দাঁড়িয়ে আছ আড়ালে, ঘরে আসবে কিনা ভাবছ সেই কথা। একবার একটু শুনেছি চুড়ির শব্দ। তোমার ফিকে পাটকিলে রঙের আঁচলের একটুখানি দেখা যায় উড়ছে বাতাসে দরজার বাইরে। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি নে, দেখছি পশ্চিম আকাশের রোদ্দুর চুরি করেছে তোমার ছায়া, ফেলে রেখেছে আমার ঘরের মেঝের 'পরে। দেখছি শাড়ির কালো পাড়ের নীচে থেকে তোমার কনক-গৌরবর্ণ পায়ের দ্বিধা ঘরের চৌকাঠের উপর। আজ ডাকব না তোমাকে। আজ ছড়িয়ে পড়েছে আমার হালকা চেতনা-- যেন কৃষ্ণপক্ষের গভীর আকাশে নীহারিকা, যেন বর্ষণশেষে মিলিয়ে-আসা সাদা মেঘ শরতের নীলিমায়। আমার ভালোবাসা যেন সেই আল-ভেঙে-যাওয়া খেতের মতো অনেক দিন হল চাষি যাকে ফেলে দিয়ে গেছে চলে; আনমনা আদিপ্রকৃতি তার উপরে বিছিয়েছে আপন স্বত্ব নিজের অজানিতে। তাকে ছেয়ে উঠেছে ঘাস, উঠেছে অনামা গাছের চারা সে মিলে গেছে চার দিকের বনের সঙ্গে সে যেন শেষরাত্রির শুকতারা, প্রভাত-আলোয় ডুবিয়ে দিল তার আপন আলোর ঘটখানি। আজ কোনো-সীমানা-দেওয়া নয় আমার মন, হয়তো তাই ভুল বুঝবে আমাকে। আগেকার চিহ্নগুলো সব গেছে মুছে, আমাকে এক করে নিতে পারবে না কোনোখানে কোনো বাঁধনে বেঁধে।
খোকা থাকে জগৎ-মায়ের অন্তঃপুরে -- তাই সে শোনে কত যে গান কতই সুরে। নানান রঙে রাঙিয়ে দিয়ে আকাশ পাতাল মা রচেছেন খোকার খেলা- ঘরের চাতাল। তিনি হাসেন, যখন তরু - লতার দলে খোকার কাছে পাতা নেড়ে প্রলাপ বলে। সকল নিয়ম উড়িয়ে দিয়ে সূর্য শশী খোকার সাথে হাসে, যেন এক-বয়সী। সত্যবুড়ো নানা রঙের মুখোশ প'রে শিশুর সনে শিশুর মতো গল্প করে। চরাচরের সকল কর্ম ক'রে হেলা মা যে আসেন খোকার সঙ্গে করতে খেলা। খোকার জন্যে করেন সৃষ্টি যা ইচ্ছে তাই -- কোনো নিয়ম কোনো বাধা- বিপত্তি নাই। বোবাদেরও কথা বলান খোকার কানে, অসাড়কেও জাগিয়ে তোলেন চেতন প্রাণে। খোকার তরে গল্প রচে বর্ষা শরৎ , খেলার গৃহ হয়ে ওঠে বিশ্বজগৎ। খোকা তারি মাঝখানেতে বেড়ায় ঘুরে, খোকা থাকে জগৎ-মায়ের অন্তঃপুরে। আমরা থাকি জগৎ-পিতার বিদ্যালয়ে -- উঠেছে ঘর পাথর-গাঁথা দেয়াল লয়ে। জ্যোতিষশাস্ত্র-মতে চলে সূর্য শশী, নিয়ম থাকে বাগিয়ে ল'য়ে রশারশি। এম্নি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে বৃক্ষ লতা, যেন তারা বোঝেই নাকো কোনোই কথা। চাঁপার ডালে চাঁপা ফোটে এম্নি ভানে যেন তারা সাত ভায়েরে কেউ না জানে। মেঘেরা চায় এম্নিতরো অবোধ ভাবে, যেন তারা জানেই নাকো কোথায় যাবে। ভাঙা পুতুল গড়ায় ভুঁয়ে সকল বেলা, যেন তারা কেবল শুধু মাটির ঢেলা। দিঘি থাকে নীরব হয়ে দিবারাত্র, নাগকন্যের কথা যেন গল্পমাত্র। সুখদুঃখ এম্নি বুকে চেপে রহে, যেন তারা কিছুমাত্র গল্প নহে। যেমন আছে তেম্নি থাকে যে যাহা তাই-- আর যে কিছু হবে এমন ক্ষমতা নাই। বিশ্বগুরু-মশায় থাকেন কঠিন হয়ে, আমরা থাকি জগৎ-পিতার বিদ্যালয়ে।
আমাকে শুনতে দাও, আমি কান পেতে আছি। পড়ে আসছে বেলা; পাখিরা গেয়ে নিচ্ছে দিনের শেষে কণ্ঠের সঞ্চয় উজাড়-করে-দেবার গান। ওরা আমার দেহ-মনকে নিল টেনে নানা সুরের, নানা রঙের, নানা খেলার প্রাণের মহলে। ওদের ইতিহাসের আর কোনো সাড়া নেই, কেবল এইটুকু কথা-- আছি, আমরা আছি, বেঁচে আছি, বেঁচে আছি এই আশ্চর্য মুহূর্তে।-- এই কথাটুকু পৌঁছল আমার মর্মে। বিকালবেলায় মেয়েরা জল ভরে নিয়ে যায় ঘটে, তেমনি করে ভরে নিচ্ছি প্রাণের এই কাকলি আকাশ থেকে মনটাকে ডুবিয়ে দিয়ে। আমাকে একটু সময় দাও। আমি মন পেতে আছি। ভাঁটা-পড়া বেলায়, ঘাসের উপরে ছড়িয়ে-পড়া বিকেলের আলোতে গাছেদের নিস্তব্ধ খুশি, মজ্জার মধ্যে লুকোনো খুশি, পাতায় পাতায় ছড়ানো খুশি। আমার প্রাণ নিজেকে বাতাসে মেলে দিয়ে নিচ্ছে বিশ্বপ্রাণের স্পর্শরস চেতনার মধ্যে দিয়ে ছেঁকে। এখন আমাকে বসে থাকতে দাও, আমি চোখ মেলে থাকি। তোমরা এসেছ তর্ক নিয়ে। আজ দিনান্তের এই পড়ন্ত রোদ্দুরে সময় পেয়েছি একটুখানি; এর মধ্যে ভালো নেই, মন্দ নেই, নিন্দা নেই, খ্যাতি নেই। দ্বন্দ্ব নেই, দ্বিধা নেই-- আছে বনের সবুজ, জলের ঝিকিমিকি-- জীবনস্রোতের উপর তলে অল্প একটু কাঁপন, একটু কল্লোল, একটু ঢেউ। আমার এই একটুখানি অবসর উড়ে চলেছে ক্ষণজীবী পতঙ্গের মতো সূর্যাস্তবেলার আকাশে রঙিন ডানার শেষ খেলা চুকিয়ে দিতে-- বৃথা প্রশ্ন কোরো না। বৃথা এনেছ তোমাদের যত দাবি। আমি বসে আছি বর্তমানের পিছন মুখে অতীতের দিকে গড়িয়ে-পড়া ঢালুতটে। নানান বেদনায় ধেয়ে-বেড়ানো প্রাণ একদিন করে গেছে লীলা ওই বনবীথির ডাল দিয়ে বিনুনি-করা আলোছায়ায়। আশ্বিনে দুপুর বেলা এই কাঁপনলাগা ঘাসের উপর, মাঠের পারে, কাশের বনে, হাওয়ায় হাওয়ায় স্বগত উক্তি মিলেছে আমার জীবনবীণার ফাঁকে ফাঁকে। যে সমস্যাজাল সংসারের চারি দিকে পাকে-পাকে জড়ানো তার সব গিঁঠ গেছে ঘুচে। যাবার পথের যাত্রী পিছনে যায় নি ফেলে কোনো উদ্যোগ, কোনো উদ্বেগ, কোনো আকাঙক্ষা; কেবল গাছের পাতার কাঁপনে এই বাণীটি রয়ে গেছে-- তারাও ছিল বেঁচে, তারা যে নেই তার চেয়ে সত্য ওই কথাটি। শুধু আজ অনুভবে লাগে তাদের কাপড়ের রঙের আভাস, পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার হাওয়া, চেয়ে দেখার বাণী, ভালোবাসার ছন্দ-- প্রাণগঙ্গার পূর্বমুখী ধারায় পশ্চিম প্রাণের যমুনার স্রোত।