যখন এ দেহ হতে রোগে ও জরায় দিনে দিনে সামর্থ্য ঝরায়, যৌবন এ জীর্ণ নীড় পিছে ফেলে দিয়ে যায় ফাঁকি, কেবল শৈশব থাকে বাকি। বদ্ধ ঘরে কর্মক্ষুব্ধ সংসার--বাহিরে অশক্ত সে শিশুচিত্ত মা খুঁজিয়া ফিরে। বিত্তহারা প্রাণ লুব্ধ হয় বিনা মূল্যে স্নেহের প্রশ্রয় কারো কাছে করিবারে লাভ, যার আবির্ভাব ক্ষীণজীবিতেরে করে দান জীবনের প্রথম সম্মান। "থাকো তুমি' মনে নিয়ে এইটুকু চাওয়া কে তারে জানাতে পারে তার প্রতি নিখিলের দাওয়া শুধু বেঁচে থাকিবার। এ বিস্ময় বারবার আজি আসে প্রাণে প্রাণলক্ষ্মী ধরিত্রীর গভীর আহ্বানে মা দাঁড়ায় এসে যে মা চিরপুরাতন নূতনের বেশে।
চলে গেল, আর কিছু নাই কহিবার। চলে গেল, আর কিছু নাই গাহিবার। শুধু গাহিতেছে আর শুধু কাঁদিতেছে দীনহীন হৃদয় আমার, শুধু বলিতেছে, "চলে গেল সকলেই চলে গেল গো, বুক শুধু ভেঙে গেল দ'লে গেল গো।" বসন্ত চলিয়া গেলে বর্ষা কেঁদে কেঁদে বলে, "ফুল গেল, পাখি গেল-- আমি শুধু রহিলাম, সবই গেল গো।" দিবস ফুরালে রাতি স্তব্ধ হয়ে রহে, শুধু কেঁদে কহে, "দিন গেল, আলো গেল, রবি গেল গো-- কেবল একেলা আমি, সবই গেল গো।" উত্তরবায়ুর সম প্রাণের বিজনে মম কে যেন কাঁদিছে শুধু "চলে গেল, চলে গেল, সকলেই চলে গেল গো।" উৎসব ফুরায়ে গেলে ছিন্ন শুষ্ক মালা পড়ে থাকে হেথায় হোথায়-- তৈলহীন শিখাহীন ভগ্ন দীপগুলি ধুলায় লুটায়-- একবার ফিরে কেহ দেখে নাকো ভুলি, সবে চলে যায়। পুরানো মলিন ছিন্ন বসনের মতো মোরে ফেলে গেল, কাতর নয়নে চেয়ে রহিলাম কত-- সাথে না লইল। তাই প্রাণ গাহে শুধু, কাঁদে শুধু, কহে শুধু, "মোরে ফেলে গেল, সকলেই মোরে ফেলে গেল, সকলেই চলে গেল গো।" একবার ফিরে তারা চেয়েছিল কি? বুঝি চেয়েছিল। একবার ভুলে তারা কেঁদেছিল কি? বুঝি কেঁদেছিল। বুঝি ভেবেছিল-- লয়ে যাই--নিতান্ত কি একেলা কাঁদিবে? তাই বুঝি ভেবেছিল। তাই চেয়েছিল। তার পরে? তার পরে! তার পরে বুঝি হেসেছিল। একফোঁটা অশ্রুবারি মুহূর্তেই শুকাইল। তার পরে? তার পরে! চলে গেল। তার পরে? তার পরে! ফুল গেল, পাখি গেল, আলো গেল, রবি গেল, সবাই গেল, সবই গেল গো-- হৃদয় নিশ্বাস ছাড়ি কাঁদিয়া কহিল, "সকলেই চলে গেল গো, আমারেই ফেলে গেল গো।"