শান্তিনিকেতন, ২৮। ৩। ৩৯          


 

ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে (dhakira dhak bajay khale bile)


                          পাকুড়তলির মাঠে

                   বামুনমারা দিঘির ঘাটে

               আদিবিশ্ব-ঠাকুরমায়ের আস্‌মানি এক চেলা

                          ঠিক দুক্ষুর বেলা

                       বেগ্‌নি-সোনা দিক্‌-আঙিনার কোণে

                   ব'সে ব'সে ভুঁইজোড়া এক চাটাই বোনে

                          হলদে রঙের শুকনো ঘাসে।

               সেখান থেকে ঝাপসা স্মৃতির কানে আসে

                   ঘুম-লাগা রোদ্‌দুরে

                       ঝিম্‌ঝিমিনি সুরে--

                   "ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে,

               সুন্দরীকে বিয়ে দিলেম ডাকাতদলের মেলে।"

 

                   সুদূর কালের দারুণ ছড়াটিকে

               স্পষ্ট করে দেখি নে আজ, ছবিটা তার ফিকে।

                   মনের মধ্যে বেঁধে না তার ছুরি,

               সময় তাহার ব্যথার মূল্য সব করেছে চুরি।

                   বিয়ের পথে ডাকাত এসে হরণ করলে মেয়ে,

               এই বারতা ধুলোয়-পড়া শুকনো পাতার চেয়ে

                   উত্তাপহীন, ঝেঁটিয়ে-ফেলা আবর্জনার মতো।

                       দুঃসহ দিন দুঃখেতে বিক্ষত

                   এই-কটা তার শব্দমাত্র দৈবে রইল বাকি,

                       আগুন-নেভা ছাইয়ের মতন ফাঁকি।

                          সেই মরা দিন কোন্‌ খবরের টানে

                              পড়ল এসে সজীব বর্তমানে।

               তপ্ত হাওয়ার বাজপাখি আজ বারে বারে

                              ছোঁ মেরে যায় ছড়াটারে,

               এলোমেলো ভাবনাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে

                   টুক্‌রো করে ওড়ায় ধ্বনিটাকে।

               জাগা মনের কোন্‌ কুয়াশা স্বপ্নেতে যায় ব্যেপে,

                   ধোঁয়াটে এক কম্বলেতে ঘুমকে ধরে চেপে,

                       রক্তে নাচে ছড়ার ছন্দে মিলে--

                   "ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে।'

 

               জমিদারের বুড়ো হাতি হেলে দুলে চলেছে বাঁশতলায়,

                          ঢঙ্‌ঢঙিয়ে ঘন্টা দোলে গলায়।

 

               বিকেলবেলার চিকন আলোর আভাস লেগে

                   ঘোলা রঙের আলস ভেঙে উঠি জেগে।

                       হঠাৎ দেখি, বুকে বাজে টন্‌টনানি

                   পাঁজরগুলোর তলায় তলায় ব্যথা হানি।

                       চটকা ভাঙে যেন খোঁচা খেয়ে--

                   কই আমাদের পাড়ার কালো মেয়ে--

               ঝুড়ি ভ'রে মুড়ি আনত, আনত পাকা জাম,

                          সামান্য তার দাম,

                       ঘরের গাছের আম আনত কাঁচামিঠা,

                   আনির স্থলে দিতেম তাকে চার-আনিটা।

                       ওই যে অন্ধ কলুবুড়ির কান্না শুনি--

                    কদিন হল জানি নে কোন্‌ গোঁয়ার খুনি

                          সমত্থ তার নাতনিটিকে

                   কেড়ে নিয়ে ভেগেছে কোন্‌ দিকে।

               আজ সকালে শোনা গেল চৌকিদারের মুখে,

                   যৌবন তার দ'লে গেছে, জীবন গেছে চুকে।

                       বুক-ফাটানো এমন খবর জড়ায়

                          সেই সেকালের সামান্য এক ছড়ায়।

                   শাস্ত্রমানা আস্তিকতা ধুলোতে যায় উড়ে--

               "উপায় নাই রে, নাই প্রতিকার' বাজে আকাশ জুড়ে।

                   অনেক কালের শব্দ আসে ছড়ার ছন্দে মিলে--

                       "ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে।'

 

               জমিদারের বুড়ো হাতি হেলে দুলে চলেছে বাঁশতলায়,

                          ঢঙ্‌ঢঙিয়ে ঘন্টা দোলে গলায়।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •