শান্তিনিকেতন, ১০ জুন, ১৯৩৬


 

অকাল ঘুম (okal ghum)


             এসেছি অনাহূত।

                   কিছু কৌতুক করব ছিল মনে--

                     আচমকা বাধা দেব অসময়ে

                       কোমরে-আঁচল-জড়ানো গৃহিণীপনায়।

                     দুয়ারে পা বাড়াতেই চোখে পড়ল--

                            মেঝের 'পরে এলিয়ে পড়া

                                 ওর অকাল ঘুমের রূপখানি।

    দূর পাড়ায় বিয়ে-বাড়িতে বাজছে শানাই সারঙ সুরে।

         প্রথম প্রহর পেরিয়ে গেছে

              জ্যৈষ্ঠরৌদ্রে ঝাম্‌রে-পড়া সকাল বেলায়।

                স্তরে স্তরে দুখানি হাত গালের নীচে,

                     ঘুমিয়েছে শিথিলদেহে

                          উৎসবরাতের অবসাদে

                       অসমাপ্ত ঘরকন্নার এক ধারে।

                     কর্মস্রোত নিস্তরঙ্গ ওর অঙ্গে অঙ্গে,

                       অনাবৃষ্টিতে অজয় নদের

                     প্রান্তশায়ী শ্রান্ত জলশেষের মতো।

                   ঈষৎ খোলা ঠোঁটদুটিতে মিলিয়ে আছে

                     মুদে-আসা ফুলের মধুর উদাসীনতা।

              দুটি ঘুমন্ত চোখের কালো পক্ষ্ণচ্ছায়া

                     পড়েছে পাণ্ডুর কপোলে।

                ক্লান্ত জগৎ চলেছে পা টিপে

                     ওর খোলা জানলার সামনে দিয়ে

                          ওর শান্তনিশ্বাসের ছন্দে।

                                ঘড়ির ইশারা

                     বধির ঘরে টিক্‌টিক্‌ করছে কোণের টেবিলে,

                       বাতাসে দুলছে দিনপঞ্জী দেয়ালের গায়ে।

চলতি মুহূর্তগুলি গতি হারালো ওর স্তব্ধ চেতনায়,

                       মিলল একটি অনিমেষ মুহূর্তে;

                   ছড়িয়ে দিল তার অশরীরী ডানা

                          ওর নিবিড় নিদ্রার 'পরে।

    ওর ক্লান্ত দেহের করুণ মাধুরী মাটিতে মেলা,

         যেন পূর্ণিমারাতের ঘুম-হারানো অলস চাঁদ

              সকালবেলায় শূন্য মাঠের শেষ সীমানায়।

              পোষা বিড়াল দুধের দাবি স্মরণ করিয়ে

                  ডাক দিল ওর কানের কাছে।

              চমকে জেগে উঠে দেখল আমাকে,

                     তাড়াতাড়ি বুকে কাপড় টেনে

              অভিমানভরে বললে, "ছি, ছি,

                   কেন জাগালে না এতক্ষণ।"

         কেন! আমি তার জবাব দিই নি ঠিকমত।  "'

    যাকে খুব জানি তাকেও সব জানি নে

         এই কথা ধরা পড়ে কোনো একটা আকস্মিকে।

             হাসি আলাপ যখন আছে থেমে,

                মনে যখন থমকে আছে প্রাণের হাওয়া,

                   তখন সেই অব্যক্তের গভীরে

                       এ কী দেখা দিল আজ।

                   সে কি অস্তিত্বের সেই বিষাদ

                          যার তল মেলে না,

                সে কি সেই বোবার প্রশ্ন

                   যার উত্তর লুকাচুরি করে রক্তে,

           সে কি সেই বিরহ,

                   যার ইতিহাস নেই,

    সে কি অজানা বাঁশির ডাকে অচেনা পথে স্বপ্নে-চলা।

ঘুমের স্বচ্ছ আকাশতলে

    কোন্‌ নির্বাক রহস্যের সামনে ওকে নীরবে শুধিয়েছি,

                       "কে তুমি।

         তোমার শেষ পরিচয় খুলে যাবে কোন্‌ লোকে।"

      সেদিন সকালে গলির ও পারে পাঠশালায়

         ছেলেরা চেঁচিয়ে পড়ছিল নামতা;

       পাট-বোঝাই মোষের গাড়ি

         চাকার ক্লিষ্টশব্দে মুচড়ে দিচ্ছিল বাতাসকে;

           ছাদ পিটোচ্ছিল পাড়ার কোন্‌ বাড়িতে;

              জানলার নীচে বাগানে

                চালতা গাছের তলায়

                   উচ্ছিষ্ট আমের আঁঠি নিয়ে

                     টানাটানি করছিল একটা কাক।

      আজ এ সমস্তর উপরেই ছড়িয়ে পড়েছে

         সেই দূরকালের মায়ারশ্মি।

                ইতিহাসে-বিলুপ্ত

    তুচ্ছ এক মধ্যাহ্নের আলস্য-আবিষ্ট রৌদ্রে

           এরা অপরূপের রসে রইল ঘিরে

                অকাল ঘুমের একখানি ছবি।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •