আমার শেষবেলাকার ঘরখানি বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে, তার নাম দেব শ্যামলী। ও যখন পড়বে ভেঙে সে হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতো, মাটির কোলে মিশবে মাটি; ভাঙা থামে নালিশ উঁচু করে বিরোধ করবে না ধরণীর সঙ্গে; ফাটা দেয়ালের পাঁজর বের ক'রে তার মধ্যে বাঁধতে দেবে না মৃতদিনের প্রেতের বাসা। সেই মাটিতে গাঁথব আমার শেষ বাড়ির ভিত যার মধ্যে সব বেদনার বিস্মৃতি, সব কলঙ্কের মার্জনা, যাতে সব বিকার সব বিদ্রূপকে ঢেকে দেয় দূর্বাদলের স্নিগ্ধ সৌজন্যে; যার মধ্যে শত শত শতাব্দীর রক্তলোলুপ হিংস্র নির্ঘোষ গেছে নিঃশব্দ হয়ে। সেই মাটির ছাদের নিচে বসব আমি রোজ সকালে শৈশবে যা ভরেছিল আমার গাঁটবাঁধা চাদরের কোনা এক-একমুঠো চাঁপা আর বেল ফুলে। মাঘের শেষে যার আমের বোল দক্ষিণের হাওয়ায় অলক্ষ্য দূরের দিকে ছড়িয়েছিল ব্যথিত যৌবনের আমন্ত্রণ। আমি ভালোবেসেছি বাংলাদেশের মেয়েকে; যে-দেখায় সে আমার চোখ ভুলিয়েছে তাতে আছে যেন এই মাটির শ্যামল অঞ্জন, ওর কচি ধানের চিকন আভা। তাদের কালো চোখের করুণ মাধুরীর উপমা দেখেছি ঐ মাটির দিগন্তে নীল বনসীমায় গোধূলির শেষ আলোটির নিমীলনে। প্রতিদিন আমার ঘরের সুপ্ত মাটি সহজে উঠবে জেগে ভোরবেলাকার সোনার কাঠির প্রথম ছোঁওয়ায়; তার চোখ-জুড়ানো শ্যামলিমায় স্মিত হাসি কোমল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে চৈত্ররাতের চাঁদের নিদ্রাহারা মিতালিতে। চিরদিন মাটি আমাকে ডেকেছে পদ্মার ভাঙনলাগা খাড়া পাড়ির বনঝাউবনে, গাঙশালিকের হাজার খোপের বাসায়; সর্ষে-তিসির দুইরঙা খেতে গ্রামের সরু বাঁকা পথের ধারে, পুকুরের পাড়ির উপরে। আমার দু-চোখ ভ'রে মাটি আমায় ডাক পাঠিয়েছে শীতের ঘুঘুডাকা দুপুরবেলায়, রাঙা পথের ও পারে, যেখানে শুকনো ঘাসের হলদে মাঠে চরে বেড়ায় দুটি-চারটি গোরু নিরুৎসুক আলস্যে, লেজের ঘায়ে পিঠের মাছি তাড়িয়ে; যেখানে সাথীবিহীন তালগাছের মাথায় সঙ্গ-উদাসীন নিভৃত চিলের বাসা। আজ আমি তোমার ডাকে ধরা দিয়েছি শেষবেলায়। এসেছি তোমার ক্ষমাস্নিগ্ধ বুকের কাছে, যেখানে একদিন রেখেছিলে অহল্যাকে, নবদূর্বাশ্যামলের করুণ পদস্পর্শে চরম মুক্তি-জাগরণের প্রতীক্ষায়, নবজীবনের বিস্মিত প্রভাতে।
এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি। কেউ বা আসে এপারে, কেউ পারের ঘাটে দেয় রে পাড়ি। পথিকেরা বাঁশি ভ'রে যে সুর আনে সঙ্গে ক'রে তাই যে আমার দিবানিশি সকল পরান লয় রে কাড়ি। কার কথা যে জানায় তারা জানি নে তা। হেথা হতে কী নিয়ে বা যায় রে সেথা। সুরের সাথে মিশিয়ে বাণী দুই পারের এই কানাকানি তাই শুনে যে উদাস হিয়া চায় রে যেতে বাসা ছাড়ি।
ও কী সুরে গান গাস, হৃদয় আমার? শীত নাই গ্রীষ্ম নাই, বসন্ত শরৎ নাই, দিন নাই রাত্রি নাই -- অবিরাম অনিবার ও কী সুরে গান গাস, হৃদয় আমার? বিরলে বিজন বনে বসিয়া আপন মনে ভূমি-পানে চেয়ে চেয়ে, একই গান গেয়ে গেয়ে-- দিন যায়, রাত যায়, শীত যায়, গ্রীষ্ম যায়, তবু গান ফুরায় না আর? মাথায় পড়িছে পাতা, পড়িছে শুকানো ফুল, পড়িছে শিশিরকণা, পড়িছে রবির কর, পড়িছে বরষা-জল ঝরঝর ঝরঝর, কেবলি মাথার 'পরে করিতেছে সমস্বরে বাতাসে শুকানো পাতা মরমর মরমর-- বসিয়া বসিয়া সেথা, বিশীর্ণ মলিন প্রাণ গাহিতেছে একই গান একই গান একই গান। পারি নে শুনিতে আর একই গান একই গান। কখন থামিবি তুই, বল্ মোরে বল্ প্রাণ! একেলা ঘুমায়ে আছি-- সহসা স্বপন টুটি সহসা জাগিয়া উঠি সহসা শুনিতে পাই হৃদয়ের এক ধারে সেই স্বর ফুটিতেছে, সেই গান উঠিতেছে-- কেহ শুনিছে না যবে চারি দিকে স্তব্ধ সবে সেই স্বর সেই গান অবিরাম অবিশ্রাম অচেতন আঁধারের শিরে শিরে চেতনা সঞ্চারে। দিবসে মগন কাজে, চারি দিকে দলবল, চারি দিকে কোলাহল। সহসা পাতিলে কান শুনিতে পাই সে গান, নানাশব্দময় সেই জনকোলাহল। তাহারি প্রাণের মাঝে একমাত্র শব্দ বাজে-- এক সুর, এক ধ্বনি, অবিরাম অবিরল-- যেন সে কোলাহলের হৃদয়ম্পন্দন-ধ্বনি-- সমস্ত ভুলিয়া যাই, বসে বসে তাই গনি। ঘুমাই বা জেগে থাকি, মনের দ্বারের কাছে কে যেন বিষণ্ণ প্রাণী দিনরাত বসে আছে-- চিরদিন করিতেছে বাস, তারি শুনিতেছি যেন নিশ্বাস-প্রশ্বাস। এ প্রাণের ভাঙা ভিতে স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে ঘুঘু এক বসে বসে গায় একস্বরে, কে জানে কেন সে গান গায়। বলি সে কাতর স্বরে স্তব্ধতা কাঁদিয়া মরে, প্রতিধ্বনি করে হায়-হায়। হৃদয় রে, আর কিছু শিখিলি নে তুই, শুধু ওই গান! প্রকৃতির শত শত রাগিণীর মাঝে শুধু ওই তান! তবে থাম্ থাম্ ওরে প্রাণ, পারি নে শুনিতে আর একই গান, একই গান।