লিপি (lipi)
হে ধরণী, কেন প্রতিদিন
তৃপ্তিহীন
একই লিপি পড় ফিরে ফিরে?
প্রত্যুষে গোপনে ধীরে ধীরে
আঁধারের খুলিয়া পেটিকা,
স্বর্ণবর্ণে লিখা
প্রভাতের মর্মবাণী
বক্ষে টেনে আনি
গুঞ্জরিয়া কত সুরে আবৃত্তি কর যে মুগ্ধমনে।
বহুযুগ হয়ে গেল কোন্ শুভক্ষণে
বাষ্পের গুণ্ঠনখানি প্রথম পড়িল যবে খুলে,
আকাশে চাহিলে মুখ তুলে।
অমর জ্যোতির মূর্তি দেখা দিল আঁখির সম্মুখে।
রোমাঞ্চিত বুকে
পরম বিস্ময় তব জাগিল তখনি।
নিঃশব্দ বরণ-মন্ত্রধ্বনি
উচ্ছ্বসিল পর্বতের শিখরে শিখরে।
কলোল্লাসে উদ্ঘোষিল নৃত্যমত্ত সাগরে সাগরে
"জয়, জয়, জয়।'
ঝঞ্ঝা তার বন্ধ টুটে ছুটে ছুটে কয়
"জাগো রে, জাগো রে'
বনে বনান্তরে।
প্রথম সে দর্শনের অসীম বিস্ময়
এখনো যে কাঁপে বক্ষোময়।
তলে তলে আন্দোলিয়া উঠে তব ধূলি,
তৃণে তৃণে কণ্ঠ তুলি
ঊর্ধ্বে চেয়ে কয় --
"জয়, জয়, জয়।'
সে বিস্ময় পুষ্পে পর্ণে গন্ধে বর্ণে ফেটে ফেটে পড়ে;
প্রাণের দুরন্ত ঝড়ে,
রূপের উন্মত্ত নৃত্যে, বিশ্বময়
ছড়ায় দক্ষিণে বামে সৃজন প্রলয়;
সে বিস্ময় সুখে দুঃখে গর্জি উঠি কয় --
"জয়, জয়, জয়।'
তোমাদের মাঝখানে আকাশ অনন্ত ব্যবধান;
ঊর্ধ্ব হতে তাই নামে গান।
চিরবিরহের নীল পত্রখানি-'পরে
তাই লিপি লেখা হয় অগ্নির অক্ষরে।
বক্ষে তারে রাখো,
শ্যাম আচ্ছাদনে ঢাকো;
বাক্যগুলি
পুষ্পদলে রেখে দাও তুলি --
মধুবিন্দু হয়ে থাকে নিভৃত গোপনে;
পদ্মের রেণুর মাঝে গন্ধের স্বপনে
বন্দী কর তারে;
তরুণীর প্রেমাবিষ্ট আঁখির ঘনিষ্ঠ অন্ধকারে
রাখ তারে ভরি;
সিন্ধুর কল্লোলে মিলি, নারিকেলপল্লবে মর্মরি,
সে বাণী ধ্বনিতে থাকে তোমার অন্তরে;
মধ্যাহ্নে শোনো সে বাণী অরণ্যের নির্জন নির্ঝরে।
বিরহিণী, সে লিপির যে উত্তর লিখিতে উন্মনা
আজও তাহা সাঙ্গ হইল না।
যুগে যুগে বারম্বার লিখে লিখে
বারম্বার মুছে ফেল; তাই দিকে দিকে
সে ছিন্ন কথার চিহ্ন পুঞ্জ হয়ে থাকে;
অবশেষে একদিন জ্বলজ্জটা ভীষণ বৈশাখে
উন্মত্ত ধূলির ঘূর্ণিপাকে
সব দাও ফেলে
অবহেলে,
আত্মবিদ্রোহের অসন্তোষে।
তার পরে আরবার বসে বসে
নূতন আগ্রহে লেখ নূতন ভাষায়।
যুগযুগান্তর চলে যায়।
কত শিল্পী, কত কবি তোমার সে লিপির লিখনে
বসে গেছে একমনে।
শিখিতে চাহিছে তব ভাষা,
বুঝিতে চাহিছে তব অন্তরের আশা।
তোমার মনের কথা আমারি মনের কথা টানে,
চাও মোর পানে।
চকিত ইঙ্গিত তব, বসনপ্রান্তের ভঙ্গিখানি
অঙ্কিত করুক মোর বাণী।
শরতে দিগন্ততলে
ছলছলে
তোমার যে অশ্রুর আভাস,
আমার সংগীতে তারি পড়ুক নিশ্বাস।
অকারণ চাঞ্চল্যের দোলা লেগে
ক্ষণে ক্ষণে ওঠে জেগে
কটিতটে যে কলকিঙ্কিণী,
মোর ছন্দে দাও ঢেলে তারি রিনিরিনি
ওগো বিরহিণী।
দূর হতে আলোকের বরমাল্য এসে
খসিয়া পড়িল তব কেশে,
স্পর্শে তারি কভু হাসি কভু অশ্রুজলে
উৎকন্ঠিত আকাঙক্ষায় বক্ষতলে
ওঠে যে ক্রন্দন,
মোর ছন্দে চিরদিন দোলে যেন তাহারি স্পন্দন।
স্বর্গ হতে মিলনের সুধা
মর্তের বিচ্ছেদপাত্রে সংগোপনে রেখেছ, বসুধা;
তারি লাগি নিত্যক্ষুধা,
বিরহিণী অয়ি,
মোর সুরে হোক জ্বালাময়ী।