হারুনা-মারু জাহাজ,  ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪


 

সাবিত্রী (sabitri)


ঘন অশ্রুবাষ্পে ভরা মেঘের দুর্যোগে খড়্‌গ হানি

            ফেলো, ফেলো টুটি।

হে সূর্য, হে মোর বন্ধু, জ্যোতির কনকপদ্মখানি

              দেখা দিক্‌ ফুটি।

বহ্নিবীণা বক্ষে লয়ে, দীপ্ত কেশে, উদ্‌বোধিনী বাণী

সে পদ্মের কেন্দ্রমাঝে নিত্য রাজে, জানি তারে জানি।

              মোর জন্মকালে

প্রথম প্রত্যুষে মম তাহারি চুম্বন দিলে আনি

              আমার কপালে।

 

সে চুম্বনে উচ্ছলিল জ্বালার তরঙ্গ মোর প্রাণে,

              অগ্নির প্রবাহ।

উচ্ছ্বসি উঠিল মন্দ্রি বারম্বার মোর গানে গানে

              শান্তিহীন দাহ।

ছন্দের বন্যায় মোর রক্ত নাচে সে চুম্বন লেগে

উন্মাদ সংগীত কোথা ভেসে যায় উদ্দাম আবেগে,

              আপনা-বিস্মৃত।

সে চুম্বনমন্ত্রে বক্ষে অজানা ক্রন্দন উঠে জেগে

              ব্যথায়-বিস্মিত।

 

তোমার হোমাগ্নি-মাঝে আমার সত্যের আছে ছবি,

              তারে নমো নম।

তমিস্র সুপ্তির কূলে যে বংশী বাজাও, আদিকবি,

              ধ্বংস করি তম,

সে বংশী আমারি চিত্ত, রন্ধ্রে তারি উঠিছে গুঞ্জরি

মেঘে মেঘে বর্ণচ্ছটা, কুঞ্জে কুঞ্জে মাধবীমঞ্জরী,

              নির্ঝরে কল্লোল।

তাহারি ছন্দের ভঙ্গে সর্ব অঙ্গে উঠিছে সঞ্চরি

              জীবনহিল্লোল।

 

এ প্রাণ তোমারি এক ছিন্ন তান, সুরের তরণী;

              আয়ুস্রোতমুখে

হাসিয়া ভা"সায়ে দিলে লীলাচ্ছলে, কৌতুকে ধরণী

              বেঁধে নিল বুকে।

আশ্বিনের রৌদ্রে সেই বন্দী প্রাণ হয় বিস্ফুরিত

উৎকণ্ঠার বেগে, যেন শেফালির শিশিরচ্ছুরিত

              উৎসুক আলোক।

তরঙ্গহিল্লোলে নাচে রশ্মি তব, বিস্ময়ে পূরিত

              করে মুগ্ধ চোখ।

 

তেজের ভাণ্ডার হতে কী আমাতে দিয়েছ যে ভরে

              কেই বা সে জানে।

কী জাল হতেছে বোনা স্বপ্নে স্বপ্নে নানা বর্ণডোরে

              মোর গুপ্ত-প্রাণে।

তোমার দূতীরা আঁকে ভুবন-অঙ্গনে আলিম্পনা;

মুহূর্তে সে ইন্দ্রজাল অপরূপ রূপের কল্পনা

              মুছে যায় সরে।

তেমনি সহজ হোক হাসিকান্না ভাবনাবেদনা--

              না বাঁধুক মোরে।

 

তারা সবে মিলে থাক্‌ অরণ্যের স্পন্দিত পল্লবে,

              শ্রাবণবর্ষণে;

যোগ দিক নির্ঝরের মঞ্জীর গুঞ্জনকলরবে

              উপলঘর্ষণে।

ঝঞ্ঝার মদিরামত্ত বৈশাখের তাণ্ডবলীলায়

বৈরাগী বসন্ত যবে আপনার বৈভব বিলায়,

              সঙ্গে যেন থাকে।

তার পরে যেন তারা সর্বহারা দিগন্তে মিলায়,

              চিহ্ন নাহি রাখে।

 

হে রবি, প্রাঙ্গণে তব শরতের সোনার বাঁশিতে

              জাগিল মূর্ছনা।

আলোতে শিশিরে বিশ্ব দিকে দিকে অশ্রুতে হাসিতে

              চঞ্চল উন্মনা।

জানি না কী মত্ততায়, কী আহ্বানে আমার রাগিণী

ধেয়ে যায় অন্যমনে শূন্যপথে হয়ে বিবাগিনী,

              লয়ে তার ডালি।

সে কি তব সভাস্থলে স্বপ্নাবেশে চলে একাকিনী

              আলোর কাঙালি?

 

দাও, খুলে দাও দ্বার, ওই তার বেলা হল শেষ--

              বুকে লও তারে।

শান্তি-অভিষেক হোক, ধৌত হোক সকল আবেশ

              অগ্নি-উৎসধারে।

সীমন্তে, গোধূলিলগ্নে দিয়ো এঁকে সন্ধ্যার সিন্দুর,

প্রদোষের তারা দিয়ে লিখো রেখা আলোকবিন্দুর

              তার স্নিগ্ধ ভালে।

দিনান্তসংগীতধ্বনি সুগম্ভীর বাজুক সিন্ধুর

              তরঙ্গের তালে।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •