বৈশাখ ১২৯৪ 


 

রথযাত্রা (rathajatra)

আমার স্নেহাস্পদ ছাত্র শ্রীমান প্রমথনাথ বিশীর কোনো রচনা হইতে এই নাট্যদৃশ্যের ভাবটি আমার মনে আসিয়াছিল।
১ নাগরিক।
মহাকালের রথযাত্রায় এবার যে রথ অচল হয়ে রইল। কিছুতেই নড়লেন না। কার দোষে হল তা জানি, গণৎকার গুনে বলে দিয়েছেন।
২ নাগরিক।
হয়তো কারো দোষ নেই, হয়তো মহাকাল ক্লান্ত, আর চলতে রাজি নন।
১ নাগরিক।
আরে বল কী। চলতে রাজি না হলে আমাদের চলবে কী করে। ঐ দেখো-না, রথের দড়িটা পড়ে আছে, কত যুগের দড়ি-- কত মানুষের হাত পড়েছে ঐ দড়িতে, এমন করে তো কোনোদিন ধুলোয় পড়ে থাকে নি।
৩ নাগরিক।
রথ যদি না চলে, আর ঐ দড়ি পড়ে থাকে, তা হলে ও যে সমস্ত রাজ্যের গলায় দড়ি হবে।
৪ নাগরিক।
বাবা রে, ঐ দড়িটা দেখে ভয় লাগছে, মনে হচ্ছে ও যেন ক্রমে ক্রমে সাপ হয়ে ফণা ধরে উঠবে।
৩ নাগরিক।
দেখ্‌ না ভাই, একটু একটু যেন নড়ছে মনে হচ্ছে।
১ নাগরিক।
আমরা যদি না নড়াতে পারি, ও যদি আপনি নড়ে ওঠে তা হলে যে সর্বনাশ হবে।
৩ নাগরিক।
তা হলে জগতের সব জোড়গুলো বিজোড় হয়ে উঠবে রে। তা হলে রথটা চলবে আমাদের বুকের পাঁজরের উপর দিয়ে। আমরা ওকে নিজে চালাই বলেই তো ওর চাকার তলায় পড়ি নে। এখন উপায়?
১ নাগরিক।
ঐ দেখ্‌ না, পুরুতঠাকুর বসে মন্ত্র পড়ছে।
২ নাগরিক।
রথযাত্রায় সব আগেই ঐ পুরুতঠাকুরের দলরাই তো দড়ি ধরে প্রথম টানটা দিয়ে থাকেন। এবার কি শুধু মন্ত্র পড়েই কাজ সারবেন নাকি।
৪ নাগরিক।
চেষ্টার ত্রুটি হয় নি। ভোরের বেলা সেই অন্ধকার থাকতে সবার আগে ওঁরাই তো একচোট টানাটানি করে নিয়েছেন। কলিযুগে ওঁদের কি আর তেজ আছে রে।
৩ নাগরিক।
ঐ দেখ্‌, আমার কেমন মনে হচ্ছে ঐ রশিটা যেন যুগ-যুগান্তরের নাড়ীর মতো দব্‌দব্‌ করছে।
১ নাগরিক।
আমার মনে হচ্ছে ঐ রথ চলবে কোনো এক পুণ্যাত্মা মহাপুরুষের স্পর্শ পেলে।
২ নাগরিক।
আরে, রথ চালাতে পুণ্যাত্মা মহাপুরুষের জন্যে বসে থাকলে শুভলগ্নও তো বসে থাকবে না। ততক্ষণে আমাদের মতো পাপাত্মাদের দশা হবে কী।
১ নাগরিক।
পাপাত্মাদের দশা কী হবে সেজন্য ভগবানের মাথাব্যথা নেই।
২ নাগরিক।
বলিস কী রে। পুণ্যাত্মাদের জন্যে এ জগৎ তৈরি হয় নি। তা হলে যে আমরা অতিষ্ঠ হতুম। সৃষ্টিটা আমাদেরই জন্যে। দৈবাৎ দুটো-একটা পুণ্যাত্মা দেখা দেয়, বেশিক্ষণ টিকতে পারে না-আমাদের ঠেলা খেয়ে বনে জঙ্গলে গুহায় তাদের আশ্রয় নিতে হয়।
১ নাগরিক।
তা হলে তুমিই দড়াটা ধরে টান দাও না, দাদা, দেখা যাক রথ এগোয় না দড়াটা ছেঁড়ে, না তুমিই পড় মুখ থুবড়ে।
২ নাগরিক।
দাদা, আমাদের সঙ্গে পুণ্যাত্মাদের তফাতটা এই যে, গুন্‌তিতে তারা একটা-দুটো, আমরা অনেক। যদি ভরসা করে সেই অনেকে মিলে টান দিতে পারি রথ চলবেই। মিলতে পারলেম না বলে টানতে পারলেম না, পুণ্যাত্মাদের জন্যে শূন্যের দিকে তাকিয়ে রইলেম।
৪ নাগরিক।
ওরে ভাই, দড়িটা মনে হল যেন নড়ে উঠল, কথাবার্তা সামলে বলিস রে।
১ নাগরিক।
শাস্ত্রে আছে ব্রাহ্মমুহূর্তে রথের প্রথম টানটা পুরোহিতের হাতে, দ্বিতীয় প্রহরে দ্বিতীয় টানটা রাজার - সেও তো হয়ে গেল রথ এগোল না; এখন তৃতীয় টানটা কার হাতে পড়বে।
সৈন্যদলের প্রবেশ
১ সৈন্য।
বড়ো লজ্জা দিলে রে! স্বয়ং রাজা হাত লাগালে, সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাজার জনে ধরে টান দিলুম, চাকার একটু ক্যাঁচকোঁচ শব্দও হল না।
২ সৈন্য।
আমরা ক্ষত্রিয়, আমরা তো শূদ্রের মতো গোরু নই-- রথ টানা আমাদের কাজ নয়, আমাদের কাজ রথে চড়া।
২ সৈনিক।
কিম্বা রথ ভাঙা। ইচ্ছে করছে কুড়ুলখানা নিয়ে রথটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলি। দেখি মহাকাল কেমন ঠেকাতে পারেন।
১ নাগরিক।
দাদা, তোমাদের অস্ত্রের জোরে রথ চলবেও না, রথ ভাঙবেও না। গণৎকার কী গুনে বলেছে তা শোন নি বুঝি?
১ সৈনিক।
কী বল্‌ তো।
১ নাগরিক ।
ত্রেতাযুগে একবার যে কাণ্ড ঘটেছিল, এখন তাই ঘটবে।
১ সৈনিক।
আরে, ত্রেতাযুগে তো লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছিল।
১ নাগরিক।
সে নয়, সে নয়।
২ সৈনিক।
কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড?
১ নাগরিক।
তারই কাছাকাছি। সেই যে শূদ্র তপস্যা করতে গিয়েছিল, মহাকাল তাতেই তো সেদিন ক্ষেপে উঠেছিলেন। তার পর রামচন্দ্র শূদ্রের মাথা কেটে তবে বাবাকে শান্ত করেছিলেন।
৩ সৈনিক।
আজ তো সে ভয় নেই, আজ ব্রাহ্মণই তপস্যা ছেড়ে দিয়েছে, শূদ্রের তো কথাই নেই।
১ নাগরিক।
এখনকার শূদ্রেরা কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে শাস্ত্র পড়তে আরম্ভ করেছে। ধরা পড়লে বলে, আমরা কি মানুষ নই। স্বয়ং কলিযুগ শূদ্রের কানে মন্ত্র দিতে বসেছে যে তারা মানুষ। রথ যে চলে না তাতে মহাকালের দোষ কি-- না চললেই ভালো। যদি চলতে শুরু করে তা হলে চন্দ্রসূর্য গুঁড়িয়ে ফেলবে। শূদ্র চোখ রাঙিয়ে বলে কিনা আমরা কি মানুষ নই। কালে কালে কতই শুনব!
১ সৈনিক।
আজ শূদ্র পড়ছে শাস্ত্র, কাল ব্রাহ্মণ ধরবে লাঙল! সর্বনাশ!
২ সৈনিক।
তা হলে চল্‌, ওদের পাড়ায় গিয়ে একবার কষে হাত চালানো যাক। ওরা মানুষ না আমরা মানুষ, প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিই।
২ নাগরিক।
রাজাকে কে গিয়ে বলেছে, কলিযুগে শাস্ত্রও চলে না, অস্ত্রও চলে না, একমাত্র চলে স্বর্ণমুদ্রা। রাজা তাই আমাদের ধনপতি শেঠজিকে তলব করেছেন। ধনপতি টান দিলেই রথ চলবে এইরকম সকলের বিশ্বাস।
১ সৈনিক।
বেনের টানে যদি রথ চলে তা হলে আমরা অস্ত্র গলায় বেঁধে জলে ডুবে মরব।
২ সৈনিক।
তা, রাগ করলে চলবে কেন। বেনের টান আজকাল সব জায়গাতেই লেগেছে। এমন-কি, পুস্পধনুর ছিলেটা বেনের টানেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। তার তীরগুলো বেনের ঘরেই তৈরি।
৩ সৈনিক।
তা সত্যি, আজকাল আমাদের রাজত্বে রাজা থাকেন সামনে, কিন্তু পিছনে থাকে বেনে।
১ সৈনিক।
পিছনেই থাকে তো থাক্‌ না- আমরা তো থাকি ডাইনে-বাঁয়ে, মান তো আমাদেরই।
৩ সৈনিক।
পাশে যে থাকে তার মান থাকতে পারে, কিন্তু পিছনে যে থাকে ঠেলাটা যে তারই।
ধনপতির অনুচরদের প্রবেশ
১ সৈনিক।
এরা সব কে।
১ সৈনিক।
আংটির হীরে থেকে আলোর উচ্চিংড়েগুলো চোখের উপর লাফ দিয়ে পড়ছে।
৩ সৈনিক।
গলায় সোনার হার নয়তো, সোনার শিকল বললেই হয়। কে এরা।
১ নাগরিক।
এরাই তো আমাদের ধনপতি শেঠীর দল। ঐ সোনার শিকল দিয়ে এরা মহাকালকে বেঁধে ফেলেছে বলেই তাঁর রথ চলছে না।
১ সৈনিক।
তোমরা কী করতে এসেছ।
১ ধনিক।
রাজা আমাদের প্রভু ধনপতিকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কারো হাতে রথ চলছে না, তাঁর হাতে চলবে বলেই সবাই আশা করে আছে।
২ সৈনিক।
সবাই বলতে কে রে বাপু? আর আশাই বা করে কেন।
২ ধনিক।
আজকাল যা-কিছু চলছে সবই তো ধনপতির হাতে চলছে।
১ সৈনিক।
এখনই দেখিয়ে দিতে পারি তলোয়ার তার হাতে চলে না, আমাদের হাতে চলে।
৩ ধনিক।
তোমাদের হাত চালাচ্ছে কে সেটা বুঝি এখনো খবর পাওনি।
১ সৈনিক।
চুপ বেয়াদব!
২ ধনিক।
আমরা চুপ করব? আজ আমাদেরই আওয়াজ জলে স্থলে আকাশে তা জান?
১ সৈনিক।
তোমাদের আওয়াজ? আমাদের শতঘ্নী যখন বজ্রনাদ করে ওঠে-
২ ধনিক।
তোমাদের শতঘ্নী বজ্রনাদে আমাদেরই কথা এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে, এক হাট থেকে আরেক হাটে ঘোষণা করবার জন্যে আছে।
১ নাগরিক।
দাদা, ওদের সঙ্গে ঝগড়া করে পেরে উঠবে না।
১ সৈনিক।
কী বল? পারব না?
১ নাগরিক।
না, তোমাদের কোনো তলোয়ার ওদের নিমক খেয়েছে, কোনোটা বা ওদের ঘুষ খেয়েছে, খাপ থেকে বের করতে গেলেই তা বুঝতে পারবে।
১ ধনিক।
শুনেছিলেম রথের দড়িতে হাত দেবার জন্যে নর্মদা তীরের বাবাজিকে আজ আনা হয়েছিল। কী হল খবর জান।
২ ধনিক।
জানি বৈ কি। যখন এরা গুহায় গিয়ে পৌঁছল, দেখল, প্রভু পদ্মাসনে দুই পা আটকে চিত হয়ে পড়ে আছেন। সাড়াশব্দ নেই। বহুকষ্টে ধ্যান ভাঙানো হল। কিন্তু পা দুখানা আড়ষ্ট কাঠ হয়ে গেছে, চলে না।
১ নাগরিক।
শ্রীচরণের দোষ কী। তারা আজ ৬৫ বছরের মধ্যে একবারও চলার নাম করে নি। তা, বাবাজি বললেন কী?
২ ধনিক।
বলা-কওয়ার বালাই নেই। চাঞ্চল্যের অপবাদ দিয়ে জিবটাকে একেবারে কেটেই ফেলেছেন। গোঁ গোঁ করতে লাগলেন, তার থেকে যার যে-রকম খেয়াল সে সেই রকমেরই অর্থ করে নিলে।
১ ধনিক।
তার পরে?
২ ধনিক।
তার পর ধরাধরি করে বাবাজিকে রথতলা পর্যন্ত আনা গেল। কিন্তু যেমনি দড়ি ধরলেন রথের চাকা মাটির মধ্যে বসে যেতে লাগল।
১ ধনিক।
হা, হা, বাবাজি নিজের মনটাকে যেমন গভীরে ডুবিয়েছেন, মহাকালের রথটাকে সুদ্ধ তেমনি তলিয়ে দিচ্ছিলেন বুঝি?
২ ধনিক।
ওঁর পঁয়ষট্টি বৎসরের উপবাসের ভারে চাকা বসে গেল। একদিনের উপবাসের ধাক্কাতেই আমাদের পা চলতে চায় না।
১ নাগরিক।
উপবাসের ভারের কথা বলছ, তোমাদের অহংকারের ভারটা বড়ো কম নয়।
২ নাগরিক।
সে ভার আপনাকেই আপনি চূর্ণ করে। দেখব আজ তোমাদের ধনপতির মাথা কেমন হেঁট না হয়।
১ ধনিক।
আচ্ছা দেখো। বাবা মহাকালের ভোগ জোগায় কে। সে তো আমাদের ধনপতি। যদি বন্ধ করে দেয় তা হলে তাঁর যে চলা না-চলা দুই সমান হয়ে উঠবে। পেট চলা হল সব চলার মূলে।
মন্ত্রী ও ধনপতির প্রবেশ
ধনপতি।
মন্ত্রীমশাই, আজ আমাকে ডাক পড়ল কেন।
মন্ত্রী।
রাজ্যে যখনই কোনো অনর্থপাত হয় তখনই তো তোমাকেই সর্বাগ্রে ডাক পড়ে।
ধনপতি।
অর্থপাতে যার প্রতিকার সম্ভব আমার দ্বারা তার ত্রুটি হয় না। কিন্তু আজকের সংকটটা কী রকমের।
মন্ত্রী।
শুনেছ বোধ হয়, মহাকালের রথ আজ কারো হাতের টানেই চলছে না।
ধনপতি।
শুনেছি। কিন্তু মন্ত্রী এ-সব কাজ তো এতদিন--
মন্ত্রী।
জানি, এতদিন আমাদের পুরোহিত ঠাকুররাই এ-সব কাজ চালিয়েছেন। কিন্তু তখন যে এঁরা স্বাধীন সাধনার জোরে নিজে চলতেন, চালাতেও পারতেন। এখন এঁরা তোমাদেরই দ্বারে অচল হয়ে বাঁধা, এখন এঁদের হাতে কিছুই চলবে না।
ধনপতি।
অন্য অন্য বারে রাজা সেনাপতি রাজপারিষদ সকলেই রথের রশিতে হাত লাগাতেন, কখনো তো বাধা ঘটে নি। তখন আমরা তো কেবল চাকায় তেল জুগিয়ে এসেছি, রশিতে টান দিই নি তো।
মন্ত্রী।
দেখো শেঠজি, রথযাত্রাটা আমাদের একটা পরীক্ষা। কাদের শক্তিতে সংসারটা সত্যিই চলছে বাবা মহাকালের রথচক্র ঘোরার দ্বারা সেইটেরই প্রমাণ হয়ে থাকে। যখন পুরোহিত ছিলেন নেতা তখন তাঁরা রশি ধরতে না-ধরতে রথটা ঘুম-ভাঙা সিংহের মতো ধড়ফড় করে নড়ে উঠত। এবারে যে কিছুতেই সাড়া দিল না। তার থেকে প্রমাণ হচ্ছে শাস্ত্রই বল, শস্ত্রই বল, সমস্ত অর্থহীন হয়ে পড়েছে-- অর্থ এখন তোমারই হাতে। সেই তোমার সার্থক হাতটি আজ রথের রশিতে লাগাতে হবে।
ধনপতি।
আগে বরঞ্চ আমার দলের লোকে চেষ্টা করে দেখুক, যদি একটুখানি কেঁপেও ওঠে আমিও হাত দেব, নইলে সকল লোকের সামনে--
মন্ত্রী।
কেন আর দেরি করা শেঠজি। রাজ্যের সমস্ত লোক উপোস করে আছে, রথ মন্দিরে গিয়ে না পৌছলে কেউ জলগ্রহণ করবে না। তোমার চেষ্টাতেও যদি রথ না চলে লজ্জা কিসের, স্বয়ং পুরোহিত রাজা সকলেরই চেষ্টা ব্যর্থ হল, দেশসুদ্ধ লোক তো তা দেখেছে।
ধনপতি।
তাঁরা হলেন লোকপাল, আমরা হলুম পালের লোক; জনসাধারণে তাঁদের বিচার করে একরকমে, আমাদের বিচার করে আরেক রকমে। রথ যদি না চলে আমার লজ্জা আছে, কিন্তু রথ যদি চলে তা হলে আমার ভয়। তা হলে আমার সেই শুভাদৃষ্টের স্পর্ধা কোনো লোক ক্ষমা করতে পারবেই না। তখন কাল থেকে তোমারাই ভাবতে বসবে আমাকে খর্ব করা যায় কী উপায়ে।
মন্ত্রী।
যা বলছ সবই সত্য হতে পারে, কিন্তু তবুও রথ চলা চাই। আর বেশিক্ষণ যদি দ্বিধা কর তা হলে দেশের লোক ক্ষেপে যাবে।
ধনপতি।
আচ্ছা, তবে চেষ্টা করে দেখি। কিন্তু যদি দৈবক্রমে আমার চেষ্টা সফল হয় তা হলে আমার অপরাধ নিয়ো না । (দলের লোকদের প্রতি) বলো সিদ্ধিরস্তু।
সকলে।
সিদ্ধিরস্তু!
ধনপতি।
বলো, জয় সিদ্ধিদেবী!
সকলে।
জয় সিদ্ধিদেবী!
ধনপতি।
টানব কী! এ রশি যে তুলতেই পারি নে। মহাকালের রথও যেমন ভারী, রশিও তেমনি, এ ভার বহন কি সহজ লোকের কর্ম। (দলের লোকের প্রতি) এসো, তোমরাও সবাই এসো। সকলে মিলে হাত লাগাও। আমার খাতাঞ্চি কোথায় গেল। এসো, এসো কোষাধ্যক্ষ! আবার বলো, সিদ্ধরস্তু--টানো। সিদ্ধিরস্তু, আর-এক টান! সিদ্ধিরস্তু--জোরে! নাঃ, কিছুই হল না। আমাদের হাতে রশিটা ক্রমেই যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠছে।
সকলে।
দুয়ো! দুয়ো!
১ সৈনিক।
যাক। আমাদের মান রক্ষা হল।
ধনপতি।
নমস্কার, মহাকাল! তুমি আমার সহায়, তাই তুমি স্থির হয়ে রইলে। আমার হাতে যদি তুমি টলতে, আমারই ঘাড়ের উপরে টলে পড়তে, একেবারে পিষে যেতুম।
খাতাঞ্চি।
প্রভু, এই যুগে আমাদের যে সম্মান সমাদর ক্রমেই বেড়ে উঠছিল সেটার বড়ো ক্ষতি হল।
ধনপতি।
দেখ, এতকাল আমরা মহাকালের রথের ছায়ায় দাঁড়িয়ে লোকচক্ষুর অগোচরে বড়ো হয়েছি। আজ রথের সামনে এসে পড়ে আমাদের সংকট ঘটেছে-- আশেপাশে লোকের দাঁত-কিড়মিড় অনেক দিন থেকে শুনছি। এখন যদি স্পষ্ট সবাই দেখতে পায় যে, রশি ধরে আমরাই রথ চালাচ্ছি তা হলে আমাদের উপর এমন দৃষ্টি লাগবে যে বেশিক্ষণ টিঁকব না।
১ সৈনিক।
যদি সেকাল থাকত তা হলে তোমার হাতে রথ চলল না বলে তোমার মাথা কাটা যেত।
ধনপতি।
অর্থাৎ, তোমরা তা হলে হাতে কাজ পেতে। মাথা কাটতে না পেলেই তোমরা বেকার।
১ সৈনিক।
আজ কেউ তোমাদের গায়ে হাত দিতে সাহস করে না; রাজাও না। এতে বাবা মহাকালেরই মান খর্ব হয়ে গেছে।
ধনপতি।
সত্যি কথা বলি--যখন সবাই গায়ে হাত দিতে সাহস করত তখন ঢের বেশি নিরাপদে ছিলুম। আজ সবাই যে আমাদের মানতে বাধ্য হয়েছে এরই মধ্যে আমাদের মরণ। মন্ত্রীমশায়, চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবছ কী।
মন্ত্রী।
ভাবছি সব-রকম চেষ্টাই ব্যর্থ হল, এখন কোনো উপায় তো আর বাকি নেই।
ধনপতি।
ভাবনা কী। যখন তোমাদের কোনো উপায় খাটল না তখন মহাকাল নিজের উপায় নিজেই বের করবেন। তাঁর চলবার গরজ তাঁরই, আমাদের নয়; তাঁর ডাক পড়লেই যেখান থেকে হোক তাঁর বাহন ছুটে আসবে। আজ যাদের দেখাই যাচ্ছে না, কাল তারা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়বে। তার আগে আমার খাতাপত্র সমলাই গে। এসো হে কোষাধ্যক্ষ, আজ সিন্ধুকগুলো একটু শক্ত করে বন্ধ করতে হবে।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
চরের প্রবেশ
চর।
মন্ত্রীমশায়, আমাদের শূদ্রপাড়ায় ভারি গোল বেধে গেছে।
মন্ত্রীর।
কেন কী হয়েছে।
চর।
দলে দলে আসছে সব ছুটে। তারা বলে, বাবার রথ আমরা চালাব।
সকলে।
বলে কী। রশি ছুঁতেই দেব না।
চর।
কিন্তু তাদের ঠেকাবে কে।
সৈন্যদল।
আমরা আছি।
চর।
তোমরা কজনই বা আছ। তাদের মারতে মারতে তোমাদের তলোয়ার ক্ষয়ে যাবে-- তবু এত বাকি থাকবে যে রথতলায় তোমাদের আর জায়গাই হবে না।
চর।
মন্ত্রীমশায়, তুমি যে একেবারে বসে পড়লে?
মন্ত্রী।
ওরা দল বেঁধে আসছে বলে আমি ভয় করি নে।
চর।
তবে?
মন্ত্রী।
আমার মনে ভয় হচ্ছে ওরা পারবে।
সৈনিক দল।
বল কী, মন্ত্রী-মহারাজ, ওরা পারবে মহাকালের রথ টানতে! শিলা জলে ভাসবে!
মন্ত্রী।
দৈবাৎ যদি পারে তা হলে বিধাতার নূতন বিধি শুরু হবে। নীচের তলাটা হঠাৎ উপরের তলা হয়ে ওঠাকেই বলে প্রলয়। ভূমিকম্পে মাটির মধ্যে সেই চেষ্টাতেই তো বিভীষিকা। যা বরাবর প্রচ্ছন্ন আছে তাই প্রকাশ হবার সময়টাই যুগান্তরের সময়।
সৈনিক দল।
কী করতে চান, আমাদের কী করতে বলেন হুকুম করুন। আমরা কিছুই ভয় করি নে।
মন্ত্রী।
সাহস দেখাতে গিয়েই সংসারে ভয় বাড়িয়ে তোলা হয়। গোঁয়ারতমি করে, তলোয়ারের বেড়া তুলে দিয়েই মহাকালের বন্যা ঠেকানো যায় না।
চর।
তা কী করতে হবে বলেন।
মন্ত্রী।
ওদের কোনো বাধা না দেওয়াই হচ্ছে সৎপরামর্শ। বাধা দিলে শক্তি আপনাকে আপনি চিনতে পারে। সেই চিনতে দিলেই আর রক্ষে নেই।
সৈনিক দল।
তা হলে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি? ওরা আসুক?
চর।
ঐ যে এসে পড়েছে।
মন্ত্রী।
তোমরা কিচ্ছু কোরো না। স্থির হয়ে থাকো।
শূদ্রদলের প্রবেশ
মন্ত্রী।
(দলপতির প্রতি ) এই যে সর্দার। তোমাদের দেখে বড়ো খুশি হলুম।
দলপতি।
মন্ত্রীমশায়, আমরা বাবার রথ চালাতে এসেছি।
মন্ত্রী।
চিরদিন তোমরাই তো বাবার রথ চালিয়ে এসেছ, আমরা তো উপলক্ষ-মাত্র। সে কি আর জানি নে।
দলপতি।
এতদিন আমরা রথের চাকার তলায় পড়েছি, আমাদের দ'লে দিয়ে রথ চলে গেছে। এবার তো আমাদের বলি বাবা নিল না।
মন্ত্রী।
সে তো দেখতে পাচ্ছি। আজ ভোরবেলায় তোমাদের পঞ্চাশজন চাকার সামনে ধুলোয় লুটোপুটি করলে-- তবু চাকার মধ্যে একটুও ক্ষুধার লক্ষণ দেখা গেল না, নড়ল না, ক্যাঁ কোঁ করে চীৎকার করে উঠল না-- তাদের স্তব্ধতা দেখেই তো ভয় পেয়েছি।
দলপতি।
এবারে রথের তলাটাতে পড়বার জন্যে মহাকাল আমাদের ডাক দেন নি-তিনি ডেকেছেন তাঁর রথের রশিটাকে টান দিতে।
পুরোহিত।
সত্যি নাকি। কেমন করে জানলে।
দলপতি।
কেমন করে জানা যায় সে তো কেউ জানে না। কিন্তু আজ ভোরবেলা থেকেই আমাদের মধ্যে হঠাৎ এই কথা নিয়ে কানাকানি পড়ে গেছে। ছেলেমেয়ে বুড়ো জোয়ান সবাই বলছে বাবা ডেকেছেন।
সৈনিক।
রক্ত দেবার জন্যে।
দলপতি।
না, টান দেবার জন্যে।
পুরোহিত।
দেখো বাবা, ভালো করে ভেবে দেখো, সমস্ত সংসার যারা চালায় মহাকালের রথের রশির জিম্মে তাদেরই 'পরে।
দলপতি।
ঠাকুর, সংসার কি তোমরাই চালাও।
পুরোহিত।
তা দেখো, কাল খারাপ বটে, তবূ হাজার হোক আমরা তো ব্রাহ্মণ বটে।
দলপতি।
মন্ত্রীমশায়, সংসার কি তোমরাই চালাও।
মন্ত্রী।
সংসার বলতে তো তোমরাই। নিজগুণে চল, আমরা চালাক লোকেরা বলে থাকি আমরাই চালাচ্ছি। তোমাদের বাদ দিলে আমরা কজনাই বা আছি।
দলপতি।
আমাদের বাদ দিলে তোমরা যে কজনাই থাক না, থাকবে কী উপায়ে?
মন্ত্রী।
হাঁ, হাঁ, সে তো ঠিক কথা।
দলপতি।
আমরাই তো জোগাচ্ছি অন্ন, তাই খেয়ে তোমরা বেঁচে আছ। আমরাই বুনছি বস্ত্র, তাতেই তোমাদের লজ্জারক্ষা।
সৈনিক।
সর্বনাশ! এতদিন এরা আমাদেরই কাছে হাত জোড় করে বলে আসছিল "তোমরাই আমাদের অন্নবস্ত্রের মালিক'। আজ এ কী রকমের সব উলটো বুলি। আর তো সহ্য হয় না।
মন্ত্রী।
( সৈনিকের প্রতি ) চুপ করো। (দলপতিকে ) সর্দার, আমরা তো তোমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম। মহাকালের বাহন তোমরাই, সে কথা আমরা বুঝি নে, আমরা কি এত মূঢ়। তোমাদের কাজটা তোমরা সাধন করে দিয়ে যাও, তার পরে আমাদের কাজ করবার অবসর আমরা পাব।
দলপতি।
আয় রে ভাই, সবাই মিলে টান দে। মরি আর বাঁচি আজ মহাকালের রথ নড়ারই।
মন্ত্রী।
কিন্তু সাবধানে রাস্তা বাঁচিয়ে চোলো। যে রাস্তায় বরাবর রথ চলেছে সেই রাস্তায়। আমাদের ঘাড়ের উপর এসে না পড়ে যেন।
দলপতি।
রথের 'পরে রথী আছেন, রাস্তা তিনিই ঠাউরে নেবেন, আমরা তো বাহন, আমরা কী বা বুঝি। আয় রে সবাই। ঐ দেখছিস রথের চুড়ায় কেতনটা দুলে উঠেছে, স্বয়ং বাবার ইশারা। ভয় নেই, আয় সবাই।
পুরোহিত।
ছুঁলে রে ছুঁলে! রশি ছুঁলে! ছি, ছি!
নাগরিকগণ।
হায়, হায়, কী সর্বনাশ!
পুরোহিত।
চোখ বোজ্‌ রে তোরা সব, সবাই চোখ বোজ্‌! ক্রুদ্ধ মহাকালের মূর্তি দেখলে তোরা ভস্ম হয়ে যাবি।
সৈনিক।
ও কী ও! এ কি চাকারই শব্দ না কি? না আকাশ আর্তনাদ করে উঠল?
পুরোহিত।
হতেই পারে না।
নাগরিক।
ঐ তো নড়ল যেন।
সৈনিক।
ধুলো উড়েছে যে। অন্যায়, ঘোর অন্যায়! রথ চলেছে! পাপ! মহাপাপ!
শূদ্রদল।
জয়, জয় মহাকালের জয়!
পুরোহিত।
তাই তো, এ কী কাণ্ড হল!
সৈনিক।
ঠাকুর, হুকুম করো। আমাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এই অপবিত্র রথ চলা বন্ধ করে দিই।
পুরোহিত।
হুকুম করতে তো সাহস হয় না। বাবা স্বয়ং যদি ইচ্ছে করে জাত খোয়ান, আমাদের হুকুমে তার প্রায়শ্চিত্ত হবে না।
সৈনিক।
তা হলে ফেলে দিই আমাদের অস্ত্র!
পুরোহিত।
আর আমিও ফেলে দিই আমার পুঁথিপত্র!
নাগরিকগণ।
আমরা যাই সব নগর ছেড়ে। মন্ত্রীমশায়, তুমি কী করবে। কোথায় যাচ্ছ।
মন্ত্রী।
আমি যাচ্ছি ওদের সঙ্গে মিলে রশি ধরতে।
সৈনিক।
ওদের সঙ্গে মিলবে?
মন্ত্রী।
তা হলেই বাবা প্রসন্ন হবেন। স্পষ্ট দেখছি ওরা যে আজ তাঁর প্রসাদ পেয়েছে। এ তো স্বপ্ন নয়, মায়া নয়। ওদের থেকে পিছিয়ে পড়ে আজ কেউ মান রক্ষা করতে পারবে না, মান ওদের সঙ্গে থেকে।
সৈনিক।
কিন্তু তাই বলে ওদের সঙ্গে সার মিলিয়ে রশি ধরা! ঠেকাবই ওদের । দলবল ডাকতে চললুম। মহাকালের রথের পথ রক্তে কাদা হয়ে যাবে।
পুরোহিত।
আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব, মন্ত্রণা দেবার কাজে লাগতে পারব।
মন্ত্রী।
ঠেকাতে পারবে না। এবার দেখছি চাকার তলায় তোমাদেরই পড়তে হবে।
সৈনিক।
তাই সই। বাবার রথের চাকা এতদিন যত সব চণ্ডালের মাংস খেয়ে অশুচি হয়ে আছে। আজ শুদ্ধ মাংস পাবে।
পুরোহিত।
ঐ দেখো, ঐ দেখো মন্ত্রী! এরই মধ্যে রথটা রাজপথ থেকে নেমে পড়েছে। কোথায় কোন্‌ পল্লীর উপরে পড়বে কিছুই বলা যায় না।
সৈনিক।
ঐ যে ধনপতির দল ওখান থেকে চীৎকার করে আমাদের ডাকছে। রথটা যেন ওদেরই ভাণ্ডার লক্ষ্য করে চলেছে। ওরা ভয় পেয়ে গেছে। চলো চলো, ওদের রক্ষা করি গে।
মন্ত্রী।
নিজেদের রক্ষা করো, তার পরে অন্য কথা। আমার তো মনে হচ্ছে রথটা ঠিক তোমাদের অস্ত্রশালার দিকে ঝুঁকেছে, ওর আর কিছু চিহ্ন বাকি থাকবে না। ঐ দেখ।
সৈনিক।
উপায়?
মন্ত্রী।
ওদের সঙ্গে মিলে রশি ধরো-সে--তা হলে রক্ষা পাবার পথে রথের বেগটাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর দ্বিধা করবার সময় নেই।
[ প্রস্থান
সৈনিক।
(পরস্পর) কী করবে। ঠাকুর, তুমি কী করবে।
পুরোহিত।
বীরগণ, তোমরা কী করবে।
সৈনিক।
জানি নে, রশি ধরব, না, লড়াই করব! ঠাকুর, তুমি কী করবে।
পুরোহিত।
জানি নে, রশি ধরব, না, আবার শাস্ত্র আওড়াতে বসব!
১ সৈনিক।
শুনতে পাচ্ছ- হুড়মুড় শব্দে পৃথিবীটা যেন ভেঙেচুরে পড়ছে।
২ সৈনিক।
চেয়ে দেখ, ওরা টানছে বলে মনেই হচ্ছে না। রথটাই ওদের ঠেলে নিয়ে চলেছে।
৩ সৈনিক।
পুরুতঠাকুর, দেখছ রথটা যেন বেঁচে উঠেছে। কী রকম হেঁকে চলেছে। এতবার রথযাত্রা দেখেছি, ওঁর এরকম সজীবমূর্তি কখনো দেখি নি। এতকাল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলেছিল, আজ জেগে চলেছে। তাই আমাদের পথ মানছে না, নিজের পথ বানিয়ে নিচ্ছে।
২ সৈনিক।
কিন্তু গেল যে সব। রথযাত্রার এমন সর্বনেশে উৎসব তো কোনো দিন দেখি নি। ঐ যে কবি আসছে, ওকে জিজ্ঞাসা করো-না, এ-সবের মানে কী।
পুরোহিত।
আমরাই বুঝতে পারলুম না, কবি বুঝতে পারবে? ওরা তো কেবল বানিয়ে কথা বলে, সনাতন শাস্ত্রের কথা জানেই না।
১ সৈনিক।
শাস্ত্রের কথাগুলো কোন্‌কালে মরে গেছে ঠাকুর! তাই তোমাদের কথা তো আর খাটে না দেখি। ওদের যে সব তাজা কথা তাই শুনলে বিশ্বাস হয়।
কবির প্রবেশ
২ সৈনিক।
কবি, আজ রথযাত্রায় এই যে-সব উলটো পালটা কাণ্ড হয়ে গেল, কেন বুঝতে পারো?
কবি ।
পারি বৈকি।
১ সৈনিক।
পুরুতের হাতে, রাজার হাতে রথ চলল না, এর মানে কী।
কবি।
ওরা ভুলে গিয়েছিল মহাকালের শুধু রথকে মানলেই হল না, মহাকালের রথের দড়িকেও মানা চাই।
১ সৈনিক।
কবি, তোমার কথা শুনলে হঠাৎ মনে হয়, হয়তো বা একটা মানে আছে, খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় না।
কবি।
ওরা বাঁধন মানতে চায় নি, শুধু চলাকেই মেনেছিল। তাই রাগী বাঁধনটা উন্মত্ত হয়ে ওদের উপরে ল্যাজ আছড়াচ্ছে, গুঁড়িয়ে যাবে।
পুরোহিত।
আর তোমার শূদ্রগুলোই কি এত বুদ্ধিমান যে দড়ির নিয়ম সামলে চলতে পারবে।
কবি।
হয়তো পারবে না। একদিন ভাববে ওরাই রথের কর্তা, তখনই মরবার সময় আসবে। দেখো-না, কালই বলতে শুরু করবে, আমাদেরই হাল লাঙল চরকা তাঁতের জয়। যে বিধাতা মানুষের বুদ্ধিবিদ্যা নিজের হাতে গড়েছেন, অন্তরে বাহিরে অমৃতরস ঢেলে দিয়েছেন, তাঁকে গাল পাড়তে বসবে। তখন এঁরাই হয়ে উঠবেন বলরামের চেলা, হলধরের মাতলামিতে জগৎটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে।
পুরোহিত।
তখন আবার রথ অচল হলে বোধ করি কবিদের ডাক পড়বে।
কবি।
ঠাট্টা নয় পুরুতঠাকুর! মহাকাল বারেবারেই রথযাত্রায় কবিদের ডেকেছেন। তারা কাজের লোকের ভিড় ঠেলে পৌঁছতে পারে নি।
পুরোহিত।
তারা চালাবে কিসের জোরে।
কবি।
গায়ের জোরে নয়ই। আমরা মানি ছন্দ, আমরা জানি এক-ঝোঁকা হলেই তাল কাটে। আমরা জানি সুন্দরকে কর্ণধার করলেই শক্তির তরী সত্যি বশ মানে। তোমরা বিশ্বাস কর কঠোরকে-- শাস্ত্রের কঠোর বা অস্ত্রের কঠোর-- সেটা হল ভীরুর বিশ্বাস, দুর্বলের বিশ্বাস, অসাড়ের বিশ্বাস।
সৈনিক।
ওহে কবি, তুমি তো উপদেশ দিতে বসলে, ও দিকে যে আগুন লাগল।
কবি।
যুগে যুগে কতবার কত আগুন লেগেছে। যা থাকবার তা থাকবেই।
সৈনিক।
তুমি কী করবে।
কবি।
আমি গান গাব, "ভয় নেই'।
সৈনিক।
তাতে হবে কী।
কবি।
যারা রথ টানছে তারা চলবার তাল পাবে। বেতালা টানটাই ভয়ংকর।
সৈনিক।
আমরা কী করব।
পুরোহিত।
আমি কী করব।
কবি।
তাড়াতাড়ি কিছু করতেই হবে এমন কথা নেই। দেখো, ভাবো। ভিতরে ভিতরে নতুন হয়ে ওঠো। তার পরে ডাক পড়বার জন্য তৈরি হয়ে থাকো।
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •