চিঠি (chithi)
শ্রীমান দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কল্যাণীয়েষু,
দূর প্রবাসে সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে এনু,
হঠাৎ যেন বাজল কোথায় ফুলের বুকের বেণু।
আঁতি-পাঁতি খুঁজে শেষে বুঝি ব্যাপারখানা,
বাগানে সেই জুঁই ফুটেছে চিরদিনের জানা।
গন্ধটি তার পুরোপুরি বাংলাদেশের বাণী,
একটুও তো দেয় না আভাস এই দেশী ইস্পানি।
প্রকাশ্যে তার থাক্-না যতই সাদা মুখের ঢঙ,
কোমলতায় লুকিয়ে রাখে শ্যামল বুকের রঙ।
হেথায় মুখর ফুলের হাটে আছে কি তার দাম।
চারুকণ্ঠে ঠাঁই নাহি তার ধুলায় পরিণাম।
যূথী বলে, "আতিথ্য লও, একটুখানি বোসো।'
আমি বলি চমকে উঠে, "আরে রোসো, রোসো।
জিতবে গন্ধ হারবে কি গান? নৈব কদাচিৎ।'
তাড়াতাড়ি গান রচিলাম; জানি নে কার জিৎ।
তিনটে সাগর পাড়ি দিয়ে একদা এই গান
অবশেষে বোলপুরে সে হবে বিদ্যমান।
এই বিরহীর কথা স্মরি গেয়ো সেদিন, দিনু,
জুঁইবাগানের আরেক দিনের গান যা রচেছিনু।
ঘরের খবর পাই নে কিছুই, গুজব শুনি নাকি
কুলিশপাণি পুলিস সেথায় লাগায় হাঁকাহাঁকি।
শুনছি নাকি বাংলাদেশের গান হাসি সব ঠেলে
কুলুপ দিয়ে করছে আটক আলিপুরের জেলে।
হিমালয়ে যোগীশ্বরের রোযের কথা জানি,
অনঙ্গেরে জ্বালিয়েছিলেন চোখের আগুন হানি।
এবার নাকি সেই ভূধরে কলির ভূদেব যারা
বাংলাদেশের যৌবনেরে জ্বালিয়ে করবে সারা।
সিমলে নাকি দারুণ গরম, শুনছি দার্জিলিঙে
নকল শিবের তাণ্ডবে আজ পুলিস বাজায় শিঙে।
জানি তুমি বলবে আমায়, "থামো একটুখানি,
বেণুবীণার লগ্ন এ নয়, শিকল ঝম্ঝমানি!
শুনে আমি রাগব মনে, কোরো না সেই ভয়--
সময় আমার আছে বলেই এখন সময় নয়।
যাদের নিয়ে কাণ্ড আমার তারা তো নয় ফাঁকি,
গিলটি-করা তকমা-ঝোলা নয় তাহাদের খাকি।
কপাল জুড়ে নেই তো তাদের পালোয়ানের টিকা,
তাদের তিলক নিত্যকালের সোনার রঙে লিখা।
যেদিন ভবে সাঙ্গ হবে পালোয়ানির পালা,
সেদিনও তো সাজাবে জুঁই দেবার্চনার থালা।
সেই থালাতে আপন ভাইয়ের রক্ত ছিটোয় যারা,
লড়বে তারাই চিরটা কাল? গড়বে পাষাণ-কারা?
রাজ-প্রতাপের দম্ভ সে তো এক দমকের বায়ু,
সবুর করতে পারে এমন নাই তো তাহার আয়ু।
ধৈর্য বীর্য ক্ষমা দয়া ন্যায়ের বেড়া টুটে
লোভের ক্ষোভের ক্রোধের তাড়ায় বেড়ায় ছুটে ছুটে।
আজ আছে কাল নাই ব'লে তাই তাড়াতাড়ির তালে
কড়া মেজাজ দাপিয়ে বেড়ায় বাড়াবাড়ির চালে।
পাকা রাস্তা বানিয়ে বসে দুঃখীর বুক জুড়ি,
ভগবানের ব্যথার 'পরে হাঁকায় সে চার-ঘুড়ি।
তাই তো প্রেমের মাল্য গাঁথার নাইকো অবকাশ,
হাতকড়ারই কড়াক্কড়ি, দড়াদড়ির ফাঁস।
শান্ত হবার সাধনা কই, চলে কলের রথে--
সংক্ষেপে তাই শান্তি খোঁজে উলটো দিকের পথে।
জানে সেথায় বিধির নিষেধ, তর সহে না তবু--
ধর্মেরে যায় ঠেলা মেরে গায়ের জোরের প্রভু।
রক্ত-রঙের ফসল ফলে তাড়াতাড়ির বীজে,
বিনাশ তারে আপন গোলায় বোঝাই করে নিজে।
বাহুর দম্ভ, রাহুর মতো, একটু সময় পেলে
নিত্যকালের সূর্যকে সে এক-গরাসে গেলে।
নিমেষ-'পরেই উগরে দিয়ে মেলায় ছায়ার মতো,
সূর্যদেবের গায়ে কোথাও রয় না কোনো ক্ষত।
বারে বারে সহস্রবার হয়েছে এই খেলা,
নতুন রাহু ভাবে তবু হবে না মোর বেলা।
কাণ্ড দেখে পশুপক্ষী ফুকরে ওঠে ভয়ে,
অনন্তদেব শান্ত থাকেন ক্ষণিক অপচয়ে।
টুটল কত বিজয়-তোরণ, লুটল প্রাসাদ-চুড়ো,
কত রাজার কত গারদ ধুলোয় হল গুঁড়ো।
আলিপুরের জেলখানাও মিলিয়ে যাবে যবে
তখনো এই বিশ্বদুলাল ফুলের সবুর সবে।
রঙিন-কুর্তি সঙিন-মুর্তি, রইবে না কিচ্ছুই,
তখনো এই বনের কোণে ফুটবে লাজুক জুঁই।
ভাঙবে শিকল টুকরো হয়ে, ছিঁড়বে রাঙা পাগ--
চূর্ণ-করা দর্পে মরণ খেলবে হোলির ফাগ।
পাগলা আইন লোক হাসাবে কালের প্রহসনে,
মধুর আমার বঁধূ রবেন কাব্যসিংহাসনে।
সময়েরে ছিনিয়ে নিলেই হয় সে অসময়,
ক্রুদ্ধ প্রভুর সয় না সবুর, প্রেমের সবুর সয়।
প্রতাপ যখন চেঁচিয়ে করে দুঃখ দেবার বড়াই,
জেনো মনে, তখন তাহার বিধির সঙ্গে লড়াই।
দুঃখ সহার তপস্যাতেই হোক বাঙালির জয়,
ভয়কে যারা মানে তারাই জাগিয়ে রাখে ভয়।
মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে মৃত্যু তারেই টানে
মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে।
পালোয়ানের চেলারা সব ওঠে যেদিন খেপে,
ফোঁসে সর্প হিংসা দর্প সকল পৃথ্বী ব্যেপে,
বীভৎস তার ক্ষুধার জ্বালায় জাগে দানব ভায়া,
গর্জি বলে "আমিই সত্য-- দেব্তা মিথ্যা মায়া,'
সেদিন যেন কৃপা আমায় করেন ভগবান--
মেশিন-গানের সম্মুখে গাই জুঁই ফুলের এই গান।--
স্বপ্নসম পরবাসে এলি পাশে কোথা হতে তুই
ও আমার জুঁই!
অজানা ভাষার দেশে
সহসা বলিলি এসে,
"আমারে চেন কি।'
তোর পানে চেয়ে চেয়ে
হৃদয় উঠিল গেয়ে,
"চিনি, চিনি সখী'!
কত প্রাতে জানায়েছে চির পরিচিত তোর হাসি,
"আমি ভালোবাসি।'
বিরহব্যথার মতো এলি প্রাণে কোথা হতে তুই
ও আমার জুঁই!
আজ তাই পড়ে মনে
বাদল-সাঁঝের বনে
ঝর ঝর ধারা,
মাঠে মাঠে ভিজে হাওয়া
যেন কী-স্বপনে-পাওয়া,
ঘুরে ঘুরে সারা।
সজল তিমিরতলে তোর গন্ধ বলেছে নিশ্বাসি,
"আমি ভালোবাসি।'
মিলনসুখের মতো কোথা হতে এসেছিস তুই
ও আমার জুঁই!
মনে পড়ে কত রাতে
দীপ জ্বলে জানালাতে
বাতাসে চঞ্চল।
মাধুরী ধরে না প্রাণে,
কী বেদনা বক্ষে আনে,
চক্ষে আনে জল।
সে রাতে তোমার মালা বলেছে মর্মের কাছে আসি,
"আমি ভালোবাসি।'
অসীম কালের যেন দীর্ঘশ্বাস বহেছিস তুই
ও আমার জুঁই!
বক্ষে এনেছিস কার
যুগ-যুগান্তের ভার,
ব্যর্থ পথ-চাওয়া--
বারে বারে দ্বারে এসে
কোন্ নীরবের দেশে
ফিরে ফিরে যাওয়া।
তোর মাঝে কেঁদে বাজে চিরপ্রত্যাশার কোন্ বাঁশি
"আমি ভালোবাসি।'