দূরে গিয়েছিলে চলি; বসন্তের আনন্দভাণ্ডার তখনো হয় নি নিঃস্ব; আমার বরণপুষ্পহার তখনো অম্লান ছিল ললাটে তোমার। হে অধীর, কোন্ অলিখিত লিপি দক্ষিণের উদ্ভ্রান্ত সমীর এনেছিল চিত্তে তব। তুমি গেলে বাঁশি লয়ে হাতে, ফিরে দেখ নাই চেয়ে আমি বসে আপন বীণাতে বাঁধিতেছিলাম সুর গুঞ্জরিয়া বসন্তপঞ্চমে, আমার অঙ্গনতলে আলো আর ছায়ার সংগমে কম্পমান আম্রতরু করেছিল চাঞ্চল্য বিস্তার সৌরভবিহ্বল শুক্লরাতে। সেই কুঞ্জগৃহদ্বার এতকাল মুক্ত ছিল। প্রতিদিন মোর দেহলিতে আঁকিয়াছি আলিপনা। প্রতিসন্ধ্যা বরণডালিতে গন্ধতৈলে জ্বালায়েছি দীপ। আজি কতকাল পরে যাত্রা তব হল অবসান। হেথা ফিরিবার তরে হেথা হতে গিয়েছিলে। হে পথিক, ছিল এ লিখন-- আমারে আড়াল করে আমারে করিবে অন্বেষণ; সুদূরের পথ দিয়ে নিকটেরে লাভ করিবারে আহ্বান লভিয়াছিলে সখা। আমার প্রাঙ্গণদ্বারে যে পথ করিলে শুরু সে পথের এখানেই শেষ। হে বন্ধু, কোরো না লজ্জা, মোর মনে নাই ক্ষোভলেশ, নাই অভিমানতাপ। করিব না ভর্ৎসনা তোমায়; গভীর বিচ্ছেদ আজি ভরিয়াছি অসীম ক্ষমায়। আমি আজি নবতর বধূ, আজি শুভদৃষ্টি তব বিরহগুণ্ঠনতলে দেখে যেন মোরে অভিনব অপূর্ব আনন্দরূপে, আজি যেন সকল সন্ধান প্রভাতে নক্ষত্রসম শুভ্রতায় লভে অবসান। আজি বাজিবে না বাঁশি, জ্বলিবে না প্রদীপের মালা, পরিব না রক্তাম্বর; আজিকার উৎসব নিরালা সর্ব-আভরণহীন। আকাশেতে প্রতিপদ-চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ পার হয়ে পূর্ণতার প্রথম প্রসাদ লভিয়াছে। দিক্প্রান্তে তারি ওই ক্ষীণ নম্র কলা নীরবে বলুক আজি আমাদের সব কথা বলা।
আমার শেষবেলাকার ঘরখানি বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে, তার নাম দেব শ্যামলী। ও যখন পড়বে ভেঙে সে হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতো, মাটির কোলে মিশবে মাটি; ভাঙা থামে নালিশ উঁচু করে বিরোধ করবে না ধরণীর সঙ্গে; ফাটা দেয়ালের পাঁজর বের ক'রে তার মধ্যে বাঁধতে দেবে না মৃতদিনের প্রেতের বাসা। সেই মাটিতে গাঁথব আমার শেষ বাড়ির ভিত যার মধ্যে সব বেদনার বিস্মৃতি, সব কলঙ্কের মার্জনা, যাতে সব বিকার সব বিদ্রূপকে ঢেকে দেয় দূর্বাদলের স্নিগ্ধ সৌজন্যে; যার মধ্যে শত শত শতাব্দীর রক্তলোলুপ হিংস্র নির্ঘোষ গেছে নিঃশব্দ হয়ে। সেই মাটির ছাদের নিচে বসব আমি রোজ সকালে শৈশবে যা ভরেছিল আমার গাঁটবাঁধা চাদরের কোনা এক-একমুঠো চাঁপা আর বেল ফুলে। মাঘের শেষে যার আমের বোল দক্ষিণের হাওয়ায় অলক্ষ্য দূরের দিকে ছড়িয়েছিল ব্যথিত যৌবনের আমন্ত্রণ। আমি ভালোবেসেছি বাংলাদেশের মেয়েকে; যে-দেখায় সে আমার চোখ ভুলিয়েছে তাতে আছে যেন এই মাটির শ্যামল অঞ্জন, ওর কচি ধানের চিকন আভা। তাদের কালো চোখের করুণ মাধুরীর উপমা দেখেছি ঐ মাটির দিগন্তে নীল বনসীমায় গোধূলির শেষ আলোটির নিমীলনে। প্রতিদিন আমার ঘরের সুপ্ত মাটি সহজে উঠবে জেগে ভোরবেলাকার সোনার কাঠির প্রথম ছোঁওয়ায়; তার চোখ-জুড়ানো শ্যামলিমায় স্মিত হাসি কোমল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে চৈত্ররাতের চাঁদের নিদ্রাহারা মিতালিতে। চিরদিন মাটি আমাকে ডেকেছে পদ্মার ভাঙনলাগা খাড়া পাড়ির বনঝাউবনে, গাঙশালিকের হাজার খোপের বাসায়; সর্ষে-তিসির দুইরঙা খেতে গ্রামের সরু বাঁকা পথের ধারে, পুকুরের পাড়ির উপরে। আমার দু-চোখ ভ'রে মাটি আমায় ডাক পাঠিয়েছে শীতের ঘুঘুডাকা দুপুরবেলায়, রাঙা পথের ও পারে, যেখানে শুকনো ঘাসের হলদে মাঠে চরে বেড়ায় দুটি-চারটি গোরু নিরুৎসুক আলস্যে, লেজের ঘায়ে পিঠের মাছি তাড়িয়ে; যেখানে সাথীবিহীন তালগাছের মাথায় সঙ্গ-উদাসীন নিভৃত চিলের বাসা। আজ আমি তোমার ডাকে ধরা দিয়েছি শেষবেলায়। এসেছি তোমার ক্ষমাস্নিগ্ধ বুকের কাছে, যেখানে একদিন রেখেছিলে অহল্যাকে, নবদূর্বাশ্যামলের করুণ পদস্পর্শে চরম মুক্তি-জাগরণের প্রতীক্ষায়, নবজীবনের বিস্মিত প্রভাতে।