গৌরবর্ণ নধর দেহ, নাম শ্রীযুক্ত রাখাল, জন্ম তাহার হয়েছিল, সেই যে-বছর আকাল। গুরুমশায় বলেন তারে, "বুদ্ধি যে নেই একেবারে; দ্বিতীয়ভাগ করতে সারা ছ'মাস ধরে নাকাল।" রেগেমেগে বলেন, "বাঁদর, নাম দিনু তোর মাকাল।" নামটা শুনে ভাবলে প্রথম বাঁকিয়ে যুগল ভুরু; তারপর সে বাড়ি এসে নৃত্য করলে শুরু। হঠাৎ ছেলের মাতন দেখি সবাই তাকে শুধায়, এ কী! সকলকে সে জানিয়ে দিল, নাম দিয়েছেন গুরু-- নতুন নামের উৎসাহে তার বক্ষ দুরুদুরু। কোলের 'পরে বসিয়ে দাদা বললে কানে-কানে, "গুরুমশায় গাল দিয়েছেন, বুঝিসনে তার মানে!" রাখাল বলে, "কখ্খোনো না, মা যে আমায় বলেন সোনা, সেটা তো গাল নয় সে কথা পাড়ার সবাই জানে। আচ্ছা, তোমায় দেখিয়ে দেব, চলো তো ঐখানে।" টেনে নিয়ে গেল তাকে পুকুরপাড়ের কাছে, বেড়ার 'পরে লতায় যেথা মাকাল ফ'লে আছে। বললে, "দাদা সত্যি বোলো, সোনার চেয়ে মন্দ হল? তুমি শেষে বলতে কি চাও, গাল ফলেছে গাছে।" "মাকাল আমি" ব'লে রাখাল দু হাত তুলে নাচে। দোয়াত কলম নিয়ে ছোটে, খেলতে নাহি চায়, লেখাপড়ায় মন দেখে মা অবাক হয়ে যায়। খাবার বেলায় অবশেষে দেখে ছেলের কাণ্ড এসে-- মেঝের 'পরে ঝুঁকে প'ড়ে খাতার পাতাটায় লাইন টেনে লিখছে শুধু-- মাকালচন্দ্র রায়।
নিভৃত এ চিত্তমাঝে নিমেষে নিমেষে বাজে জগতের তরঙ্গ-আঘাত, ধ্বনিত হৃদয়ে তাই মুহূর্ত বিরাম নাই নিদ্রাহীন সারা দিন রাত। সুখ দুঃখ গীতস্বর ফুটিতেছে নিরন্তর-- ধ্বনি শুধু, সাথে নাই ভাষা। বিচিত্র সে কলরোলে ব্যাকুল করিয়া তোলে জাগাইয়া বিচিত্র দুরাশা। এ চিরজীবন তাই আর কিছু কাজ নাই রচি শুধু অসীমের সীমা। আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে, তাহে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানসী-প্রতিমা। বাহিরে পাঠায় বিশ্ব কত গন্ধ গান দৃশ্য সঙ্গীহারা সৌন্দর্যের বেশে, বিরহী সে ঘুরে ঘুরে ব্যথাভরা কত সুরে কাঁদে হৃদয়ের দ্বারে এসে। সেই মোহমন্ত্র-গানে কবির গভীর প্রাণে জেগে ওঠে বিরহী ভাবনা, ছাড়ি অন্তঃপুরবাসে সলজ্জ চরণে আসে মূর্তিমতী মর্মের কামনা। অন্তরে বাহিরে সেই ব্যাকুলিত মিলনেই কবির একান্ত সুখোচ্ছ্বাস। সেই আনন্দমুহূর্তগুলি তব করে দিনু তুলি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ।