হে প্রিয়, আজি এ প্রাতে নিজ হাতে কী তোমারে দিব দান। প্রভাতের গান? প্রভাত যে ক্লান্ত হয় তপ্ত রবিকরে আপনার বৃন্তটির 'পরে; অবসন্ন গান হয় অবসান। হে বন্ধু কী চাও তুমি দিবসের শেষে মোর দ্বারে এসে। কী তোমারে দিব আনি। সন্ধ্যাদীপখানি? এ-দীপের আলো এ যে নিরালা কোণের, স্তব্ধ ভবনের। তোমার চলার পথে এরে নিতে চাও জনতায়? এ যে হায় পথের বাতাসে নিবে যায়। কী মোর শকতি আছে তোমারে যে দিব উপহার। হোক ফুল, হোক-না গলার হার, তার ভার কেনই বা সবে, একদিন যবে নিশ্চিত শুকাবে তারা ম্লান ছিন্ন হবে। নিজ হতে তব হাতে যাহা দিব তুলি তারে তব শিথিল অঙ্গুলি যাবে ভুলি-- ধূলিতে খসিয়া শেষে হয়ে যাবে ধূলি। তার চেয়ে যবে ক্ষণকাল অবকাশ হবে, বসন্তে আমার পুষ্পবনে চলিতে চলিতে অন্যমনে অজানা গোপন গন্ধে পুলকে চমকি দাঁড়াবে থমকি, পথহারা সেই উপহার হবে সে তোমার। যেতে যেতে বীথিকায় মোর চোখেতে লাগিবে ঘোর, দেখিবে সহসা-- সন্ধ্যার কবরী হতে খসা একটি রঙিন আলো কাঁপি থরথরে ছোঁয়ায় পরশমণি স্বপনের 'পরে, সেই আলো, অজানা সে উপহার সেই তো তোমার। আমার যা শ্রেষ্ঠধন সে তো শুধু চমকে ঝলকে, দেখা দেয়, মিলায় পলকে। বলে না আপন নাম, পথেরে শিহরি দিয়া সুরে চলে যায় চকিতে নূপুরে। সেথা পথ নাহি জানি, সেথা নাহি যায় হাত, নাহি যায় বাণী। বন্ধু, তুমি সেথা হতে আপনি যা পাবে আপনার ভাবে, না-চাহিতে না-জানিতে সেই উপহার সেই তো তোমার। আমি যাহা দিতে পারি সামান্য সে দান-- হোক ফুল, হোক তাহা গান।
কে আমার ভাষাহীন অন্তরে চিত্তের মেঘলোকে সন্তরে, বক্ষের কাছে থাকে তবুও সে রয় দূরে, থাকে অশ্রুত সুরে। ভাবি বসে, গাব আমি তারই গান-- চুপ করে থাকি সারা দিনমান, অকথিত আবেগের ব্যথা সই। মন বলে, কথা কই কথা কই! চঞ্চল শোণিতে যে সত্তার ক্রন্দন ধ্বনিতেছে অর্থ কী জানি তাহা, আদিতম আদিমের বাণী তাহা। ভেদ করি ঝঞ্ঝার আলোড়ন ছেদ করি বাষ্পের আবরণ চুম্বিল ধরাতল যে আলোক, স্বর্গের সে বালক কানে তার বলে গেছে যে কথাটি তারই স্মৃতি আজো ধরণীর মাটি দিকে দিকে বিকাশিছে ঘাসে ঘাসে-- তারই পানে চেয়ে চেয়ে সেই সুর কানে আসে। প্রাণের প্রথমতম কম্পন অশথের মজ্জায় করিতেছে বিচরণ, তারই সেই ঝংকার ধ্বনিহীন-- আকাশের বক্ষেতে কেঁপে ওঠে নিশিদিন; মোর শিরাতন্তুতে বাজে তাই; সুগভীর চেতনার মাঝে তাই নর্তন জেগে ওঠে অদৃশ্য ভঙ্গিতে অরণ্যমর্মর-সংগীতে। ওই তরু ওই লতা ওরা সবে মুখরিত কুসুমে ও পল্লবে-- সেই মহাবাণীময় গহনমৌনতলে নির্বাক স্থলে জলে শুনি আদি-ওংকার, শুনি মূক গুঞ্জন অগোচর চেতনার। ধরণীর ধূলি হতে তারার সীমার কাছে কথাহারা যে ভুবন ব্যাপিয়াছে তার মাঝে নিই স্থান, চেয়ে-থাকা দুই চোখে বাজে ধ্বনিহীন গান।