তোমার যে ছায়া তুমি দিলে আরশিরে হাসিমুখ মেজে, সেইক্ষণে অবিকল সেই ছায়াটিরে ফিরে দিল সে যে। রাখিল না কিছু আর, স্ফটিক সে নির্বিকার আকাশের মতো-- সেথা আসে শশী রবি, যায় চলে, তার ছবি কোথা হয় গত। একদিন শুধু মোরে ছায়া দিয়ে, শেষে সমাপিলে খেলা আত্মভোলা বসন্তের উন্মত্ত নিমেষে শুক্ল সন্ধ্যাবেলা। সে ছায়া খেলারই ছলে নিয়েছিনু হিয়াতলে হেলাভরে হেসে, ভেবেছিনু চুপে চুপে ফিরে দিব ছায়ারূপে তোমারি উদ্দেশে। সে ছায়া তো ফিরিল না, সে আমার প্রাণে হল প্রাণবান। দেখি, ধরা পড়ে গেল কবে মোর গানে তোমার সে দান। যদিবা দেখিতে তারে পারিতে না চিনিবারে অয়ি এলোকেশী-- আমার পরান পেয়ে সে আজি তোমারো চেয়ে বহুগুণে বেশি। কেমনে জানিবে তুমি তারে সুর দিয়ে দিয়েছি মহিমা। প্রেমের অমৃতস্নানে সে যে, অয়ি প্রিয়ে, হারায়েছে সীমা। তোমার খেয়াল ত্যেজে পূজার গৌরবে সে যে পেয়েছে গৌরব। মর্তের স্বপন ভুলে অমরাবতীর ফুলে লভিল সৌরভ।
শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য সুহৃদ্বরেষু আমরা কি সত্যই চাই শোকের অবসান? আমাদের গর্ব আছে নিজের শোককে নিয়েও। আমাদের অতি তীব্র বেদনাও বহন করে না স্থায়ী সত্যকে-- সান্ত্বনা নেই এমন কথায়; এতে আঘাত লাগে আমাদের দুঃখের অহংকারে। জীবনটা আপন সকল সঞ্চয় ছড়িয়ে রাখে কালের চলাচলের পথে; তার অবিরাম-ধাবিত চাকার তলায় গুরুতর বেদনার চিহ্নও যায় জীর্ণ হয়ে, অস্পষ্ট হয়ে। আমাদের প্রিয়তমের মৃত্যু একটিমাত্র দাবি করে আমাদের কাছে সে বলে--"মনে রেখো।" কিন্তু সংখ্যা নেই প্রাণের দাবির, তার আহ্বান আসে চারিদিক থেকেই মনের কাছে; সেই উপস্থিত কালের ভিড়ের মধ্যে অতীতকালের একটিমাত্র আবেদন কখন হয় অগোচর। যদি বা তার কথাটা থাকে তার ব্যথাটা যায় চলে। তবু শোকের অভিমান জীবনকে চায় বঞ্চিত করতে। স্পর্ধা ক'রে প্রাণের দূতগুলিকে বলে-- খুলব না দ্বার। প্রাণের ফসলখেত বিচিত্র শস্যে উর্বর, অভিমানী শোক তারি মাঝখানে ঘিরে রাখতে চায় শোকের দেবত্র জমি,-- সাধের মরুভূমি বানায় সেখানটাতে, তার খাজনা দেয় না জীবনকে। মৃত্যুর সঞ্চয়গুলি নিয়ে কালের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ। সেই অভিযোগে তার হার হতে থাকে দিনে দিনে। কিন্তু চায় না সে হার মানতে; মনকে সমাধি দিতে চায় তার নিজকৃত কবরে। সকল অহংকারই বন্ধন, কঠিন বন্ধন আপন শোকের অহংকার। ধন জন মান সকল আসক্তিতেই মোহ, নিবিড় মোহ আপন শোকের আসক্তিতে।
সে পরম পরিপূর্ণ প্রভাতের লাগি, হে ভারত, সর্বদুঃখে রহো তুমি জাগি সরলনির্মলচিত্ত-- সকল বন্ধনে আত্মারে স্বাধীন রাখি, পুষ্প ও চন্দনে আপনার অন্তরের মাহাত্ম্যমন্দির সজ্জিত সুগন্ধি করি, দুঃখনম্রশির তাঁর পদতলে নিত্য রাখিয়া নীরবে। তাঁ' হতে বঞ্চিত করে তোমারে এ ভবে এমন কেহই নাই-- সেই গর্বভরে সর্বভয়ে থাকো তুমি নির্ভয় অন্তরে তাঁর হস্ত হতে লয়ে অক্ষয় সম্মান। ধরায় হোক-না তব যত নিম্ন স্থান তাঁর পাদপীঠ করো সে আসন তব যাঁর পাদরেণুকণা এ নিখিল ভব।