নিশীথচেতনা (nishithachetanaa)
স্তব্ধ বাদুড়ের মতো জড়ায়ে অযুত শাখা
দলে দলে অন্ধকার ঘুমায় মুদিয়া পাখা।
মাঝে মাঝে পা টিপিয়া বহিছে নিশীথবায়,
গাছে নড়ে ওঠে পাতা, শব্দটুকু শোনা যায়।
আকাশের পানে চেয়ে জাগিয়া রয়েছি বসি,
মাঝে মাঝে দুয়েকটি তারা পড়িতেছে খসি।
ঘুমাইছে পশুপাখি, বসুন্ধরা অচেতনা--
শুধু এবে দলে দলে আঁধারের তলে তলে
আকাশ করিয়া পূর্ণ স্বপ্ন করে আনাগোনা।
স্বপ্ন করে আনাগোনা! কোথা দিয়া আসে যায়!
আঁধার আকাশ-মাঝে আঁখি চারি দিকে চায়।
মনে হয় আসিতেছে শত স্বপ্ন নিশাচরী
আকাশের পার হতে, আঁধার ফেলিছে ভরি।
চারি দিকে ভাসিতেছে চারি দিকে হাসিতেছে,
এ উহারে ডাকিতেছে আকাশের পানে চেয়ে--
বলিতেছে, "আয় বোন, আয় তোরা আয় ধেয়ে।"
হাতে হাতে ধরি ধরি নাচে যত সহচরী,
চমকি ছুটিয়া যায় চপলা মায়ার মেয়ে।
যেন মোর কাছ দিয়ে এই তারা গেল চলে,
কেহ বা মাথায় মোর, কেহ বা আমার কোলে।
কেহ বা মারিছে উঁকি হৃদয়-মাঝারে পশি,
আঁখির পাতার 'পরে কেহ বা দুলিছে বসি।
মাথার উপর দিয়া কেহ বা উড়িয়া যায়,
নয়নের পানে মোর কেহ বা ফিরিয়া চায়।
এখনি শুনিব যেন অতি মৃদু পদধ্বনি,
ছোটো ছোটো নূপুরের অতি মৃদু রনরনি।
রয়েছি চকিত হয়ে আঁখির নিমেষ ভুলি--
এখনি দেখিব যেন স্বপ্নমুখী ছায়াগুলি।
অয়ি স্বপ্ন মোহময়ী, দেখা দাও একবার।
কোথা দিয়ে আসিতেছ, কোথা দিয়ে চলিতেছ,
কোথা গিয়ে পশিতেছ বড়ো সাধ দেখিবার।
আঁধার পরানে পশি সারা রাত করি খেলা
কোন্খানে কোন্ দেশে পালাও সকালবেলা!
অরুণের মুখ দেখে কেন এত হয় লাজ--
সারা দিন কোথা বসে না জানি কী কর কাজ।
ঘুম-ঘুম আঁখি মেলি তোমরা স্বপনবালা,
নন্দনের ছায়ে বসি শুধু বুঝি গাঁথ মালা।
শুধু বুঝি গুন গুন গুন গুন গান কর,
আপনার গান শুনে আপনি ঘুমায়ে পড়।
আজি এই রজনীতে অচেতন চারি ধার--
এই আবরণ ঘোর ভেদ করি মন মোর
স্বপনের রাজ্য-মাঝে দাঁড়া দেখি একবার।
নিদ্রার সাগরজলে মহা-আঁধারের তলে
চারি দিকে প্রসারিত এ কী এ নূতন দেশ--
একত্রে স্বরগ-মর্ত্য, নাহিকো দিকের শেষ।
কী যে যায় কী যে আসে চারি দিকে আশেপাশে--
কেহ কাঁদে কেহ হাসে, কেহ থাকে কেহ যায়!
মিশিতেছে, ফুটিতেছে, গড়িতেছে, টুটিতেছে,
অবিশ্রাম লুকাচুরি-আঁখি না সন্ধান পায়।
কত আলো কত ছায়া, কত আশা কত মায়া,
কত ভয় কত শোক, কত কী যে কোলাহল-
কত পশু কত পাখি, কত মানুষের দল।
উপরেতে চেয়ে দেখো কী প্রশান্ত বিভাবরী--
নিশ্বাস পড়ে না, যেন জগৎ রয়েছে মরি।
একবার করো মনে আঁধারের সংগোপনে
কী গভীর কলরব চেতনার ছেলেখেলা,
সমস্ত জগৎ ব্যেপে স্বপনের মহামেলা।
মনে মনে ভাবি তাই এও কি নহে রে ভাই,
চৌদিকে যা-কিছু দেখি জাগিয়া সকালবেলা,
এও কি নহে রে শুধু চেতনার ছেলেখেলা!
স্বপ্ন, তুমি এসো কাছে, মোর মুখপানে চাও,
তোমার পাখার 'পরে মোরে তুলে লয়ে যাও।
হৃদয়ের দ্বারে দ্বারে ভ্রমি মোরা সারা নিশি
প্রাণে প্রাণে খেলাইয়া প্রভাতে যাইব মিশি।
ওই যে মায়ের কোলে মেয়েটি ঘুমায়ে আছে,
একবার নিয়ে যাও ওদের প্রাণের কাছে।
দেখিব কোমল প্রাণে সুখের প্রভাতহাসি
সুধায় ভরিয়া প্রাণ কেমনে বেড়ায় ভাসি।
ওই যে প্রেমিক দুটি কুসুমকাননে শুয়ে,
ঘুমাইছে মুখে মুখে চরণে চরণ থুয়ে,
ওদের প্রাণের ছায়ে বসিতে গিয়েছে সাধ--
মায়া করি ঘন্টাইব বিরহের পরমাদ।
ঘুমন্ত আঁখির কোণে দেখা দিবে আঁখিজল,
বিরহবিলাপগানে ছাইবে মরমতল।
সহসা উঠিবে জাগি, চমকি শিহরি কাঁপি
দ্বিগুণ আদরে পুন বুকেতে ধরিবে চাপি।
ছোটো দুটি শিশু ভাই ঘুমাইছে গলাগলি,
তাদের হৃদয়-মাঝে আমরা যাইব চলি।
কুসুমকোমলহিয়া কভু বা দুলিবে ভয়ে,
রাবির কিরণে কভু হাসিবে আকুল হয়ে।
আমি যদি হইতাম স্বপনবাসনাময়
কত বেশ ধরিতাম, কত দেশ ভ্রমিতাম,
বেড়াতেম সাঁতারিয়া ঘুমের সাগরময়।
নীরব চন্দ্রমা-তারা,নীরব আকাশ-ধরা-
আমি শুধু চুপি চুপি ভ্রমিতাম বিশ্বময়।
প্রাণে প্রাণে রচিতাম কত আশা কত ভয়--
এমন করুণ কথা প্রাণে আসিতাম কয়ে,
প্রভাতে পুরবে চাহি ভাবিত তাহাই লয়ে।
জাগিয়া দেখিত যারে বুকেতে ধরিত তারে,
যতনে মুছায়ে দিত ব্যথিতের অশ্রুজল,
মুমূর্ষু প্রেমের প্রাণ পাইত নূতন বল।
ওরে স্বপ্ন, আমি যদি স্বপন হতেম হায়,
যাইতাম তার প্রাণে যে মোরে ফিরে না চায়।
প্রাণে তার ভ্রমিতাম, প্রাণে তার গাহিতাম,
প্রাণে তার খেলাতেম অবিরাম নিশি নিশি।
যেমনি প্রভাত হত আলোকে যেতাম মিশি।
দিবসে আমার কাছে কভু সে খোলে না প্রাণ,
শোনে না আমার কথা, বোঝে না আমার গান।
মায়ামন্ত্রে প্রাণ তার গোপনে দিতাম খুলি,
বুঝায়ে দিতেম তারে এই মোর গানগুলি।
পরদিন দিবসেতে যাইতাম কাছে তার,
তা হলে কি মুখপানে চাহিত না একবার?