আণ্ডেস জাহাজ,  ১৯ অক্টোবর, ১৯২৪


 

আশা (asha)


মস্ত যে-সব কাণ্ড করি, শক্ত তেমন নয়;

জগৎ-হিতের তরে ফিরি বিশ্বজগৎময়।

সঙ্গীর ভিড় বেড়ে চলে; অনেক লেখাপড়া,

অনেক ভাষায় বকাবকি, অনেক ভাঙাগড়া।

ক্রমে ক্রমে জাল গেঁথে যায়, গিঁঠের পরে গিঁঠ

মহল-'পরে মহল ওঠে, ইঁটের 'পরে ইঁট।

কীর্তিরে কেউ ভালো বলে , মন্দ বলে কেহ;

বিশ্বাসে কেউ কাছে আসে কেউ করে সন্দেহ।

কিছু খাঁটি, কিছু ভেজাল, মসলা যেমন জোটে,

মোটের 'পরে একটা কিছু হয়ে ওঠেই ওঠে।

 

কিন্তু যে-সব ছোটো আশা করুণ অতিশয়,

সহজ বটে শুনতে লাগে, মোটেই সহজ নয়।

একটুকু সুখ গানের সুরে ফুলের গন্ধে মেশা

গাছের-ছারায়-স্বপ্ন-দেখা অবকাশের নেশা,

মনে ভাবি চাইলে পাব; যখন তারে চাহি,

তখন দেখি চঞ্চলা সে কোনোখানেই নাহি।

অরূপ অকূল বাষ্পমাঝে বিধি কোমর বেঁধে

আকাশটারে কাঁপিয়ে যখন সৃষ্টি দিলেন ফেঁদে

আদ্যযুগের খাটুনিতে পাহাড় হল উচ্চ

লক্ষযুগের স্বপ্নে পেলেন প্রথম ফুলের গুচ্ছ।

 

     বহুদিন মনে ছিল আশা

          ধরণীর এক কোণে

          রহিব আপন-মনে;

ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা

          করেছিনু আশা।

গাছটির স্নিগ্ধ ছায়া, নদীটির ধারা,

ঘরে-আনা গোধূলিতে সন্ধ্যাটির তারা,

চামেলির গন্ধটুকু জানালার ধারে,

ভোরের প্রথম আলো জলের ওপারে।

     তাহারে জড়ায়ে ঘিরে

     ভরিয়া তুলিব ধীরে

জীবনের কদিনের কাঁদা আর হাসা;

     ধন নয়, মান নয়, এইটুকু বাসা

          করেছিনু আশা।

 

বহুদিন মনে ছিল আশা

     অন্তরের ধ্যানখানি

     লভিবে সম্পূর্ণ বাণী;

ধন নয়, মান নয়, আপনার ভাষা

          করেছিনু আশা।

মেঘে মেঘে এঁকে যায় অস্তগামী রবি

কল্পনার শেষ রঙে সমাপ্তির ছবি,

আপন স্বপনলোক আলোকে ছায়ায়

রঙে রসে রচি দিব তেমনি মায়ায়।

     তাহারে জড়ায়ে ঘিরে

     ভরিয়া তুলিব ধীরে

জীবনের কদিনের কাঁদা আর হাসা।

ধন নয়, মান নয়, ধেয়ানের ভাষা

          করেছিনু আশা।

 

বহুদিন মনে ছিল আশা

    প্রাণের গভীর ক্ষুধা

    পাবে তার শেষ সুধা;

ধন নয়, মান নয়, কিছু ভালোবাসা

          করেছিনু আশা।

হৃদয়ের সুর দিয়ে নামটুকু ডাকা,

অকারণে কাছে এসে হাতে হাত রাখা,

দূরে গেলে একা বসে মনে মনে ভাবা,

কাছে এলে দুই চোখে কথা-ভরা আভা।

     তাহারে জড়ায়ে ঘিরে

     ভরিয়া তুলিব ধীরে

জীবনের কদিনের কাঁদা আর হাসা।

ধন নয়, মান নয়, কিছু ভালোবাসা

              করেছিনু আশা।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •