শান্তিনিকেতন, ৪ জুন, ১৯৩৬


 

চিরযাত্রী (chirojatri)


         অস্পষ্ট অতীত থেকে বেরিয়ে পড়েছে ওরা দলে দলে,

                   ওরা সন্ধানী, ওরা সাধক,

                       বেরিয়েছে পুরাপৌরাণিক কালের

                            সিংহদ্বার দিয়ে।

              তার তোরণের রেখা

                   আঁচড় কেটেছে অজানা আখরে,

                              ভেঙে-পড়া ভাষায়।

         যাত্রী ওরা, রণযাত্রী,

           ওদের চিরযাত্রা অনাগতকালের দিকে।

                     যুদ্ধ হয় নি শেষ,

              বাজছে নিত্যকালের দুন্দুভি।

                   বহুশত যুগের পদপতনশব্দে

                       থর্‌থর্‌ করে ধরিত্রী,

  অর্ধেক রাত্রে দুরুদুরু করে বক্ষ,

                     চিত্ত হয় উদাস,

                       তুচ্ছ হয় ধনমান,

                            মৃত্যু হয় প্রিয়।

                       তেজ ছিল যাদের মজ্জায়,

           যারা চলতে বেরিয়েছিল পথে

                মৃত্যু পেরিয়ে আজও তারাই চলেছে;

                     যারা বাস্তু ছিল আঁকড়িয়ে

                তারা জিয়ন-মরা, তাদের নিঝুম বস্‌তি

                     বোবা সমুদ্রের বালুর ডাঙায়।

                   তাদের জগৎজোড়া প্রেতস্থানে

                            অশুচি হাওয়ায়

                               কে তুলবে ঘর,

                     কে রইবে চোখ উলটিয়ে কপালে,

                               কে জমাবে জঞ্জাল।

       কোন্‌ আদিকালে মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে

                 বিশ্বপথের চৌমাথায়।

           পাথেয় ছিল রক্তে, পাথেয় ছিল স্বপ্নে,

                   পাথেয় ছিল পথেই।

                 যেই এঁকেছে নক্‌শা,

                     ঘর বেঁধেছে পাকা গাঁথুনির,

                          ছাদ তুলেছে মেঘ ঘেঁষে_

                পরের দিন থেকে মাটির তলায়

                       ভিত হয়েছে ঝাঁঝরা।

                   সে বাঁধ বেঁধেছে পাথরে পাথরে,

                          তলিয়ে গেছে বন্যার ধাক্কায়।

           সারারাত হিসেব করেছে স্থাবর সম্পদের,

                   রাতের শেষে হিসেবে বেরোল সর্বনাশ।

সে জমা করেছে ভোগের ধন সাত হাট থেকে,

                ভোগে লেগেছে আগুন,

                     আপন তাপে গুমরে গুমরে

                গেছে ভোগের জোগান আঙার হয়ে।

           তার রীতি, তার নীতি, তার শিকল, তার খাঁচা

                           চাপা পড়েছে মাটির নীচে।

                                পরযুগের কবরস্থানে।

         কখনো বা ঘুমিয়েছে সে

           ঝিমিয়ে-পড়া নেশার আসরে বাতি-নেবা দালানে

                   আরামের গদি পেতে।

              অন্ধকারে ঝোপের থেকে

                   ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্কন্ধকাটা দুঃস্বপ্ন,

              পাগ্‌লা জন্তুর মতো

                   গোঁ গোঁঃ শব্দে ধরেছে তার টুঁটি চেপে,

                বুকের পাঁজরগুলোর ঠক ঠক দিয়েছে নাড়া,

                   গুঙরে উঠে জেগেছে সে মৃত্যুযন্ত্রণায়।

         ক্ষোভের মাতুনিতে ভেঙে ফেলেছে মদের পাত্র,

              ছিঁড়ে ফেলেছে ফুলের মালা।

           বারে বারে রক্তে-পিছল দুর্গমে

              ছুটে এসেছে শতচ্ছিদ্র শতাব্দীর বাইরে

                পথ-না-চেনা দিক্‌সীমানার অলক্ষ্যে।

         তার হৃৎপিণ্ডের রক্তের ধাক্কায় ধাক্কায়

              ডমরুতে বেজেছে গুরু গুরু,

                   "পেরিয়ে চলো, পেরিয়ে চলো।"

                   ওরে চিরপথিক,

         করিস নে নামের মায়া,

              রাখিস নে ফলের আশা,

                   ওরে ঘরছাড়া মানুষের সন্তান।

কালের-রথ-চলা রাস্তায়

         বারে বারে কারা তুলেছিল জয়ের নিশান

              বারে বারে পড়েছে চুরমার হয়ে

                   মানুষের কীর্তিনাশা সংসারে।

         লড়াইয়ে-জয়-করা রাজত্বের প্রাচীর

              সে পাকা করতে গেছে ভুল সীমানায়।

         সীমানাভাঙার দল ছুটে আসছে

                বহু যুগ থেকে

              বেড়া ডিঙিয়ে, পাথর গুঁড়িয়ে,

                   পার হয়ে পর্বত;

              আকাশে বেজে উঠছে নিত্যকালের দুন্দুভি,

                     "পেরিয়ে চলো,

                               পেরিয়ে চলো।"

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •