তখন বয়স সাত। মুখচোরা ছেলে, একা একা আপনারি সঙ্গে হত কথা। মেঝে বসে ঘরের গরাদেখানা ধরে বাইরের দিকে চেয়ে চেয়ে বয়ে যেত বেলা। দূরে থেকে মাঝে-মাঝে ঢঙ ঢঙ করে বাজত ঘণ্টার ধ্বনি, শোনা যেত রাস্তা থেকে সইসের হাঁক। হাঁসগুলো কলরবে ছুটে এসে নামত পুকুরে। ও পাড়ার তেলকলে বাঁশি ডাক দিত। গলির মোড়ের কাছে দত্তদের বাড়ি, কাকাতুয়া মাঝে-মাঝে উঠত চীৎকার করে ডেকে। একটা বাতাবিলেবু, একটা অশথ, একটা কয়েতবেল, একজোড়া নারকেলগাছ, তারাই আমার ছিল সাথী। আকাশে তাদের ছুটি অহরহ, মনে-মনে সে ছুটি আমার। আপনারি ছায়া নিয়ে আপনার সঙ্গে যে খেলাতে তাদের কাটত দিন সে আমারি খেলা। তারা চিরশিশু আমার সমবয়সী। আষাঢ়ে বৃষ্টির ছাঁটে, বাদল-হাওয়ায়, দীর্ঘ দিন অকারণে তারা যা করেছে কলরব, আমার বালকভাষা হো হা শব্দ করে করেছিল তারি অনুবাদ। তার পরে একদিন যখন আমার বয়স পঁচিশ হবে, বিরহের ছায়াম্লান বৈকালেতে ওই জানালায় বিজনে কেটেছে বেলা। অশথের কম্পমান পাতায় পাতায় যৌবনের চঞ্চল প্রত্যাশা পেয়েছে আপন সাড়া। সকরুণ মূলতানে গুন্ গুন্ গেয়েছি যে গান রৌদ্রে-ঝিলিমিলি সেই নারকেলডালে কেঁপেছিল তারি সুর। বাতাবিফুলের গন্ধ ঘুমভাঙা সাথীহারা রাতে এনেছে আমার প্রাণে দূর শয্যাতল থেকে সিক্ত আঁখি আর কার উৎকণ্ঠিত বেদনার বাণী। সেদিন সে গাছগুলি বিচ্ছেদে মিলনে ছিল যৌবনের বয়স্য আমার। তার পরে অনেক বৎসর গেল আরবার একা আমি। সেদিনের সঙ্গী যারা কখন চিরদিনের অন্তরালে তারা গেছে সরে। আবার আরেকবার জানলাতে বসে আছি আকাশে তাকিয়ে। আজ দেখি সে অশ্বত্থ, সেই নারকেল সনাতন তপস্বীর মতো। আদিম প্রাণের যে বাণী প্রাচীনতম তাই উচ্চারিত রাত্রিদিন উচ্ছ্বসিত পল্লবে পল্লবে। সকল পথের আরম্ভেতে সকল পথের শেষে পুরাতন যে নিঃশব্দ মহাশান্তি স্তব্ধ হয়ে আছে, নিরাসক্ত নির্বিচল সেই শান্তি-সাধনার মন্ত্র ওরা প্রতিক্ষণে দিয়েছে আমার কানে-কানে।