শিলঙে এক গিরির খোপে পাথর আছে খসে-- তারি উপর লুকিয়ে ব'সে রোজ সকালে গেঁথেছিলেম ভোরের সুরে গানের মালা। প্রথম সূর্যোদয়ের সঙ্গে ছিল আমার মুখোমুখির পালা। ডানদিকেতে অফলা এক পিচের শাখা ভরে ফুল ফোটে আর ফুল প'ড়ে যায় ঝরে। কালো ডানায় হলদে আভাস, কোন্ পাখি সেই অকারণের গানে ক্লান্তি নাহি জানে,-- তেমনিতরো গোলাপলতা লতাবিতান ঢেকে অজস্র তার ফুলের ভাষায় অন্ত না পায় উদ্দেশহীন ডেকে। পাইনবনের প্রাচীন তরু তাকায় মেঘের মুখে, ডালগুলি তার সবুজ ঝরনা ধরার পানে ঝুঁকে মন্ত্রে যেন থমক-লেগে আছে। দুটি দালিম গাছে ঘনসবুজ পাতার কোলে কোলে ঘনরাঙা ফুলের গুচ্ছ দোলে। পায়ের কাছে একটি কণ্টিকারি-- অন্তরঙ্গ কাছের সঙ্গ তারি, দূরের শূন্যে আপনাকে সে প্রচার নাহি করে। মাটির কাছে নত হলে পরে স্নিগ্ধ সাড়া দেয় সে ধীরে ধূলিশয়ন থেকে নীলবরনের ফুলের বুকে একটুখানি সোনার বিন্দু এঁকে। সেদিন যত রচেছিলাম গান কন্টিকারির দান তাদের সুরে স্বীকার করা আছে। আজকে যখন হৃদয় আমার ক্ষণিক শান্তি যাচে দুঃখদিনের দুর্ভাবনার প্রচণ্ড পীড়নে, হঠাৎ কেন জাগল আমার মনে, সেই সকালের টুকরো একটুখানি-- মাটির কাছে কণ্টিকারির নীল-সোনালির বাণী।
বিজ্ঞানাচার্য শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু করকমলেষু বন্ধু, এ যে আমার লজ্জাবতী লতা কী পেয়েছে আকাশ হতে কী এসেছে বায়ুর স্রোতে পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে সে যে প্রাণের কথা। যত্নভরে খুঁজে খুঁজে তোমায় নিতে হবে বুঝে, ভেঙে দিতে হবে যে তার নীরব ব্যাকুলতা। আমার লজ্জাবতী লতা। বন্ধু, সন্ধ্যা এল, স্বপনভরা পবন এরে চুমে। ডালগুলি সব পাতা নিয়ে জড়িয়ে এল ঘুমে। ফুলগুলি সব নীল নয়ানে চুপিচুপি আকাশপানে তারার দিকে চেয়ে চেয়ে কোন্ ধেয়ানে রতা। আমার লজ্জাবতী লতা। বন্ধু, আনো তোমার তড়িৎ-পরশ, হরষ দিয়ে দাও, করুণ চক্ষু মেলে ইহার মর্মপানে চাও। সারা দিনের গন্ধগীতি সারা দিনের আলোর স্মৃতি নিয়ে এ যে হৃদয়ভারে ধরায় অবনতা-- আমার লজ্জাবতী লতা। বন্ধু, তুমি জান ক্ষুদ্র যাহা ক্ষুদ্র তাহা নয়, সত্য যেথা কিছু আছে বিশ্ব সেথা রয় এই-যে মুদে আছে লাজে পড়বে তুমি এরি মাঝে-- জীবনমৃত্যু রৌদ্রছায়া ঝটিকার বারতা। আমার লজ্জাবতী লতা।