প্রাণমন (pranmon)

আমার জানলার সামনে রাঙা মাটির রাস্তা।

ওখান দিয়ে বোঝাই নিয়ে গোরুর গাড়ি চলে; সাঁওতাল মেয়ে খড়ের আঁটি মাথায় করে হাটে যায়, সন্ধ্যাবেলায় কলহাস্যে ঘরে ফেরে।

কিন্তু, মানুষের চলাচলের পথে আজ আমার মন নেই।

জীবনের যে ভাগটা অস্থির, নানা ভাবনায় উদ্বিগ্ন, নানা চেষ্টায় চঞ্চল, সেটা আজ ঢাকা পড়ে গেছে। শরীর আজ রুগ্ন, মন আজ নিরাসক্ত।

ঢেউয়ের সমুদ্র বাহিরতলের সমুদ্র; ভিতরতলে যেখানে পৃথিবীর গভীর গর্ভশয্যা ঢেউ সেখানকার কথা গোলমাল করে ভুলিয়ে দেয়। ঢেউ যখন থামে তখন সমুদ্র আপন গোচরের সঙ্গে অগোচরের, গভীরতলের সঙ্গে উপরিতলের অখণ্ড ঐক্যে স্তব্ধ হয়ে বিরাজ করে।

তেমনি আমার সচেষ্ট প্রাণ যখনি ছুটি পেল, তখনি গভীর প্রাণের মধ্যে স্থান পেলুম যেখানে বিশ্বের আদিকালের লীলাক্ষেত্র।

পথ-চলা পথিক যত দিন ছিলুম তত দিন পথের ধারের ঐ বটগাছটার দিকে তাকাবার সময় পাই নি; আজ পথ ছেড়ে জানলায় এসেছি, আজ ওর সঙ্গে মোকাবিলা শুরু হল।

আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ক্ষণে ক্ষণে ও যেন অস্থির হয়ে ওঠে। যেন বলতে চায়, 'বুঝতে পারছ না?'

আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলি, 'বুঝেছি, সব বুঝেছি; তুমি অমন ব্যাকুল হোয়ো না।'

কিছু ক্ষণের জন্যে আবার শান্ত বয়ে যায়। আবার দেখি, ভারি ব্যস্ত হয়ে ওঠে; আবার সেই থর্‌থর্‌ ঝর্‌ঝর্‌ ঝল্‌মল্‌।

আবার ওকে ঠাণ্ডা করে বলি, 'হাঁ হাঁ, ঐ কথাই বটে; আমি তোমারই খেলার সাথি, লক্ষহাজার বছর ধরে এই মাটির খেলাঘরে আমিও গণ্ডূষে গণ্ডূষে তোমারই মতো সূর্যালোক পান করেছি, ধরণীর স্তন্যরসে আমিও তোমার অংশী ছিলেম।'

তখন ওর ভিতর দিয়ে হঠাৎ হাওয়ার শব্দ শুনি; ও বলতে থাকে, 'হাঁ, হাঁ, হাঁ।'

যে ভাষা রক্তের মর্মরে আমার হৃৎপিণ্ডে বাজে, যা আলো-অন্ধকারের নিঃশব্দ আবর্তন ধ্বনি, সেই ভাষা ওর পত্রমর্মরে আমার কাছে এসে পৌঁছয়। সেই ভাষা বিশ্বজগতের সরকারি ভাষা।

তার মূল বাণীটি হচ্ছে, 'আছি, আছি; আমি আছি, আমরা আছি।'

সে ভারি খুশির কথা। সেই খুশিতে বিশ্বের অণু পরমাণু থর্‌থর্‌ করে কাঁপছে।

ঐ বটগাছের সঙ্গে আমার আজ সেই এক ভাষায় সেই এক খুশির কথা চলছে।

ও আমাকে বলছে, 'আছ হে বটে?'

আমি সাড়া দিয়ে বলছি, 'আছি হে মিতা।'

এমনি করে 'আছি'তে এক তালে করতালি বাজছে।

  •  

Rendition

Please Login first to submit a rendition. Click here for help.