মরণের ছবি মনে আনি। ভেবে দেখি শেষ দিন ঠেকেছে শেষের শীর্ণক্ষণে। আছে ব'লে যত কিছু রয়েছে দেশে কালে-- যত বস্তু, যত জীব, যত ইচ্ছা, যত চেষ্টা, যত আশানৈরাশ্যের ঘাতপ্রতিঘাত দেশে দেশে ঘরে ঘরে চিত্তে চিত্তে, যত গ্রহনক্ষত্রের দূর হতে দূরতর ঘূর্ণ্যমান স্তরে স্তরে অগণিত অজ্ঞাত শক্তির আলোড়ন আবর্তন মহাকালসমুদ্রের কূলহীন বক্ষতলে, সমস্তই আমার এ চৈতন্যের শেষ সূক্ষ্ম আকম্পিত রেখার এ ধারে। এক পা তখনো আছে সেই প্রান্তসীমায়, অন্য পা আমার বাড়িয়েছি রেখার ও ধারে, সেখানে অপেক্ষা করে অলক্ষিত ভবিষ্যৎ লয়ে দিনরজনীর অন্তহীন অক্ষমালা আলো-অন্ধকারে-গাঁথা। অসীমের অসংখ্য যা-কিছু সত্তায় সত্তায় গাঁথা প্রসারিত অতীতে ও অনাগতে। নিবিড় সে সমস্তের মাঝে অকস্মাৎ আমি নেই। একি সত্য হতে পারে। উদ্ধত এ নাস্তিত্ব যে পাবে স্থান এমন কি অণুমাত্র ছিদ্র আছে কোনোখানে। সে ছিদ্র কি এতদিনে ডুবাতো না নিখিলতরণী মৃত্যু যদি শূন্য হত, যদি হত মহাসমগ্রের রূঢ় প্রতিবাদ।
ওগো মৌন, না যদি কও না-ই কহিলে কথা। বক্ষ ভরি বইব আমি তোমার নীরবতা। স্তব্ধ হয়ে রইব পড়ে, রজনী রয় যেমন করে জ্বালিয়ে তারা নিমেষহারা ধৈর্যে অবনতা। হবে হবে প্রভাত হবে আঁধার যাবে কেটে। তোমার বাণী সোনার ধারা পড়বে আকাশ ফেটে। তখন আমার পাখির বাসায় জাগবে কি গান তোমার ভাষায়। তোমার তানে ফোটাবে ফুল আমার বনলতা?
সংসারে মোরে রাখিয়াছ যেই ঘরে সেই ঘরে রব সকল দুঃখ ভুলিয়া। করুণা করিয়া নিশিদিন নিজ করে রেখে দিয়ো তার একটি দুয়ার খুলিয়া। মোর সব কাজে মোর সব অবসরে সে দুয়ার রবে তোমারি প্রবেশ-তরে, সেথা হতে বায়ু বহিবে হৃদয়-'পরে চরণ হতে তব পদরজ তুলিয়া। সে দুয়ার খুলি আসিবে তুমি এ ঘরে, আমি বাহিরিব সে দুয়ারখানি খুলিয়া। আর যত সুখ পাই বা না পাই, তবু এক সুখ শুধু মোর তরে তুমি রাখিয়ো। সে সুখ কেবল তোমার আমার প্রভু, সে সুখের 'পরে তুমি জাগ্রত থাকিয়ো। তাহারে না ঢাকে আর যত সুখগুলি, সংসার যেন তাহাতে না দেয় ধূলি, সব কোলাহল হতে তারে তুমি তুলি যতন করিয়া আপন অঙ্কে ঢাকিয়ো। আর যত সুখে ভরুক ভিক্ষাঝুলি, সেই এক সুখ মোর তরে তুমি রাখিয়ো। যত বিশ্বাস ভেঙে ভেঙে যায়, স্বামী, এক বিশ্বাস রহে যেন চিতে লাগিয়া। যে অনলতাপ যখনি সহিব আমি দেয় যেন তাহে তব নাম বুকে দাগিয়া। দুখ পশে যবে মর্মের মাঝখানে তোমার লিখন-স্বাক্ষর যেন আনে, রুক্ষ বচন যতই আঘাত হানে সকল আঘাতে তব সুর উঠে জাগিয়া। শত বিশ্বাস ভেঙে যদি যায় প্রাণে এক বিশ্বাসে রহে যেন মন লাগিয়া।