ভেবেছিলাম চেয়ে নেব, চাই নি সাহস করে-- সন্ধেবেলায় যে মালাটি গলায় ছিলে পরে-- আমি চাই নি সাহস করে। ভেবেছিলাম সকাল হলে যখন পারে যাবে চলে ছিন্ন মালা শয্যাতলে রইবে বুঝি পড়ে। তাই আমি কাঙালের মতো এসেছিলেম ভোরে-- তবু চাই নি সাহস করে। এ তো মালা নয় গো, এ যে তোমার তরবারি। জ্বলে ওঠে আগুন যেন, বজ্র-হেন ভারী-- এ যে তোমার তরবারি। তরুণ আলো জানলা বেয়ে পড়ল তোমার শয়ন ছেয়ে, ভোরের পাখি শুধায় গেয়ে "কী পেলি তুই নারী'। নয় এ মালা, নয় এ থালা, গন্ধজলের ঝারি, এ যে ভীষণ তরবারি। তাই তো আমি ভাবি বসে এ কী তোমার দান। কোথায় এরে লুকিয়ে রাখি নাই যে হেন স্থান। ওগো, এ কী তোমার দান। শক্তিহীনা মরি লাজে, এ ভূষণ কি আমায় সাজে। রাখতে গেলে বুকের মাঝে ব্যথা যে পায় প্রাণ। তবু আমি বইব বুকে এই বেদনার মান-- নিয়ে তোমারি এই দান। আজকে হতে জগৎমাঝে ছাড়ব আমি ভয়, আজ হতে মোর সকল কাজে তোমার হবে জয়-- আমি ছাড়ব সকল ভয়। মরণকে মোর দোসর করে রেখে গেছ আমার ঘরে, আমি তারে বরণ ক'রে রাখব পরান-ময়। তোমার তরবারি আমার করবে বাঁধন ক্ষয়। আমি ছাড়ব সকল ভয়। তোমার লাগি অঙ্গ ভরি করব না আর সাজ। নাই-বা তুমি ফিরে এলে ওগো হৃদয়রাজ। আমি করব না আর সাজ। ধুলায় বসে তোমার তরে কাঁদব না আর একলা ঘরে, তোমার লাগি ঘরে-পরে মানব না আর লাজ। তোমার তরবারি আমায় সাজিয়ে দিল আজ, আমি করব না আর সাজ।
একলা হোথায় বসে আছে, কেই বা জানে ওকে-- আপন-ভোলা সহজ তৃপ্তি রয়েছে ওর চোখে। খাটুলিটা বাইরে এনে আঙিনাটার কোণে টানছে তামাক বসে আপন-মনে। মাথার উপর বটের ছায়া, পিছন দিকে নদী বইছে নিরবধি। আয়োজনের বালাই নেইকো ঘরে, আমের কাঠের নড়্নড়ে এক তক্তপোষের 'পরে মাঝখানেতে আছে কেবল পাতা বিধবা তার মেয়ের হাতের সেলাই করা কাঁথা। নাতনি গেছে, রাখে তারি পোষা ময়নাটাকে, ছেলের গাঁথা ঘরের দেয়াল, চিহ্ন আছে তারি রঙিন মাটি দিয়ে আঁকা সিপাই সারি সারি। সেই ছেলেটাই তালুকদারের সর্দারি পদ পেয়ে জেলখানাতে মরছে পচে দাঙ্গা করতে যেয়ে। দুঃখ অনেক পেয়েছে ও, হয়তো ডুবছে দেনায়, হয়তো ক্ষতি হয়ে গেছে তিসির বেচাকেনায়। বাইরে দারিদ্র৻ের কাটা-ছেঁড়ার আঁচড় লাগে ঢের, তবুও তার ভিতর-মনে দাগ পড়ে না বেশি, প্রাণটা যেমন কঠিন তেমনি কঠিন মাংসপেশী। হয়তো গোরু বেচতে হবে মেয়ের বিয়ের দায়ে, মাসে দুবার ম্যালেরিয়া কাঁপন লাগায় গায়ে, ডাগর ছেলে চাকরি করতে গঙ্গাপারের-দেশে হয়তো হঠাৎ মারা গেছে ঐ বছরের শেষে-- শুকনো করুণ চক্ষু দুটো তুলে উপর-পানে কার খেলা এই দুঃখসুখের, কী ভাবলে সেই জানে। বিচ্ছেদ নেই খাটুনিতে, শোকের পায় না ফাঁক, ভাবতে পারে স্পষ্ট ক'রে নেইকো এমন বাক্। জমিদারের কাছারিতে নালিশ করতে এসে কী বলবে যে কেমন ক'রে পায় না ভেবে শেষে। খাটুলিতে এসে বসে যখনি পায় ছুটি, ভাব্নাগুলো ধোঁয়ায় মেলায়, ধোঁয়ায় ওঠে ফুটি। ওর যে আছে খোলা আকাশ, ওর যে মাথার কাছে শিষ দিয়ে যায় বুলবুলিরা আলোছায়ার নাচে, নদীর ধারে মেঠো পথে টাট্টু চলে ছুটে, চক্ষু ভোলায় খেতের ফসল রঙের হরির-লুটে-- জন্মমরণ ব্যেপে আছে এরা প্রাণের ধন অতি সহজ ব'লেই তাহা জানে না ওর মন।