বারো
Verses
বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়াঘাটে
শেষধাপের কাছটাতে ।
কালো জল নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে পা ডুবিয়ে দিয়ে ।
জীবনের পরিত্যক্ত ভোজের ক্ষেত্র পড়ে আছে পিছন দিকে
অনেক দিনের ছড়ানো উচ্ছিষ্ট নিয়ে ।
মনে পড়ছে ভোগের আয়োজনে
ফাঁক পড়েছে বারম্বার ।
কতদিন যখন মূল্য ছিল হাতে
হাট জমে নি তখনো,
বোঝাই নৌকো লাগল যখন ডাঙায়
তখন ঘণ্টা গিয়েছে বেজে,
ফুরিয়েছে বেচাকেনার প্রহর ।
অকালবসন্তে জেগেছিল ভোরের কোকিল;
সেদিন তার চড়িয়েছি সেতারে,
গানে বসিয়েছি সুর ।
যাকে শোনাব তার চুল যখন হল বাঁধা,
বুকে উঠল জাফরানি রঙের আঁচল
তখন ঝিকিমিকি বেলা,
করুণ ক্লান্তি লেগেছে মূলতানে ।
ক্রমে ধূসর আলোর উপরে কালো মরচে পড়ে এল ।
থেমে-যাওয়া গানখানি নিভে-যাওয়া প্রদীপের ভেলার মতো
ডুবল বুঝি কোন্ একজনের মনের তলায়,
উঠল বুঝি তার দীর্ঘনিশ্বাস,
কিন্তু জ্বালানো হল না আলো ।
এ নিয়ে আজ নালিশ নেই আমার ।
বিরহের কালোগুহা ক্ষুধিত গহ্বর থেকে
ঢেলে দিয়েছে ক্ষুভিত সুরের ঝর্না রাত্রিদিন ।
সাত রঙের ছটা খেলেছে তার নাচের উড়নিতে
সারাদিনের সূর্যালোকে,
নিশীথরাত্রের জপমন্ত্র ছন্দ পেয়েছে
তার তিমিরপুঞ্জ কলোচ্ছল ধারায় ।
আমার তপ্ত মধ্যাহ্নের শূন্যতা থেকে উচ্ছ্বসিত
গৌড়-সারঙের আলাপ ।
আজ বঞ্চিত জীবনকে বলি সার্থক --
নিঃশেষ হয়ে এল তার দুঃখের সঞ্চয়
মৃত্যুর অর্ঘ্যপাত্রে,
তার দক্ষিণা রয়ে গেল কালের বেদিপ্রান্তে ।
জীবনের পথে মানুষ যাত্রা করে
নিজেকে খুঁজে পাবার জন্যে ।
গান যে মানুষ গায়, দিয়েছে সে ধরা,আমার অন্তরে;
যে মানুষ দেয় প্রাণ দেখা মেলে নি তার ।
দেখেছি শুধু আপনার নিভৃত রূপ
ছায়ায় পরিকীর্ণ,
যেন পাহাড়তলিতে একখানা অনুত্তরঙ্গ সরোবর ।
তীরের গাছ থেকে
সেখানে বসন্তশেষের ফুল পড়ে ঝ'রে,
ছেলেরা ভাসায় খেলার নৌকো,
কলস ভরে নেয় তরুণীরা
বুদ্বুদফেনিল গর্গরধ্বনিতে ।
নববর্ষার গম্ভীর বিরাট শ্যামমহিমা
তার বক্ষতলে পায় লীলাচঞ্চল দোসরটিকে ।
কালবৈশাখী হঠাৎ মারে পাখার ঝাপট,
স্থির জলে আনে অশান্তির উন্মন্থন,
অধৈর্যের আঘাত হানে তটবেষ্টনের স্থাবরতায়;
হঠাৎ বুঝি তার মনে হয় --
গিরিশিখরের পাগলা-ঝোরা পোষ মেনেছে
গিরিপদতলের বোবা জলরাশিতে --
বন্দী ভুলেছে আপনার উদ্বেলকে,উদ্দামকে--
পাথর ডিঙিয়ে আপন সীমানা চূর্ণ করতে করতে নিরুদ্দেশের পথে
অজানার সংঘাতে বাঁকে বাঁকে
গর্জিত করল না সে আপন অবরুদ্ধ বাণী,
আবর্তে আবর্তে উৎক্ষিপ্ত করল না
অন্তর্গূঢ়কে ।
মৃত্যুর গ্রন্থি থেকে ছিনিয়ে ছিনিয়ে
যে উদ্ধার করে জীবনকে
সেই রুদ্র মানবের আত্মপরিচয়ে বঞ্চিত
ক্ষীণ পাণ্ডুর আমি
অপরিস্ফুটতার অসন্মান নিয়ে যাচ্ছি চলে ।
দুর্গম ভীষণের ওপারে
অন্ধকারে অপেক্ষা করছে জ্ঞানের বরদাত্রী;
মানবের অভ্রভেদী বন্ধনশালা
তুলেছে কালো পাথরে গাঁথা উদ্ধত চূড়া
সূর্যোদয়ের পথে;
বহু শতাব্দীর ব্যথিত ক্ষত মুষ্টি
রক্তলাঞ্ছিত বিদ্রোহের ছাপ
লেপে দিয়ে যায় তার দ্বারফলকে;
ইতিহাসবিধাতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ
দৈত্যের লৌহদুর্গে প্রচ্ছন্ন;
আকাশে দেবসেনাপতির কন্ঠ শোনা যায় ----
"এসো মৃত্যুবিজয়ী' ।
বাজল ভেরী,
তবু জাগল না রণদুর্মদ
এই নিরাপদ নিশ্চেষ্ট জীবনে;
ব্যূহ ভেদ ক'রে
স্থান নিই নি যুধ্যমান দেবলোকের সংগ্রাম-সহকারিতায় ।
কেবল স্বপ্নে শুনেছি ডমরুর গুরুগুরু,
কেবল সমরযাত্রীর পদপাতকম্পন
মিলেছে হৃৎস্পন্দনে বাহিরের পথ থেকে ।
যুগে যুগে যে মানুষের সৃষ্টি প্রলয়ের ক্ষেত্রে
সেই শ্মশানচারী ভৈরবের পরিচয়জ্যোতি
ম্লান হয়ে রইল আমার সত্তায়;
শুধু রেখে গেলেম নতমস্তকের প্রণাম
মানবের হৃদয়াসীন সেই বীরের উদ্দেশে --
মর্তের অমরাবতী যাঁর সৃষ্টি
মৃত্যুর মূল্যে, দুঃখের দীপ্তিতে ।
আরো দেখুন