হৃদয় যখন ভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে তখন কোম্পানির দমকল এলেও থামাতে পারে না। একান্নবর্তী পরিবার-প্রথা সম্বন্ধে সভায় দাঁড়িয়ে অনর্গল বলতে লাগলুম, সভাপতি ঘুমিয়ে পড়াতে নিষেধ করবার কেউ রইল না। শেষকালে দুজন ছোকরা এসে দুই হাত ধরে আমাকে টেনে বসিয়ে দিলে। সেদিন এত উৎসাহ হয়েছিল!

বটে, তা হবার কথাই তো। তা, আপনি কী বলেছিলেন?

আমি বলেছিলেম, স্বার্থত্যাগের একমাত্র উপায় একান্নবর্তী পরিবার। যেখানে পরের অর্থেই জীবননির্বাহ হয় সেখানে স্বার্থের কোনো প্রয়োজনই হয় না। খবরের কাগজে আমার বক্তৃতা খুব রটে গেছে-- তারা সকলেই বলছে, দুঃখের বিষয় দৌলতবাবুর পরিবার কেউ নেই, তিনি একলা।

জয় হোক বাবা! আমি তোমার পিসে।

সে কী মশায়, আমার তো পিসি নেই।

না, তাঁর কাল হয়েছে বটে।

পিসি কোনোকালেই যে ছিলেন না।

(ঈষৎ হাসিয়া) সে কী করে হয় বাবা! আমি তা হলে তোমার পিসে হলুম কী করে! (কানাইয়ের প্রতি) কী বলেন মশায়!

তা তো বটেই।

যে আজ্ঞে, তা আপনার কী অভিপ্রায়ে আগমন?

অভিপ্রায় তেমন বিশেষ কিছু নয়। শুনলুম আমরা পৃথক হয়ে আছি ব'লে খবরের কাগজে নিন্দে করছে, তাই একত্র বাস করতে এসেছি।

আপনার সম্পত্তি কিছু আছে?

কিছু নাই, কোনো বালাই নেই, কোনো উৎপাত নেই। কেবল এক খুড়তুতো ভাই আছে-- তা, সেও এল ব'লে।

তা বটে। তাঁর কিছু আছে?

কিছু না, কোনো ঝঞ্ঝাট না। কেবল দুই স্ত্রী ও চারটি শিশুসন্তান; তরাও এল ব'লে। এতক্ষণ এসে পড়ত; যাত্রা করবার বেলা দুই স্ত্রীতে চুলোচুলি বেধে গেছে, তাই যা দেরি।

কানাই, কি করা যায়!

তোমাকে কিছুই করতে হবে না-- তারা আপনারাই আসবে, ভাবনা কী দৌলত! এত অল্পে কাতর হোয়ো না। তারা আজ সন্ধ্যার মধ্যেই এসে পৌঁছবে।

মামা, তোমার বক্তৃতায় বড়ো লজ্জা দিয়েছ।

কে হে বাপু, কে তুমি?

আজ্ঞে, আপনারই ভাগ্‌নে রামচরণ। ইস্টিশনে লোক পাঠিয়ে দিন-- সেখেনে একটি পুঁটুলি আর বুড়ি মাকে রেখে এসেছি।

এখানে কী করতে আসা?

বাস করতে।

আর কোথাও বাসস্থান নেই?

একরকম আছে বটে, কিন্তু সেখানে স্বার্থত্যাগ শিক্ষা হয় না।

(ভীতভাবে) কানাই!

আপনার উপদেশ উনি যেরকম দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করেছেন ওঁকে বোধ হয় নড়ানো শক্ত হবে।

দাদা, চাকরি ছেড়ে এলুম, নইলে তোমার যে নিন্দে হয়। কে আছিস রে! ঝট্‌ করে দুটো ডাব পেড়ে নিয়ে আয় তো। বড়ো পিপাসা লেগেছে।

এই লও খুড়ো, আমার সমস্ত স্বার্থ বিসর্জন দিতে এসেছি। এই আমার ভাঙা বোক্‌নো, থেলো হুঁকো আর এই বেড়ালছানাটি। এর মধ্যে ও দুটো পৈতৃক সম্পত্তি, বেড়ালছানা আমার স্বোপার্জিত। আর আমার দোষ দিতে পারবে না, তোমার এখানেই আমি লেগে রইলুম।

তুমি আমার কে হও বাপু?

আজ্ঞে আমি দর্জি, আপনার গায়ের মাপ নিতে এসেছি।

এখন যাও, টানাটানির সময়। এখন আমি কাপড় করাতে পারব না।

খলিফাজি, যাও কোথায়। আমার গায়ের মাপটা নেও। খুড়োর গায়ে যে-রকম ফুলকাটা ছিটের জামা দেখছি অমনি ছ-জোড়া হলেই আমার চলে যাবে। যদি বেশ ভালো রকম করে তৈরি করে দিতে পারো তো খুড়ো তোমাকে খুশি করে দেবেন, বুঝেছ খালিফাজি?

যে আজ্ঞে।

(দৌলতকে প্রণাম করিয়া বালকের প্রতি) তোর জ্যাঠামশায়কে প্রণাম কর্‌। দাদা, এই লও তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র।

আমার ভ্রাতুষ্পুত্র।

যাকে চলিত বাংলায় বলে ভাইপো। দাদা যে একেবারে অবাক্‌। ভ্রাতৃ শব্দের ষষ্ঠীতে হয় ভ্রাতুঃ, তার উপরে পুত্র শব্দ যোগ করলেই হল ভ্রাতুষ্পুত্র। স্বয়ং পাণিনি বোপদেব রয়েছেন, অন্য প্রমাণের প্রয়োজন কী? অতএব ইনি হলেন ভাইপো।

আপনার ছেলেটি কী করেন?

ওকে নিজেই পড়াচ্ছিলুম। হ্রস্ব ই পর্যন্ত সেরে দীর্ঘ ঈতে এমনি আটকে পড়ল যে ভাবলুম, দৌলদ্দা যখন আছেন তখন ছেলের লেখাপড়ার দরকার কী? যে বেটার হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান নেই তার পক্ষে বাবা জ্যাঠা দুই সমান। কেমন কিনা?

সমান বৈকি।

দাদা বলেছেন, নিজের ক্ষুধা হেয় জ্ঞান ক'রে পরের ক্ষুধানিবৃত্তির সুখ একমাত্র একান্নবর্তী পরিবারেই সম্ভব। শুনেই ঠাওরালুম, এ সুখ দাদা নিশ্চয়ই অনেক দিন পান নি। যদি বা পেয়ে থাকেন বিস্মৃত হয়েছেন। তাই নিতান্ত মমতাপরবশ হয়ে ছেলেটিকে এখানে নিয়ে এলুম। রাবণের চুলো যদি কোথাও জ্বলে সে এর পেটের মধ্যে।

(দৌলতের কান মলিয়া) কী রে শালা! শুনলুম না কি শালার শোকে সভায় দাঁড়িয়ে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিস?

কে হে তুমি বেল্লিক! ভদ্রলোকের কানে হাত দাও!

ভগ্নীপতির কান মলব না তো কি কান ভাড়া করে এনে মলব! কী বলেন মশায়?

কথাটা তো ঠিক বটে।

কী বল হে কানাই! আমার স্ত্রীই নেই, তো আবার শালা কিসের?

তোমারই যেন স্ত্রী নেই, তাই বলে আর কারো স্ত্রী নেই? একটু ভেবে দেখো-না।

স্ত্রী তো অনেকেরই আছে, তা আর ভাবতে হবে কী!

(হাসিয়া) তবে?

(সরোষে) তবে কী! তুমি আমার শালা কোন্‌ সম্পর্কে?

কেন, দাদার সম্পর্কে। দাদা আছেন তো! শালাই যেন ভাঁড়ালে, কিন্তু দাদা বেকবুল গেলে তো চলবে না!

আমি তো জানতেম নেই, কিন্তু আজ যে-রকম দেখছি তাতে--

থাক্‌, তা হলেই তো চুকে গেল। বেশি বকাবকিতে কাজ কী? ভদ্রলোক বসে আছেন, এঁর সামনে কে শালা আর কে শালা নয় তা নিয়ে তক্‌রার করা ভালো দেখায় না। (দৌলতের পশ্চাৎ হইতে তাকিয়া টানিয়া লইয়া) একটু জিরোনো যাক, এক ছিলিম তামাক ডাকো।

(দৌলতকে) আপনার জলখাবার।

(সরোষে) বেটা, তোকে এখানে কে খাবার আনতে বলেছে? বাড়ি-ভিতর নিয়ে যা!

বিলক্ষণ, তাতে দোষ হয়েছে কী! (ভৃত্যের প্রতি) ওরে তুই দিয়ে যা, এ দিকে দিয়ে যা।

পোড়ারমুখো তোমার মরণ হয় না!

(শশব্যস্তে) এঁরা কে?

বাবা, ব্যস্ত হোয়ো না, আমার সেই খুড়তুত ভাই এসে পৌঁচেছেন।

ও আবাগের বেটা ভূত!

মার্‌ ঝাঁটা, মার্‌ ঝাঁটা!

ভাই কানাই!

সহিষ্ণুতা শিক্ষার এমন উপায় আর কী আছে!

মিন্‌সে তুমি বুড়োবয়সে আক্কেল খুইয়ে বসেছ!

ওগো, এত লোকের এত স্বামী মরছে, যমরাজ কি তোমাকেই ভুলেছে!

বাছারা একটু ঠাণ্ডা হও।

ঠাণ্ডা হব কিরে মিন্‌সে। তুই ঠাণ্ডা হ, তোর সাত পুরুষ ঠাণ্ডা হয়ে মরুক।

কানাই!

গৃহ পূর্ণ হয়েছে--

গ্রহ পূর্ণ হয়েছে বলো--

যাই হোক, আজ আর আমাকে প্রয়োজন নেই। আমি এই বেলা সরি।

(উচ্চস্বরে ) কানাই, আমাকে একলা রেখে পালাও কোথায়!

(দৌলতকে চাপিয়া ধরিয়া) একলা কিসের! আমরা সবাই আছি, আমরা কেউ নড়ব না।

বল কী!

হাঁ, তোমার গা ছুঁয়ে বলছি।