অপরিচিতা (oporichita)
পথ বাকি আর নাই তো আমার, চলে এলাম একা,
তোমার সাথে কই হল গো দেখা?
কুয়াশাতে ঘন আকাশ, ম্লান শীতের ক্ষণে
ফুল ঝরাবার বাতাস বেড়ায় কাঁপন-লাগা বনে।
সকল শেষের শিউলিটি যেই ধুলায় হবে ধূলি,
সঙ্গিনীহীন পাখি যখন গান যাবে তার ভুলি,
হয়তো তুমি আপন-মনে আসবে সোনার রথে
শুকনো পাতা ঝরা ফুলের পথে।
পুলক লেগেছিল মনে পথের নূতন বাঁকে
হঠাৎ সেদিন কোন্ মধুরের ডাকে।
দূরের থেকে ক্ষণে-ক্ষণে রঙের আভাস এসে
গগন-কোণে চমক হেনে গেছে কোথায় ভেসে।
মনের ভুলে ভেবেছিলাম তুমিই বুঝি এলে
গন্ধরাজের গন্ধে তোমার গোপন মায়া মেলে --
হয়তো তুমি এসেছিলে, যায় নি আড়ালখানা,
চোখের দেখায় হয় নি প্রাণের জানা।
হয়তো সেদিন তোমার আঁখির ঘন তিমির ব্যেপে
অশ্রুজলের আবেশ গেছে কেঁপে।
হয়তো আমায় দেখেছিলে বাঁকিয়ে বাঁকা ভুরু,
বক্ষ তোমার করেছিল ক্ষণেক দুরু দুরু,
সেদিন হতে স্বপ্ন তোমার ভোরের আধো-ঘুমে
রঙিয়েছিল হয়তো ব্যথার রক্তিমকুঙ্কুমে --
আধেক-চাওয়ায় ভুলে-যাওয়ায় হয়েছে জাল বোনা
তোমায় আমায় হয় নি জানাশোনা।
তোমার পথের ধারে ধারে তাই এবারের মতো
রেখে গেলাম গান গাঁথিলাম যত।
মনের মাঝে বাজল যেদিন দূর চরণের ধ্বনি
সেদিন আমি গেয়েছিলাম তোমার আগমনী;
দখিন বাতাস ফেলেছে শ্বাস রাতের আকাশ ঘেরি,
সেদিন আমি গেয়েছি গান তোমার বিরহেরি;
ভোরের বেলায় অশ্রুভরা অধীর অভিমান
ভৈরবীতে জাগিয়েছিল গান।
এ গানগুলি তোমার বলে চিনবে কখনো কি?
ক্ষতি কী তায়, নাই চিনিলে সখী!
তবু তোমায় গাইতে হবে নাই তাহে সংশয়,
তোমার কন্ঠে বাজবে তখন আমার পরিচয় --
যারে তুমি বাসবে ভালো, আমার গানের সুরে
বরণ করে নিতে হবে সেই তব বন্ধুরে।
রোদন খুঁজে ফিরবে তোমার প্রাণের বেদনখানি,
আমার গানে মিলবে তাহার বাণী।
তোমার ফাগুন উঠবে জেগে, ভরবে আমের বোলে,
তখন আমি কোথায় যাব চলে।
পূর্ণ চাঁদের আসবে আসর, মুগ্ধ বসুন্ধরা,
বকুলবীথির ছায়াখানি মধুর মূর্ছাভরা --
হয়তো সেদিন বক্ষে তোমার মিলন-মালা গাঁথা,
হয়তো সেদিন ব্যর্থ আশায় সিক্ত চোখের পাতা --
সেদিন আমি আসব না তো নিয়ে আমার দান,
তোমার লাগি রেখে গেলেম গান।