হা বিধাতা -- ছেলেবেলা হতেই এমন (ha bidhata chhelebela)
প্রথম সর্গ
হা বিধাতা -- ছেলেবেলা হতেই এমন
দুর্বল হৃদয় লয়ে লভেছি জনম,
আশ্রয় না পেলে কিছু, হৃদয় আমার
অবসন্ন হয়ে পড়ে লতিকার মতো।
স্নেহ-আলিঙ্গন-পাশে বদ্ধ না হইলে
কাঁদে ভূমিতলে পড়ে হয়ে ম্রিয়মাণ।
তবে হে ঈশ্বর! তুমি কেন গো আমারে
ঐশ্বর্যের আড়ম্বরে করিলে নিক্ষেপ;
যেখানে সবারি হৃদি যন্ত্রের মতন;
স্নেহ প্রেম হৃদয়ের বৃত্তি সমুদয়
কঠোর নিয়মে যেথা হয় নিয়মিত।
কেন আমি হলেম না কৃষক-বালক,
ভায়ে ভায়ে মিলে মিলে করিতাম খেলা,
গ্রামপ্রান্তে প্রান্তরের পর্ণের কুটিরে
পিতামাতা ভাইবোন সকলে মিলিয়া
স্বাভাবিক হৃদয়ের সরল উচ্ছ্বাসে,
মুক্ত ওই প্রান্তরের বায়ুর মতন
হৃদয়ের স্বাধীনতা করিতাম ভোগ।
শ্রান্ত হলে খেলা-সুখে সন্ধ্যার সময়ে
কুটিরে ফিরিয়া আসি ভালোবাসি যারে
তার স্নেহময় কোলে রাখিতাম মাথা,
তা হইলে দ্বেষ ঘৃণা মিথ্যা অপবাদ
মুহূর্তে মুহূর্তে আর হত না সহিতে।
হৃদয়বিহীন প্রাসাদের আড়ম্বর
গর্বিত এ নগরের ঘোর কোলাহল
কৃত্রিম এ ভদ্রতার কঠোর নিয়ম
ভদ্রতার কাষ্ঠ হাসি,নহে মোর তরে।
দরিদ্র গ্রামের ভাঙাচোরা পথ,
গৃহস্থের ছোটোখাটো নিভৃত কুটির
যেখানে কোথা বা আছে, তৃণ রাশি রাশি,
কোথা বা গাছের তলে বাঁধা আছে গাভী
অযত্নে চিবায় কভু গাছের পল্লব
কভু বা দেখিছে চাহি বাৎসল্য-নয়নে
ক্রীড়াশীল কুটিরের শিশুদের দিকে।
কুটিরের বধূগন উঠিয়া প্রভাতে
আপনার আপনার কাজে আছে রত।
সে ক্ষুদ্র কুটির আর ভাঙাচোরা পথ,
দিগন্তের পদতলে বিশাল প্রান্তর
... যৌবনময় হৃদয়ে যাহার
... তৃণফুল শুকায় নিভৃতে
ছবি দেখে কল্পনার স্বপ্নের মতন
তা হইলে মধুময় কবিতার মতো
কেমন আরামে যেত জীবন কাটিয়া।
এমন হৃদয়হীন উপেক্ষার মাঝে
একজন ছিল মোর প্রেমের প্রতিমা,
অমিয়া, সে বালিকারে কত ভালোবাসি।
দিগন্তের দূর প্রান্তে ঘুমন্ত চন্দ্রমা,
ধবল জলদ জালে, আধো আধো ঢাকা--
বালিকা তেমনি আহা মধুর কোমল।
সেই বালা দয়া করি হৃদয় আমার
রেখেছিল জুড়াইয়া স্নেহের ছায়ায়।
অনন্ত-প্রণয়ময়ী রমণী তোমরা
পৃথিবীর মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
তোমাদের স্নেহধারা যদি না বর্ষিত
হৃদয় হইত তবে মরুভূমিসম
স্নেহ দয়া প্রেম ভক্তি যাইত শুকায়ে।
তোমরাই পৃথিবীর সংগীত, কবিতা,
স্বর্গ, সে তো তোমাদের বিরাজে
সে হৃদয়ে স্নেহছায়ে দিলে গো আশ্রয়
পাষাণ-হৃদয় সেও যায় গো গলিয়া!
কেহই আশ্রয় যবে ছিল না অমিয়া!
জননী, ভগ্নীর মতো বেসেছিলে ভালো
সে কি আর এ জনমে পারিব ভুলিতে?
বিষণ্ণ কাতর এক বালকের 'পরে
সে যে কী স্নেহের ধারা করেছ বর্ষণ
চিরকাল হৃদয়ে তা রহিবে মুদ্রিত।
ওই স্নেহময় কোলে রাখি শ্রান্ত মাথা
কাতর হইয়া কত করেছি রোদন
কত-না ব্যথিত হয়ে আদরে যতনে
অঞ্চলে সে অশ্রুজল দিয়াছ মুছায়ে।
কবিতা লিখিলে ছুটে ওই কোলে গিয়া
ওই গলা ধরে তাহা শুনিতাম কত
বাল্যহৃদয়ের মোর যত ছিল কথা
তোমার কাছেতে কিছু করিনি গোপন।
ওই স্নেহময় কোল ছিল স্বর্গ মোর
সেইখানে একবার মুখ লুকাইলে
সব শ্রান্তি সব জ্বালা যেত দূর হয়ে।
শ্রান্ত শিশুটির মতো ওই কোলে যবে
নীরবে নিষ্পন্দ হয়ে রহিতাম শুয়ে
অনন্ত স্নেহেতে পূর্ণ আনত নয়নে
কেমন মুখের পানে চাহিয়া রহিতে
তখন কী হর্ষে হৃদি যাইত ফাটিয়া!
কতবার করিয়াছি কত অভিমান,
আদরেতে উচ্ছ্বসিয়া কেঁদেছি কতই।