এবং অনেক ইতিহাস আছে। আমি একান্ত সসঙ্কোচে তাহার প্রতি হস্তক্ষেপ করি নাই। অভ্যাস অনুরাগ ও চর্চ্চা অনুসারে রাজনীতি আমার অধিকার বহির্‌ভূত। কেবল মনে মনে ঈষৎ ভরসা আছে যে, রাজনৈতিক প্রসঙ্গও সম্ভবতঃ যুক্তিশাস্ত্রের বিধানের মধ্যে ধরা দেয়, অর্থাৎ সত্যের নিয়ম হয়ত এখানেও খাটে, এই জন্য সহজ বুদ্ধির উপর নির্ভর করিয়া লর্ড্‌ ক্রসের রচিত বিধির বিরুদ্ধে আমার আপত্তি ব্যক্ত করিয়াছি। অনভিজ্ঞতাবশতঃ যদি কোন ত্রুটি বা অসর্ম্পূণতা প্রকাশ পায়, তবে আমার পরবর্ত্তী যোগ্যতর বক্তা মহাশয়েরা অনুগ্রহপূর্ব্বক তাহা সংশোধন ও সম্পূরণ করিয়া লইবেন। যনি কোন অন্যায় অবিবেচনার কথা বলিয়া থাকি, তবে তাহার পাপের ভার শ্রোতৃবর্গ অনুগ্রহপূর্ব্বক বক্তার নিজের শিরে চাপাইবেন, কোন সম্প্রদায় বা সভার স্কন্ধে আরোপ করিবেন না।

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •