ফাল্গুন, ১৩৩০


 

লীলাসঙ্গিনী (lilasongini)


দুয়ার-বাহিরে যেমনি চাহি রে

           মনে হল যেন চিনি--

কবে, নিরুপমা, ওগো প্রিয়তমা,

           ছিলে লীলাসঙ্গিনী?

কাজে ফেলে মোরে চলে গেলে কোন্‌ দূরে,

মনে পড়ে গেল আজি বুঝি বন্ধুরে?

ডাকিলে আবার কবেকার চেনা সুরে--

           বাজাইলে কিঙ্কিণী।

বিস্মরণের গোধূলিক্ষণের

           আলোতে তোমারে চিনি।

 

এলোচুলে বহে এনেছ কী মোহে

           সেদিনের পরিমল?

বকুলগন্ধে আনে বসন্ত

           কবেকার সম্বল?

চৈত্র-হাওয়ায় উতলা কুঞ্জমাঝে

চারু চরণের ছায়ামঞ্জীর বাজে,

সেদিনের তুমি এলে এদিনের সাজে

           ওগো চিরচঞ্চল।

অঞ্চল হতে ঝরে বায়ুস্রোতে

           সেদিনের পরিমল।

 

মনে আছে সে কি সব কাজ, সখী,

           ভুলায়েছ বারে বারে--

বন্ধ দুয়ার খুলেছ আমার

           কঙ্কণঝংকারে।

ইশারা তোমার বাতাসে বাতাসে ভেসে

ঘুরে ঘুরে যেত মোর বাতায়নে এসে

কখনো আমের নবমুকূলের বেশে

           কভু নবমেঘভারে।

চকিতে চকিতে চলচাহনিতে

           ভুলায়েছ বারে বারে।

 

নদীকূলে-কূলে কল্লোল তুলে

           গিয়েছিলে ডেকে ডেকে।

বনপথে আসি করিতে উদাসী

           কেতকীর রেণু মেখে।

বর্ষাশেষের গগন-কোনায়-কোনায়

সন্ধ্যামেঘের পুঞ্জ সোনায় সোনায়

নির্জন ক্ষণে কখন অন্যমনায়

           ছুঁয়ে গেছ থেকে থেকে--

কখনো হাসিতে কখনো বাঁশিতে

           গিয়েছিলে ডেকে ডেকে।

 

কী লক্ষ্য নিয়ে এসেছ এ বেলা

           কাজের কক্ষ-কোণে।

সাথি খুঁজিতে কি ফিরিছ একেলা

           তব খেলা-প্রাঙ্গণে।

নিয়ে যাবে মোরে নীলাম্বরের তলে

ঘরছাড়া যত দিশাহারাদের দলে,

অযাত্রা-পথে যাত্রী যাহারা চলে

           নিষ্ফল আয়োজনে?

কাজ ভোলাবারে ফেরো বারে বারে

           কাজের কক্ষ-কোণে।

 

আবার সাজাতে হবে আভরণে

           মানসপ্রতিমাগুলি?

কল্পনাপটে নেশার বরনে

           বুলাব রসের তুলি?

বিবাগী মনের ভাবনা ফাগুন-প্রাতে

উড়ে চলে যাবে উৎসুক বেদনাতে,

কলগুঞ্জিত মৌমাছিদের সাথে

           পাখায় পুষ্পধূলি।

আবার নিভৃতে হবে কি রচিতে

           মানসপ্রতিমাগুলি।

 

দেখো না কি, হায়, বেলা চলে যায়--

           সারা হয়ে এল দিন।

বাজে পূরবীর ছন্দে রবির

           শেষ রাগিণীর বীন।

এতদিন হেথ ছিনু আমি পরবাসী,

হারিয়ে ফেলেছি সেদিনের সেই বাঁশি,

আজ সন্ধ্যায় প্রাণ ওঠে নিশ্বাসি

           গানহারা উদাসীন।

কেন অবেলায় ডেকেছ খেলায়,

           সারা হয়ে এল দিন।

 

এবার কি তবে শেষ খেলা হবে

           নিশীথ-অন্ধকারে।

মনে মনে বুঝি হবে খোঁজাখুঁজি

           অমাবস্যার পারে?

মালতীলতায় যাহারে দেখেছি প্রাতে

তারায় তারায় তারি লুকাচুরি রাতে?

সুর বেজেছিল যাহার পরশ-পাতে

           নীরবে লভিব তারে?

দিনের দুরাশা স্বপনের ভাষা

           রচিবে অন্ধকারে?

 

যদি রাত হয় না করিব ভয়--

           চিনি যে তোমারে চিনি।

চোখে নাই দেখি, তবু ছলিবে কি

           হে গোপনরঙ্গিণী।

নিমেষে আঁচল ছুঁয়ে যায় যদি চলে

তবু সব কথা যাবে সে আমায় বলে,

তিমিরে তোমার পরশলহরী দোলে

           হে রসতরঙ্গিণী।

হে আমার প্রিয়, আবার ভুলিয়ো,

           চিনি যে তোমারে চিনি।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •