বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী-- মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু, কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন; মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ। সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে অক্ষয় উৎসাহে-- যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী কুড়াইয়া আনি। জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে। আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি, এই স্বরসাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক-- রয়ে গেছে ফাঁক। কল্পনায় অনুমানে ধরিত্রীর মহা-একতান কত-না নিস্তব্ধ ক্ষণে পূর্ণ করিয়াছে মোর প্রাণ। দু্র্গম তুষারগিরি অসীম নিঃশব্দ নীলিমায় অশ্রুত যে গান গায় আমার অন্তরে বারবার পাঠায়েছে নিমন্ত্রণ তার। দক্ষিণমেরুর ঊর্ধ্বে যে অজ্ঞাত তারা মহাজনশূন্যতায় রাত্রি তার করিতেছে সারা, সে আমার অর্ধরাত্রে অনিমেষ চোখে অনিদ্রা করেছে স্পর্শ অপূর্ব আলোকে। সুদূরের মহাপ্লাবী প্রচন্ড নির্ঝর মনের গহনে মোর পঠায়েছে স্বর। প্রকৃতির ঐকতানস্রোতে নানা কবি ঢালে গান নানা দিক হতে; তাদের সবার সাথে আছে মোর এইমাত্র যোগ-- সঙ্গ পাই সবাকার, লাভ করি আনন্দের ভোগ, গীতভারতীর আমি পাই তো প্রসাদ নিখিলের সংগীতের স্বাদ। সব চেয়ে দুর্গম-যে মানুষ আপন অন্তরালে, তার কোনো পরিণাপ নাই বাহিরের দেশে কালে। সে অন্তরময় অন্তর মিশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়। পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার, বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবনযাত্রার। চাষি খেতে চালাইছে হাল, তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-- বহুদূরপ্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার তারি 'পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার। অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে। মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে, ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে। জীবনে জীবন যোগ করা না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা। তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা আমার সুরের অপূর্ণতা। আমার কবিতা, জানি আমি, গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী। কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন, কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন, যে আছে মাটির কাছাকাছি, সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি। সাহিত্যের আনন্দের ভোজে নিজে যা পারি না দিতে নিত্য আমি থাকি তারি খোঁজে। সেটা সত্য হোক, শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ। সত্য মূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি ভালো নয়, ভালো নয় নকল সে শৌখিন মজ্দুরি। এসো কবি, অখ্যাতজনের নির্বাক্ মনের। মর্মের বেদনা যত করিয়ো উদ্ধার-- প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারি ধার, অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি রসে পূর্ণ করি দাও তুমি। অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারি তাই তুমি দাও তো উদ্বারি। সাহিত্যের ঐকতানসংগীতসভায় একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়-- মূক যারা দুঃখে সুখে, নতশির স্তব্ধ যারা বিশ্বের সম্মুখে, ওগো গুণী, কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি। তুমি থাকো তাহাদের জ্ঞাতি, তোমার খ্যাতিতে তারা পায় যেন আপনারি খ্যাতি-- আমি বারংবার তোমারে করিব নমস্কার।
আমি পথিক, পথ আমারি সাথি। দিন সে কাটায় গনি গনি বিশ্বলোকের চরণধ্বনি, তারার আলোয় গায় সে সারা রাতি। কত যুগের রথের রেখা বক্ষে তাহার আঁকে লেখা, কত কালের ক্লান্ত আশা ঘুমায় তাহার ধুলায় আঁচল পাতি। বাহির হলেম কবে সে নাই মনে। যাত্রা আমার চলার পাকে এই পথেরই বাঁকে বাঁকে নূতন হল প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। যত আশা পথের আশা, পথে যেতেই ভালোবাসা, পথে চলার নিত্যরসে দিনে দিনে জীবন ওঠে মাতি।