কেন চেয়ে আছ, গো মা, মুখপানে! এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে, আপন মায়েরে নাহি জানে। এরা তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না-- মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভানে। তুমি তো দিতেছ মা, যা আছে তোমারি-- স্বর্ণশস্য তব,জাহ্নবীবারি, জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী। এরা কী দেবে তোরে, কিছু না, কিছু না-- মিথ্যা কবে শুধু হীন পরানে! মনের বেদনা রাখো মা মনে, নয়নবারি নিবারো নয়নে, মুখ লুকাও মা, ধূলিশয়নে-- ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে। শূন্য-পানে চেয়ে প্রহর গণি গণি দেখো কাটে কি না দীর্ঘ রজনী, দুঃখ জানায়ে কী হবে জননী, নির্মম চেতনহীন পাষাণে।
একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে, বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে। তোমরা শুধায়েছিলে মোরে ডাকি পরিচয় কোনো আছে নাকি, যাবে কোন্খানে। আমি শুধু বলেছি, কে জানে। নদীতে লাগিল দোলা, বাঁধনে পড়িল টান, একা বসে গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান। সেই গান শুনি কুসুমিত তরুতলে তরুণতরুণী তুলিল অশোক, মোর হাতে দিয়ে তারা কহিল, "এ আমাদেরই লোক।' আর কিছু নয়, সে মোর প্রথম পরিচয়।
তার পরে জোয়ারের বেলা সাঙ্গ হল, সাঙ্গ হল তরঙ্গের খেলা; কোকিলের ক্লান্ত গানে বিস্মৃত দিনের কথা অকস্মাৎ যেন মনে আনে; কনকচাঁপার দল পড়ে ঝুরে, ভেসে যায় দূরে-- ফাল্গুনের উৎসবরাতির নিমন্ত্রণলিখন-পাঁতির ছিন্ন অংশ তারা অর্থহারা। ভাঁটার গভীর টানে তরীখানা ভেসে যায় সমুদ্রের পানে। নূতন কালের নব যাত্রী ছেলেমেয়ে শুধাইছে দূর হতে চেয়ে, "সন্ধ্যার তারার দিকে বহিয়া চলেছে তরণী কে।' সেতারেতে বাঁধিলাম তার, গাহিলাম আরবার-- মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়।